এক.
ক্লাসে অনেক যত্ন নিয়ে পড়ান প্রফেসর তোফাজ্জল হোসেন, পারতপক্ষে ভাল ছাত্রছাত্রীরা এই বিষয় পড়তে চায় না, নিতান্ত বাধ্য হয়ে মেধা তালিকার শেষের দিক থেকে এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয় তারা। আজকাল সবার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি অথবা হাল আমলে উড়ে এসে জুড়ে বসা বিবিএ, এমবিএর দিকে ঝোক বেশি, উদ্ভিদবিদ্যার মত প্রাচীন ও মৌলিক বিষয়গুলোতে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। আশ্চার্য! মানুষ গাছ নিয়ে কিভাবে উদাসীন হতে পারে ভেবে পান না তোফাজ্জল হোসেন, এসব নিয়ে তার মনে বেশ আক্ষেপ। হঠাৎ লেকচার থামিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরে তাকালেন ষাটোর্ধ প্রফেসর। বাহাতে চশমার ফ্রেমটা একটু টেনে নাকের অগ্রভাগে নিয়ে এসে তার উপর দিয়ে ক্লাসের শেষ বেঞ্চের দিকে চোখ পাকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। এতক্ষণ ক্লাস জুড় মৃদু গুঞ্জন চলছিল এখন পিনপতন নিস্তব্ধতা, কি ঘটতে যাচ্ছে সবাই মুটামুটি আঁচ করতে পেরেছে।
“এই ছেলে! এই! উঠে দাঁড়াও। কি করছ তুমি ?”, বেশ রাগান্বিত স্বরেই বলেন তিনি।
আনমনে লিখেই যাচ্ছে সে, কোন দিকে তার খেয়াল নেই। ঘোরের মধ্যে আছে এখন সে, তার চোখের সামনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব সমীকরণ নেচে বেড়াচ্ছে, সে এখন অন্য জগতের বাসিন্দা। বেশ কয়েকদিন ধরে এমন হচ্ছিল, আজ মনে হয় চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে গেছে। অবচেতন মন বলছে সমাধানের খুব কাছ দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সে। অনেক দূর থেকে কে যেন “এই ছেলে, এই ছেলে বলে চিৎকার করছে”, আজব! মানুষের কোন কান্ডজ্ঞান নেই না কি! বিজ্ঞানের এই চূড়ান্ত আবিষ্কারের সন্ধিক্ষণে এভাবে কেউ বাধা দিতে পারে? না দেওয়া উচিত। আরে! অদ্ভুত তো! সে এত অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা করছে কেন? তাকে এখন সমীকরণের দিকে মননিবেশ করতে হবে যেভাবেই হোক। আবার কে যেন জোরে ডেকে উঠল, “এই ছেলে, এই ছেলে”। হঠাৎ কাঠপেন্সিলের তীক্ষ্ণ খোঁচায় মোহভঙ্গ হয় তার, মৃদু চিৎকার দিয়ে বা হাতে ডান বাহু খামচে ধরে ডলতে ডলতে পাশের ছাত্রের দিকে অবাক হয়ে তাকায় সে।
- এই ছেলে, দাঁড়াও বলছি, কি নাম তোমার?
স্যার, রায়হান
- “পুরো নাম কি, রোল নাম্বার কত?”, কিছুটা রাগত স্বরেই বলেন তিনি।
মোহাম্মদ রায়হান ভুঁঞা, ৯৮৭৪১
- সেই শুরু থেকে দেখছি লেকচারের দিকে তোমার কোন মনযোগ নেই, শুধু খাতায় কি যেন লিখে যাচ্ছ! এত ইমপোর্টেন্ট ক্লাস যদি মনযোগ দিয়ে না শোন তাহলে পরীক্ষায় পাস করবে কি করে? এতক্ষণ কি পড়াচ্ছিলাম বলতে পরবে?
“না স্যার”, আমতা আমতা করে বলে রায়হান, কিছুটা বিরক্ত হয় সে, অস্থির লাগছে তার; বেশি দেরি হলে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা সমীকরণটা হারিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল হয় স্যার যদি এখন ক্লাস থেকে বের করে দেয়, মনে মনে ভাবে সে।
আজ সবকিছুই যেন তার অনুকুলে; তোফাজ্জল হোসেন বলেল, “নিউকোভিচ* ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন। গাছের ক্লোরোপ্লাস্টের* এই প্যাটার্ন প্রথম আবিষ্কার করেন রুস উদ্ভিদ বিজ্ঞানি নিউকোভিচ, ১৯৩৫ সালে। তুমি এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত রিপোর্ট দিবে আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে, এটা তোমার এসাইনমেন্ট। এখন সোজা বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে”।
খুব মন খারাপ হয়েছে এমন ভাব করে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায় রায়হান। শুরু থেকেই মানব সভ্যতা অগ্রসর হয়েছে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে, কিন্তু শতাব্দিন্তর আর্কিমিডিস, নিউটন, আইনস্টাইন বা হকিং এর মত কিছু মহামানবের আবির্ভাব হয় যারা সভ্যতাকে এক লাফে কয়েক শতাব্দি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, আজ প্রফেসর তোফাজ্জল হোসেন “নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন” এসাইনমেন্ট দিয়ে এমনি একজনকে ক্লাস থেকে বের করে ইতিহাসে অংশ হয়ে গেছেন নিজের অজান্তেই।
তিনদিন ধরে ঘর থেকে বের হচ্ছে না রায়হান, টেবিলে মাথা গুঁজে ক্রমাগত লিখেই যাচ্ছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, মাঝেমাঝে শুধু বিপুল বেগে মাথা নেড়ে কয়েকগাছি কাগজ একত্র করে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, তারপর আবার প্রথম থেকে শুরু করছে লেখা। এ নিয়ে দশবার হল, ধৈর্য্যের শেষসীমায় পৌছে গেছে, এবার না হলে আর হবে না, মনে মনে ভাবে রায়হান; এত কাছে এসেও কি শেষ করতে পারবে না? ভুলটা কোথায় করছে ভেবেই পাচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ে তোফাজ্জল স্যারের এসাইনমেন্টের কথা, আর তিনদিন পরেই জমা দিতে হবে, কিন্তু একটুও এগোয়নি কাজ। ধ্যাৎ, যা হয় হবে, ডান হাত হাওয়ায় চালিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেয় সে; নিউকোভিচ না টিউকোভিচ প্যাটার্ন নিয়ে এখন মাথা ঘামালে চলবে না। আবার প্রথম থেকে শুরু করে সে।
একটানা ছয় ঘন্টা ধরে প্রায় পনের বিশ পৃষ্ঠা লেখার পর থামে সে, হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সমাধানগুলোর দিকে; একটু মনক্ষুণ্ন হয়; এত খাটাখাটুনির কোন লাভ হল না তাহলে! বোসনিক স্ট্রিং থিউরি* অনুযায়ী ইউনিভার্স ছাব্বিশ মাত্রার কিন্তু সুপার-স্ট্রিং থিউরি* অনুসারে ইউনিভার্স এগার মাত্রার এ দুই থিউরির সীমাবদ্ধতাগুলোকে সমাধান করে ইউনিফাইড-স্ট্রিং* থিউরি ইউনিভার্সকে ছয় মাত্রায় সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু রায়হানের সমীকরনের সমাধান অনুসারে ইউনিভার্স মাত্র পাঁচ মাত্রার; একটা মাত্রা কিছুতেই মিলছে না। আবার ভুলটা কোথায় সেটাও বুঝতে পারছে না। আর পারছে না সে, মাথা ভার ভার লাগছে, বসেই টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ে।
মৃদু খিলখিল হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রায়হানের, উঠেই দেখে একটা সবুজ মাঠে শুয়ে আছে, চারদিক আলো ঝলমল করছে কিন্তু আকাশটা কাল। যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ! এ কোথায় চলে এসেছে সে? খিল খিল হাসির শব্দে পিছনে ফিরে তাকায় সে, দেখে চোদ্দ-পনের বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়াচ্ছে। দৌড়ে যাচ্ছে অনবরত। দৌড়াতে দৌড়াতে প্রায় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় সে, এমন সময় মেয়েটি বলে উঠল, “তুমি আসবে না? আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?”। এত দূর থেকে কোন শব্দ শুনতে পারার কথা না, কিন্তু রায়হান স্পষ্ট শুনতে পেল মেয়েটার কথা, কণ্ঠে নিশ্চিত ঝরে পড়ছিল আকুতি। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে সে, ঘেমে একেবারে জবজব অবস্থা, প্রচন্ড ভয় পায় সে, ভয় পাওয়ার কারন হল মেয়েটির গায়ের রং একেবারে গাড় সবুজ, চুলের রঙ এমনকি চোখের রঙ পর্যন্ত। কি উদ্ভট স্বপ্ন! কয়েকদিন ধরে খুব বেশিই চাপ নিয়ে ফেলেছে। জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খায় সে, ঘড়িতে বিকাল তিনটা বাজে, পুরা সকাল ঘুমিয়ে কাটিয়েছে! এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। মুখহাত ধুয়ে, মুখে খোচাখোচা দাড়ি নিয়েই লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হয় সে।
“নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন” নিয়ে ত পুরা লঙ্কাকান্ড ঘটে যাচ্ছে উদ্ভিদবিজ্ঞান জগতে! ২০০০ সালে ওয়াল্ড সাইন্স পত্রিকা একে শতাব্দির সেরা রহস্যময় আবিষ্কারের তিন নাম্বারে রেখেছে। পড়তে পড়তে একেবারে ডুবে যায় রায়হান, মোহগ্রস্থের মত পৃষ্ঠার পত পৃষ্ঠা পড়তে থাকে সে। বিভিন্ন বিজ্ঞানি একে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, কিন্তু কেউই পুরোপুরিভাবে করতে পারনি। কেউ বলেছে এর পিছনে ঈশ্বরের কীর্তি আছে আবার কেউ বলছে এটা বৃক্ষের শৈল্পিক মনের বহিঃপ্রকাশ, কেউ কেউ নিউটনের মহাকর্ষ আবার কেউ কেউ আইনষ্টাইনের রিলেটিভিটি থিউরী দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। মাথার মধ্যে ভয়ংকর গতিতে চিন্তা চলতে থাকে রায়হানের, মনে হচ্ছে যেন মস্তিষ্কের সবগুলো নিউরোন একযোগে চরম কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে। ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে, চোখের খুব কাছে নিয়ে প্যাটার্নটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার, আপাত দৃষ্টিতে এটাকে প্যাটার্ন বলার কোন কারন নেই, বিক্ষিপ্তভাবে পাতার তল বরারব কোষের ভিতর ক্লোরোপ্লাস্টগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার মধ্যেও একটা প্যাটার্ন আছে, যে কোন গাছের পাতার একটা কোষে ক্লোরাপ্লাস্টের সংখ্যা ৭৫ থেকে ১০০ এর মধ্যে। একটা কোষে যেভাবে ক্লোরোপ্লাস্টগুলো বিন্যাস্ত ঠিক সাতটা কোষের পর আট নাম্বার কোষে একই ভাবে ক্লোরোপ্লাস্টগুলো বিন্যস্ত হয়ে আছে। এই প্যাটার্নগুলো আবার উপর থেকে নিচে ও নিচ থেকে উপরেও একই রকম। যদি প্রথম কোষের ক্লোরোপ্লাস্টের বিন্যাসকে A, পরেরটিকে B এভাবে ক্রমান্বয়ে চিহ্নিত করি তাহলে প্যাটার্নটা হবে,
........ ABCDEFG ABCDEFG ABCDEFG AB .........
........ BCDEFGA BCDEFGA BCDEFGA BC .........
........ CDEFGAB CDEFGAB CDEFGAB CD.........
........ DEFGABC DEFGABC DEFGABC DE.........
বাহির থেকে কোন শক্তি প্রয়োগ করে এই প্যাটার্নকে বিশৃঙ্খল করে দিলে মুহূর্তেই আবার আগের অবস্থায় চলে আসে ক্লোরোপ্লাস্টগুলো। ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক পালস দিয়ে, হাই পাওয়ার লেজার, ফোটন ট্রিটমেন্ট দিয়ে; এমন কি কৃত্রিমভাবে শূণ্য গ্র্যাভেটি তৈরি করে তার মধ্যে এই প্যাটার্নটিকে বিশৃঙ্খল করে পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু ফলাফল সেই একই, মুহূর্তেই আগের অবস্থায় চলে আসে ক্লোরোপ্লাস্টগুলো। আবিষ্কারের পর থেকে প্রায় নব্বই বছর ধরে তাবৎ উদ্ভিদ বিজ্ঞানিসহ বিভিন্ন শাখার সব বাঘা বাঘা বিজ্ঞানিদের কাছে চরম দুর্বোধ্য হয়ে আছে এই নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন। অনেকক্ষণ ধরে চোখের সামনে ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যাথ হয়ে যায় রায়হানের, মাথা ডিপডিপ করে হালকা ব্যাথার পূর্বাভাস দিচ্ছে, তবুও একদৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে সে। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পরে চেয়ার থেকে, কোন শব্দ বের হয় না গলা দিয়ে, চোখ বড় বড় করে বই এর খোলা পাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। হঠাৎ বইটা বগলদাবা করে হুড়মুড় করে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আক্ষরিক অর্থেই এক দৌড়ে রুমে ফিরে আসে সে। এসেই গত তিন দিনে ইউনিফাইড স্ট্রিং থিউরী নিয়ে করা সমীকরনগুলো বের করে সে। পাগলের মত পৃষ্ঠা উল্টাতে ও লিখতে থাকে, মাঝেমাঝে ক্যালকুলেটর টিপে হিসাব করতে থাকে, ঘন্টা চারেক পর থামে, মৃদু হাপাচ্ছে চরম উত্তেজনায়। কিছুক্ষণ মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকে সমাধানটার দিকে রায়হান যেন সদ্য ভুমিষ্ঠ শিশু!, প্রচন্ড ঝড়ের পর যেন চরম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিপাশ, অদ্ভুত রকমের এক মমত্ববোধ অনুভব করতে থাকে সমাধানটার প্রতি। রায়হান বুঝতে পারে সে এমন এক সমাধান বের করেছে যেটা সমগ্র পৃথিবী জন্য চরম বিপর্যয় অথবা চরম উৎকর্ষ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। করনীয় ঠিক করে নেয় রায়হান, চোয়াল শক্ত করে টেনে নেয় কম্পিউটারেরে কিবোর্ডটি দৃঢ অকম্পিত হাতে।
দুই.
ক্লাস থেকে এই মাত্র বের হয়েছে পিপার, আকাশে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় চারকোনা বুক ফুলিয়ে। গাঢ় সবুজ কৃত্রিম আকাশ, মৃদু ক্রোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তার; সবুজ চোখদুটো মুহূর্তে ঘন কাল হয়ে যায়। দ্রুত পা চালায় সে। আজ এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে ক্লাস শেষ করতে। একজন সহজ একটা জিনিস শুধু প্যাচাচ্ছিল, শেষে এক ধমক দিয়ে পরে রুমে এসে বুঝে নিতে বলেছে। খুব সন্তর্পণে হাঁটছে সে, মাঝেমাঝেই পিছেনে ফিরে ও আশপাশ সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবেই এগুচ্ছে; সাবধান হওয়া খুব জরুরী, আজকাল ফোটন কাউন্সিলের স্পাইগুলো বেশ তৎপর; আর ওদের আছে সর্বোচ্চ ক্ষমতা, সবচেয়ে ভয়ের কথা জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই তাদের। হাঁটতে হাঁটতে শহরের একপ্রান্তের প্রায় নির্জন অঞ্চলে চলে আসে সে। তার পরেই বনাঞ্চল শুরু; কমলা রং* এর বিশাল বিশাল গাছের ঘন বন, চারপাশ একবার দেখে নিয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ে বনে।
কিছুক্ষণ হেঁটে আরও গভীরে চলে যায় পিপার; বড় একটা গাছের নিচে এসে থামে সে, একটু নিচু হয়ে গাছের এক জায়গায় পুরাটা হাত ঢুকিয়ে দেয়। মুহূর্তেই মাটি ফুঁড়ে একটি দরজা বের হয়ে আসে। এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে অল্পক্ষণ দাঁড়ায় সে, বুঝতে পারছে তাকে স্ক্যান করা হচ্ছে, কিছু সময়ের মধ্যেই দরজাটা খুলে যায়। একটি পেঁচানো সিঁড়ি মাটির অনেক গভীরে চলে গেছে। ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যায় পিপার। কিছুদূর এগিয়ে বিশাল একটা হল ঘরের মত জায়গায় পৌছায় সে। উপস্থিত প্রায় একশ এর মত লোক মুহূর্তেই যে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে, কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। পিপার সবাইকে আশ্বস্ত করে, “তোমরা কাজ করে যাও, আমি আমি রুটিন ভিজিটে এসেছি, কিছুক্ষণ থেকেই চলে যায়।” বলেই সেন্ট্রাল ট্রান্সমিটিং রুমের দিকে এগিয়ে যায় সে। তার পিছন পিছন ঢুকে বেইজ কমান্ডার লিলি।
সেন্ট্রাল ট্রান্সমিটিং রুমে শ্রেণীবদ্ধ টিউবের মধ্যে শুয়ে আছে দশজন পুরুষ ও দশজন মহিলা, তাদের প্রত্যেকের মাথায় একটা করে হেলমেট লাগানো তা থেকে নানান আকৃতির ও সবুজ রং এর ইলেক্টিক্যাল তার বের হয়ে বিশাল আকারের একটা ডিভাইসের মধ্যে ঢুকেছে। প্রত্যেকটি টিউবের উপর মনিটরের মত একটা ডিভাইসে যাবতিয় ডাটা দেখাচ্ছে সবার, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, হার্টবিট, লিকুইড ফ্লো-রেট ইত্যাদি নানান ইনফরমেশন। একজন টেকনিসিয়ান কর্মী সর্বক্ষণ সেগুলো মনিটর করছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে পিপার, “আর কতক্ষণ আছে এদের সেশন?”
- এই ত স্যার আর কিছুক্ষণ মাত্র, উত্তর দেয় টেকনিসিয়ান মেয়েটি।
পরের টিম রেডি ত? উত্তর যদিও জানেন তবুও জিজ্ঞেস করেন তিনি।
- জ্বি স্যার, তারা সবাই রেডি আছে।
ভাল, হঠাৎ খুব মায়া হয় তার এই সকল স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য। কিসের আশায় এরা এত ত্যাগ স্বীকার করছে? বেশিভাগই তো চরম মেধাবী; না হয় অভিজাত পরিবারে ও ধনীর দুলাল, ইচ্ছা করলেই তো হেসে খেলে জীবন পার করে দিতে পারত এরা! ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে যান পিপার। পিপার কিকি-এন্টি-ফোটন-কাউন্সিল* এর সুপ্রিম লিডার। সংগঠনটিনর বিভিন্ন শাখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এটা তার কেন্দ্রীয় কার্যালয়, খুবই গোপন একটি সংগঠন তবে অন্যান্য এন্টি-ফোটন-কাউন্সিলের মত সহিংস বা উগ্র নয়। এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাধমে শত বছরের এই অভিশপ্ত ফোটন কাউন্সিলের গ্রাস থেকে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করা।
পিপারের একমাত্র মেয়ে টুটুর গতকাল মৃত্যুবার্ষিকী গিয়েছে দিনের শুরু থেকে তাই মনটা তার ভার ভার, দীর্ঘ দিন রোগে ভুগে একটু একটু করে মৃত্যুবরণ করে টুটু, এ শোক আজও মেনে নিতে পারেনি সে। টুটুর মৃত্যুই তার মত সহজ সরল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষককে বিদ্রোহী নেতা হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। কিই বা করার ছিল তার! ভয়ংকর জীবানু টিক্সোনে আক্রান্ত হয়েছিল টুটু, এই জীবানু তার শরিরের ক্লোরোপ্লাস্টকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল ক্রমাগত, কোন প্রতিষেধক নেই এই রোগের, একটাই চিকিৎসা ক্রমাগত ফোটন থ্যারাপি দেওয়া, যা এখনকার ব্যবস্থায় অসম্ভব ব্যয়বহুল। কিন্তু তার মত মধ্যম আয়ের একজন শিক্ষক এত ক্রেডিট কোথা থেকে পাবে? কাউন্সিলের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। তিলেতিলে মৃত্যু! কিন্তু কেন? প্রকৃতি যে জিনিস বিনামূল্যে দিয়েছে সেটা কেন ক্রেডিটের বিনিময়ে কিনতে হবে! ভয়ংকর ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার, তারপর ধীরে ধীরে শিক্ষকতা পেশার আড়ালে চরম গোপনীয়তায় গড়ে তোলে এই বিদ্রোহী সংগঠন।
প্রায় বিশ টার্পিক আবর্তন* ধরে সংগঠনটি অহিংস এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই শুধু মাত্র সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া। তবে পিপারের বিশ্বাস চূড়ান্ত সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা। খুব তাড়াতাড়িই তাদের এই আন্দোলন বড় ধরণের কোন সাফল্যের মুখ দেখবে। নিজের রুমে বসে নতুন কর্মপন্থা নিয়ে চিন্তা করছিল সে, এমন সময় বেজে ওঠে সপ্তম মাত্রার সাইরেন! এই বেইজে বিশ টার্পিক আবর্তনের প্রথম এত উচ্চমাত্রার সাইরেন! লাফ দিয়ে উঠে সেন্ট্রাল ট্রান্সমিটিং রুমের দিকে দৌড়ে যায় পিপার। সবাই ইতমধ্যে পৌঁছে গেছে সেখানে। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, আসলেই কি তারা এই এলার্ম শুনতে পাচ্ছে? কাঁপাকাঁপা হাতে মনিটরের উপর কয়েকটা বাটন দ্রুত টিপে দেয় পিপার। সাথেসাথে সামনের স্ক্রীনে ভেসে উঠে অনেকগুলো সংখ্যা,
1 1 2 2 3 2 1 4 2 2 5 2 3 6 2 4 7 2 5 8 2 6 9 2 7 10 2 8 11 2 8 1 12 2 8 2 13 2 8 3
সংখ্যাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ চোখের কোণে কাল একটা আভা মুহূর্তে দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়, কিকি গ্রহের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী পিপার বুকে হাত বুলাতে বুলাতে চেয়ারে বসে পড়েন। সবাই স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিছু শোনার আশায়।
“বন্ধুগন বন্ধুগন বন্ধুগন, আমরা শেষ পর্যন্ত আলোর দেখা পেয়েছি”, কণ্ঠ কিছুটা কেঁপেকেঁপে উঠে তার “এত টার্পিক আবর্তন ধরে আমরা যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি অচিরেই তার অবসান হতে যাচ্ছে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমি কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে রাজি নই, আমাদের এখনো অনেক পথ যেতে হবে, মনে রাখতে হবে আমাদের লক্ষ্য ফোটন কাউন্সিল হলেও আমাদে মূল লক্ষ্য কিন্তু সিলিকন আমভ্রেলা সিস্টেম, কারন একটি ফোটন কাউন্সিলকে ধ্বংস করলে আরেকটা কাউন্সিল দাঁড়িয়ে যাবে, তাই শোষণের মূল হাতিয়ারের বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধ। আমি আজ আপনাদের জানাতে চাই, আমরা অসীম এই মহাবিশ্বে এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধান পেয়েছি যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রায় আমাদের সমকক্ষ। এটাই আমাদের মূল শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হবে ফোটন কাউন্সিলের বিপক্ষে।”, কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বক্তব্য শুরু করেন পিপার, “এখন অনেক কাজ বাকি, সবাই সাধ্যের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজনে মৃত্যুকেও চোখ রাঙ্গাতে হবে। মনে রাখতে হবে ইতিহাসের শিক্ষা হল ‘প্রকৃত বিপ্লবী বিপ্লবের স্বাদ গ্রহণের জন্য বেঁচে থাকে না’। আমাদের বিপ্লব আগামী প্রজন্মের জন্য, শোষণহীন সমাজের জন্য।”। দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে একটু হাঁপিয়ে উঠেন পিপার, গালভরে পানি পান করে একটু স্বস্তি পান, তারপর দ্রুত হাতে কাছে টেনে নেন ছোট আকারের তার প্রিয় কম্পিউটার; অনেক কাজ বাকী, আজ থেকে বিপ্লবে যুক্ত হলো নতুন মাত্রা।
তন্ময় হয়ে শুনছিল সবাই সুপ্রীম কমান্ডারের কথা, বক্তৃতা শেষ হতেই ছেড়ে দেওয়া স্প্রিং এর মত লাফিয়ে উঠে তারা, মৌচাকের মত কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে সম্পূর্ণ বেইজ মুহূর্তের মধ্যে। সবার চোখে মুখে দীপ্ত প্রত্যয়ের স্পষ্ট ছাপ।
তিন.
সুন্দর গোছানো ড্রয়িং রুম, ঝকঝক তকতক করছে প্রতিটি আসবাব; কোথাও বিন্দু পরিমান ধুলোকনা নেই; দেয়ালের ঘড়িটাও টিকটিক করে চলছে সেকেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে, ছয়টা বেজে দশ। দেয়ালে কিছু অদ্ভুত রকমের পেন্টিং ঝুলে আছে, এটা আজকাল আভিজাত্যের লক্ষন। বোঝাই যাচ্ছে প্রফেসর সাহেবের রুচি আছে। নিজের পায়ে স্যান্ডেল-সু এর দিকে আড়চোখে তাকায় সে, হালকা রং চটে গেছে, পায়ের আঙ্গুলগুলো মাথা দিয়ে বের হয়ে আছে, বৃদ্ধাঙ্গুলের নখটা হালকা বড় হয়ে উদ্ভট ভঙ্গীতে বেকে আছে, এত ছিমছাম ঘরের মধ্যে নিজেকেই কেমন যেন উটকো লাগে রায়হানের। কাজের মেয়ে সেই যে কতক্ষণ আগে বসিয়ে রেখে গেছে আর কোন খবর নেই, আদৌ কী তার কথা ভিতরে বলেছে সে? কে জানে! অভিজাত শ্রেণীর অন্দরমহলের পরিচারিকাদের স্ট্যাটাস অন্যদের চেয়ে ঢের উপরে, তাদের ঠাটবাটই আলাদা। এত ভোরে কারও বাসায় এসে বিরক্ত করাটাও শোভন দেখায় না, তাকে যে ঢুকতে দিয়েছে এইত বেশি, অবশ্য সে জন্য একটু মিথ্যা কথা বলতে হয়ছে গেটে। রিকশা থেকে নেমে খুব প্রত্যয়ের সাথে বলেছে প্রফেসর চাচা আছেন? গ্রাম থেকে এসেছি, উনি আমার চাচা হন। গেটে দারোয়ান আর কিছু বলেনি। বোঝাই যাচ্ছে গ্রাম থেকে প্রায়ই এমন কেউ না কেউ আসে।
পাক্কা এক ঘন্টা বিশ পর নিচে নেমে আসেন ডঃ প্রফেসর কামরুল হাসান, এই সময়ের ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের হেড ও স্ট্যাটিস্টিক্যাল-কোয়ান্টাম-মেকানিক্সের সেরা শিক্ষক। শুধু সেরা শিক্ষক বললে কম বলা হবে, বর্তমান সময়ে হাতেগোনা যে কজন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্ট্রিং-থিউরী শাখায় কাজ করছেন তিনি তাদের অন্যতম। চেহারার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপটা স্পষ্ট, মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা, টিকোল নাক, তার ঠিক নিচেই ভয়ংকর দর্শন পুরু দারোগা টাইপ গোঁফ, প্রফেসরদের এমন গোঁফ থাকতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করত না রায়হান; ব্যাকব্রাশ করা ঘন কাঁচা পাকা চুলের সংমিশ্রিণ, যা তার চেহারায় জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয় রায়হান।
- আরে বস, বস; সালামের উত্তর দিয়ে বলেন তিনি। চুল থেকে পা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি রায়হানকে। কপালে মৃদু ভাঁজ ফেলে বুঝতে চেষ্টা করছেন এত সকালে তার এখানে আসার উদ্দেশ্য। এমন উটকো ঝামেলায় প্রায়ই তাকে পড়তে হয় ডিপার্টমেন্টে। কোথা থেকে হাজির হয় উদ্ভট সব প্রকল্প নিয়ে, ‘বিনা জ্বালানীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, অথবা কোন শক্তি ছাড়া কন্টিনিয়াস যন্ত্র, অথবা ফুয়েলবিহীন গাড়ি’ যেগুলো সবগুলোই ভুয়া না হয় আউটপুট থেকে ইনপুট বেশি, কিন্তু তারা কখনো বাসায় আসে না। ছেলেটাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না তার।
স্যার আমি আপনার একজন ভক্ত।
- একটু বিরক্ত হয় প্রফেসর কামরুল। এই সাত সকালে ভক্তের দেখা পাওয়ায় তিনি মোটেও প্রীত হননি। আর তিনি তো কোন সেলিব্রেটি না, না কোন রাজনীতিবিদ যে তার অগনিত ভক্ত থাকবে। ইউনিভার্সিটির বাইরে তাকে কেউই তেমন একটা চেনে না, এমনকি ঢাবির তার মত হাজার হাজার শিক্ষক আছে, নিজের ডিপার্টমেন্ট ছাড়া কে কার খবর রাখে? তিনি হালকা হাসি দিয়ে বিরক্তভাবটা গোপন করে জিজ্ঞাসু নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন ‘ঠিক আছে, বুঝলাম; এখন তোমার আর কিছু কি বলার আছে?’ এমন ভাব।
আসলে রায়হান আলাপচারিতা এভাবে শুরু করতে চায়নি, কিন্তু সারা রাত না ঘুমিয়ে ক্লান্তিকর ট্রেন ভ্রমন করে সে ঢাকায় এসেছে, তাই মাথাটা একটু ধরা ধরা লাগছে। “স্যার আমি আসলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ি। ছোট বেলা থেকে আমার ইচ্ছা ছিল ফিজিক্সে পড়া, জন্মগতভাবে আমার ব্রেনের গঠন এমন এ আমি খুব সহজেই ফিজিক্সের অনেক কিছু বুঝে যাই, আর নিজেকে সেভাবেই প্রশিক্ষিত করি ছোট বেলা থেকেই। যেকোন ঘটনাকে আমি সমীকরনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারতাম, চোখ বুজলেই আমার সামনে নানান সমীকরন নেচে বেড়াতে থাকে। কিন্তু দেশের এডমিশন পরীক্ষার সিস্টেমের যে অবস্থা! ঢাবিতে চান্স পাইনি। এমন কি ফিজিক্স পাইনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই। শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার চান্স পেয়ে সেখানে পড়ছি। কিন্তু আমি রুমমেট বেছে বেছে নিয়েছি ফিজিক্সের ছাত্র সেই সুবাদের ফিজিক্সের ক্লাসগুলো করছি, আর লাইব্রেরী ও ইন্টারনেট ত আছেই। সারাদিন ফিজিক্স নিয়েই থাকতাম, আমার পছন্দের বিষয় হল স্ট্রিং থিওরী, এই বিষয়ে যত নতুন নতুন রিসার্চ পেপার বের হত সব আমার পড়া”, প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে কিছুটা গুছিয়ে বলে রায়হান।
- এবার কিছুটা কনফিউসড হয়ে যান প্রফেসর কামরুল হাসান। ছেলেটা কি চাচ্ছে? সে কি ফিজিক্সে এডমিশনের কোন সুযোগ খোঁজছে? না কি অন্য কোন কাহিনী? ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু করে রায়হান, “হঠাৎ করে অনেকটা ভাগ্যগুনেই কয়েকদিন আগে নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন সম্পর্কে জানতে পারি, ঠিক সেই সময় আমি ইউনিফাইড-স্ট্রিং থিউরী নিয়ে কাজ করছিলাম। বিচিত্র কিছু কারনে আমার সমীকরন ইউনিফাইড-স্ট্রিং সমীকরনের সাথে মিলছিল না। আমি ভেবেছিলাম কোথাও নিশ্চয় ভুল করছি, কিন্তু পরে বুঝতে পারি এটা আমার ভুল না, পূর্বের সমীকরনই ভুল ছিল, আমি শুধু ইউনিফাইড-স্ট্রিং থিউরীর সমীকরনই বের করেনি, সেই সাথে এটা দিয়ে নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন এই সমস্যার সমাধান করে তা প্রমাণও করেছি”।
- এইবার প্রফেসর বুঝতে পারেন রায়হানকেও সেই পাগলামোতে পেয়েছে যারা কিছুদিন পরপর উদ্ভোট প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়। কিছুটা বিরক্ত ফুটিয়ে তুলে তিনি বলেন, “যতটুকু জানি ‘নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন’ এটা উদ্ভিদবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত; তাহলে ফিজিক্সের টিচার হিসাবে আমি তোমার জন্য কি করতে পারি?”
স্যার, আগামী মাসে মিউনিখে স্ট্রিং থিউরী নিয়ে যে আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলন হবে আপনি সেখানে প্রথম সারিতেই থাকবেন, আমি চাই আপনি সেখানে এই ফলাফল প্রকাশ করেন। আর বিষয়টা মোটেও উদ্ভিদবিদ্যার অন্তভূক্ত নয়, আমি ‘নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন’ ব্যাবহার করেছি শুধু মাত্র আমার থিউরি প্রমাণ করার জন্য, এটা মূলত কোয়ান্টাম-ম্যাকানিক্সের স্ট্রিং থিউরির অন্তভুক্ত।
-এবার বিরক্তিটা আর চেপে না রেখে তিনি বললেন, “তুমি কীভাবে ভাবলে এটা প্রকাশের যোগ্য, তার উপর সেখানে কি উপস্থাপন করা হবে সে সব তো অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে, আর তোমার ফলাফল আমি কেন প্রকাশ করব?”
ব্যাগ থেকে এক বান্ডিল প্রিন্ট করা কাগজ বের করে রায়হান বলল, “স্যার, আপনি শুধু এইগুলো একবার পড়ে দেখেন, বাদবাকী আপনার ইচ্ছা। এ ফলাফল প্রকাশ করার মত প্লাটফর্ম আমি পাব না, আমার কথা কেউ শুনতেই চাইবে না বিশ্বাস করা তো পরের ব্যাপার, আর এই সেনসেটিভ বিষয়টা আমি ভুল হাতে পড়ুক তা চাই না, কেন চাই না সেটা রিপোর্টটা পুরোটা পড়লেই আপনার কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
- “আচ্ছা, রেখে যাও, আমি সময় করে পড়ে দেখব।”, বলেই হাতঘড়িতে সময় দেখে, বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনি পুরু গোফ বরাবর চালিয়ে থুতুনি পর্যন্ত বুলাতে বুলাতে চোখ নাচিয়ে যেন বলতে চাইলেন যে বাছা আর কিছু কি চাই তোমার ? না হলে আমি খুব ব্যস্ত আছি তুমি এবার আসতে পার।
সালাম দিয়ে বের হয়ে আসে রায়হান, প্রথম ইম্প্রেশনটা একেবারে খারাপ হয়নি। বের হতে হতে শুনতে পায় প্রফেসর সাহেব কাজের মেয়েটিকে ডেকে তার রিপোর্টটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে আসতে। ঠোঁটের কোনে হাসি মৃদু উকি দিয়ে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় তার। আজ ‘নিউকোভিচ ক্লোরোপ্লাস্টিক প্যাটার্ন’ এর উপর এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার কথা প্রোফেসর তোফাজ্জল হোসেনের কাছে, স্যার নিশ্চয় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন আর পরীক্ষায় কিভাবে সায়েস্তা করবেন তা ভাবছেন।
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় মধ্যাহ্ন, সকাল থেকে আজ বেশ ধকল গেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে মিটিং ছিল, এই সকল সরকারি মিটিং গুলোতে যা হয়, কাজের চেয়ে অকাজই বেশি, তৈলমর্দন ও অহেতুক সময়ক্ষেপণ; প্রফেসর কামরুল হাসান সাহেব এধরনের মিটিং গুলোতে সবসময় অনেক আকাঙ্খা নিয়ে আসেন আর একরাস আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে বের হন। আজ প্রথম থেকেই অন্যমনষ্ক ছিলেন, মাথার মধ্যে সকালের ঘটনাই ঘুরে ফিরে আসছিল বারবার; ছেলেটার চোখে অন্যরকম কী যেন একটা আছে। কোন রকমে লাঞ্চ সেরেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে রায়হানের রিপোর্ট পড়তে শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বসে পড়েন তিনি, তারও কিছুক্ষণ পর প্রায় দৌড়িয়ে নিজের স্টাডিরুমে ঢুকেন, দরজা বন্ধ করে পড়তে থাকেন রায়হানের রিপোর্ট। মাথা ঘুরছে তার, কী পড়ছেন তিনি এটা! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না!
বোসনিক স্ট্রিং থিউরী অনুযায়ী ইউনিভার্স ছাব্বিশ মাত্রার কিন্তু সুপার-স্ট্রিং থিউরি* অনুসারে ইউনিভার্স এগার মাত্রার; এ দুই থিউরির সীমাবদ্ধতাগুলোকে সমাধান করে ইউনিফাইড-স্ট্রিং* থিউরির মাধ্যমে ইউনিভার্সকে ছয় মাত্রায় সঙ্গায়িত করেন এই শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্যার জোহান কোনাল, এর জন্য তিনি নোবেল পুরুষ্কার পান গতবছর। আর রায়হান এই ইউনিফাইড-স্ট্রিং* থিউরিকে সংশোধীত করে ইউনিভার্সকে নিয়ে এসেছে পাঁচ মাত্রায় আর অবশিষ্ঠ একটি মাত্রাকে গ্র্যাভেটি স্ট্রিং হিসাবে দেখিয়েছে। ব্রিলিয়েন্ট অবজার্বেশন! এই গ্র্যাভেটি স্ট্রিং কখনো মাত্রা হিসাবে আবার কখনো স্ট্রিং হিসাবে আচরন করে। রায়হানের সমীকরন অনুসারে স্ট্রিং দুই প্রকার, অবজেক্ট স্ট্রিং ও গ্র্যাভেটি স্ট্রিং। একমাত্রার অবজেক্ট স্ট্রিং গুলো; X, Y, Z এই তিনটি মাত্রা বরাবর বিভিন্ন কম্পাঙ্কে প্রকম্পিত হয়ে স্থান (স্পেস) তৈরি করে, আর সময় মাত্রা T বরাবর প্রকম্পিত হয়ে একত্রে চার মাত্রার স্থান-সময় (স্পেস-টাইম) তৈরি করে। আর গ্র্যাভেটি স্ট্রিং গুলো এই চার মাত্রার স্পেস-টাইমের মধ্য দিয়ে সময় মাত্রাকে স্থির রেখে, শুণ্য সময়ে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করে অথবা স্থানকে স্থির রেখে শুণ্য স্থানে অসীম সময় অতিক্রম করে।
দুকান দিয়ে যেন আগুনের হলকা বের হচ্ছে প্রফেসর কামরুল হাসান সাহেব, বাঁ হাতের কব্জি উল্টিয়ে সময় দেখেন তিনি, রাত সাড়ে নয়টা বাজে! ইন্টারকমে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন তিনি। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার মত অবস্থা তার অবশিষ্ট নেই। পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশের একটা গাছ থেকে একডালা পাতা পেড়ে নেন তিনি। এত রাতে কামরুল স্যারকে হাতে করে গাছের ডাল নিয়ে ল্যাবে আসতে দেখে মোটেও অবাক হয় নি নাইটগার্ড, তার বিশ বছরের নাইটগার্ড জীবনে প্রফেসরদের অনেক পাগলামো দেখেছে, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবলেসহীন ভাবে সে ল্যাবের দরজা খুলে দিয়ে বাহিরের টুলে বুসে ঝিমুতে থাকে যথারীতি।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা টানা কাজ করার পর সবকিছু সেট হয়, তিনটি পৃথক পাতাকে একটা বায়ুশুন্য টিউবে রেখে কয়েকটা তার এর মধ্যে জুড়ে দেন তিনি। এবার তিনি পরমানুর পিরিউডিক টেবিল খুলে বসেন, যদিও প্রত্যেকটি পরমানুর ইলেকট্রন সংখ্যা ও বিন্যাস তার মুখস্ত তবুও কোন ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আরও একবার তার সেট করা মেসেজটার সাথে পিরিওডিক টেবিলে পরমানুর অর্বিট অনুসারে ইলেকট্রনের বিন্যাস মিলিয়ে দেখেন তিনি,
সিরিয়েল ----পরমানু ------ ইলেক্ট্রোন সংখ্যা অর্বিট অনুসারে
১ ---------- হাইড্রোজেন ---------- ১
২ ---------- হিলিয়াম -------------- ২
৩ ---------- লিথিয়াম -------------- ২,১
৪ ---------- ব্যারিলিয়াম ----------- ২,২
৫ ---------- বোরন ------------------২,৩
৬ ---------- কার্বন ------------------২,৪
৭ ---------- নাইট্রোজেন ----------২,৫
৮ ----------অক্সিজেন ------------ ২,৬
৯ ---------- ফ্লোরিন ----------------২,৭
১০ ----------নিয়ন -----------------২,৮
১১ ----------সোডিয়াম ----------- ২,৮,১
১২ ----------ম্যাগনেশিয়াম ------- ২,৮,২
হুমম, সব ঠিক আছে, তার ম্যাসেজটা দাঁড়ায়,
১,১,২,২,৩,২,১,৪,২,২,৫,২,৩,৬,২,৪,৭,২,৫,৮,২,৬,৯,২,৭,১০,২,৮,১১,২,৮,১,১২,২,৮,২
লম্বা করে একটা দম নিয়ে কিছুক্ষণ তা আটকে রাখেন, তারপর পাওয়ার সুইচটা অন করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকেন এক দৃষ্টিতে। ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপের* ভিডিও আউটপুট আসছে এই মনিটরে, একেক মুহূর্ত যেন একেক যুগের মত লাগছে তার কাছে, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও তার কানে আসছে। ঠিক একশ সত্তর সেকেন্ড পর; মনিটরে পাতার কোষের ক্লোরপ্লাস্টগুলোকে নড়ে উঠতে দেখেন তিনি। কিছুক্ষণ বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে থাকে ক্লোরপ্লাস্টগুলো, আরও কিছুক্ষণ পর একটা প্যাটার্নে রূপ নেয় তা, ‘নিউকোভিচের প্যাটার্ন’ অনুযায়ী কিছুক্ষণের মধ্যে তা আবার আগের প্যাটার্নে ফিরে আসার কথা; কিন্তু যদি রায়হানের থিউরি ঠিক হয় তাহলে নতুন কোন প্যাটার্ন পাওয়া যাবে। চোখের পাতা নাড়াতেও ভয় পাচ্ছেন প্রফেসর সাহেব। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেন তিনি। অবাক হয়ে দেখেন এখনো কোন পরিবর্তন নেই প্যাটার্নে। ক্লোরপ্লাস্টগুলো তার কোডিং করা প্যাটার্নেই আছে, নতুন কোন প্যাটার্নে রুপ নিচ্ছে না আবার নিউকোভিচ প্যাটার্নও হচ্ছে না। এসির ঠান্ডার মধ্যেও রীতিমত ঘামতে থাকেন তিনি, সার্টের উপরের দিকের কয়েকটি বোতাম খুলে দিয়ে নিজের অজান্তেই হাতের কাগজগুলো দিয়ে বাতাস করতে থাকেন তিনি। প্রায় পনের মিনিট পর; ভিডিওতে হঠাৎ ক্লোরপ্লাস্টগুলো তৎপর হয়ে উঠে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লোরপ্লাস্টগুলো নড়েচড়ে একটা প্যাটার্নে দাঁড়িয়ে যায়, অবাক হয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন তিনি প্যাটার্নটা। মাই গড! ও মাই গড!! বলতে বলতে তিনি চেয়ারটায় বসে পড়েন।
চার.
বিকাল বেলায় রাস্তায় হাঁটছে পিপার। মনটা একটু বিষন্ন, যে গতিতে তাদের কার্যক্রম চলবে বলে তিনি আশা করেছিলে সেভাবে চলছে না। আজ একটা গোপন মিটিং আছে বেইজ কমান্ডার লিলির সাথে, মেয়েটা বেশ চটপটে আর ব্রিলিয়ান্ট, একটাই সমস্যা একটু বেশি ইমোশনাল, সেই ভাল; ইমোশন না থাকলে কি কেউ বিপ্লবপন্থীদের দলে নাম লেখাতে পারে? মাথা নিচু করে হাঁটছেন তিনি, চোখে তার মুক্তির স্বপ্ন, তার মন বলছে আর বেশি দেরি নেই, খুব তাড়াতাড়িই আসবে তাদের বহুকাঙ্খিত সফলতা। রেস্তোরাঁয় ঢুকেই তিনি দেখেন এক কোণায় চেয়ার পেতে বসে আছে লিলি। হাত নাড়িয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে। কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে দুগালে হালকা চুমু খায়, যেন কোন এক প্রেমিক জুটি, ডেটিং এ এসেছে।
- কি খবর লিলি? পরিবার কেমন আছে?
এইত ভাল, পরিবারও ভাল চলছে।
- তোমাদের প্রোগ্রেস কতটুকু?
তারা আমাদের তুলনায় বার টার্পিক বছর পিছিয়ে আছে। আপনি যে সময়টাতে গ্র্যাভেটি স্ট্রিং থিউরির প্রবর্তন করেন তারা এখন সেই স্টেজে আছে। তাদের কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য পাব বলে তো আমার মনে হচ্ছে না!
- সভ্যতা ও বুদ্ধিমত্ত্বার বিকাশটা কিন্তু খুবই অদ্ভুত, এই যে আমরা এই গ্রহে আধিপত্য স্থাপন করে আছি, আমরা কি সর্ববিষয়ে বাদবাকি প্রাণীদের চেয়ে বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে? তাদের কাছ থেকে হয়ত গতানুগতিক প্রযুক্তিগত কোন সাহায্য হয়ত পাব না, তবে এমন কোন সাহায্য হয়ত পেয়ে যাব যেটা আমাদের ধারনারও বাইরে। তবে বিনিময়ে তারা কি চায় সেটাই এখন আমাদের বের করতে হবে। তোমার যাই মনে হোক, আমার বিশ্বাস খুব অচিরেই সবকিছুর অবসান ঘটবে। কি নিবে বলো?
না পিপার, তুমিত জান আমি চফয় কিছু নেই না। আর এত দামী রেস্তোরাঁয়ত প্রশ্নই উঠে না।
- কিছু না নিলে সন্দেহ করবে, আমি স্পেশাল ফোটন ভেনিলা অর্ডার দিচ্ছি। তাদের সাথে যোগাযোগ এখন কোন পর্যায়ে আছে?
সেটাই এখন এক বিশাল সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, তাদের সাথে আমাদের ভাষা ও কালচারের বিস্তর তফাৎ। তাদের প্রথম মেসেজ ছিল এক থেকে বার পর্যন্ত পরমানুর ইলেক্ট্রোন বিন্যাস আর আমাদের ফিরতি রিপ্লাই ছিল তের থেকে চব্বিশ পর্যন্ত পরমানুর ইলেক্ট্রোন বিন্যাস। সেদিন তো আপনিও বেইজে ছিলেন। আমাদের এখন একটা কমন ভাষা বের করতে হবে, যার মাধ্যমে আমার মেসেজ আদান প্রদান করতে পারব। আপাতত আমরা প্রাইম সংখ্যা ও বিভিন্ন সিরিজ আদান প্রদান করছি।
- কতদিন লাগতে পারে কমন ভাষা বের করতে?
সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে আমাদের প্রাইমারি অবজেকটিভ এখন এটাই, আমি সব রিসোর্স এই কাজেই লাগিয়েছি।
- তাড়াতাড়ি কর; কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দাও, আর আমরা যে এই গ্রহের বিপ্লবী গ্রুপ এটা তাদের এখনই জানানোর দরকার নেই। ভাষাটা ঠিক মত আয়ত্ব হয়ে গেলে তাদের সর্বোচ্চ প্রতিনিধির সাথে আমার একটা আলোচনার ব্যবস্থা করবে।
ঠিক আছে; আমি রেগুলার তোমাকে সব খবর জানাব। তোমাকে কেমন যেন একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে?
- একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমাদের তিন নাম্বার বেইজের একজন টেকনিক্যাল এনালিস্ট ধরা পড়ে গিয়েছিল, তবে কোন ইনফরমেশন নিতে পারেনি, তার আগেই সে হিপ্পোমানির* ক্যাপসুল ফাটিয়ে দেয়। সে সহ তিনজন এজেন্ট মারা যায় সাথে সাথে। ঐ এনালিষ্ট আমার প্রাক্তন ছাত্র ছিল বলে আজ সকালে কয়েকজন কাউন্সিলের এজেন্ট তার ব্যাপারে খোঁজখবর করতে এসেছিল। সতর্ক থেকো আগামী কয়েকদিন। অবশ্য সাবধানের থেকেও কোন লাভ নেই, মনে দুঃশ্চিন্তটা আবার ভর করে পিপারের মনে। সামনে অনেক মৃত্যু, অনেক ধ্বংস অপেক্ষা করছে, ফোটন কাউন্সিল সহজে ছেড়ে দেবে না।
রেস্তোরাঁ থেকে হাত ধরাধরি করে বের হয়ে আসে পিপার ও লিলি। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় পিপার। পুরো আকাশ ঢেকে আছে সিলিকামভ্রেলার* চাদরে। সে জীবনে মুক্ত আকাশ দেখেনি, দাদার কাছে গল্প শুনেছিল মুক্ত আকাশ নাকি ভয়ংকর অকল্পনীয় সুন্দর আর নীলাভ রঙের। যে করেই হোক এই মুক্ত আকাশ আবার মুক্ত করতে হবে তাকে; যে করেই হোক।
পাচ.
মিউনিখে আজ স্ট্রিং থিউরির দ্বাদশ কনফারেন্সের শেষদিন। এধরনের কনফারেন্সে নতুন তেমন কিছু হয় না আজকাল, কালেভদ্রে দুএকজন নতুন কিছু উপস্থাপন করতে পারে, বাকি সবই চর্বিতচর্বন; আর শেষের দিনে সাধারনত হাই-হ্যালো, খবরা খবর নেওয়া, খাওয়া দাওয়া ও সবশেষে সভাপতির সমাপনি বক্তৃতা এই তো হয়। কিন্তু এই শেষের দিনেই যে শতাব্দির সেরা চমক অপেক্ষা করছিল সেটা মনে হয় কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। সবাই ছোট ছোট গ্রুপে গল্প করছিল, কয়েকজন খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত, এমন সময় ধীরে ধীরে স্টেজে উঠলেন প্রফেসর কামরুল হাসান। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি বলেল, “প্রিয় বন্ধু ও সহকর্মীবৃন্দ, আমরা মনে হয় এই দ্বাদশ কনফারেন্স খুব সফলভাবেই শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু আমি আপনাদের এখন যে কথাটা বলতে স্টেজে উঠেছি সেটা না বলা পর্যন্ত এই সম্মেলন পূর্ণতা পেতে পারে না আমি নিশ্চিত।”, সবাই একটু নড়েচড়ে বসে তার কথায়; তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হলেও প্রফেসর কামরুল হাসানের নাম উচ্চারন হয় বিশ্বে অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর সাথে একটু দম নিয়ে তিনি আবার শুরু করেন, “আমি আজ এমন একটি বিষয় নিয়ে উপস্থিত হয়েছি যা আধুনিক বিজ্ঞানের কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ভিত্তি নাড়িয়ে দিবে আরও স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে স্ট্রিং থিউরি সম্মন্ধে আমাদের এতদিনের ধারনা আমূল পাল্টে দিবে।”, উপস্থিত বিজ্ঞানিদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। “আমি আর সময়ক্ষেপণ না করে স্টেজে ডাকছি রায়হান ভূঁঞা কে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা নিরাশ হবেন না”।
মাথা নিচু করে ইতস্থত পা ফেলে স্টেজের দিকে এগিয়ে যায় রায়হান। বিশ্বের এত বড় বড় নামকরা বিজ্ঞানীদের মাঝে তার থিউরি উপস্থাপন করতে হবে ভাবতে তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে, সম্পূর্ণ হল সেন্ট্রালি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও তার কপালে মৃদুমৃদু ঘামের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে। প্রফেসর তার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে, অভয় দেয়। বুকে কিছুটা বল ফিরে পায় রায়হান। ধীরে ধীরে তার থিউরি উপস্থাপন শুরু করে সে; কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তার, সারা হল জুড়ে তখন শুধু রায়হানের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। একে একে ব্যাখ্যা করতে থাকে তার মাত্রার সমীকরনগুলো, গ্র্যাভেটি স্ট্রিং ও অবজেক্ট স্ট্রিং নিয়ে তার সমীকরনের পর্যায়গুলো, কিভাবে X,Y ও Z মাত্রায় অবজেক্ট স্ট্রিং গুলো নির্দিষ্ট কম্পাংকে প্রকম্পিত হয়ে ‘স্পেস, মৌলিক কণা ইলেক্ট্রোন, প্রোটন, নিউট্রন’ ইত্যাদি গঠন করে, আর T বারার স্ট্রিং গুলো নির্দিষ্ট কম্পাংকে প্রকম্পিত হয়ে ‘টাইম’ গঠন করে, কীভাবে এই চারমাত্রা একীভূত হয়ে স্পেস-টাইম তৈরি করে। পিনপতন নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করছে হল জুড়ে। সবাই যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। লেকচারের শেষের পর্যায়ে এসে সে ব্যাখ্যা করতে থাকে কিভাবে গ্র্যাভেটি স্ট্রিং গুলো এই চার মাত্রার স্পেস-টাইমের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় শুন্য সময়ে অসীম দূরুত্ব অথবা শূন্য দূরত্বের অসীম সময়ে, কিভাবে এই গ্র্যাভেটি স্ট্রিং গুলো টাইম ও স্পেসের মধ্যে ভ্রমন করে অবজেক্ট স্ট্রিং গুলোকে প্রভাবিত করে স্পেসের গঠন বদলে দিতে পারে; এই সব নিয়েই আমাদের পঞ্চমাত্রার ইউনিভার্স। প্রায় ঘন্টাখানেক পর শেষ হয় তার প্রেজেন্টশনের প্রথম পর্ব।
সবাই মনে হয় ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। একে অপরের দিকে তাকাছে জিজ্ঞাসু নয়নে, কোন কথা বের হচ্ছে না তাদের মুখ দিয়ে; শুধু ভাবছে “কি বলছে এই ছেলে?”
সাময়িক বিরতির পর শুরু হয় লেকচারের দ্বিতীয় পর্যায়। আমি এবার আপনাদের একটা পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করব যেটা আমাদের এই থিউরি কে প্রমাণ করবে। খুবই সহজ একটা পরীক্ষা। আমরা সবাই জানি প্রায় চার যুগ ধরে আমরা মহাশূন্যে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির সিগনাল প্রেরণ করে যাচ্ছি এই আশায় যে ভিনগ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ত আমাদের মেসেজ পেয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে, কিন্তু এই মহা মহাশূন্যে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ আলোক বৎসর পার হয়ে এই মেসেজ কেউ পাবে আবার রিপ্লাই দিলেও আমরা রিসিভ করতে পারব সেটা একেবারে সুদূরপরাহত চিন্তা। আসলে প্রায় আট যুগ ধরে আমরা নিজেরাই একটা সিগলান রিসিভ করে যাচ্ছি তবে এটার অর্থ বের না করতে পারার কারনে যোগাযোগ স্থাপণ সম্ভব হয়নি। জ্বী, আপনারা ঠিকই ধরতে পেরেছেন, আমি ‘নিউকোভিচ ক্লোরপ্লাস্টিক প্যাটার্নের’ কথাই বলছি।
উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে একটা গুঞ্জণ শুরু হয়, কী বলছে এই ছেলে! এও কী সম্ভব?
ভিনগ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ত হাজার বছর ধরে আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে, এই নিউকোভিচ প্যাটার্নের মাধ্যমে, আর আমরা এই প্যাটার্ন দেখতেই পেয়েছি ১৯৩৫ সালে আর এখন এর মর্মোদ্ধার করতে পেরেছি। ঐ বুদ্ধিমান প্রাণীরা গ্র্যাভেটি স্ট্রিং এর মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীর গাছের পাতার মধ্যে যে ক্লোরপ্লাস্ট আছে সেগুলোকে একটা প্যাটার্নের মত করে সাজিয়ে রেখেছে। গ্র্যাভেটি স্ট্রিং যেহেতু শূন্য সময়ে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তাই আমার এই প্যাটার্ন বিশৃঙ্খ করে দিলেও মুহূর্তেই আবার আগের প্যাটার্নে ফিরে আসে। ভিন গ্রহের প্রাণীরা গ্র্যাভেটি স্ট্রিং গুলোকে যে ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পিত করে আমাদের এই প্যাটার্ন পাঠাচ্ছে আমার সেই একই ফ্রিকোয়েন্সিতেই যদি অন্য প্যাটার্ন পাঠাই তখন তারা আমাদের মেসেজ রিসিভ করতে পারবে এবং পুনরায় রিপ্লাই দিবে। এখন একটি পাতার পাশাপাশি সাতটি কোষের ক্লোরপ্লাস্টগুলোকে বাইনারিতে কনভার্ট করলে এই রকম দাঁড়ায়,
A = 1001 0001 1000 0100 1110 0111 0010 1010 0000 0000 0000 = 12^14
B = 0011 0110 0001 1010 1101 1101 1101 0110 0000 0101 = 232,378,979,845
C = 1011 0111 1110 0110 0111 1011 0010 0011 0110 1101 = 789,845,844,845
D = 1000 1100 0101 0110 0100 0110 1011 1110 = 2,354,464,446
E = 1000 0001 0101 0011 1011 0101 1111 0111 1100 0011 = 555,455,215,555
F = 0101 0100 1110 0000 1001 0111 0010 1000 1000 1010 = 364,545,255,562
G = 1101 0111 0000 0010 1101 1100 0011 = 225,455,555
প্রথম আমি বুঝতে পারছিলাম না তারা কিভাবে আমাদের কে ফ্রিকোয়েন্সি পাঠাবে, কারন তাদের সময়ের একক আর আমাদের একক একই রকম নাও হতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সি হল প্রতি সেকেন্ডের কম্পন সংখ্যা, কিন্তু এই ‘সেকেন্ড’ তো আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের কাছে সেকেন্ড হয়ত অন্য রকম। তারা যেহেতু আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমত্বায় এগিয়ে সেহেতু তারা নিশ্চয় এই বিষয়টা ভেবেছে, তাই তারা মেসেজের মধ্যেই নিশ্চয় এই সময়ের এককটা দিয়ে দিয়েছে। পরে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম অবজেক্ট স্ট্রিং গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চারটি মাত্রা, একটি গ্র্যাভেটি স্ট্রিং ও একটি যে নতুন গঠনে রুপান্তত করা হবে সেইটা মোট ছয়টা ফ্রিকোয়েন্সি লাগে ,কিন্তু তাদের মেসেজে মোট সাতটা ফ্রিকোয়েন্সি। নিশ্চয় প্রথমটা হবে স্ট্যান্ডার্ড কোন সময়ের একক। তারা নিশ্চয় এমন কিছুকে সময়ের একক হিসাবে ব্যাবহার করবে যেটা ইউনিভার্সের সর্বত্র এক। তাই প্রথমেই অনুমান করে নিলাম এটা পরমানুর ভাইব্রেশন ফ্রিকোয়েন্সি, যেটা মহাবিশ্বের সব জায়গায় এক। আমাদের সময় হিসাবে পরমানুর ভাইব্রেশন ফিকোয়েন্সি হল ১০^১৩ হার্জ আর তাদের প্রথম মেসেজটাকে যদি তাদের হিসাব মতে পরমানুর ভাইব্রেশন ফিকোয়েন্সি ধরি তাহলে সেটা দাঁড়ায় ১০^১৪ হার্জ, অর্থাৎ আমাদের এখানে ১০ সেকেন্ড মানে ওদের ১ সেকেন্ড, আমাদের ১০ বছর মানে ওদের ১ বছর। এই অনুপাতে বাকি ফ্রিকোয়েন্সিগুলো সহজেই বের করা যায়। একটু থামে রায়হান। গলা শুকিয়ে এসেছে তার এতক্ষণ কথা বলতে বলতে। হলরুম যেন মৃত্যুপুরী, সবাই নিশ্চুপ; যেন পাথরের মূর্তি একেক জন।
সময়ের এই বাঁধা সমাধান হওয়ার পর আমরা একটা পাতার মধ্যে ছয়টি ফ্রিকোয়েন্সি ফাংশন চার্জ করে পিরিয়ডিক* টেবিলের প্রথম ১২টি পরমানুর ইলেকট্রনের বিন্যাস প্যাটার্ন মেসেজ হিসাবে পাঠাই, কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লোরপ্লাস্টগুলো নিউকোভিচ প্যাটার্নে ফিরে না এসে নতুন এক প্যার্টানে রূপ নেয়, সেটা পুনরায় ডিকোড করে দেখতে পাই, ১২ থেকে ২৪ পর্যন্ত পরমানুর ইলেকট্রনের বিন্যাস। পরমানুর ইলেক্ট্রোন বিন্যাস মেসেজ হিসাবে পাঠানোর কারন হল আমরা এমন একটা ডাটা পাঠাতে চেয়েছিলাম যেটা মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম। সেক্ষেত্রে এই পরমানুর বিন্যাসের চেয়ে ইউনিফর্ম আর কোন ডাটা বা সিরিজ হতে পারেনা। আমরা মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান পেয়েই গেলাম, বলেই তার গলাটা একটু উদাস হয়ে যায়। শুধু তাই না, আমাদের হাতে এখন এমন প্রযুক্তি আছে যেটার সাহায্যে আমরা অসীম দূরুত্বের কোন বস্তুকে কোয়ান্টাম লেভেলে পরিবর্তন করতে পারব। শেষে এসে রায়হানের গলাটা কেমন যেন একটু ধরে আসে; জানি না আমি সভ্যতার জন্য কোন বিপর্যয় ডেকে আনলাম, ভাবে সে।
ছয়.
ভিনগ্রেহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাথে পৃথিবীর মানুষের যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে আজ প্রায় দুই বছর। প্রথম দিকে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে, সে কি আবেগে উদ্বেলিত বিশ্ব! যেন এক মুহূর্তে বিশ্বের সকল মানুষকে নিয়ে এসেছিল এক মঞ্চে এই একটি ঘটনা; বৃহত্তর আশায় এক লহমায় ভুলে গিয়েছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো, সব বড় বড় দৈনিকগুলোতে সপ্তাহে সপ্তাহে নিয়মিত আপডেট ছাপা হত। ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে আসে আবেগ, একে একে সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে দৈনন্দিন রুটিরুজির প্রতিযোগিতায়, যার যার অবস্থান থেকে; যথারীতি। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী, সামরিক ও বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্পেসাল সেল গড়ে তোলে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে। রায়হানকে চিফ ট্যাকনিক্যাল কনসালটেন্ট হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এ সেলের। এই দুটি বছর দিনরাত পরিশ্রম করেছে সে, আজ সেটা সম্পূর্ণ হবাব দিন।
- ঋভু, সব ঠিকঠাক আছে ত?”, কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ঝড়ে পড়ে রায়হানের।
দাদা, আমি নিজে সব কয়েকবার চেক করেছি, আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। সপ্রতিভ জবাব দেয় ঋভু।
ঋভু মুখোপাধ্যায়, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ। বিশ্বের অনেক ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, মানবভাষা ও যান্ত্রিকভাষা নিয়ে তার মৌলিক কিছু গবেষণা আছে, পশ্চিম বঙ্গের মেয়ে, একটু কাঠখোট্টা কিন্তু কাজর ব্যাপারে অসাধারন। রায়হান নিজের তাকে সিলেক্ট করেছিল এই প্রোজেক্টের জন্য। ওর কথার উপর ভরসা করা যায়। তবুও আশ্বস্ত হয় না রায়হান, সকাল থেকেই বেশ টেনসন হচ্ছে, আজ যে ভিনগ্রহের প্রাণীদের প্রতিনিধিদের সাথে পৃথিবীর প্রতিনিধিদের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ! পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করবেন জাতিসংঘের মহাসচিব, সাথে অনেক দেশের এম্বাসেডরও থাকবেন। শেষ পর্যন্ত না কোন ঝামেলা পেকে যায়! রীতিমত ঘামতে থাকে রায়হান।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঠিক সময়েই শুরু হয় সম্মেলন। প্রথমে বড় স্ক্রীনে ভেসে উঠে কিছু সংখ্যা, তার পর মুহূর্তেই ভেসে উঠে ডিকোডেট ম্যাসেজ।
- কিকি গ্রহের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও ক্ষুধার্ত কিকিবাসির পক্ষ থেকে মুক্ত স্বাধীন ও উদারমনষ্ক পৃথিবীবাসির প্রতি জানাই আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন; সেই সাথে বাড়িয়ে দিচ্ছি চিরবন্ধুত্বের হাত। আমি এন্টি ফোটন কাউন্সিলের সুপ্রীম কমান্ডার ও পদার্থ বিজ্ঞানী পিপার বলছি।
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় জাতিসংঘের মহাসচিব। চোখের ইশারায় ঋভুকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বলেন, “ম্যাসেজ ঠিক মত ডিকোড হয়েছে তো? কোথাও কোন ভুল হয়নি তো? আমরা প্রথমেই কি ঐ গ্রহের বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করলাম?” ঋভু তাকে আস্বস্থ করলে তিনি পালটা ম্যাসেজ পাঠান, “শান্তিপ্রিয় ও বন্ধুভাবাপন্ন পৃথিবীবাসির পক্ষ থেকে আমি জাতিসংঘের মহাসচিব ডার্ভিস ক্যামাল। আমাদের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা”
-আমরা খুবই আনন্দিত যে পৃথিবীবাসির মত মিত্র সাথে পেয়েছি। আমরা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চালিয়ে যাব অদূর ভবিষ্যতেও। আমরা ১২৫ বছর ধরে অত্যধিক গোপনে পৃথিবীবাসির সংগে যোগাযোগের চেষ্টা করে চলেছি, অবশেষে আমরা সফল; আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এই চেষ্টা চালিয়েছি। আমরা বঞ্চিত কিকিবাসি পৃথিবীবাসির নিকট সাহায্য প্রত্যাশী।
আমরা শান্তির উদ্দেশ্যে সামর্থের মধ্যে যে কোন সাহায্য করতে প্রস্তুত।
- আমরা ফোটন কাউন্সিলের বিরুদ্ধে অহিংস সংগ্রাম করে যাচ্ছি, আর আমাদের উদ্দেশ্য যে শান্তি স্থাপন তার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমান হল আমাদের কাছে ১২৫ বছর ধরে এমন প্রযুক্তি আছে যেটার সাহায্যে অসীম দূরত্বের যে কোন বস্তুকে পারমানবিক লেভেলে পরিবর্তন করা সম্ভব, আমরা এই প্রযুক্তি শুধু মাত্র শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর কাজে ব্যবহার করেছি। এই গ্রহে আমিই প্রথম এই থিউরির প্রবর্তন করি, এখন পর্যন্ত আমি সহ শুধু মাত্র তিন জন এই থিউরির ব্যাপার জানে; যদি আগ্রাসী ও উগ্রপন্থী ফোটন কাউন্সিলের হাতে এই প্রযুক্তি পড়ে যায় তাহলে তার শান্তিপ্রিয় ব্যবহারের কোন গ্যারন্টি আমরা দিতে পারব না। তবে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যেন তাদের হাতে এই প্রযুক্তি না পড়ে।
আমরা কিভাবে আপনাদের সহযোগিতা করতে পারি?
- কিকিবাসী ২০০০ বছর ধরে গুটি কয়েক স্বার্থবাদীর হাতে বন্দী হয়ে আছে। এ গ্রহের যাবতীয় শক্তির উৎস আমাদের নক্ষত্র টার্পিক। আমাদের টার্পিকের আলো থেকে সরাসরি খাদ্য গ্রহণ করি। পৃথিবীর ভাষায় যাকে বলা হয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া। খাদ্যের জন্য আমাদের কোন কষ্ট করতে হত না। কিন্তু ২০০০ বছর আগে আমাদের কিছু বিজ্ঞানীরা সমগ্র গ্রহের স্থলভাগকে সিলিকনের আবরনে ঢেকে দেয় ছাতার মত করে, উদ্দেশ্য ছিল টার্পিক থেকে আসা আলোকে পরিশোধিত করে খাদ্যের মান উন্নত করা। কিন্তু কিছুদিন যেতেই এই সিলিকামভ্রেলা হয়ে উঠে শোষনের হাতিয়ার। গুটিকয়েক প্রভাবশালী কিকিবাসি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করে এই সিলিকামভ্রেলাকে। যে খাদ্য আমরা অনায়াসে পেয়ে যেতাম, সে খাদ্য ফোটন এখন আমাদের ক্রেডিট দিয়ে কিনতে হয়। ক্রেডিট দিলেই তবে ফোটন মেলে। অনেক ব্যয়বহুল ফোটন রেষ্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে যেগুলো অভিজাত কিকিবাসিদের নিত্য আনাগোনা। কিছু কিছু পাব হয়েছে পোষা প্রাণীদের; যেখানে কিকিবাসি একফোঁটা আলোর জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে ক্রেডিট আয়ের জন্য সেখানে অনেকে পোষা প্রাণীর জন্য ব্যায় করছে অসংখ্য ফোটন। আমাদের আন্দোলন সাধারন কিকিবাসির বিরুদ্ধে নয়, এমন কি অভিজাত কিকি বাসির প্রতিও আমাদের আলাদা কোন ক্ষোভ নেই। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, সিলিকামভ্রেলা ধ্বংস করে আলোকে আবার মুক্ত করে দেওয়া কিকিগ্রহের জন্য।
নিঃসন্দেহে আপনাদের এই আন্দোলন প্রশংসনীয়। কিন্তু এই সিলিকামভ্রেলা ধ্বংসের ব্যাপারে আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
- আপনাদের কাছে এখন গ্র্যাভেটি স্ট্রিং প্রযুক্তি আছে, যেটার মাধ্যমে অসীম দূরত্বের বস্তুকে পারমানবিক লেভেলে পরিবর্তন করা সম্ভব। সেটার জন্য আপনাদের লাগবে সিলিকামভ্রেলার সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি। সেটা আমরা আপনাদের দিব। আমাদের কাছে এই প্রযুক্তি অনেক বছর ধরে থাকলেও সিলিকামভ্রেলা ধ্বংস করার জন্য যে পরিমান বৈদ্যুতিক শক্তি লাগবে তা আমাদের নেই।
পাশে বসা সামরিক উপদেষ্টার দিকে তাকায় মহাসচিব ডার্ভিস ক্যামাল; জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। উপদেষ্টা বলেন, “স্যার যতটুকু ইনফরমেশন পাওয়া যায় তা নিয়ে নেন, আমরা কি করব সেটা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে”। “আমরা নীতিগত ভাবে শান্তির জন্য সাহায্য করতে প্রস্তুত তবে আমাকে কাউন্সিলের পারমিশন নিতে হবে, আর যে পরিমান বৈদ্যুতিক শক্তি লাগবে এই কাজে সেটাও থাকতে হবে। আপনারা টেকনিক্যাল সব ডাটা পাঠান।”, উৎকণ্ঠার সাথে বললেন মহাসচিব। ঝানু এই এডমিনিস্ট্রেটরকে কিছুটা বিহ্বল মনে হচ্ছে।
সাত.
তুমুল বিতর্ক চলছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে টেকনিক্যাল সম্মেলনে। নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভোটের মধ্যমে নির্ধারন হয় যে কিকি গ্রহবাসির বিদ্রোহী গ্রুপকে সাহায্য করা হবে। কিন্তু এর জন্য যে বিদ্যুৎ প্রয়োজন প্রায় ৮৫,২৫০ টেরা-ওয়াট-ঘন্টা সেটা নিয়েই এই বিতর্ক। এটা সমগ্র পৃথিবীর সম্মিলিত বিদ্যুৎ এর ৫০ মিনিটের উৎপাদনের সমান। এত বিশাল আকারের বিদ্যুৎ কিভাবে একত্রে পাওয়া যাবে সেটাই এখন মূল সমস্যা! আলোচনা চলছে, কিন্তু কোন উপায় বের হচ্ছে না। একেকজন একেক উপদেশ দিচ্ছে কিন্তু কার্যত সম্ভবপর নয় প্রায় সবগুলোই।
এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিলেন, সবাই যখন মুটামুটি হতাশ তখন রায়হান দাঁড়িয়ে বললেন, “আর্থ-আওয়ার কে ব্যবহার করতে পারি”
সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
- প্রতি বছর মার্চের শেষে আর্থ-আওয়ার নামের একটা আন্দোলন পরিচালনা করে একটি সংগঠন। এক ঘন্টার জন্য সব লাইট নিভিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টা সেই সাথে পৃথিবীর প্রতি দরদ প্রদর্শন। আমরা এটাকে জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি দিয়ে গ্লোবালি আরও বড় পরিসরে স্যান্ডার্ড একটা সময়ে একসাথে পালন করতে পারি। সমগ্র বিশ্বের এক ঘন্টায় উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তি দিয়ে অনায়াসে সিলিকামভ্রেলাকে পানিতে রুপান্তরিত করা সম্ভব। সমস্যা একটাই ছয়টি মহাদেশের সবগুলো দেশকে একত্রে অংশগ্রহণ করতে হবে।
কথাগুলো নিজের কানেই যেন কেমন কেমন লাগছিল রায়হানের। প্রয়োজনে পৃথিবীর জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারে না যে দেশগুলো তারা কীভাবে ভিনগ্রহের কোণ অজানা জাতির জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করবে!
আট.
সাইরেন বেজে উঠেছে সমগ্র বেইজ জুড়ে, কি ভয়ংকর হৃদয় কাঁপান সাইরেন! এমন সময় আসবে সেটা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিল পিপার, গত একমাসে একে একে তিনটি বেইজের পতন হয়েছে। বাকী ছিল এই মূল বেইজটি। একসপ্তাহ আগেই বেইজের সবাইকে আত্মগোপনে চলে যেতে অর্ডার দেন তিনি। জরুরী কার্যক্রম চালানোর জন্য তিনি সহ আর দুইজনকে থেকে যেতে বলেন তিনি। বেইজ কমান্ডার লিলি থেকে যায় তার সাথে। পৃথিবীবাসির সাহায্যের আশায় বসে আছেন তিনি, কিন্তু তাদের আর কোন খবর নেই, তারা কি আমাদের ত্যাগ করল! মনে মনে ভাবে পিপার। যাই হোক, ধরা পরার আগে এই বেইজের সব ডাটা নষ্ট করে দিতে হবে, যেভাবেই হোক এই প্রযুক্তি তাদের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না।
চারদিক থেকে লেজার গান তাক করে একে একে ভিতরে প্রবেশ করে ফোটন কাউন্সিলের স্পেশাল ক্র্যাকডাউন ফোর্স। কোন প্রতিরোধের মুখেই পড়তে হয়নি তাদের, নির্লিপ্তভঙ্গীতে হাসিমুখে সোফায় বসে আছেন প্রফেসর পিপার, লিলি ও একজন এনালিষ্ট। জানে ধরা পরা মানেই নিশ্চিত যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু, প্রকাশ্যে তাদের চরম অত্যাচার করে হত্যা করা হবে যাতে অন্য কেউ এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এমনই চলে আসছে যুগযুগ ধরে; তবে তারা কি পেরেছে বিপ্লবের স্পৃহাকে দমাতে! না! তারা ভুলে যায় বিপ্লবীর প্রতিটি রক্তের ফোঁটা রক্তবীজ হয়ে হাজার বিপ্লবী প্রসূত হয়। তাইত পিপার অপেক্ষা করে কখন তাকে রক্তাক্ত করে শাষকশ্রেনী বিপ্লবের স্পৃহার বারুদে আরও একবার ছেড়ে দেবে স্ফুলিঙ্গের ছটা।
নয়.
অসাধ্য সাধন হয়েছে। স্থান নিউইয়োর্ক, ৩০শে মার্চ, রাত ০০:০০ অপারেশন কিকি-সিলিকামভ্রেলা-০০১ এর কোন্ট্রোল রুম। অপারেটর মাইক্রোফোনে বলে যাচ্ছে,
এশিয়া মহাদেশ অফলাইন, কোর্ডিনেট চার্জড;
আফ্রিকা মহাদেশ অফলাইন, কোর্ডিনেট চার্জড;
অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ অফলাইন, কোর্ডিনেট চার্জড;
ইউরোপ মহাদেশ অফলাইন, কোর্ডিনেট চার্জড;
দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশ অফলাইন, কোর্ডিনেট চার্জড;
উত্তর আমেরিকা মহাদেশ অফলাইন, “স্যার কোর্ডিনেট কি চার্জ করবো?” লিভারের উপর হাত রেখে বলে অপারেটরের, কণ্ঠে স্পষ্ট উৎকণ্ঠা। কি এক মহাসৃষ্টির উল্লাসে একত্রিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ববাসি!
স্থির হয়ে নিজ চেয়ারে বসে আছেন এই মিশনের কমান্ডার ইন চিফ, জেনারেল পল সিলভা, এক মুহূর্ত ভাবলেন, শেষে গমগম করে উঠে তার ভরাট কণ্ঠ, “চার্জ দ্যা কোর্ডিনেট”। অপারেটর বিন্দু মাত্র দেরি না করে টেনে নিচে নামিয়ে দেয় লিভার। সমগ্র পৃথিবী এখন অন্ধকার, অন্য কোথাও আলো জ্বালাবে বলে;
- মেঝেতে শুইয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে পিপার, লিলি ও ঐ এনালিষ্টকে। এনালিষ্ট ও লিলির সমগ্র শরীর হালকা হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি, মৃত্যুর ঠিক আগে মুহূর্তের তাচ্ছিল্যেই সেই হাসি। ভাল থেক লিলি মনে মনে বলে পিপার। জানে তাকে এত সহজে হত্যা করা হবে না, তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে তাকে খুব ধীরে ধীরে হত্যা করা হবে। সিলিকামভ্রেলা চার্জ হচ্ছে, কৃত্রিম আকাশের মাঝখানের জায়গাটা রক্তিম বর্ণের হয়ে গেছে, তা থেকে সাই করে নেমে আসে তীব্র লেজার পিপারের দুপা লক্ষ্য করে। তাদের এই মৃত্যুদন্ড কিকিগ্রহের প্রতিটি ঘরে ঘরে, রেস্টুরেন্টে, মাঠে, পাবে লাইভ সম্প্রচার হচ্ছে। সবাই দেখছ একজন প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী কি অবলীলায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। শিউরে উঠে সবাই; কিছুক্ষণের মধ্যে তার সবুজ পায়ের সবগুলো ক্লোরপ্লাস্ট জ্বলে হলুদাভাব বর্ণ হয়ে যায়। সারা কিকি গ্রহ উফ করে উঠে, গুটি কয়েক বাদে! কিছুক্ষণের জন্য চেতনা হারায় সে। জ্ঞান ফিরলে কিছক্ষণ পর আবার লেজার বিম তার দুই হাত লক্ষকরে নেমে আসে, অল্প সময়ের মধ্যে দুহাতও তার হলুদাভাব ধারন করে। অনেক কষ্টে চেতনা টিকিয়ে রাখে পিপার। পৃথিবীর মানুষ কি আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করল? বুঝতে পারছে না পিপার! তাদের আচরনে তো এমন মনে হয়নি! অল্পবিরতি দিয়ে আবার চার্জ হচ্ছে লেজার। এবার বুক বরারর। সাঁই করে নেমে আসে লেজারের তীব্র আলো। একেএকে মরে যেতে থাকে পিপারের বুকের ক্লোরপ্লাস্টগুলো। তীব্র ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে সে, বুক চিড়ে সুতীব্র চিৎকার বের হয়ে আসতে চায়, অনেক কষ্টে তা আটকায় সে। হঠাৎ! শান্তি! চির শান্তি! অবাক হয় পিপার! ধীরে ধীরে চোখ খোলে সে! অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে খোলা আকাশ, উজ্জল টার্পিক! চোখের সামনে ঝুলছে যেন স্বর্গ হয়ে, যেমনটি দাদার মুখ থেকে শুনেছিল ছোট বেলায়! বাস্তবে তার চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর!! সহস্র বছর পার করে দেওয়া যায় এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। আকাশ ছাপিয়ে সে কি বৃষ্টি!
- সমগ্র কিকি বাসি আজ বের হয়ে গেছে যার যার ঘর থেকে, যে এখানে ছিল সেখানেই ভিজছে মুক্তির আনন্দে, ভালবাসার বৃষ্টিতে। তারা জানে না পিপারের ত্যাগ, তারা জানে না পৃথিবীবাসির ভালবাসার কথা। প্রকৃত বিপ্লবীরা আড়ালেই থেকে যায়।
- শরীরের বেশিভাগ ক্লোরপ্লাস্ট জ্বলে গেছে পিপারের; সেলিকামভ্রেলার রূপান্তরিত পানিতে ভিজতে ভিজতে ঠোঁটের কোন মৃদু হাসি ঝুলিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিপ্লবী পিপার।
--------------------------------- সমাপ্ত -------------------------------
কৃতজ্ঞতাঃ একজন নিভৃতচারী হিতাকাঙ্ক্ষী; অনেক কষ্ট করে শখানেকের মত বানান ঠিক করে দিয়েছেন, বলেছেন আরও ভুল আছে। বাংলা ভাষাটা আসলেই অনেক কঠিন। অদৃশ্য মানুষগুলোর দৃশ্যত ভালাবাসায় সত্যি আপ্লুত হয়ে আছি।