ভালোই ঠান্ডা পড়েছে আজ, যাকে বলে একেবারে হাড় কাঁপানো শীত; সেই সাথে বেড়েছে কুয়াশাও। খালি চোখে বেশি দূর দেখা যায় না, রাস্তার ফ্লাডলাইটের আলোও কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে আছে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে। শীতের রাতে ঢাকা শহর যে এত অদ্ভুত তা আগে এভাবে অনুভব করতে পারেনি ফজলুল করিম। অবশ্য আজও পারেনি; কিভাবে পারবে? পেটে খিদা নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আর যাই হোক রোমান্টিসিজমে ভোগা যায় না। একটা কুকুর একটু পরপর এসে তাকে দেখে গেছে, কী জানি! হয়তো ফজলুল করিমকে সারা রাত একা একা রাস্তার পাশে নির্লিপ্ত বসে থাকতে দেখে ওর মনে কোন এক অজানা প্রকৃতির মায়া তৈরী হয়েছে, শেষরাতের দিকে এসে মায়ার অতিশয্যে ফজলুল করিমের গা ঘেষে শুয়ে পড়ে কুকুরটা; সে দিকে অবশ্য তার কোন খেয়াল ছিলো না, সে গভীর একাগ্রতায় ল্যাম্পপোষ্টে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ে যাচ্ছিলো।
শহরের এই দিকে সে আগে কখনো আসেনি, জন্মের পর থেকেই বড় হয়েছে যাত্রাবাড়ীর একটি এতিমখানায়। এত বছরের ঐ জায়গাটা আজ এক নিমিষেই ছেড়ে আসতে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো, কিন্তু কাউকে সে তা বুঝতে দেয়নি; হাসিমুখে একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে; এই এতিমখানায় সারা জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য তার জন্ম হয়নি। যাত্রাবাড়ী থেকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে যখন বনানী পৌছায় তখনি তার মনে হয়, এই সেই স্থান; এখানেই তাকে অপেক্ষা করতে হবে! এটাই তার ভাগ্য নির্ধারনী স্থান; আজই। আজ মানব জাতীর ইতিহাসে এক মহত্ত্বপূর্ণ দিন।
ফজরের নামাজ পড়ে লিয়াকত হাসান চৌধুরী সাহেব হাঁটতে বের হন, এটা উনার ত্রিশ বছরের অভ্যেস। প্রতিদিন বনানী সুপার মার্কেটের সামনে দিয়ে কামাল আতাতুর্কের মোড় ঘুরে এগারো নাম্বার হয়ে বাসায় ফিরেন। যৌবনের প্রথমে যখন বনানীতে স্থায়ী শেকড় গেড়ে বসেন তখন এই এলাকায় দিনে দুপুরে শিয়ালের ডাক শুনা যেত, আর আজকাল তো শুধু ইট পাথরে বস্তি চারদিকে। শুধুমাত্র সকালের বাতাসটায় উনি অতীতের সেই আমেজটা পান। ত্রিশ বছরের অভ্যেসের আজ প্রথম ছন্দপতন হলো চৌধুরী সাহেবের; আতাতুর্কের মোড়ে পৌঁছে দেখেন একটু দূরে ফুট ওভার ব্রীজের পাশের ল্যাম্পপোষ্টের নিচে একটা ছেলে গভীর মনোযোগের সাথে কি যেন পড়ছে। কৌতুহলি হয়ে উনি এগিয়ে গেলেন। মলিন চেহারা, কয়েক জায়গার তালী দেওয়া পাঞ্জাবি, রং চটচটে একটা ব্যাগ; গায়ে লেগে শুয়ে আছে একটি রাস্তার কুকুর। কুকুরটিকে উনি চিনতে পারলেন, এই এলাকায় দেখছেন অনেক দিন ধরে।
-সালাম-ও-আলাকুম, চাচা।
একটু না, বেশ চমকে উঠলেন চৌধুরী সাহেব। ছেলেটি এত স্বাভাবিক ভাবে পড়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিলো যেন ওনার জন্যই এখানে অপেক্ষা করছে সে। এতই অবাক হলেন ছেলেটির সালামের জবাব দিতেও ভুলে গেলেন।
“তুমি! তুমি আমাকে চিন?”
হাসি হাসি মুখে ছেলেটি বলল, “না”।
ছেলেটির আচরনে কি যেন একটা ছিলো, চৌধুরী সাহেব মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। নাম কি তোমার? কোথায় থাক? এখানে কি করছ? তুমি কি পড়ছিলে? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলেন উনি।
-পুরা নাম ফজলুল করিম সরদার, থাকতাম যাত্রাবাড়ীর নূর-ই-উম্মুল এতিমখানায়। গতকাল বয়স আঠারো হওয়াতে তারা আমাকে আর রাখবে না বলে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য আমাকে সুযোগ দিয়েছিলো এতিমখানার স্কুলে দপ্তরীর পদে কাজ করার জন্য, কিন্তু আমি আরও পড়াশুনা করতে চাই।
হাতে এটা কিসের বই?
-হাতে বইটা দেখিয়ে, “নিকোমাচিয়ান ইথিক্স” দর্শনের উপর লেখা খুব বিখ্যাত একটা বই, সময় কাটানোর জন্য পড়ছিলাম।
কতটুকু পর্যন্ত পড়ালেখা করেছ? একটু কৌতুহল জেগে উঠলো চৌধুরী সাহেবের।
-এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি এইবার, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে।
এস.এস.সি তে কেমন রেজাল্ট ছিলো?
-জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলাম, গোল্ডেন।
এইবার চৌধুরী সাহেব অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, সফল শিল্পপতি উনি; চোখ দেখে মানুষ চিনতে পারেন, ভবিষ্যৎ দেখতে পান। ফজলুলের চোখে উনি অন্যরকম এক জ্যোতি দেখতে পেয়েছেন। বললেন, “তুমি কি আমার সাথে যাবে? আমার বাসায় থাকবে, পড়াশুনা করবে”। বলেই নিজের মনেই একটু অবাক হলেন, এত তাড়াতাড়ি তো কখনো উনি সিদ্ধান্ত নেন না!
অবাক ব্যাপার, ছেলেটি দ্বিতীয় কোন কথা না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হেসে, অতঃপর চৌধুরী সাহেবের চোখে চোখ রেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, “চলেন”
২.
পুরা জার্মান জুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ, রাজধানী বার্লিন সেজেছে নব বধূর সাজে; যেদিকে চোখ যায় শুধু লাল আর লাল, ঝকমক করছে শহরের আকাশ ছোয়া প্রত্যেকটি বাড়ি। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে বিশ্ব বিজ্ঞান সম্মেলন, “সাইন্স-নভেম্বর” নামে খ্যাত এই উৎসব চলবে পুরা নভেম্বব মাস জুড়ে। বিশ্বব্যাপী আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার বিভাগের অসংখ্যা বৈজ্ঞানিক মিলিত হয়েছেন বিজ্ঞানের বরপূত্র এই বার্লিন শহরে। চার বছর অন্তর অন্তর যে দেশে এই “সাইন্স-নভেম্বর” অনুষ্ঠিত হয় সে দেশের জন্য এই সম্মেলন বিশাল গৌরবের ব্যাপার। ধারনা করা হয় পরবর্তী চার বছরে যদি যুগান্তকারী কোন আবিষ্কার হয়, এটা এই দেশ থেকে হবে। অবশ্য কালের আবর্তে এই সম্মেলন আর শুধু বিজ্ঞান সম্মেলন থাকেনি, এটা এখন উৎসবের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। হবে না কেন? পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার গবেষণাগারে লক্ষ লক্ষ বৈজ্ঞানিক অবিরাম গবেষণা করে যাচ্ছে, কিন্তু প্রায় সবই আগের কোন মৌলিক গবেষণার বর্ধিতরুপ নিয়ে, অনেক বছর ধরে যুগান্তকারী মৌলিক আবিষ্কার হচ্ছে না বললেই চলে।
হোটেল পেন্সিওন হয়ে স্প্রী নদীর উপর দিয়ে যে রাস্তাটা “বার্লিন ভিক্টরি কলাম” স্কয়ারের দিকে এসেছে সেটার পাশের বিস্তির্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে তুলা হয়েছে সম্মেলন কেন্দ্রভবন। একপাশে স্প্রী নদীর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আরেক দিকে শত বছরের ঐতিহ্য বহনকারী “বার্লিন ভিক্টরি কলাম”; একবিংশ শতাব্দির স্থাপত্ত্বশৈলীর উৎকর্ষতার উজ্জ্বল নিদর্শন এই কেন্দ্র ঐতিহ্য আর প্রকৃতি দুয়ে মিলে হয়ে উঠেছে অভূতপূর্ব।
পড়ন্ত বিকেল, পঞ্চাশোর্ধ এক বৃদ্ধ সম্মেলন কেন্দ্রের মূল চত্বর পেরিয়ে নদীর ধারে একটি বেঞ্চে বসে আছেন। বিষণ্ণ। তাকিয়ে আছেন নদী পেরিয়ে দুরের ঐ ঘন বনের দিকে, উদাস নয়ন। দুপুর থেকে উনি এখানে আছেন, কি যেন একটা দ্বিধা তাকে চেপে ধরেছে। হঠাৎ হাতের ঘড়িটা টিং টিং করে বেজে উঠে, সময় হয়ে গেছে, আর বসে থাকা যায় না, ধিরে ধিরে উঠে দাড়ালেন সব দ্বিধা ঝেড়ে। এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।
হাজার হাজার মানুষ কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই, যেন ঝড়ের পূর্বাভাস, সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা, একটা গুজব অনেকের কানে এসেছে কোন এক অখ্যাত বৈজ্ঞানিক না কি বিজ্ঞানের চরম আবিষ্কারটি করে ফেলেছেন। কোন দিকে না তাকিয়ে স্টেজে উঠেলেন বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক, একেবারে সাদামাটা বেশভুসা। মুঠোর মধ্যে ধরে থাকা কলমসদৃশ ডিভাইজটি পেনজেক্টারটা চালু করে দেয়ালে ফোকাস করে শুরু করেন লেকচার।
“পঞ্চইন্দ্রীয়ের ধারনা সভ্যতার শুরু থেকে, এগুলো হলো, স্পর্শানুভূতি, স্বাদ, শ্রবনানুভুতি, দৃষ্টি ও ঘ্রাণ। এইসবগুলোই হলো ইন্দ্রীয় গাহ্য কিন্তু আমাদের আরেকটা ইন্দ্রীয় আছে বলে ধারনা করা হয়, কিন্তু বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এটাকে স্বীকৃতি দেয়নি, এটা হলো, “ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়”। বিজ্ঞান স্বীকৃতি দেয়নি বলার চেয়ে বলা ভালো গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। মূলত মনে করা হয় এই ইন্দ্রীয়বলে মানুষ ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারে। এত বছরে সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতার পরেও এই ব্যাপারটা অনাবিষ্কৃত থাকার কারণ হলো এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া এবং যতটুকুই হয়েছে শুরু থেকেই একটা ভুলকে কেন্দ্রকরে এগিয়ে যাওয়া।
ভুলটা হলো, এটাকে ষষ্ঠ-ইন্দ্রীয় না ধরে, ধরতে হবে সপ্ত-ইন্দ্রীয়। প্রকৃতপক্ষে ষষ্ঠ-ইন্দ্রীয় হলো আমাদের স্মৃতি। এই স্মৃতি হতে পারে দুটি পর্যায়ে, একজনের সমগ্রজীবনের প্রত্যক্ষ স্মৃতি আর বংশ পরম্পরায় জিনের মধ্যে ধারন করে রাখা হাজার হাজার বছরের পরোক্ষ স্মৃতি। পঞ্চইন্দ্রীয়ের সাথে এই ষষ্ঠ-ইন্দ্রীয় একটি নির্দিষ্ট কম্পনাঙ্কে প্রকম্পিত হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনুমান করার ক্ষমতা সপ্ত-ইন্দ্রীয়ের প্রকাশ ঘটে, তবে তা খুবই অল্পমাত্রায়; এভাবে যখন তা সাত মাত্রায় পৌছুবে তখন এর পরম মান পাওয়া যাবে।
আমি কম্পিউটার সিমুলেসন করে দেখেছি পঞ্চইন্দ্রীয় যত প্রখর হবে আর সেই সাথে স্মৃতি যত সমৃদ্ধ হবে তত নির্ভুল ভবিষ্যদ্বানী করা সম্ভব।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যুগে যুগে কিছু মহাপুরুষ জন্মেছেন যাদের এই সপ্তইন্দ্রীয় ছিলো অত্যন্ত প্রখর, মানুষের ক্ষেত্রে যেহেতু পঞ্চইন্দ্রীয়ের ক্ষমতা প্রায় একই রকম; তাই এইসব মহাপুরুষদের সাথে সাধরন মানুষের পার্থক্য ছিলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্মৃতি শক্তি। উনারা সবাই ছিলেন অসামান্য মেধাবী, যার কিছুটা ছিলো জেনেটিক্যালি পাওয়া আর বাকিটা চর্চা ও ধ্যান।
এখন যদি আমরা পঞ্চইন্দীয় ও ষষ্ঠইন্দ্রীয়কে একটি সিস্টেমের ছয়টি ইনপুট হিসাবে কল্পনা করি, তাহলে তার আউটপুট হলো সপ্ত-ইন্দ্রীয়। আসুন এবার আর একটু জটিল সিস্টেম আলোচনা করি। এই ছয়টি ইনপুট যদি অসীম হয় এবং একটি আউটপুট যদি আরেকটা সিস্টেমে ইনপুট হিসাবে প্রবেশ করাই তাহলে অষ্টম-ইন্দ্রীয় হিসাবে আরেকটা আউটপুট পাবো। এভাবে চলতে থাকলে সপ্তম বারে গিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বানীর সক্ষমতা অসীম হয়ে যাবে। গানিতিক ভাবে,
ধরি, পাঁচটি ইন্দ্রীয় ফাংশন A, B, C, D ও E এর মান অসীম=অ;
দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞান একটি মেমরী, M এ জমা আছে।
আর, আউটপুট সপ্ত-ইন্দ্রীয়, X
এবার এই ছয়টি ইনপুটকে যদি ফাংশনের মাধ্যমে একে প্রকাশ করি তাহলে সেটা দাঁড়ায়,
প্রথম মাত্রার, X1=F(A=অ, B=অ, C=অ, D=অ, E=অ, M=অ)
দ্বিতীয় মাত্রার, X2=F(A=অ, B=অ, C=অ, D=অ, E=অ, M=অ, X1)
তৃতীয় মাত্রার, X3=F(A=অ, B=অ, C=অ, D=অ, E=অ, M=অ, X2)
……………….
………………
সপ্তম মাত্রার, X7=F(A=অ, B=অ, C=অ, D=অ, F=অ, M=অ, X6)
এই সপ্তম মাত্রার, X7 মান অসীম। This is the ultimate result, “Mind of GOD”; যার সন্ধানে মানুষ নানান দিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে লক্ষ বছর। এই কথা বলে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক চেয়ারে বসে পড়লেন মাথা নিচু করে, ক্লান্ত, বিষণ্ণ, বিধ্বস্ত; যেন উনার উপর অর্পিত কঠিন দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছেন এই মাত্র।
পিন পতন নিস্তব্ধতা, পুরা হলরুম জুড়ে, থ মেরে গেছে সবাই, কারো মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পর আবার উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ; আবার শুরু করলেন লেকচার। এবার প্রতিটি ফাংশনের বিসদ ব্যাখ্যা করতে হবে।
……………এইবার ফাংশনগুলোকে ট্রেইন করার জন্য …………………………
………………”
অনেক রাত করে হোটেলে ফিরলেন বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক, সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে ব্রেনের উপর দিয়ে; রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। পরবর্তী তিন দিন রুম থেকে বের হননি। গভীর রাত, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় দরজার কড়া নাড়ার শব্দে। উফ! এত রাতে আবার কে আসল? একটু বিরক্তভাব নিয়েই দরজা খুললেন; খুলেই জমে গেলেন বরফের মত; অজানা ভয়ের একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত চলে গেলো।
৩.
শায়লা চৌধুরী, লিয়াকত হাসান চৌধুরী সাহেবের মেয়ের ঘরের একমাত্র নাতনী। জন্মের সময় মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে কানাডা প্রাবসী, দেশে আর আসবেন বলে মনে হয় না। তার পর থেকে নানার বাসায় থেকেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে শায়লা। তুখোড় মেধাবি হলে কি হবে, নানার লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। সারাদিন ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকে। এই বয়সেই হ্যাকিং এর নেশায় পেয়ে বসেছে। কয়েকজন মিলে হ্যাকিং এর একটি গ্রুপও বানিয়ে ফেলেছে। মাঝেমাঝে ফজলুল করিমকে নিজেদের কৃতিত্বের কথা খুব গর্ব করে শোনায়। ওদের গ্রুপে নাকি হ্যাকিং এর পারদর্শিতার উপর ভিক্তি করে ব্যাল্ট দেওয়া হয়। ঐদিন চোখ বড় বড় করে বলছিলো, “জানেন ভাইয়া, পঞ্চম মাত্রার মাত্র তিনটা সিস্টেম হ্যাক করতে পারলে আমি ব্ল্যাক বেল্ট পেয়ে যাব”
“উফ! হ্যাকিং হ্যাকিং করতে করতে মেয়েটা না আবার পাগল হয়ে যায়! অবশ্য এখনো তাকে খুব একটা সুস্থ মনে হয় না, নির্ঘাত মাথায় কিছু সমস্যা আছে। না হলে আমি ওর নানাকে ডাকি চাচা বলে আর সে আমাকে ডাকে ভাই!” ভাবে ফজলুল করিম। এই যে এখন! এখনো যে অংকটা করতে দিয়েছে সেটা না করে খাতায় বাইনারি কোডে কি সব হাবিজাবি লিখছে! একবার ভাবলো একটা বিকট ধমক দিবে; অনেক কষ্টে রাগটা সংবরণ করে বলল, “কি করছ তুমি এগুলো? তোমার পরীক্ষা আর তিন মাস বাকি, আর এই পরীক্ষাটাই আসল কথা না, তার পর শুরু হবে এডমিশন টেষ্ট। তুমি যেভাবে সময় নষ্ট করছ, আমি নিশ্চিত তুমি ভালো কোথাও চান্স পাবে না”
-কি যে বলেন না! পরীক্ষা আমার খুবই ভালো হবে, আর এডমিশন টেষ্ট? ওটা নিয়েতো আমি আরও ভাবি না, ঠিকই দেশের সেরা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যাবো, আপনি দেখেন।
“ধ্যাৎ! ও না পড়লে আমার কি? আমার দায়িত্ব প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে ওকে পড়া দেখিয়ে দেওয়া”, ভাবে সে মনে মনে। “গত পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও দেখলাম না স্থির হয়ে একটু পড়তে বসতে; অথচ পরীক্ষায় বরাবরই প্রথম হয়ে এসেছে। মেয়েটির মেধা আছে, যদি একটু মনোযোগ সহকারে পড়ালেখাটা করতো না জানি আরও কত ভালো ফলাফল করতো!”
-আচ্ছা ভাইয়া, “তোমাদের ডিপার্টমেন্টে কোন ছাত্রী নেই?”
হুমম! আসলে মেয়েরা ফিজিক্স একটু কমই পড়তে চায়। আমরা যখন ভর্তি হই তখন আশিটা সিটের মধ্যে মেয়ে ভর্তি হয়েছিলো দশ কি বার জন। এখন ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত টিকে আছে মাত্র পাঁচ জন। কেন? হঠাৎ করে এ প্রশ্ন করছো কেন?
-না, এমনিতেই। মনে হলো, তুমি যে পরিমান ক্ষ্যাত আর গেয়ো, নিশ্চয় তারা সবসময় তোমাকে খেপায়?
ঠিকই বলেছ। আর বলো না। নীলা নামের একটা মেয়ে সেই ফাস্ট ইয়ার থেকে আমার পিছে লেগে আছে। আমাকে দেখলেই শিস দিয়ে উঠে, আর ডাকে “ফজু মাম্মা, কি খবর? বাদাম খাবা?” উফ! চরম বিরক্তিকর। আমাকে দেখলেই বাদাম খাওয়ার কথা কেন বলবে? ফাজিল মেয়ে কোথাকার! রাগে গা জ্বলে যায়। তবে খুবই ব্রিলিয়েন্ট, আমি যদি টিচার হিসাবে জয়েন না করি তাহলে নির্ঘাত সে হবে। একটু অবাক হয় ফজলুল, শায়লার সাথে সে এসব নিয়ে কেন কথা বলছে? নিজের উপর একটু বিরক্তও হয়।
-আজ আর পড়বো না; বলেই গটমট করে উঠে চলে যায় শায়লা।
ধরাম করে বেড রুমের দরজা লাগানোর শব্দ শুনতে পায় ফজলুল, পড়ার টেবিলে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে বসে থেকে ভাবে, “অদ্ভুত তো! শায়লাকে তো কখনো এমন উত্তেজিত হতে দেখিনি!” হঠাৎ কি মনে করে টেবিলের উপর ফেলে রাখা শায়লার লেপটপটা কাছে টেনে নেয় সে; কেন যেন তার মনে হচ্ছে আজই সেই কাঙ্খিত ইমেইলটি পেয়ে যাবে। ইমেইলটা খুলেই চোখ ছানাভরা হয়ে যায় তার! এক নিশ্বাসে এক পৃষ্ঠার ইমেলটা পড়ে ফেলে সে, ততক্ষণে তার কান দিয়ে গরম বাতাস বেরুচ্ছে, আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
৪.
চীন! গত একশ বছরে উঠে গেছে উন্নতির চরম শীখরে, এক সময়ের দরিদ্র, অভাবী, অবহেলিত জাতি আজ বিশ্বের দুই পরাশক্তির একটি। বিশাল বিশাল পাহাড় পর্বত আর খানা খন্দে ভরা চীনের কেন্দ্রে অবস্থিত সানঝি প্রদেশ, এই প্রদেশের প্রতিটি শহর যেন এক একটি প্রাকৃতিক দূর্গ। এই সানঝি প্রদেশের তংচোয়ান শহরের আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তাইহু হৃদের পাড়ে অবস্থিত জিদি উপশহর। তিন দিকে পাহাড় আর একদিকে হৃদ দিয়ে ঘেরা প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট এই উপশহরটিকে প্রকৃতি যেন নিজে হাতে ঢেলে সাজিয়েছে, যেমন মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্য তেমন দূর্গম। এমন কি শহরের উত্তর দিকে যে হৃদটা আছে, তার চার পাশও পাহাড়ে ঘেরা; যোগাযোগের একমাত্র উপায় আকাশ পথ।
চার বছর আগে অল্প কিছু লোক এই শহরে বাস করতো, হঠাৎ একমাসের নোটিসে তাদের সবাইকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকে শুরু হয় শত শত কার্গো প্লেন, চপার আর হেলিকাপ্টারের আনাগোনা। কয়েক মাসের মধ্যে তিন বাহিনীর সমন্বয়ে ছোট এই শহরকে ঘিরে গড়ে গড়ে উঠে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ঘাটি। এয়ারপোর্ট, সেনা ছাউনি, মিসাইল, যুদ্ধবিমান, ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদি দেখে এটাকে শুধু প্রতিরক্ষা দুর্গ ভাবার কোন কারণ নেই, এটার আড়ালে আসলে পরিচালিত হচ্ছে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং গোপনীয় সায়েন্স প্রজেক্ট। শত্রু স্যাটেলাইটের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই প্রজেক্টের গবেষণাগার পুরোটাই হৃদের নিচে বানানো হয়েছে। প্রায় পনের বর্গ-কিলোমিটার আয়তনের এই হৃদের এক পঞ্চমাংশ এলাকা নিয়ে এই গবেষণাগারের বিস্তৃতি।
প্রজেক্ট নস্ট্রাডমাসের চিফ সাইন্টিস্ট, সরদার ফজলুল করিম চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেই সকাল থেকে। আজ প্রজেক্ট ভিজিটে আসবেন বিজ্ঞান একাডেমির প্রধান সুসান লী, তিন বাহিনীর যুগ্ম প্রধান এডমিরাল কিম ঝালী, ডিফেন্স সেক্রেটারি এবং আরও কয়েকজন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে সুসান লী ও এডমিরাল কিম ঝালীকে সরদার ফজলুল করিম আগে থেকেই চিনেন। এই দুইজন প্রতি ছয় মাস পর পর এসে প্রজেক্টের অগ্রগতি আর নিরাপত্তা ব্যাবস্থা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে যান।
সুসান লীর সাথে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক, সরদার ফজলুল করিমের প্রথম দেখা হয়েছিলো জার্মানির ফিয়াল্লা হোটেলে, গভীর রাতে। দরজা খোলার পর শান্ত মৌন ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “আসতে পারি?” পিছনে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন এডমিরাল কিম ঝালী যার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে জমে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ, এমন ভয়ংকর দৃষ্টি মানুষের হতে পারে ধারনা ছিলো না তার।
“দেখুন, গত তিন দিন আমি চায়নার নামকরা বৈজ্ঞানিক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় ও সরকারী নানান ডিপার্টমেন্টের সাথে দিনরাত আলোচনা করে একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ‘কৃত্বিম নস্ট্রাডমাস’, আমি চাই আপনি এই প্রজেক্টের চিফ সাইন্টিস্ট হিসেবে জয়েন করেন”, কোন রকমের ভনিতা না করে সরাসরি মূল প্রসঙ্গে চলে গেলেন সুসান লী।
-প্রজেক্টের নাম শুনেই এর ধরন সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করে ফেললেন, ফজলুল করিম। বুঝতে পারার পরেও জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে কেন?”
আপনার আবিষ্কৃত সূত্রের উপর নির্ভর করেই তো এই প্রজেক্ট। আর আমরা জানি আপনি প্রতিটি ইন্দ্রীয়ের ফাংশনগুলো উপস্থাপন করলেও যে ফাংশনটা ছয়টি ইন্দ্রীয়কে একিভূত করে সেটাই প্রকাশ করেন নি। তাই আপনাকে আমাদের দরকার। আর প্রজেক্ট চলা কালে এই ফাংশনগুলোর আপডেট, মডিফিকেশন ইত্যাদি নানান ধরনের প্রতিকূলতা আসবে তখন আপনাকেই এইগুলো সমাধান করতে হবে। নিজে একজন বৈজ্ঞানিক হিসাবে আমি অনুভব করতে পারি থিউরির প্রয়োগ দেখে যাওয়া একজন বৈজ্ঞানিকের কাছে কতটা কাঙ্খিত। আর প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে শুধুমাত্র আমেরিকা ও চায়না এ দু’দেশের পক্ষেই সম্ভব এই থিউরির প্রযোগ করা। এখন ভেবে দেখুন আপনি কি করবেন।
-বৃদ্ধের হাতে আসলে দ্বিতীয় কোন পথও খুলা ছিলো না, দেরি না করে বললেন, “কবে যেতে হবে?” অবশ্য রাজি হওয়ার পিছনে আরেকটা জোরাল কারণ ছিলো। ফজলুল করিমের সপ্তইন্দ্রীয়ের বলে মনে হয়েছিলো, এই প্রজেক্টের সফলতার উপর নির্ভর করছে মানব সভ্যতার টিকে থাকা, সামনে ভয়াবহ বিপদ এগিয়ে আসছে।
এক্ষণি, নিচে গাড়ি আর এয়ারপোর্টে জেট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেছে, মনে হয় এইত সেদিনের ঘটনা! ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আনমনে অতীত ঘাটছিলেন, হঠাৎ থ্রীডিভিফোন বেজে উঠলে বাস্তবে ফিরে আসেন ফজলুল করিম। ভিজিটররা চলে এসেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই লেকের নিচে মূল টানেলের প্রধান ফটকদিয়ে প্রবেশ করবেন, এরিয়া সিকিউরিটির চিফ থ্রীডিভিফোনে জানালেন। ফজলুল করিম বিলম্ব না করে সুপারক্যাপে চড়ে এগিয়ে গেলেন তাদেরকে অভ্যর্থনা করার জন্য।
“হ্যালো! মিস্টার সরদার”, বলে সহাস্যে দুহাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসলেন বিজ্ঞান একাডেমির প্রধান সুসান লী। ঠিক পিছনেই এডমিরাল কিম ঝালী কে দেখে পুরানো সেই ভীতিটা আবার অনুভব করলনে ফজলুল করিম। এই সমস্যাটা কিছুতেই ধরতে পারছেন না; ঝালী কে দেখলেই কেন যেন ভেতর ভেতর ভীষণ রকমে চমকে উঠেন, ভয়ের একটা স্রোত বিদ্যুত চমকের মত মেরুদন্ডের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত চলে যায়।
-“আপনাকে আবার দেখতে পেয়ে ভালো লাগলো, স্যার” হাসিমুখে সুসানের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা করমর্দন করে বললেন।
প্রজেক্টের অগ্রগতি কেমন? কথা বলতে বলতে দুজনে একটি সুপারক্যাপে চড়ে বসলেন। পিছনে পিছনে আরও তিনটি সুপারক্যাপে চড়ে অনুসরন করতে থাকেন অন্যরা।
-এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু চলছে, আশা করছি চার মাসের মধ্যে ডাটা ফিডিং স্টেজ শুরু করতে পারবো।
কথা বলতে বলতে একটি টানেলের শেষ প্রান্তে পৌছে যায় সবাই। ফজলুল করিম পাসওয়ার্ড প্রবেশ করালে কয়েক সেকেন্ড পর চল্লিশ সেন্টিমিটারের পুরু ইস্পাতের দরজা সাই করে উপরে উঠে যায়। সুপারক্যাপ নিয়ে সবাই প্রায় একশ-বাই-একশ বর্গমিটারের বিশাল আকৃতির একটি কক্ষে প্রবেশ করে। সূর্যমুখি ফুলের পাঁপড়ির মত ছড়িয়ে থাকা এই ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রন কক্ষ এর কেন্দ্রে অবস্থিত, যার প্রতিটি পাপড়ি একেকটি একশ-বাই-একশ বর্গমিটারের ইউনিট; প্রত্যেকটি ইউনিট টানেলের মাধ্যেমে কেন্দ্রের সাথে যুক্ত। একে একে সবগুলো ইউনিট ঘুরে দেখলেন সবাই, প্রতিটি ইউনিটেই একযোগে কাজ এগিয়ে চলছে। সর্বমোট বারটি ইউনিট, ছয়টি ইন্দ্রীয়ের জন্য ছয়টি ইউনিট, আর ছয়টা রিজার্ভ হিসাবে রাখা হবে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য।
চারদিকে বড় বড় মনিটরে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ইউনিটে বিপুল উদ্যমে কাজ করছে শত শত বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান। অকল্পনিয় ক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক সব লক্ষ লক্ষ প্রসেসর, সেন্সর আর মেমরি সেটাপ করা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে দিন রাত মিলিয়ে দুই সিফটে, নিরলস। প্রতিটি ইউনিট আবার বিশ্বের সব ডিজিটাল লাইব্রেরি, ওয়েবসাইট, ব্লগ, অনলাইন নিউজপেপার, ট্রাফিক সিগনাল, স্ট্রিট ভিডিউ ক্যামেরা, সার্ভার, স্যাটেলাইট ইত্যাদির সাথে হাইপারনেটের মাধ্যমে যুক্ত।
সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলেন সুসান লী, আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ফজলুল করিমের চোখে চোখ রেখে, “ডাটা ফিডিং শুরু হলে তো চলবে দুই মাস তাই না? উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে চললেন, “তার মানে ছয় মাস পর আমরা প্রথম এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবো?”
-আশা করছি স্যার।
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এডমিরাল কিম ঝালী এর ঠোঁটে কোনায় একচিলতে হাসি দেখা দিয়েই চোখের পলকে মিলিয়ে গেলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকে নজর না থাকলে ফজলুল করিমের চোখে এটা ধরা পড়তো না। ভয়ের সেই অনুভুতটা আবার টের পেলেন। মানুষের মুচকি হাসিও এতটা পৈশাচিক হয় কি করে?
৫.
আজ প্রায় এক বছর ফজলুল করিম আমেরিকায়, পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক স্কলারশীপ “প্রেসিডেন্টশিয়াল স্কলারশীপ” নিয়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের উপর গবেষণা করছে। ও চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকমাস প্রচন্ড নিসঙ্গতায় ভুগে শায়লা, নিজের ঘর থেকে বলতে গেলে বেরই হয়নি। আচ্ছা লোকটা কি বোকা? কিছুই কী বুঝে না? না কি স্বার্থপর? অভিমানে শায়লা আর ঢাকাতেই থাকেনি, চলে এসেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন সাবজেক্টে এডমিশন নিয়ে। প্রথম প্রথম ভুলে থাকার অনেক চেষ্টা করেছে, পারেনি; শেষে একদিন বাধ্য হয়ে লিখে ফেলে একটা চিঠি, সত্যিকারের চিঠি, কাগজে-কলমের চিঠি। পোষ্ট করতে গিয়েও অজানা কারনে আর করতে পারেনি, পোষ্ট অফিসেই ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে খামসহ। ফেরত চলে এসেছে। পরের দিন আবার লিখতে বসে, এবারও পোষ্ট করতে পারেনি। আবার পরের দিন চেষ্টা করে, পারেনি। চৌতুর্থ দিনশেষে একটা অভিনব আইডিয়া তার মাথা আসে, আচ্ছা “যদি এমন করি যে চিঠিও লিখলাম কিন্তু সে বুঝতেও পারলো না কি লিখছি, বুঝার জন্যে আবার আমার কাছেই আসতে হবে; তাহলে কেমন হয়?” মনে মনে ভাবে শায়লা।
নতুন এক খেলায় মেতে উঠে শায়লা। প্রতি মাসে একটি করে চিঠি লিখতে থাকে ফজলুল করিমের কাছে, প্রতিটিতে লুকান থাকে একটি করে গোপন মেসেজ, যে মেসেজ উদ্ধার করা একমাত্র শায়লার পক্ষেই সম্ভব।
-হঠাৎ একদিন শায়লাকে ইমেল করে ফজলুল করিম, “শায়লা, গত ছয় মাসে তোমার কাছ থেকে ছয়টি চিঠি পেয়েছি, কিন্তু এইগুলোর তো কোন মানে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি চিঠিতে যা লিখে পাঠাচ্ছ সেটা তো ইমেইলেও পাঠাতে পারো? এভাবে চিঠি লেখার মানে কি?”
“গাধাটা চিঠির মর্ম কি বুঝবে?” মনে মনে ভাবে শায়লা। ইমেইলের জবাবে লিখে, “প্রতিটি চিঠিতে একটা লুকানো মেসেজ আছে। দেখি বের করতে পার কি না। তাহলে বুঝবো কত বড় তোমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়! আর যদি না পর তাহলে যখন দেশে ফিরবে সবগুলো চিঠি সাথে নিয়ে এসো আর নাকে খত দিয়ে আমার কাছ থেকে বুঝে নিও”
-মেয়েটার মাথা থেকে হ্যাকিংটা আর গেলো না, আর দিনদিন একটু বেয়াদবও হয়ে যাচ্ছে কেমন! ভাবে ফজলুল করিম। কিন্তু ঠিকই আবার চিঠিগুলো নিয়ে বসে যায় মর্মোদ্ধারে।
চার বছর পর দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ফজলুল করিম। আমেরিকাতে ভালো সুযোগ পেয়েছিলো, কিন্তু মন বসাতে পারেনি। সে চেয়েছে শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশে বসেই নিড়িবিলি গবেষণা করে যাবে। একদিন ব্যাগ ভর্তি শায়লার পাঠানো সব চিঠি নিয়ে হাজির হলো তার বাসায়।
-অনেক চেষ্টা করেছি। যত ধরনের এনক্রিপশন-ড্যাক্রিপশন এলগোরিদম আছে সব গুলো দিয়ে চেষ্টা করেছি, লেটেস্ট সব সফটওয়ার ব্যবহার করেছি। ফলাফল শূন্য। আসলেই কি কোন লুকানো মেসেজ আছে? না কি তুমি আমার সাথে মজা করেছ?
“তাহলে, তুমি হার স্বীকার করছো?” মুচকি হেসে বলে শায়লা।
-আচ্ছা যাও, স্বীকার করছি।
ঠিক আছে, স্তুপ একটা চিঠি টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলো শায়লা,
“সমরসের পূর্ণ আলোর সপ্তকাহনে দিলেম তিনশ দুটি নীলপদ্ম।
কিন্তু কি বিপুল তাচ্ছিলে তা ফিরিয়ে দিলে তুমি, নিষ্ঠুর!
এই যদি ছিলো তব হৃদয়ে তবে কেন এই অভিনয়?
প্রথম জীবনে যদি নাই বা পেলাম, তবে কি পরজনমে?
মরে কি তবে হবো অমর, রইবো তব হৃদয়ে?
সঙ্গে করে নিয়ে যাব সুখস্মৃতি আমাদের যত
হল না; হল না, হেরেই জিতে গেলে তুমি পাষাণ”
কবিতার মত মনে হলেও, আসলে তা নয়, শিরনামটা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ক্ষ্যাতনামা লেখক সমরেশ মজুমদারের “সাত কাহন” বইটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর ২০৩ টি নীলপদ্ম মানে বুঝানো হয়েছে এই বই এর ২০৩ নাম্বার পৃষ্ঠা। এবার চিঠিটির প্রথম বাক্যটি বাদে পরের বাক্যগুলোর প্রথম শব্দ সাতকাহন বই এর ২০৩ নাম্বার পৃষ্ঠার কত নাম্বার শব্দ সেটা গুনে বের কর। সেই হিসাবে, “কিন্তু, এই, প্রথম, মরে, সঙ্গে, হল” এই শব্দগুলি যথাক্রমে ১৯, ২০, ২১, ১৬, ৯ ও ৪ নাম্বার শব্দ। এখন A থেকে Z পর্যন্ত বর্ণগুলোকে ১,২,৩ এভাবে ক্রমান্বয়ে নাম্বারিং করলে, ১৯, ২০, ২১, ১৬, ৯ ও ৪র্থ সংখ্যাগুলোর মানে দাঁড়ায়, S,T,U,P,I,D কিছু বুঝলে? বলেই হি হি করে হেসে উঠে শায়লা।
মেয়েটার কি মাথা পুরাই খারাপ হয়ে গেলো? নাহলে এমন পাগামি করার মানে কী? ভাবে ফজলুল করিম। তুমি বলতে চাচ্ছ যে এ পর্যন্ত তুমি যত কবিতা, চিঠি, কাহিনী লিখে পাঠিয়েছ সবগুলোতে এভাবে আমাকে গালি দিয়েছ?
খিলখিল করে হেসে উঠলো শায়লা। বলল, এতক্ষণে বুঝেছ? বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। পিছনে হতবিহ্ববল হয়ে বসে থাকে ফজলুল করিম।
৬.
চারদিকে খুশির আমেজ বয়ে চলছে, সবাই একটু relax ভাব, সেই সাথে চাপা উত্তেজনা। টানা সাড়ে চার বছর কাজ করার পর আজ তিন দিনের ছুটি চলছে “প্রজেক্ট নস্ট্রাডমাসে”। গতকাল হয়ে গেলো প্রজেক্টের উদ্ভোধন, মাননীয় প্রেসিডেন্ট ঝিনঝিং সান নিজে উদ্ভোধন করেছেন। প্রথমেই বৈজ্ঞানিক ফজলুল করিমকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, “মিস্টার করিম, শুভেচ্ছা। আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন। চীনা জাতি আপনার কাছে ঋণী থাকবে হাজার বছর”।
ফজলুল করিম মৃদু হেসে বললেন, “ধন্যবাদ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমি চাই শুধু চীনা জাতি না, এই আবিষ্কারের সুফল ভোগ করুক সমগ্র মানবজাতি।”
প্রেসিডেন্ট ফজলুল করিমের শেষের কথাগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, “আপনার এই নস্ট্রাডমাস কত বছর পর্যন্ত নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে?”
এখন পর্যন্ত এর ক্ষমতা তিনশ বছর, তবে এই ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার সম্ভবনা পঞ্চাশ ভাগ। তবে প্রায় নির্ভুল ভাবে ভবিষ্যৎ বানী করতে পারবে আগামী দুই’শ বছর পর্যন্ত।
“স্যার, সব রেডি, আপনি যে কোন কিছু জানতে চাইতে পারেন আমাদের এই নস্ট্রাডমাসের কাছে”, প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বললেন এডমিরাল কিম ঝালী।
সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো প্রেসিডেন্ট কি জানতে চান অদ্ভুত এই যন্ত্রের কাছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রেসিডেন্ট খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন,
“আগামি…দুইশত…বছরে…মানবজাতির…সবচেয়ে…গুরুত্বপূর্ণ …ঘটনা…কোনটি…হবে?”
টানা এক মিনিট কোন সারাশব্দ নেই, ঠিক তার এক সেকেন্ডপর মিষ্টি একটি মেয়ে কণ্ঠে নস্ট্রাডমাস উত্তর দিলো, “ধন্যবাদ, আপনার প্রশ্ন গ্রহণ করা হয়েছে, প্রসেস চলছে, উত্তর পেতে সময় লাগবে ৮২ ঘন্টা ২০ সেকেন্ড ৩৫ মিলিসেকেন্ড”
প্রেসিডেন্ট ঝিনঝিং সান মুচকি হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “জ্যান্টেলম্যান, আমি জানি আপনারা গত সাড়ে চার বছর কি পরিমান পরিশ্রম করেছেন। আপনাদের এই অবদান, আত্মত্যাগ ভুলার নয়। আমি আজ থেকে তিনদিনের ছুটি ঘোষণা করছি। তিন দিন পর আমরা আবার এখানে একত্রিত হবো প্রশ্নের উত্তরের জন্য, সে পর্যন্ত ছুটি উপভোগ করুন”
ছুটি একেবারেই উপভোগ করতে পারেন নি ফজলুল করিম সরদার, অসংখ্যা চিন্তা ঘুরে ফিরে আসছে। এই প্রযুক্তি শুধু চীনাদের হাতে তুলে দিয়ে ভুল করলাম কি? কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না, একটা দ্বিধা সারাক্ষণ কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছিলো তাকে। কি উত্তর দিবে নস্ট্রাডমাস? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্য তারিখ? পারমানবিক যুদ্ধের ভয়াবহ পরিনতি? নাকি বৈজ্ঞানিক এমন কোন আবিষ্কার যেটা সমগ্র মানব জাতিকে এক কাতারে নিয়ে আসবে? নাকি ভিনগ্রহের প্রাণীর সন্ধান আবিষ্কার ও ওদের সাথে যোগাযোগের বর্ণনা?
তিন দিন পর; চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই হাজির হয় প্রজেক্ট নস্ট্রাডমাসের নিয়ন্ত্রন কক্ষে, সবার মনেই বয়ে চলছে ঝড়! কি বলবে নস্ট্রাডমাস। পিনপতন নিস্তব্ধতা সমগ্র রুম জুড়ে। হঠাৎ চরম এই নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে কথা বলে উঠলো নস্ট্রাডমাস।
“আগামি দুইশত বছরে মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ২১৫৮ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখে ১৪:৪৬:২০ সময়ে পৃথিবীতে মৃত্যু হার হবে শূন্য”
হতবিহ্বল হয়ে যায় উপস্থিত সবাই, বিজ্ঞান একাডেমির প্রধান সুসান লীর সবার প্রথমে হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “মানে? মানে কি ঐদিন মানুষ মৃত্যুকে জয় করবে? প্লিজ সম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করুন”, উত্তেজনায় উনি ভুলেই গেলেন যন্ত্রকে প্লিজ বলে সম্মোধন করার দরকার নেই।
“নেগেটিভ। ঐটার মানে হলো ঐদিন পৃথিবী থেকে শেষ মানুষটির মৃত্যু হবে, তারপর যেহেতু মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য তাই হারও শূন্য হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে মানুষের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হলো ২০৪৬ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে ৮:২০:০৩ সময়ে আমেরিকার আলাস্কার একটি গোপন সামরিক ল্যাবরেটরী থেকে দূর্ঘটনা বসত HAX23 নামের একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। জেনেটিক্যালি মডিফাই করা এই HAX23 ভাইরাসের বৈশিষ্ট হলো এটা শুধু মাত্র মানুষের ভ্রুনে আক্রমন করবে এবং তিনমাস বয়সের ভ্রুনকে নষ্ট করে গর্ভপাত ঘটাবে। শুধু মাত্র মানুষের দেহেই এই ভাইরাস বংশবৃদ্ধি ঘটাবে কিন্তু পরিবাহিত হবে যেকোন মাধ্যেমে পানিতে ভেসে, পশু পাখির মাধ্যমে, এমন কি বাতাসের মাধ্যেমেও। ২০৪৭ সালে জানুয়ারীর ২৯ তারিখে ১০:৪৫ সময়ে পৃথিবীর সমগ্র মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। এর আর কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া নেই”
সবগুলো চোখ একসাথে ঘুরে যায় দেয়ালের উপর টানানো এটমিক ক্যালেন্ডার ও ঘড়িটার দিকে। ওখানে জ্বলজ্বল করছে, “২১ এ ডিসেম্বর ২০৪৬”। সবাই বুঝতে পারে দেরি হয়ে গেছে আর কিছু করার নেই।
“সম্পূর্ণটা একটা পোষ্টে আসছে না, বাকী আংশটা প্রথম কমেন্ট আকারে দিয়ে দিলাম”
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:৪৪