একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে মাকে ছুয়ে দিতে চায় অনিন্দিতা। অথচ এই মা আজ সকালে খুব জোরে এক চড় লাগিয়েছেন তার ছোট তুলতুলে গালে! তার চিৎকারে ঘুম থেকে নানী উঠে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। অথচ মা তাকে কোলে নেয় নি! অতপর নানী তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ভৎসর্নার সুরে বলেছেন,''কেন বাচ্চা মেয়েটাকে জোর করে দূরে ঠেলে দিচ্ছিস! দুধের শিশু! মায়ের শরীরের গন্ধের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে! একটু কোলে নিলে কি তোর শরীর খসে পড়বে?''
তবুও অনিন্দিতাকে কোলে তুলে নেয় নি আদৃতা। চোখে মুখে কৃত্রিম কাঠিন্য ফুটিয়ে মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে চলে এসেছে। নানীর কাছে থেকে অভ্যস্ত হোক। যত দ্রুত সে মাকে ভুলে যাবে ততই মঙ্গল! অথচ এই শিশুটিকে নিয়ে অনিক আর আদৃতার ভালোবাসার চাদরে থোকা থোকা ফুলের মত রঙিন সুতোয় বুনিত হয়েছিল স্নেহের আকাশ চুম্বি স্বপ্ন! অনিন্দিতার পৃথিবীতে আসার প্রতিটি অনুভুতি মনে রেখেছে আদৃতা! বারো সপ্তাহ পর যখন ডাক্তারের কি যেন এক যন্ত্রে প্রথম ফিটাল হার্ট সাউন্ড শোনা যায় সে খুশিতে উদ্বেলিত হয় অনিককে ডেকে বলেছে ,''দেখো আমার বাবু নিশ্বাস নিচ্ছে!''
একটু একটু অনিন্দিতার তার মাঝে বড় হওয়াকে সে গভীরভাবে অনুভব করেছে! তার শিশুর তার মাঝে নড়াচড়া দেখে গভীর বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছে! এই নড়াচড়াকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় সম্ভবত বলে ব্রাক্সটন হিক'স সাইন। তার শিশুটি যে তার মাঝে আছে তার নিশ্চিত প্রমাণ! স্বতির নিশ্বাস ফেলেছে আদৃতা! তার সীমাহীন খুশি ইউটেরাসের ব্যাথাহীন সংকোচনে ছড়িয়ে পড়েছে তার রক্তের অববাহিকায়! মা হওয়ার এই সীমাহীন তৃপ্তি সে ছড়িয়ে দিয়েছে পরিবারের সবার মাঝে! আর আজ এই শিশুকে নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা! এমন কি তার গায়ে হাতও তুলেছে সে, যে অভিমানে শিশুটি মাকে ভুলে যাবে! মায়ের কাছে আর আসতে চাইবে না!
ঘরের লাইট নিভিয়ে ঘরকে আরো অন্ধকার করে দেয় আদৃতা! আজকাল অন্ধকার তার বেশি ভালো লাগে! একটু একটু করে নিজের ছায়াও মিলিয়ে যায়! রাত গভীর হয়! তার দু চোখে আসে কিছুটা প্রশান্তি! কোলাহল এখন আর আগের মত ভালো লাগে না! দম বন্ধ হয়ে আসে পাখির কিচির মিচিরে! আর যখন জীবনের কাটা ঘুরে ঘুরে হয় টাইম বোমের মত! যে কোন সময় শেষ হয়ে যেতে পারে সব কিছু, তখন অন্ধকারের চেয়ে বেশি আর কে ই বা নৈকট্য হতে পারে! এই আঁধারে নিমেষেই লুকিয়ে যায় জীবনের সব কষ্টগুলো!
আস্তে আস্তে স্বামীর কাছে সরে যায় আদৃতা। স্বামীর হাত দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরে গভীর মমতায়। অনিক যে বিরক্ত হচ্ছে ঢের বুঝতে পারে আদৃতা। তবুও হাতদুটো ছাড়তে ইচ্ছে হয় না!
আর অনিকও তো কম সহ্য করে নি! আর কত! অসুস্থ বউকে নিয়ে দিনের পর দিন ডাক্তারের কাছে ছুটে বেরিয়েছে! পাগলের মত দিশাহীন হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়! তারও তো জীবন আছে নাকি! অসুস্থ বউকে নিয়ে আর কত দিন! মাঝে মাঝে আদৃতার খুব কষ্ট হয়! মনে হয় এখনই হয়ে যাক সব কিছুর অবসান। 'মার্সি কিলিং' নামে একটা কথা প্রচলিত আছে পৃথিবীর কিছু দেশে। ইংলিশে একে বলে EUTHANESIA. খুব অসুস্থ রোগীদের ওভার ডোজ ড্রাগ দিয়ে মৃত্যুকে এগিয়ে আনা হয়। এতে তাদের কষ্ট লাঘব হয়! তার ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু হতে পারে না! .....না......না। ভয়ে শিউরে ওঠে আদৃতা! সে আরো কিছু দিন বাঁচতে চায়! আরো কিছু দিন সে থাকতে চায় অনিক আর তার একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতাকে সাথে নিয়ে।
এ সময় ড্রয়িং রুম থেকে অনিন্দিতার কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আদৃতা ছুটে যায় দরজার কাছে! আবার ফিরে আসে! আবার ছুটে যায়! কেউ কি তার মেয়েটি কোলে তুলে নিচ্ছে না? একটু পর থেমে যায় অনিন্দিতার কান্না। তার নানীর কন্ঠ ভেসে আসে ,''এই যে নানু , কাঁদছো কেনো? দেখো আমি তোমার জন্য কি নিয়ে এসেছি?'' অনিন্দিতার কান্না থেমে যায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আদৃতা। তবুও সাতপাঁচ ভাবনায় জটলা পেকে থাকে মন। আস্তে আস্তে তা গভীর শংকায় রুপান্তরিত হয়ে কালো মেঘে গর্জন তুলে আদৃতার দু চোখে দিয়ে যায় এক পশলা বৃষ্টি! সে যখন থাকবে না কে দেখে রাখবে তার মেয়েকে? অনিক যদি নতুন বিয়ে করে সৎ মা আনে? সে কি তাকে ভালোবাসবে আপন মায়ের মত?
আদৃতার শাশুড়ি ইতোমধ্যে ছেলের জন্য নতুন করে বউ খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন! ও পাড়ার এক ঘটকের কাছে সন্ধানও পেয়েছেন দুটি মেয়ের। আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছেন ,''মেয়ে সুস্থ সবল হতে হবে। ছেলের বাচ্চার যত্ন নিতে হবে। দু দিন পর পর ব্যামো বাঁধাবে এমন রোগা পটকা হলে চলবে না।'' আদৃতা সব শুনেও না শোনার ভান করে থেকেছে! এগুলো তার অনাহুত ভবিষ্যতের জন্য আয়োজন! যেখানে সে মুছে যাওয়া স্মৃতি হয়ে কেবল ছবির সাটানো ফ্রেমে ঝুলে থাকবে! আচ্ছা EUTHANESIA কি এর থেকেও বেশি নিষ্ঠুর? সেখানেও কি এভাবে আমাদের সামাজিক নিয়মের মত মৃত্যুর আয়োজন করা হয়? হয়ত না! সেটি বরং এর থেকে ভালো! সেখানে কষ্ট লাঘব হয়, আর এখানে বুকের উপর পাথরের মত চাপিয়ে দেয়া হয় এক বোঝা কষ্ট! নিজের মত করেই উত্তর তৈরী করে নেয় আদৃতা!
হঠাৎ সে মাথার প্রচণ্ড ব্যাথায় বিছানায় এলিয়ে পড়ে! একবার সংজ্ঞাহীনও হয়ে গিয়েছিল হয়ত! সেটা ঘুমের ঘোর নাকি তন্দ্রা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ মনে হয় একটি শিশু বুঝি তার বুকের উপর খেলা করছে! তার তুলতুলে নরম পায়ের গদি তার পেটের উপর তুলছে সুড়সুড়ি। সে কিছুতেই শিশুটির নাম মনে করতে পারে না! শুধু মনে হয় খুব চেনা! খুব পরিচিত একজন! যে হুবুহু তারই মত দেখতে! অনেকক্ষন ভেবে বুঝে এ তার নাড়িছেঁড়া ধন! তার এক মাত্র মেয়ে অনিন্দিতা! এটা হয়ত ব্রেইন এবসিসের সব থেকে শেষের দিকের লক্ষণ! আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। আচ্ছা তার শিশুটিকেও কি সে ভুলে যাবে? যে ছিল তার শরীরের অংশ? তার শরীর থেকে নিউট্রিশান , রক্ত, অক্সিজেন সব শুষে নিয়ে যে তিল তিল করে তার মাঝে বেড়ে উঠেছে? রোগের দাপটে মানুষ কি তার আত্মাকেও ভুলে যায়? হয়তবা!
বহুদিন পর হয়ত বড় হয়ে অনিন্দিতা লোকের মুখে শুনবে তার মায়ের কাহিনী। অনেকটা রুপকথার গল্পের মত! তারও এক মা ছিল! যে তাকে অনেক ভালোবাসতো! কখনো কখনো সেই মা তাকে দূরেও সরিয়ে রেখেছে! অনিন্দিতা কি বুঝবে তার মায়ের সীমাহীন ক্ষয়িষ্ণু ব্যাথার হৃদয় খনক কাহিনী! হয়ত বুঝবে! মেয়ে তো মায়েরই জাত! হয়ত সেও নিজের মত করেই সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে তার মাকে। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী মায়াবতী নারীর স্থানে তাকে বসাবে। যেখানে রুপকথার রানীরাও হয় পরাজিত! রুপকথারা হয় সাঙ্গ!