পাতিলে টগবগ করে ফুটছিল পানি। সেই গরম পানির মধ্যে কবিরাজ জোর করে চেপে ধরেন মেয়েটির (২৩) মুখ। এরপর পাতিলসহ মাথার ওপর দেওয়া হয় কাঁথাচাপা। তীব্র যন্ত্রণায় মেয়েটি চিৎকার করলেও কবিরাজ তাঁকে ছাড়ছিলেন না।
একপর্যায়ে গ্রামবাসী এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। ততক্ষণে ভয়াবহভাবে ঝলসে যায় মেয়েটির মুখ। অবস্থা বেগতিক দেখ সটকে পড়েন কবিরাজ ইসমাইল মোল্লা (৬৫)। পেটের ব্যথা উপশমের নামে ভয়ংকর এ অপচিকিৎসা দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩১ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের হাসানপুর গ্রামে। ওই দিন থেকে সাঁথিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মেয়েটি।
এ ঘটনায় মেয়েটির দাদা বাদী হয়ে কবিরাজ ইসমাইল মোল্লাকে আসামি করে ১ জুন সাঁথিয়া থানায় ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে হত্যাচেষ্টার মামলা করেছেন। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত পুলিশ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
মেয়েটি ও তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর পাঁচেক আগে মেয়েটির বিয়ে হয়। কিন্তু পরে স্বামী তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। দুই বছর ধরে মেয়েটি ক্ষেতুপাড়ার মাঝডাঙা গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে আছেন। মেয়েটির বাবা দিনমজুর। ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে মেয়েটি তীব্র পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন। ব্যথা উপশম না হওয়ায় এক ফুফুর সহায়তায় মেয়েটি হাসানপুর গ্রামের কবিরাজ ইসমাইল মোল্লার শরণাপন্ন হন। কবিরাজ মেয়েটিকে দেখে জানান, শত্রুতা করে কেউ তাঁকে ‘গাছ’ খাইয়ে দিয়েছে। চিকিৎসার মাধ্যমে ওই গাছ বের করা না হলে কখনোই তাঁর পেটের ব্যথা সারবে না। এ জন্য কবিরাজ মেয়েটির পরিবারের কাছে এক হাজার টাকা দাবি করেন। মেয়েটির বাবা-মা ধারদেনা করে ওই টাকা জোগাড় করে গত ৩০ মে তাঁকে হাসানপুর গ্রামে ফুফুর বাড়িতে চিকিৎসার জন্য পাঠান। পরদিন সকাল সাতটার দিকে কবিরাজ ইসমাইল ফুফুর বাড়িতে এসে একটি পাতিলে টগবগ করে পানি ফোটাতে বলেন। পানি ফোটানো হলে তিনি ফুটন্ত পানিতে মেয়েটির মুখ চেপে ধরেন।
গত রোববার সাঁথিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, মুখে দগদগে ঘা নিয়ে মেয়েটি একটি শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কাতরাতে কাতরাতে তিনি বলেন, ‘কোবর্যাজ কইছিল গরম পানির ভাপ নাক-মুখ দিয়্যা প্যাটে গেলি প্যাট ব্যথা ভালো হয়া যাবি। কোবর্যাজ আমাক গরম পানির ভিতর ঠাইস্যা ধরার পর আমি কত চিক্কুর দিছি। কিন্তু আমাক ছাড়ে নাই। একসময় আমি অজ্ঞান হয়া পড়ি।’
মেয়েটির মা বলেন, ‘ওরা ওই দিনই মেয়েকে ভ্যানে তুইল্যা আমার বাড়ি পাঠায়া দেয়। ও যহন বাড়িত আসে তহন ওর জ্ঞান নাই। সারা মুখে বড় বড় ফোসকা। পরদিন (১ জুন) ফোসকা আরও বড় হয়া মুখ কদাকার হয়া যায়। শ্যাষে মেয়ে ব্যথায় চিক্কুর পারা শুরু করলি গিরামের লোকজনের সাহায্য নিয়্যা ওই দিনই হাসপাতালে নিয়্যা আসি।’
সাঁথিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, ‘মেয়েটিকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন মুখের অবস্থা এতই বীভৎস ছিল যে, চোখ বাঁচানো যাবে কি না সংশয় ছিল। তবে আমরা তাঁর জন্য চেষ্টা করেছি। এখন তিনি শঙ্কামুক্ত ও ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন। তবে তাঁর চেহারা কিছুটা বিকৃত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা মনসুরুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েটি হতদরিদ্র বলে আমরা হাসপাতালের দরিদ্র তহবিল থেকে যতদূর পারছি দিচ্ছি। এ ছাড়া বিনা খরচে তাঁর চিকিৎসা চলছে।’
মাঝডাঙা গ্রামবাসী বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই কবিরাজ ইসমাইল মোল্লা টাকার বিনিমিয়ে এমন অপচিকিৎসা করছিলেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক।
সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বজলুর রশিদ বলেন, ‘কবিরাজ ইসমাইল মোল্লাকে ধরতে জোর প্রচেষ্টা চলছে।’ "প্রথম আলো "
এই রকম জগন্য অপরাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত।