প্রতি সপ্তাহে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার জন্য আমার নাকি কুখ্যাতি আছে। সেই কুখ্যাতি টা ধরে রাখতে আবারও সিনেমা হলে চলে গেলাম "দুটি মনের পাগলামি" দেখতে।
সিটে বসার আগেই পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এটিএম শামসুজ্জামান লাঠি দিয়ে আটার বস্তা পেটাচ্ছে। বস্তা পিটানির তালে তালে ক্যামেরাম্যান যেই আকারে ক্যামেরা কাপায়া নিয়া বেড়াইতেছিল তাতে আমি নিশ্চিত ক্যামেরা ম্যান ব্যাটা থুড়থুড়া বুইড়া আছিল। ওইত্তেরী এইডা তো আটার বস্তা না! এইডা তো সিনেমার নায়িকা! হুদাই নায়িকারে আটার বস্তা ভাইবা "মিশটেক" করি ফেলেছি। আর যেন "মিশটেক" না হয় তাই সতর্ক দৃষ্টি রাখা শুরু করলাম। সতর্ক দৃষ্টি দিয়া দেখলাম ঠোটে লিপস্টিক ওয়ালা পোলার আবির্ভাব হইল(এক লিপস্টিক ওয়ালারে নিয়াই বাচিনা, আবার আরেকটার আমদানী) । এইবার ক্যামেরাম্যান রে নিয়া আরেকদফা সন্দেহ করলাম। নায়িকার ঠোট একবারও জুম করেনাই কিন্তু নায়কের ঠোট বারবার জুম করতাছে
একটু পরে দেখি আরেক নায়কের আবির্ভাব আর মাশাআল্লাহ এইটার ঠোটে মনে হয় এক স্টিক লিপস্টিক পুরাই লেইপা দিছে। শালার সবকয়ডারে নিয়াই সন্দেহ হইতাছে। প্রথম নায়ক নায়িকারে হাতিরঝিলে নিয়া গিয়া গান শুরু করলো "মন থাকেনা আর ঘরে"। মন ক্যাম্নে ঘরে থাকবে? বাংলা সিনেমার মন তো এখন হাতির ঝিলে। প্রত্যেকটা সিনেমায় এই এক জায়গা দেখতে দেখতে চোখে অসুখ হইয়া গ্যাছে। গান শেষ হওয়ার পর শুরু হইল হাডুডু খেলা, নায়িকা এইবার গ্রামে। প্রথম নায়কের কাহিনী হাতিরঝিলেই শেষ। এইবার শুরু দ্বিতীয় নায়কের কাহিনী। নায়ক হাডুডু খেলায় জিতে পুরষ্কার হিসেবে পাইলো একটা গরু। গাই গরু না ষাঁড় গরু সেইটা খেয়াল করিনাই। এইদিকে নায়কের খেলায় ফিদা হয়ে নায়িকা নায়কের প্রেমে পড়ে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ভেসে এল ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমার গানের বাজনা।
পরদিন নায়িকা তার সইয়ের সাথে স্কুলে যাচ্ছে (কলেজ হইলেও একপ্রকার মানা যাইতো) বিপরিত দিক দিয়ে নায়কও কাবিলার সাথে করে আসছে। নায়ক কিছুই করতে পারলো না কিন্তু কাবিলা ঠিকই নায়িকার সইয়ের সাথে আই কন্টাক্ট করে ফেলল। এই কাবিলা যেই সিনেমাতেই থাকে সেই সিনেমারই অঘোষিত নায়ক হইয়া যায়।
এটিএম এর একটা বুইড়া চামচা ছিল। কাবিলা এইটারে দেখা মাত্রই কাছা মারলো। তারপর কুস্তিগীর দের মত ঠ্যাং তোলে আর থোড়ায় বাড়ি মারে। যখনই ঠ্যাং তোলে তখনই পিস্তলে গুলি লোড হওয়ার শব্দ হয়। কাবিলা কি ঠ্যাং তুইলাই গুলি লোড করতাছে। ওমা একটু পর থোড়ায় বাড়ি দেয়ার সাথে সাথে গোলাগুলির শব্দ শুরু হইয়া গেল! বাপরে কাবিলা দেহি কাছা মাইরাই আইজিআই খেলা শুরু কইরা দিছে।
পরেরদিন কাবিলার নায়িকা পেয়ারা পাড়তে পাড়তে গাছ থেইকা পইড়া গেল। পড়লোতো পড়লো কাবিলার গায়ের উপরে। কাবিলার জন্য দু:খ হইতেছিল এই ব্যাটা উঠবে কেমতে। নায়ক নায়িকা আইসা না হেল্পাইলে কাবিলার ওইভাবেই সারাজীবন পার করা লাগতো। এই ফাকে নায়ক নায়িকার ফোন নাম্বার নিলো। নায়িকা রাত বারোটার আগে ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমাইয়া গেল। নায়ক ফোন দিলো রাত বারোটার পর (ধুর শালা কিপ্টা)। হায়হায় নায়িকার ফোনে কল আইলো অথচ ফোনের ডিসপ্লে কালাই হইয়া থাকলো। অত:পর এই ফোনের স্ক্রীন নষ্ট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম। ফোনের গুজুরিং গুজুরিং এ নায়ক নায়িকার মাঝে চুক্তি হইলো তারা দিনের বেলায় দেখা করবে না। রাতের বেলায় দেখা করবে (এহেম এহেম , কাম সারছে :3 )।
নায়ক নায়িকা রাতের বেলায় দেখা করতে আসলো। তারপর সস্তা কিছু
প্রেমের ডায়লগ শুরু হল। আমি নিশ্চিত এখনকার মাইয়ারা এইসব সস্তা ডায়লগ শুনলে তার প্রেমিক রে ঝাটা দিয়া পিটাইবো। যাউক গা এরপর শুরু হইলো গান। গান শেষে দেখাগেলো কাবিলা তার নায়িকারে আর নারিকেল গাছ রে একসাথে জড়ায়া ধরছে। আরে ব্যাটা তুই একটারেই দুই হাত দিয়া বেড় পাবিনা তো দুইটারে একসাথে ধরোস কোন সাহসে?? হঠাত বিনের বাজনা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম আল্লাহ হলের ভিত্রে সাপ ঢুকলো না তো! কিন্তু একি! কাবিলা আর তার নায়িকা দেখি গান গাইতাছে
"মোকলেস কথা দে মোকলেস কথা দে আমারে ছাইড়া তুই যাইবি না আমি যে তোর দিওয়ানা ;
এই তো বোজ্জো"
সিরিয়াসলি এইটা ছিল গানের লিরিকস! এই গানের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবিলম্বে অস্কার, গ্র্যামি, ফিতাকৃমি, গোলকৃমি যাবতীয় এওয়ার্ড দেওয়া উচিত।
এই গান শেষ হইতে না হইতেই দেখা গেলো নায়িকার কোলে নায়ক শুইয়া আছে। আবার গান। কাবিলার গানের এক মিনিট পর আরেকটা গান। মানে লাস্ট তিনটা গানের মাঝে ১-২মিনিট বিরতি। ডিরেক্টরের কি ডাইরিয়া হইছে নি? একেতো সি গ্রেড মডেলিং টাইপের গান তাও দুই মিনিট পর পর্। এই গান শেষ হওয়ার পর দেখা গেলো দুপুর হয়ে গেছে অথচ নায়িকার কোল থেকে নায়কের মাথা তোলার নাম নাই। নায়িকার ভাই সেইটা দেখে ফেলল। নায়িকাকে বকাঝকা করার পরও নায়িকা ঠিকই নায়কের সাথে ফোনে কথা বলল। নায়িকার ভাই এইবার ফোন মারলো আছাড়। ফোন ডা আগের থেইকাই আন্ধা ছিল এইবার হইল মার্ডার।
প্রেমের টানে এইবার নায়িকা নায়কের কাছে ছুটে এলো। কিন্তু নায়িকার ভাই সেইখানেও তার গ্যাং আর ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প নিয়া হাজির্। ব্যাট আর স্ট্যাম্প দিয়া ইচ্ছামত নায়করে পিটাইয়া হাসপাতালে পাঠায়া দিলো। নায়কের মা রে দেখলাম অনেকগুলা হাড়িপাতিল হাতে নিয়া ঘরের দিকে যাইতে। একটা ভবিষ্যদ্বানী করে ফেললাম, নয়কের মা শুনবে তার ছেলে হাসপাতালে আর ওমনি হাড়িপাতিল গুলো ছুড়ে মারবে। আরে আরে হলোও যে তাই! এতক্ষন নায়কের বিরক্তিকর অভিনয়(!) অনেক কষ্টে সহ্য করেছি। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পরের অভিনয় দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল। যে অভিনয়ের "অ" জানেনা তার অভিনয় দেখার চেয়ে যন্ত্রনার কিছু নেই।
যাই হোক নায়ক কি না কি বুঝে হাসপাতাল থেকে ছুটে গেল নায়িকার বাড়িতে। প্রথমে নায়ক নিজেই পিটাইলো নায়িকার ভাইয়ের চামচাগুলারে। চামচাগুলারে পিটায় আর সেইগুলা ড্যান্স দিতে দিতে শুইয়া পড়ে। হ্যা তারা কোমোর দুলিয়ে ড্যান্সই দিচ্ছিল। তারপর আবার নায়ক সেই ব্যাট স্ট্যাম্পের প্যাদানী খাইলো। একটা জিনিস বুঝলাম নায়কের ভাই খুব ক্রিকেট অনুরাগী। তাই সাথে সবসময়ই ব্যাট বল স্ট্যাম্প রাখেন। নায়িকার ভাই নায়িকা কে বলল, "যদি সুজন কে বাচাতে চাস তবে তাকে বলে দে তুই তাকে ঘৃনা করিস"। নায়ক বেচে যাবে এই শর্তে নায়িকা তাকে অপমান করতে রাজী হল। একেতো মাইর খাইয়া নায়কের অবস্থা টাইট তার উপর নায়িকা আইসা নায়ক রে অপমান কইরা থুইয়া গেল। নায়িকার ভাষ্যমতে হাডুডু খেলায় তার ভাইকে হারানোর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সে প্রেমের অভিনয় করে। এ যেন কাটা ঘায়ে ঝাল আর লবণ এর ছিটা।
নায়ক শোকে দু:খে "বেঈমান, এই পৃথিবীটা বেঈমান" ডায়লগে আকাশ বাতাস ভারী করে তুলল। সাথে বোতলের পর বোতল বাংলা মদ সাবাড় করতে থাকলো। নায়িকার এদিকে সেই শহুড়ে প্রথম নায়কের সাথে বিয়েও হয়ে গেল। মদ খেতে খেতে নায়ক মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ফেলল। এক পর্যায়ে নায়ক মদ খেতে খেতেই মারা গেল। শেষমেশ দেবদাসের কাহিনী মাইরা দিলো।
মধ্যবিরতির পর থেকে যে ননস্টপ কান্নাকাটি শুরু হয়েছিল তা সিনেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামলো না। এত কান্নাকাটি হলে আবেগ কিভাবে ধরে রাখি? :'( নায়ক কান্দে, নায়কের মা কান্দে, নায়কের বোন কান্দে, নায়িকা কান্দে, নায়িকার মা কান্দে, নায়িকার সই কান্দে, নায়িকার জামাই কান্দে সবাই কান্দে, কানতে কানতে হল ডারে মরাবাড়ি বানায়া হালাইছে। সিনেমা দেখার পর ভাবতেছিলাম আমি আসলেই এপিক লেভেলের ধৈর্য্যশীল। এই রকম সিনেমাও যে হজম করতে পারে তার ধৈর্য্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন করারও সাহস পাবেনা। সিনেমায় যেই রকম জঘন্য অভিনয়, গান, নাচ, কাহিনী, ক্যামেরার কাজ দেখা গেছে তা যেন আর কোনো সিনেমায় না দেখা যায়।