পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
তদন্ত আদালতের সুপারিশ মালার ওপর ভিত্তি করে সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য ও চার্জ সিট বানানো হয়। সেই চার্জ সিটের ওপর ভিত্তি করে হয় কোর্ট মার্শাল। এ নিয়মের বাইরে যাবার কোন উপায় সেনা আইনে নেই।
জেনারেল জিয়ার পি এস লে. কর্নেল ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্যে দু' দু'বার বীর বিক্রম খেতাবে ভুষিত হ'ন। জুনের প্রথম দিকে শুনি যে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, পরে ছেড়ে দিয়ে আবার জুলাইয়ের প্রথম দিকে তাকে ধরা হয়। তদন্ত আদালতের একজন সদস্য ছিলেন মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর ঊত্তম (অবসরপ্রাপ্ত)। তিনি এবং অন্যান্য সদস্যেরা যখন তদন্ত আদালতের কাজ শেষ করেন (সাক্ষ্য-উৎঘাটিত তথ্য-মতামত-সুপারিশ), তখন কর্নেল মাহফুজকে সেই তদন্ত আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। সুপারিশে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়ার কথাই বলা হয়নি।কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ সিট হয়েছে, তাঁর কোর্ট মার্শাল চলছে। কিভাবে এটা সম্ভব? নাকি আসলেই এগুলো শুধুই গুজব?
........দীপ জ্বলা রাত ফিরে আসবে আবার.........
রাত শেষের পথে। সন্ধ্যায় কোত্থেকে যেন ভাংগা হারমোনিয়ম যোগার করা হয়েছে। তখন থেকেই লাকী "এই নীলমনিহার' গাইছে।একে তো ভাংগা তার ওপরে হারমনিয়ম। এই জিনিস থেকে এত অপুর্ব সুর কিভাবে ওঠায় ও? মনে পড়ে গেল যে আমার সামনে সারারাত ধরে যে গাইছে, এ পর্যন্ত (এবং তার ২৯ বছর পর পর্যন্ত) সে আকাশবাণী কোলকাতার সর্বকনিষ্ঠ সংগীত পরিচালক। লাকীর হারমোনিয়ম বাজানো যদি বিশ্বভারতী শুনতো, তা'লে অবশ্যই তারা রবীন্দ্র সংগীতের সাথে এই বাদ্য যন্ত্রটি বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিত।
ভোরের আলো ফুটলো এক সময়। অনেক অনেক দিন পর একটি রাত কাটলো বিভীষিকাহীন ভাবে। ঐ রাতটার জন্যে আমি সারা জীবন লাকী আকন্দের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
কোর্ট মার্শালের খবর আসতেই থাকলো। সেখানকার সব অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার, একপেশে নীতি, যথেচ্ছাচার--সব কিছুরই। ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল এর প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে প্রকাশ্য মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী মেজর জেনারেল আব্দুর রহমানকে। সে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ব্যাঙ্গ করতো। প্রকাশ্যে বংগবন্ধুকে বিদ্রুপ করতো। শুনলাম যে বন্দীদের ৩ জন করে এক একটি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের সেলে রাখা হয়েছে, যে সেলে লম্বা হয়ে শোয়া পর্যন্ত যায়না। প্রাকৃতিক কাজ ৩ জনকেই সেখানে সারতে হ'ত একটি পাত্রে। কোন কোন সেলে নাকি ঐ বর্জ্য পাত্র খাবারের পাত্র হিসেবেও ব্যাবহার করতে হয়েছে। আমরা ঐ সব গুজব তখন ঠিক বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ জানি, সে গুজবগুলো সবই সত্য ছিল।
তারিখটি মনে নেই। তবে পরিষ্কার মনে আছে সেদিনটি ছিল ২৭শে রামজান। পিটির পর (তখন রামজানে পিটি হ'ত) বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পিরিওড। সকাল আটটাও বাজেনি। অধিনায়ক তলব করলেন। বিকেলে কুমিল্লা স্টেডিয়াম কর্ডন করতে হবে। একটি হেলিকপ্টার আসবে, সেখানে কিছু কয়েদী থাকবে, তাদেরকে নিয়ে কুমিল্লা জেলে সোপর্দ করতে হবে। আমি অধিনায়কের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। তিনি জানতেন যে চট্টগ্রাম বিদ্রোহীদের মধ্যে আমার এক কোর্স মেট আছে যে আমার আতি অন্তরংগ বন্ধু এবং আরেকজনের সাথে আছে গাঢ় হৃদ্যতা।
দুপুরের আগেই ডিউটি বদলে যায়। যিনি আমাকে ২৯শে মে তে টি্পরা বাজার এম পি চেক পোস্টে নামিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই ডিউটিটি করেন।
শেষ বিকেলের দিকে হেলিকপ্টার নামে। বের করা হ্য় কয়েদীদের। চোখ বাঁধা, হাতে পায়ে কাফ, লোহার শেকল, ডান্ডা বেড়ি, এগুলো এমন ভাবে বাঁধা যে কেঊই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিল না। তারা যে কখনো সেনা বাহিনীতে অফিসার ছিল বা সেনাবাহিনীতে ছিল তা অতি কষ্টেও কল্পনাতে আনা যাচ্ছিল না। তাদেরকে চ্যাংদোলা করে ওঠানো হ'ল গাড়িতে। ওঠানোর সময় কর্তব্যরত অফিসারটি একজনকে সনাক্ত করেন- মেজর আব্দুল কাইঊম খান- বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে উনি আমাদের G-2 (General Staff Officer Grade-2) ছিলেন। দু'জনের মধ্যে অল্প কিছুক্ষণ কথোপকথন হয়।
মেজর আব্দুল কাইউম খানকে যখন চিটাগাং জেলে পাঠানো হয়, তার বাবা, সে সময়কার দিনের বিরাট ব্যাবসায়ী, তখন দক্ষিণ আমেরিকায় (সম্ভবতঃ পেরুতে)। তাকে খুঁজে পেতেই লেগে যায় দিন তিনেক। তিনি দেশে আসেন। সেনা প্রধানের সাথে দেখা করেন। এর ফলশ্রুতিতে একদিন গভীর রাতে/ভোর রাতে কুমিল্লা জেলের একটি ফটক খুলে যায়। বাইরে অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে মেজর আব্দুল কাইঊম খান সোজা ঢাকা বিমান বন্দরে। সেখান থেকে আমেরিকায়।জর্জিয়া স্টেট ইঊনিভারসিটি্ থেকে ফিনান্সে ১৯৮৯ সালে পিএইচডি করে অনেকদিন সে দেশে কাটিয়ে এখন স্বদেশে।
যেখানে আমরা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হাজার হাজার কোটি টাকার গল্পে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেখানে এক কোটি টাকার কথা এক্ষণে কিভাবে বলি?
জনশ্রুতি আছে যে সেনাপ্রধানের সাথে মেজর আবদুল কাইয়ুম খানের বাবার সাক্ষাতের সময় কোটি টাকার বিনিময় হয়েছিল।
ইস, আমার বন্ধুটার বাবা আনসার এডজুট্যান্ট না হয়ে যদি অতি সফল ব্যাবসায়ী হতেন!
এ গানটি কি সে জন্যেই রফিক এত গাইতো?
I work all night, I work all day, to pay the bills I have to pay
Ain't it sad
And still there never seems to be a single penny left for me
That's too bad
In my dreams I have a plan
If I got me a wealthy man
I wouldn't have to work at all, I'd fool around and have a ball...
Money, money, money
Must be funny
In the rich man's world
Money, money, money
Always sunny
In the rich man's world
Aha-ahaaa
All the things I could do
If I had a little money
It's a rich man's world
........................................
.......................................
...........................................
বন্দীদের কুমিল্লা কারাগারে নেয়ার সপ্তাহ দু' য়েক পর আরেকটি গুজবে সেনানিবাস অস্থির হয়ে পড়ে। ১৮ জন অফিসারের প্রাণদন্ডাদেশ হয়েছে। যে নাম গুলো শোনা গেল তার মধ্যে আমার বন্ধু রফিক এবং আমার অতি প্রিয় জেষ্ঠ, ক্যাপ্টেন জামিলের নাম শুনে আমি অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। তিনি ছিলেন বর্তমান সেনা প্রধানের কোর্স মেট(BAO, Bangladesh Army Order অনেকটা সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপনের মত, সেনা বাহিনীর জন্যে প্রযোজ্য। সব কিছু শেষ হবার অনেক পরে, সেই ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের রায় BAOর মাধ্যমে আমাদের জানানো হয়। সেখানে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আফিসার ছিলেন ঠিকই ১৮ জন। তার মধ্যে ৫ জনের দন্ডাদেশ সেনা প্রধান কমিয়ে/মওকুফ করে দিয়েছিল)।
আমি ছোট বেলা থেকেই ভোজন বিলাসী। বাসার রান্নার কথা না হয় বাদই দিলাম, ফৌজদারহাটের খাবারও ছিল স্বাদু। কমিশনের পর যখন অফিসারর্স মেসে ওঠার সুযোগ পেলাম তখন সেখানকার খাবার আর খেতে পারিনা। ক্যাপ্টেন জামিল তখন সর্ব কনিষ্ঠ বিবাহিত অফিসার, যশোর সেনানিবাসে। কোন এক সময়ে তিনি আমাকে মেসে খেতে দেখেন এবং তার নীল হোন্ডা ১১০ এ করে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। আমার মেস থেকে তার বাসার দুরত্ব ছিল অনেক। আমি থাকতাম স্টেশন মেসে (এখন সে মেসটির কি নাম জানিনা)। ঊনি শান্তলায়। প্রায় প্রতিদিন রাতে আমাকে নিয়ে যেতেন তার বাসায়। তাঁর স্ত্রী ছিলেন কুমিল্লার প্রখ্যাত রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের কন্যা, যিনি স্বনামে (মার্কার জোরে নয়) নিজ এলাকা থেকে একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের ছোট্ট একটি ছেলে ছিল-ভিকি। রোজার সময় প্রত্যেকদিন গেমসএর শেষে আমাকে ইফতার করাতে নিয়ে যেতেন। রামজানের একদিন জিওসি জেনারেল শওকতের ইফতার করার কথা আমাদের সেনাদলের সাথে। সাজ সাজ রব। সারাদিন প্রচন্ড কাজের চাপ গিয়েছে, তার ওপর অভুক্ত। ইফতারের আগে আগে কাপড় বদলাতে মেসে এসেছি, দেখি ক্যাপ্টেন জামিল তার নীল মো বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তিনি তো আর জানেন না জিওসি আসছেন আমাদের সাথে ইফতার করতে। অগ্র পশ্চাদ বিবেচনা না করে চট করে পাজামা পাঞ্জাবীতে বদলে আমি তাঁর হোন্ডার পিছে। তার প্রিয় গানগুলো ছিল সব BoneyM এর:
let the words of our mouth,
and the meditation of our heart,
be acceptable in thy sight be tonight
let the words of our mouth,
-কোথায় যেন পড়েছিলাম সেই কবে। বাইবেলে নিশ্চয়ই।
By the rivers of
Babylon,
where we sat down.
yeaheah we wept,
when we remembered Zion.
ঐ ইফতারটি আমার জন্যে অত্যন্ত দামী হয়ে গ্যাছিল।
৩রা সেপ্টেম্বর রিট করা হয়। আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে "কাকস্য পরিবেদনা"।
যারা রিট করেছেন তারা তো আর সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেনি।
পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে আইউব খান ক্ষমতা দখল করার পরই শাসনতন্ত্রের কিছু পরিবর্তন আনেন । তার মধ্যে একটি ছিল "যদি সেনাবাহিনীতে কোন কোর্ট মার্শালে কারো কোন শাস্তি হয় তাহ'লে সে দন্ড লঘু করা বা মওকুফ করার এক্তিয়ার শুধুমাত্র সেনা বাহিনীর মধ্যেই সীমিত থাকবে। বেসামরিক কোন আদালত সে রায়ের ব্যাপারে কুটোটিও
নাড়তে পারবেনা"। Please forgive me if something is LOST IN TRANSLATION (অনুবাদে যদি কিছু হারিয়ে ফেলি ক্ষমা করবেন)।
আইয়ুব গেল ইয়াহিয়া আসলো, পাকি খেদানো হ'ল, বংগবন্ধু, জিয়া, এরশাদ এল আর গেল, খালেদা, হাসিনা দু' দুবার করে রাষ্ট্রের হাল ধরলো। এ মানবতা বিরোধী আইন এখন পর্যন্ত রদ করা হয় নি।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের জন্ম বংগবন্ধুর শাসনামলে। কত বংগবন্ধু জিয়া হ'ল, ভাসানী হয়ে আবার ডিগবাজী খেল, কত জিয়া আঊলিয়া হয়ে গেল , কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন একদিনের জন্যেও রদ হয়নি।
আজ যদি আমি বলি সেনা আইনের সে ধারা, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সংবিধান পরষ্পর সাংঘর্ষিক, তা হ'লে কি ভুল বলা হবে?
৩/৪ দিনের মধ্যেই রিট প্রত্যাখ্যাত হয়।সেদিনই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। ২২ শে সেপ্টেম্বর আপিল ও প্রত্যাখ্যাত হয়।
২৩ শে সেপ্টেম্বর,১৯৮১, সম্ভবতঃ দিনটি ছিল বুধবার।
আগুনের মত ছড়িয়ে পড়লো সংবাদটি। ১২ জন অফিসারের ফাঁসী হয়ে গেছে। ময়নামতি সেনানিবাসের গোয়েন্দা দলে কর্মরত যে অফিসারটির ফাসীঁর সময় কুমিল্লা জেলে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল, সেনা বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে, তিনি সেদিনই পদত্যাগ করলেন।
আমার প্রিয় সখা, আমার প্রাণের বন্ধু, যার জন্যে দুপুরের খাবার নিয়ে বসে থাকতাম, হেন কোন দুষ্টুমী নেই যা একসাথে করিনি, রাতের পর রাত গল্পে গানে কাটিয়ে দিয়েছি, সে আর নেই, চলে গেছে দূর কোন পরবাসে, যেখানে আমিও একদিন যাব।
কিন্তু এ যাওয়া মেনে নেবার নয়।
পরিনত বয়সে নয়, দুর্ঘটনায় নয়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে এ মৃত্যু নয়,
এ মৃত্যু
পাশার চালে, খাঁচায় বন্ধ ইদুরের মৃত্যু,
মসনদে বসার কুট চক্রে অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু,
এ মৃত্যু মানবেতরো মৃত্যু।
আমি আমার দেশ থেকে মৃত্যুদন্ডের বিধানের অবসান চাই।
আমি সব মানুষের সাংবিধানিক বিচারের অধিকার চাই।
আমি জিয়া হত্যার বিচার চাই।
আমি মঞ্জুর হত্যার বিচার চাই।
আমি চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের পুনর্বিচার চাই।
আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১২ রাত ১২:২২