পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
গুমোট গরম। মাথার ওপরের টিনের চাল ভেদ করে প্রচন্ড তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। আগে এ সময় হয় পাহাড়ের ওপরের অফিসার্স মেসের ডাইনিং হ'লে চুটিয়ে আড্ডা মারছি না হয় এখনো সেনাদলের সাথে।
এখন অন্য সময়ে, বোধ করি অন্য ভুবনেও। রুটিন কাজ ছাড়া আর কিছুই করা হয় না। যা কথা হয় সৈনিকদের সাথেই।অফিসারেরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেনা বললেই চলে। সবাই যেন বোবা। বুকের ভেতরের অসম্ভব চাপ, আর ধরা গলা সর্ব সময়ের সংগী। রাতে ঘুম হয়না বললেই চলে। যা কিছুক্ষণ হয় দূঃস্বপ্ন আর বিভীষিকাময় সব দৃশ্য সে ঘুমকে দখল করে রাখে। ছোট্ট একটা ঘুম (nap) দেয়া যায় কিন্তু এখনও ঘুমুতে ভয় পাচ্ছি দূঃস্বপ্নের ভয়ে, যদিও চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। দরোজায় টোকা পড়লো।
রামগড়ের কাঁঠাল দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করে টহলে যাবার আধঘন্টার মধ্যে আমাদের অভিযানের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।
ফিরে আসলাম ভিন্ন এক সেনা নিবাসে। যেখানে বাতাসও বহে না। একজন আরেকজনের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। NCE (non combatant enrolled) থেকে অধিনায়ক পর্যন্ত সবাই ম্লান মুখে যার যার প্রাত্যহিক কাজ করে যাচ্ছে। অফিসারদের অবস্থা সব'চে জঘন্য। বেশির ভাগই অজানা আশংকায় দিন কাটায়।
সে সময় ময়নামতি ছিল সবচে' ভাল পরিবেশের সেনানিবাস, যে সেনানিবাস দেশে আপাত গৃহ যুদ্ধ ঠেকিয়েছে। অন্য সেনা নিবাসগুলোর এবং বিশেষ করে চিটাগাং সেনানিবাসের অবস্থা তখন কি হতে পারে তা চিন্তার মধ্যেও আনতে পারতাম না।
১লা জুনের মধ্যে সব অফিসারেরা আত্মসমর্পন করে। এর মধ্যে মেজর রেজা, যিনি জেনারেল মনজুরের শেষ সময়গুলোতে তার নিরাপত্তা অফিসারের দ্বায়িত্ব পালন করেন (তিনি বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতেনই না, ২৯ শে মের রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন) তিনি ছাড়া আর সবাই, সাধারন ক্ষমায় বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পন করে। মেজর খালেদ (প্রয়াত) ও মেজর মোজাফফর পালিয়ে যায়। এ দু'জন ছিলেন বিদ্রোহে সবচেয়ে সক্রিয় পাঁচ জনের দু'জন। ৩ রা জুনের মধ্যে অন্যান্য অফিসারদের ধরা হয়। এর মধ্যে বিদ্রোহের সময় ব্রিগেডিয়ার মহসীন ছিলেন চোখের অসুখে অসুস্থ্য অবস্থায় SIQ (Sick in Quarter)। তদন্ত আদালত শুরু হয় ৪ ই জুন। ৫ তারিখ থেকেই নানা ভয়াবহ সব গুজব ছড়িয়ে পরে। বন্দী অফিসারদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের সব বিবরন আসতে থাকে। প্রচন্ড মার, দু'হাতের সব ক'টা নখ উপড়ে ফেলা (জেষ্ঠ্য অফিসারদের বিশেষ করে), বৈদ্যুতিক শক, জননেন্দ্রিয় দিয়ে কাঁচের রড প্রবেশ করানো, হেন কোন নির্যাতন নেই যা করা হয়নি, যত দিন পর্যন্ত না তারা মন গড়া সাক্ষ্যে সাক্ষর করেছেন।
নির্যাতিতেরা ছিল মুক্তি্যোদ্ধা আর নির্যাতকদের দল নেতাও ছিল আরেক মুক্তি যোদ্ধা-কর্ণেল/ব্রিগেডিয়ার আশরাফ, DG, NSI (পরে মেজর জেনারেল)। আমি এখনো ভেবে পাইনা আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী এক মুক্তি যোদ্ধা কিসের লোভে তার সহযোদ্ধাদের অবর্ননীয় অত্যাচার করে, তাদেরকে নিজ নিজ মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর করিয়ে নেয়। তদন্ত আদালত শেষে Summary of Evidence (সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য) তৈরি করা হয় এবং চার্জ সিট দেয়া হয়, যার ওপর ভিত্তি করে চিটাগাং জেলে গোপন কোর্ট মার্শালে (যেখানে বেসামরিক আইনজীবীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ) তাদের বিচার শুরু হয়। পৈশাচিক অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে নেয়া মনগড়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার শুরু হয়। তদন্ত আদালত চলাকালে ও কোর্ট মার্শালের সময় সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সার্বক্ষণিক ভাবে উপস্থিত থাকতো।
আবার টোকা।
দরোজা খুলে দেখি বন্ধু লাকী আকন্দ!
১৯৭৮এ আমার ওপর ভার পড়লো ডিভিশনের সবার জন্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। আমাকে ভার দিয়েছেন স্বয়ং জিওসি, মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী বীর উত্তম। সপ্তাহ খানেক আগেই ডিভিশনাল স্টাডি পিরিওডে যখন আমি তাঁর কার্টুন আকঁছিলাম, অতি বিরক্তিকর বক্তৃতা শোনার অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে, তখন স্বয়ং জিওসির কাছেই হাতে নাতে ধরা পড়ে যাই। গোল মুখ, ইয়া বড় গোঁফ, জেনারেল শওকত ছাড়া আর কে হতে পারে? আমার স্কেচটি নিয়ে উনি ডিভিশনের সব অফিসারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন "We have a gifted cartoonist here!" এ ঘটনার দিন তিনেক পরই ডিভ সদরের মেজর প্যাঁচা মাহবুব আমাকে তলব করে জানিয়ে দিলেন যে মাননীয় জিওসি আমার অংকন প্রতিভায় মুগ্ধ। তিনি মনে করেন যে আমার চেয়ে ভাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর কেঊই আয়োজন করতে পারবেনা।
তো লাকী আকন্দকে নিয়ে গিয়েছিলাম যশোর সেনানিবাসে এক বিকেলে। সাথে ফকির আলমগীর, প্রয়াত ফিরোজ সাঁঈ ও একজন গায়িকা, সম্ভবতঃ রুনা খান। প্রথমে ফকির উঠলো। উঠেই ফিরোজ সাঁঈএর গান গুলো একের পর এক গাওয়া শুরু করলো। বেচারা ফিরোজ সাঁঈএর উইংসের পাশ থেকে সে কি লাফালাফি! ফিরোজের গান সবার ভালই লাগলো। রুনা খান সুপার হিট। সব শেষে লাকী আকন্দের নাম ঘোষিত হ'ল। সংগে সংগে সংগে মূহুর্মূহু করতালিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হ'ল। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। লাকী যে সৈনিকদের মধ্যেও এত জনপ্রিয় তা আমার জানা ছিল না।
লাকী স্টেজে ওঠার সংগে সংগে করতালি হঠাৎ করেই বন্ধ হ'ল। ও যতক্ষণ স্টেজে ছিল একটি করতালিও আর পড়েনি। ঘটনার কারন জানতে পেরেছিলাম পরদিন। সে সময়ে যাত্রার এক অত্যন্ত জনপ্রিয় নায়িকা ছিল প্রিন্সেস লাকী খান। আমার বন্ধুর নাম ঘোষিত হ'তেই সবাই মনে করেছিল যে সে প্রিন্সেসই এখন স্টেজে আসছে।
..........দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়............
অবাক হয়ে লাকীকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। লাকী বললো যে ক'দিন থেকেই আমাকে নিয়ে সে ভয়ংকর দূঃস্বপ্ন দেখছে। আমার কোন হদিস তার জানা ছিলনা। আমাদের বাড়িতে গিয়ে মার কাছ থেকে জেনেছে যে আমি কুমিল্লায় সেনানিবাসে। এটুকু জেনেই সে চলে এসেছে আমার রুম পর্যন্ত। আমি মনে মনে বললাম "এ না হ'লে লাকী!"
কিছুক্ষণ পরই গেমস। আগে হ'লে গেমস থেকে অব্যহতি নিয়ে নিতাম। তখন দূঃসময়। লাকীকে ঘরে রেখে আমি বিকেলের খেলাধুলায় চলে গেলাম।
আগামী পরশু ছোট্ট একটা পর্বে সমাপ্য।