পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
পর্ব-৪
সকাল চারটার পর থেকে, ১ লা জুন, ১৯৮১।
দরোজা দিয়ে বের হয়ে আসতেই দু'পাশ থেকে খটাস খটাস, স্টেনের ওপড় হাতের তালুর বাড়ির শব্দ। চমকে উঠলাম। দু'জন এম পি (Military Police) আমাকে অভিবাদন জানালো।
-তোমরা? এখানে? আমার রুমের সামনে? তোমাদের ডিউটি কোথায়?
-স্যার, এখানেই।
-এখানে? মানে?
কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে ওদের কজন তোতলাতে তোতলাতে বল্লঃ বি এম স্যার তিন নয় (3x9, 3 guard commanders 9 guards in 24 hours, each group for 8 hours)সান্ত্রী লাগিয়েছেন আপনার রুমে আর চিটাগাং থেকে আসা স্যারদের ঐ রুমে।
এই প্রথম আমি চিন্তিত হ'লাম রফিককে নিয়ে। গাড়িতে উঠে বিএম এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, পেলাম না। কমান্ডারের সাথে প্রথমে VHFএ না পেয়ে পরে HF সেটে কথা বললাম। আমাকে উনি বললেন চিটাগাং থেকে আসা অফিসারদের নিরাপত্তার জন্যেই গার্ডের ব্যাবস্থা উনি নিজেই করেছেন।
মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এই প্রথম আমি চেইন অফ কমান্ডে বিশ্বাস হারালাম। বাঘের খাঁচায় যে রফিকরা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ঢুকেছে আর আমিও তাদের রেখে এসেছি সেখানে, তখুনি তা বুঝতে শুরু করলাম।
আমার কমান্ডারকে আমি যদি বিশ্বাস করতে পারতাম! সত্যি কথাটা বলতে তাঁর কি অসুবিধে ছিল?
আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাওম।
বাজে সকাল সাড়ে চারটা।
সামনে আমি আমার জীপে, আমার পেছনে সাতটা গাড়ি, সবার পেছনেরটায় আমাদের রসদ আর cook house. মাঝখানের গাড়িগুলোয় যুদ্ধের সরঞ্জাম। মনটাকে অন্য কোনখানে নিয়ে যাবার জন্যে মনে মনে আমি হিসেব করা শুরু করলাম কত গুলো গোলা, কত সংখ্যক গুলি আর ক্য়টা জীবন লাগতে পারে চিটাগাং রেডিও স্টেশন দখল করতে।
অনেকক্ষন ধরে বসে আছি জ্যামে। চিটাগাং থেকে বহরের পর বহর সৈন্যদল আসছে। তারাই এই সাত সকালে চিটাগাং এর রাস্তায় জ্যাম লাগিয়েছে। অধিনায়কের সাথে যোগাযোগ করলাম সকাল সাতটায়। জানিয়ে দিলাম যে আমাকে যদি MP Escort না দেয়া হয় রাস্তা ক্লিয়ার করতে আর আধ ঘন্টার মধ্যে, তা'লে আমি ১১টার মধ্যে রেডিও স্টেশনে পৌছুতে পারবো না। উনি বল্লেন যে খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যাবস্থা করছেন তিনি।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মার্চ ১৯৭১।চিটাগাং রেডিও স্টেশন। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস, আমার প্রিয় ফুপাতো বোনটা গাইছেঃ "তোমার এই খেলাঘরে/ শিশুকাল কাটিলো রে/তোমার এই ধুলামাটি/ অংগে মাখি / ধন্য জীবন মানি.........আমার তখন বারো, ওর এগারো,
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি ..।.।...তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম আমার নিজের স্বাধীন দেশের সেনা বাহিনীতে আমরা বিভাজিত হয়ে মরণ খেলায় মাতবো? যেখান থেকে আমার বোনটি না জেনে তার স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে দাড়াঁনো দেশটির জাতীয় সংগীত গাইলো, সেটাকেই উড়িয়ে দিতে যাচ্ছি আমি, শত্রু মুক্ত করতে নয় সহযোদ্ধা মুক্ত করতে।
৩০ লক্ষ বলী,
আড়াই লক্ষ সম্ভ্রম,
১ কোটি বাধ্য অভিবাসন,
৬০ হাজার যুদ্ধ শিশু,
চিকিৎসা আওতা বহির্ভুত অগোচর অগনিত গর্ভপাত,
আশ্রয় শিবিরে অগনিত অসহায় শিশু আর বৃদ্ধের কলেরায় মৃত্যু
বীরের এ রক্ত স্রোত, মাতার.।.।।.....।.।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।...।।
কিছু শকুনের খাদ্য যোগানোর জন্যেই
...যে MP Escort আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার করে নিয়ে যাবে তাদেরকে আমাদের ফ্রিকয়েন্সী দেয়াছিল। তারা যোগাযোগ করলো ও যে তারাও আমাদের মাইল টাক পেছনে জ্যামে আটকে গেছে...।
শর্শের মধ্যে ভুত! সাড়ে দশটার সময় আমি আমার প্রাক্তন বিএমএ কমাডান্ট ব্রিগেডিয়ার লতিফকে চিটাগাং থেকে আসতে দেখে জীপ থেকে নামলাম। কুশলাদী জিজ্ঞেস করলাম (নিয়ম অনুযায়ী তাঁরই আমাকে জিজ্ঞেস করার কথা।কিন্ত আমি বিজয়ী পক্ষের উনি বিজেতা)। Nuremberg Trial এর সেই বিখ্যাত ঊক্তিটি মনে পড়ে গেল- Yes! Our greatest crime is that we lost the war! কে যেন কাকে বলছিল বিচারের সময়।
২৪ পদাতিক ডিভিশনের একমাত্র কমান্ডার যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন সে সময় তিনি হলেন এই লতিফ। বাকী তিন ব্রিগেড কমান্ডার ( এক বীর বিক্রম ও এক বীর প্রতীক সহ)কে ফাঁসীতে ঝুলতে হয়। চার কমান্ডারের মধ্যে শুধু লতিফই যে ছিলেন প্রত্যাগত।
আনুমানিক দশটার দিকে অধিনায়ক যোগাযোগ করলেন আবার। চিটাগাং রেডিও স্টেশন আত্ম সমর্পন করেছে। আমার আর চিটাগাং যাবার দরকার নেই। পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা তখন যেখানে, সেখানেই যেন অবস্থান করি। আমরা তখন জোড়ালগঞ্জে।
আমার জীপটা সেখানে থেমেছে, তার বাঁ পাশেই একটা সমতল খালি জায়গা। আতি পুরনো কিছু গাছ, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। তার পর শ'খানেক বছরের পুরোনো একটা মসজিদ। গাড়ি থেকেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল। নেমে হাবিলদার মেজরকে নিয়ে রেকী (reconnaissance) করলাম দ্রুত। মিনিট বিশেকের মধ্যে সব তাঁবু দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ চারিদিকে আলো বেশ কিছুটা কমে যাওয়ায় আমি চারিপাশ লক্ষ করলাম।আমাদের ক্যাম্প ঘিরে শয়ে শয়ে লোক এবং প্রতি মূহুর্তে বাড়ছে।
সে সময় পর্যন্ত আমার কোন ধারনাই ছিল না জিয়া কতটা জনপ্রিয়। তিন বছরের কিছু কম সময়ে দেখেছি যে জিয়া নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বি্রোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তখন অফিসার ছিল চার কিসিমেরঃ
১। মুক্তিযোদ্ধা।
২। প্রত্যাগত-সংখ্যায় সবচেয়ে বেশী।
৩।7th Fleet (JRB officerদের সাতটি কোর্সের "লিডার"দের অফিসারের মর্যাদা দিয়ে সেনা বাহিনীতে আত্মীকরন করা হয়)।
৪। আমরা-বাংলাদেশী কমিশনড আফিসার।
১, ৩ ও ৪ ক্রমিকের অফিসারেরা ছিল মোটামূটি একদল। প্রত্যাগতরা আরেক। জিয়ার ওপর আমাদের ছিল চাপা অসন্তোষ।
আমরা মনে করতাম যে ২ ক্রমিকের অফিসারেরা জিয়ার প্রতি খুবই সন্তষ্ট।
আমার সেনা উপদলের চারপাশে এত মানুষ জড়ো হ'ল যে আমি চিন্তিত হয়ে পরলাম ।পুরো জোড়াল গঞ্জ ভেংগে পড়েছে। করের হাট ও অন্যান্য জায়গা থেকে লোকজন আসছেই। আমি একটা গাছের ডালে চড়ে ওদের তীক্ষভাবে লক্ষ করতে থাকলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিন চার জন নেতা গোছের লোককে চিহ্নিত করে RP (Regimental Police) হাবিলদারকে তাদের ডেকে আনতে পাঠালাম। একজন এলাকার চেয়ারম্যান, আরেকজন স্কুলের হেড মাস্টার, একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যান, দুজন মেম্বার। কেঊই বিএনপি বা এর অংগ সংগঠনের নয়। তারা লমা সালাম দিল "স্লঅঅঅঅমালাইমুম সার"। সালাম দিয়ে প্রথমেই আমাদের অনেক প্রশংসা করলো। তারা ধরে নিয়েছে যে চিটাগাং থেকে যারা ঢাকার দিকে যাচ্ছে তারা জিয়াকে মেরেছে আর যারা ঢাকার দিক থেকে চিটাগাং যাচ্ছে তারা জিয়ার সমর্থক। একটু পড়েই তারা আমদের অনুরোধ করা শুরু করলো যে তারা আমাদের তাঁবু গাড়তে দেখেই একটা গরু ও দুটো খাসী জবাই করেছে আমাদের জন্যে। দুপুরের আতিথ্য যেন আমরা গ্রহন করি। যতই আমি বোঝাতে চাই যে সে আতিথ্য নেয়া নিয়ম বহির্ভুত , ততই তারা পীড়াপীড়ি আর অনুনয় বিনয় করতে থাকে। ঘন্টা খানেক চেষ্টা করে তাদের সাথে পেরে না ঊঠে আমি বলে ঊঠলাম যে আমরা যে কোন সময় সে স্থান ত্যাগ করতে পারি। তাদের উত্তর -আমরা যেখানে যাব সেখানেই তারা খাবার পৌছে দেবে।
ঊপায়ান্তর না দেখে আমি আমার অধিনায়কে সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলাম। তারপর সহ অধিনায়ককে। তাদের সাথে আমার কমিঊনিকেশন নেট ওঅর্ক VHF এ। রেঞ্জ, ক্ষেত্র ভেদে ৫ থকে ৮ মাইল মাত্র। যোগাযোগ হ'ল না। মহাসড়ক ধরে তখন একটা সিগন্যাল দলকে ঢাকার দিকে যেতে দেখে থামালাম। একজন হাবিলদারকে আদেশ করলাম তক্ষুণি তাদের HF সেট দিয়ে ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। সে হাবিলদারের কোন কারনই ছিল না আমার আদেশ মানার। সে আমার under command নয়। কিন্তু বিজেতার সে মনোবল ছিলনা। মাত্র ১০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার অধিনায়কের অনুমতি নেয়ার কোন চেষ্টাও সে করলো না। পাঁচ মিনিটে সংযোগ স্থাপন হ'ল। কমানডারকে পেলাম না। তিনি তখন একসাথে ডিভ সদর ও সেনা সদরের সাথে কথা বলছেন। অগত্যা বি এমের সাথে যোগাযোগ করলাম। বি এম বললেনঃ " You goof, why don't you understand that this is their expression of love for General Zia! Accept their invitation humbly. This is a different time and you are in a different world!" (হাঁদারাম, বুঝছনা কেন এটা জেনারেল জিয়ার প্রতি ওদের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। বিনীতভাবে ওদের আতিথ্য গ্রহন কর । এটা ভিন্ন সময় ও তুমি এখন ভিন্ন জগতে)।
চেয়ারম্যান সাহেবকে বিনীত ভাবে বললাম যে আমরা তাঁর আতিথ্য গ্রহন করছি। জনতার মধ্যে হুল্লোর পরে গেল। দুপুরের খাবার না বানাতে আদেশ দিয়ে মসজিদটার কাছে এলাম একা। নির্জন। দিঘিতে টলটলে জল। মনে আসলো যে ২৯ তারিখ সকালে পিটির পর আর গোসল করিনি। ৩০ তারিখের চড়ানো পোশাক গায়ে থেকে নামাই নি। দৌড়ে এসে টেন্টে কাপড় ছেড়ে সর্টস পড়ে দিঘিতে ঝাপিয়ে পড়লাম। অনেকক্ষন ডুব সাঁতার দিয়ে যখন আমি পানি ছেড়ে উঠলাম, ততক্ষনে আংগুলের চামড়া কুঁচকে গেছে আর ক্ষিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
কাছেই একটি স্কুলের মাঠে এলাহী কান্ড। গরুর ও খাসীর মাংসের সাথে পোলাও, বিভিন্ন সাইজের মুরগীর রোষ্ট, কলিজা, গুরদা এসব দিয়ে একটা পদ, মুরগীর লটপটি আরও হরেক রকমের খাবার। ১৫/২০টা টেবিল এক সাথে করে সব সাজানো হয়েছে। তিল ধারনের স্থান নেই। চেয়ারম্যান একটু কুন্ঠিত হয়ে বললেন অনেক গ্রামবাসী তাদের বাড়ি থেকে ভালবেসে আমাদের জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে, তাই এত হযবরল।
খাচ্ছি আর মনে করছি -যে মানুষটিকে এতদিন প্রতিপক্ষ জেনে এসেছি সে মানুষটির প্রাপ্য ভালবাসা উজাড় করে আমাকে দেয়া হচ্ছে!
কী বিচিত্রই না এ জীবন। কি অদ্ভুতই না এর ঘটনা প্রবাহ।
-চলবে।
(আগামীকাল কোন পর্ব বের হবেনা, অনিবার্য কারনে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭