১। এটা প্রকাশিত হবার পর আমার পরিচয় গোপন থাকবেনা, যা আমি এতদিন সযতনে রক্ষা করেছি।
২। ব্যাক্তিগত ঘটনা বয়ান পাঠকদের কাছে মাঝে মধ্যে আত্মপ্রচার ও পারিবারিক প্রচারের মত লাগবে যা আসলেই অশোভন, অরুচিকর এবং বিরক্তিকর। এগুলোও আমি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছি আজীবন।
৩। কোন পক্ষাবলম্বন না করে লেখাটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। আমার জন্যে আরো কঠিন। কারন যৌবন যখন সদ্য দেহ-মনে ভর করে আমার সমগ্র সত্তাকে ভীষনভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে, যা কিছুই সুন্দর তারই প্রেমে পড়ছি, ঠিক সে সময়ই বংগবন্ধুর সাথে আমার পরিচয়। নিরপেক্ষভাবে তাঁর ব্যাপারে লিখতে আমার খুবই কষ্ট হবে এবং আমাকে অসাধ্য সাধন করতে হবে।
৪। শুধুমাত্র স্মৃতি নির্ভর লেখার মূল সমস্যাটা হ'ল ভুল স্মৃতি মনের মধ্যে থাকা। যে কেউ যদি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কোন বক্তব্যে দ্বিমত প্রকাশ করেন, তা'লে তাকে আমি অনুরোধ করবো মন্তব্যে তা তুলে ধরতে। আমার স্মৃতি ঘাটতে সাহায্য করার নেই কেউ আমার হাতের কাছে।
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো-আমার যে একটা দায় আছে আমার পরের প্রজন্মগুলোর কাছে।
আমার এই দায় শোধ যদি এই প্রজন্মকে আমাদের গৌরবময় আর কলংকলেপিত অতীতকে নিরপেক্ষ ভাবে দেখতে শেখার পথে একপাও এগিয়ে নিয়ে যায়, তা'লেই আমি মনে করবো সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত সৃতিচারন। পারিবারিক ঘটনাবলীর চর্বণ। সমগ্র দেশের ব্যাপারটা কখনোই প্রধান্য বিস্তার করবেনা, সে সাধ্য বা যোগ্যতা আমার নেই।
পুরো সময়টার কিছু অনুল্লেখ যোগ্য অংশ বিষদ ভাবে আসবে আবার অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ পরবে, ব্যাক্তগত স্মৃতিচারনের এটা একটা বিরাট সমসয়া। অনুরোধ করি বিষয়টা মনে রেখে আমার এ লেখাটা পড়বেন ।
পুরোটা পড়ার পর অনেকের কাছেই এটাকে "পর্বতের মূষিক প্রসব" বলে মনে হ'তে পারে। তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
পর্ব-১পর্ব-২পর্ব-৩ পর্ব-৪
পর্ব৫পর্ব-৬পর্ব-৭ পর্ব-৮ পর্ব-৯ পর্ব-১০ পর্ব-১১ পর্ব-১২ পর্ব-১৩ পর্ব-১৪ পর্ব-১৫ পর্ব-১৬পর্ব-১৭ পর্ব-১৮পর্ব ১৯ পর্ব-২০
জাতীয় রক্ষী বাহিনী ও বাংলাদেশ সেনা বাহিনী
১৯৭২ সালে আমরা থাকতাম ১/৭ আসাদ এভিনিউ। আসাদ গেট দিয়ে ঢুকে মোহাম্মদপুর বাজারের দিকে যেতে হাতের ডানের প্রথম বাসাটি। বাসাটি এখনো রিয়েল এস্টেট ওয়ালাদের খপ্পরে পড়েনি। তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বাড়িটিতে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে যা স্বভাবতই বাড়ির সৌন্দর্য্যহানি ঘটিয়েছে। রক্ষী বাহিনী সে বছরই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের বাসা থেকে হাঁটা দুরত্বে, এখনকার সংসদ ভবন চত্ত্বরে তাদের একটা ছাউনি (সদর দপ্তর?) ছিল। আমাদের খুব কৌতুহল ছিল তাদের ব্যাপারে। আমরা প্রায় বিকেলেই হাঁটতে হাটঁতে চলে যেতাম সেখানে। চকচকে নতুন গাড়ী (আমার মনে আছে মিৎসুবিসি ট্রাক ছিল তাদের) ওয়্যারলেস সেট, অস্ত্র-সস্ত্র সব কিছু সব সময় ঝকঝক করতো। তাদের ইউনিফর্ম, জুতো, বেল্ট টুপী, টুপী চুড়োতে পাখির পালক (plume), আমার সেখানে গেলেই মনে হত নতুন বিয়ে করা কোন দম্পতির বাড়ির আংগিনায় ঢুকে পড়েছি।
অন্যদিকে সেনা বাহিনীর অবস্থা তখন করুণ। আমার এক ছোট ভাই পড়তো আদমজী কেন্টনমেন্ট স্কুলে। তার সাথে ঢাকা সেনানিবাসে গেলেই চোখে পড়তো তাদের করুণ অবস্থা। অত্যন্ত পুরোনো খাকি
পোশাক, এমনই রং জ্বলা যে দুর থেকে মনে হত নৌ বাহিনীর সদস্য। কাছে গেলে তাদের অতি দৃষ্টি কটু জুতো ও টুপি চোখে পড়তো। টুপি গুলো মনে হত আল আমিনের যুদ্ধ খ্যাত জেনারেল মন্টোগোমারীর
টুপি, ১৯৪১এ সেলাই করা। জুতো আর বেল্ট ছিল ছেঁড়া। আমি জুতোর ভেতর থেকে আংগুল বের হওয়া সেনা সদস্যও দেখেছি। কোরিয়ার যুদ্ধ ফেরৎ লক্কর ঝক্কর এম ৩৮ জীপ আর গজ পিক আপ ছাড়া তখন সেনানিবাসে অন্য কোন যান বাহন তেমন চোখে পড়তো না। বাবার আহসানুল্লাহ ইনজিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠি ব্রিগেডিয়ার তৌহিদের কাছে একবার গিয়েছিলাম ছবি সত্যায়িত করাতে। তার ইউনিটের (সেনাদল) সৈনিক বা অফিসারদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে ২য় বিশ্বযুদ্ধের চলচিত্রে অভিনয় করা জার্মানদের হাতে মার খাওয়া পলায়নপর সৈনিকের ভুমিকায় অভিনয় করছে তারা।
তাদের মনোবলও ছিল লক্ষ্য করার মতো নীচু। তাদের চলাফেরা, ওঠা বসা দাঁড়িয়ে থাকার ধরনের মধ্যে কেমন যেন পুলিশিয় ভাব চলে এসেছিল। গাল, ঘাড়, মাথা চুলকানো, চোদ্দ ব্যাকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, যেখানে সেখানে শব্দ করে থুতু ফেলা এসবও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। জে সি ওদের (সুবেদার, নায়েব সুবেদার ইত্যাদি) ও অফিসারদের কারো কারো ছিল নোয়াপাতি থেকে মাঝারী আকারের ভূঁড়ি।
অন্যদিকে জে আর বি (জাতীয় রক্ষী বাহিনী)র প্রতিটি সদস্য ছিল যেন খাপ খোলা তলোয়ার। ঋজু, বলিষ্ঠ, ভর পেট খাওয়া ( well fed), পেশী বহুল এবং অকল্পনীয় ভাবে সুশৃংখল। বংগবন্ধুর হত্যার পর পরই রক্ষী বাহিনীর সব লিডারদের {অফিসার, একই পরীক্ষা দিয়ে যারা সবচে' ভাল করতো তাদের লিডার, তারপরের কিছু ডেপুটি লিডার (সুবেদার সমপর্যারের), তার পরের কিছু এ্যাসিসট্যান্ট লিডার (হাবিলদার সমপর্যারের) এবং ফেল্টুগুলো হ'ত সাধারন সদস্য (সৈনিক), জে আর বি র লিডারদের রাতারাতি সেনাবাহিনীর অফিসার বানানোয় নিয়মিত সেনা অফিসারদের চাপা ক্ষোভ আমি '৭৮ থকে '৯৪ পর্যন্ত লক্ষ্য করেছি } ঢাকায় তলব করা হয়। তখন সুন্দরবনে সর্বহারা সংহারে নিয়োজিত জেআরবির একটি দল (unit), গহীন বনে আড়াই মাস বিনা রসদে ডিউটি করেছে, শুধু লিডারের নতুন আদেশ না পাওয়াতে।
যদিও আমি কেডেট কলেজে পড়ার সুবাদে সেনা বাহিনীর সাথে সম্পর্কিত ছিলাম , তবুও সেনা বাহিনী ও পুলিশের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করতে পারতাম না। জেআরবি ছিল শৃংখলা, তারুন্য আর আতংকের প্রতীক। অনেকটা র্যাবের মত। এখন যেভাবে আমরা র্যাবকে দিয়ে বিচার বহির্ভুত, রাষ্ট্র সমর্থিত হত্যা ও সন্ত্রাস (state sponsored terrorism) চালাই ঠিক সে ভাবেই জেআরবি দিয়ে জাসদ (শ্রেনীহীন, সৃষ্টিকর্তাহীন সমাজ কায়েমে বদ্ধ পরিকর) ও সর্বহারাদের নিশ্চিহ্ন করাতেই মূলত নিয়োজিত ছিল জেআরবি। জাসদ তুল্য কোন উদাহরন না দিতে পারলেও সর্বহারাদেরটা পারবো। পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি ও এ জাতীয় বেশ কিছু মাটির নীচে থাকা দল অধ্যুষিত এলাকায় যারা থাকেন তারা বিনা চেষ্টাতেই সর্বহারা পার্টির সেকালের রূপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পারবেন।
১৯৭৪ আসতে আসতে রক্ষী বাহিনী ভীতি চরমে ওঠে। এমনকি তখন যারা ত্যাদোড় শিশু তাদেরকেও মারা "ঘুমাও নয় তো রক্ষী আসবে" বলে ঘুম পাড়াতো বলে শুনেছি। এর মধ্যেই জারিকৃত "জাতীয় রক্ষী বাহিনী এ্যাক্ট, ১৯৭২" তে সংশোধন করে রক্ষী বাহিনীকে আরো সুসংহত করা করা হয়।
আমদের যাদের বাড়ি ছিল চিটাগাংএর উত্তরে তারা কলেজ থেকে বাড়ি যেতাম কলেজ কর্তৃপক্ষের সংরক্ষিত রেলগাড়ীর রিজার্ভ করা বগীতে। স্বাধীনতার পর সবাই স্বাধীন হয়ে গেল। সংরক্ষিত বগীতে যে কেউ যে কোন স্টেশনে ঢুকে পড়তো। আমাদের সাইজগুলো সবাইকে অনুপ্রাণিত করতো আমাদের আসনগুলো দখল করতে। কুমিল্লা পার হতে না হতে আমরা সব দাঁড়িয়ে থাকা আসনহীন যাত্রী হয়ে যেতাম। আমাদের বন্ধু নারায়নগন্জের উঠতি মাস্তান (এবং আমাদের চেয়ে এক মাথা উঁচু) ইসমাত একটা বুদ্ধি বের করলো। সে ফেনী থেকে দু'জন সেনাবাহিনীর সৈনিক উঠালো আমাদের কমপার্টমেন্টে। বসালো দু' দরজার ধারে। লাকসাম রেল স্টেশনে গাড়ি থামতে না থামতেই জনগণ আমাদের কামরায় উঠে পড়লো। সেনা সদস্যের নিষেধ অবজ্ঞা করে। কিছুক্ষণ পর দেখি সৈনিকদ্বয় আমাদের মতই দাড়িয়ে আছে। ইসমাত হাল ছাড়বার পাত্র নয়। দুজন রক্ষী রেলগাড়ির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত দৌড়াচ্ছিল, ট্রেনে ওঠার জন্যে । আমাদের কমপার্টমেন্টে "সংরক্ষিত" লেবেল ঝোলানো দেখে ঢুকছিল না।
ইসমাত ওদেরকে অনেক সাধ্য সাধনা করে ভেতরে নিয়ে এল।
পানির ওপর ভাসমান কর্পূরের মাঝখানে যদি একটুকরো সাবান আলতো করে ছোঁয়ান তা'লে যা হয় তাই হ'ল। মূহুর্তের মধ্যে আমাদের কামরা খালি হয়ে গেল।
কিছু কিছু জনগন, জরূরী নির্গমনের পথ হিসেবে কামরার জানালাগুলোও ব্যাবহার করলো।
ওদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থা করুণ থেকে করুণতরো হতে থাকে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার ছিল সেনা বাহিনীর (এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর ) টি ও ই (Table of Organization & Equipment) আইন আকারে পাশ করা হচ্ছিল না, বছর বছর সরকারী (রাষ্ট্রপতির) আদেশে অস্থায়ীভাবে বাহিনীটির কিছুদিনের জন্যে আয়ু বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। এই টি ও ই র মাধ্যমেই একটা বাহিনী তার বেতন, ভাতা, রসদ, অস্ত্র , গোলাবারুদ ও সরন্জামের বৈধতা পেয়ে থাকে। একট আহত বাঘকে না মেরে যদি ফেলে রাখা হয় তা'লে যা হবার কথা ঠিক তাই ঘটে কিছুদিন পরে।
ওপরের পরিচ্ছদের বর্ণনার বিষয়গুলো ছিল সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত।
আজও যেমন র্যাবের সমর্থকের অভাব হয়না, সে সময়ও রক্ষী বাহিনীর সমর্থকের অভাব হয়নি। তবে বিচার বহির্ভুত হত্যা যে ঠান্ডা খুন ছাড়া আর কিছুই না, তাকে যে কোনভাবেই মহিমাময় করা যায়না, আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে স্থান নেয়া রক্ষী বাহিনীর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
তাদের গৌরবের কিছুই নেই।
ম্যান সেরু মিয়া
ওপরের মানুষটির মন্ত্রীত্ব যখনও (সম্ভবতঃ) শেষ হয়নি তখন বাজারে একটি গুজব ছড়ানো হয়। চিটাগাংএ ধরা পড়ে চোরাচালানের বিশাল এক সম্ভার। শোনা যেতে থাকে ম্যান সেরু মিয়া বলে এক চোরাচালানীর মাল সে সব। তার ক'দিন পরই ছড়িয়ে পড়ে গুজব - তাজুদ্দিন আহমদই হচ্ছেন ম্যান সেরু মিয়া। তবে যারা এই গুজবটা ছড়িয়েছিল তারা খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। তাজুদ্দিন আহমদের স্পার্টিয় (Spartan) জীবন যাপন, হিন্দু বিধবাদের মত খাওয়া দাওয়া তখন ঢাকার রসালো আলোচ্য বিষয় ছিল। কেউই ব্যাপারটা আমলে নেয় নি।
DROPPING OFF THE SKIPPER
একদিন সন্ধ্যায় বাবাকে তলব করেন বংগ বন্ধু। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে তাঁর সংগী হই। বংগবন্ধু নীচের বৈঠকখানায় বসে আছেন। তার ডানে বসা খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, বাঁয়ে শেখ ফজলুল হক মণি। ঠিক উল্টো দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছেন নিঃসংগ সারথী। যিনি কোন এক ভুলে যাওয়া সুদূর অতীতে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের কথাও ভুলে গ্যাছি আমরা।
বত্রিশ নম্বরের গেট দিয়ে বেরুতে বেরুতে বাবা স্বগোতোক্তি করলেন "We are dropping off the skipper, we are heading for a big trouble" (আমরা জাহাজের কান্ডারীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতে যাচ্ছি, আমরা ধাবিত হচ্ছি বিরাট বিপদের দিকে)।
সেদিন বাবাকে বংগবন্ধু নির্দেশ দিলেন দেড় মাস সময়ের মধ্যে BMTF (Bangladesh Machine Tools Factory) থকে ৭,০০০ সেচ পাম্প তৈরি করে BADC (Bangladesh Agricultural Development Corporation) সরবরাহ করতে।
আদেশটা পালন করা ছিল পুরোপুরি অসম্ভব এক ব্যাপার।
বাবা কাঁথা বালিশ নিয়ে জয়দেবপুর গমন করলেন।
-চলবে
আগামীকাল, পরশু এবং ২১ ফেব্রুয়ারীতে কোন পর্ব বেরুবেনা বলে দুঃখিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪০