
আসাদ গেট আড়ং-এর সামনে আজকে গাজরা পাওয়া গেল না, নওরিতার মেজাজ খুবই খারাপ। এখন আবার সেই কাঁটাবন যেতে হবে। ভ্রু কুঁচকে অলকের দিকে তাকায় নওরিতা। যেন আসাদগেটে গাজরা না পাওয়ার পেছনে অলকের হাত ছিলো! অকলের দেরি করে আসা একটা কারণ বটে, তবে অলক নওরিতাকে আশ্বস্ত করে বলে,' চলো শাহবাগ যাই, কাঁটাবন কিংবা শাহবাগ মোড়ে নিশ্চই গাজরা পাবো, মন খারাপ করার কি আছে ?'
- ক'টা বাজে ঘড়ি দেখেছো? এখন শাহবাগ গেলে আমি শাড়ি কিনবো কোন সময়? ভাবলাম আসাদ গেট থেকে গাজরা কিনে কাছাকাছি বুটিক হাউজগুলো থেকে একটা লাল পাড়ের শাড়ি কিনবো। নাহ্ আজকেও তোমার দেরি করে আসতে হলো!
ঝাড়ি খেয়ে অলক ট্যাক্সি ডাকতে গেলে নওরিতা থামায়।
- ট্যাক্সি লাগবে না, রিক্সা করে যাবো।
- এই না বললে দেরি হয়েছে, এখন আবার ট্যাক্সিতে যেতে চাইছ না যে?
- তোমার কি ধারণা তোমার সঙ্গে শপিং করতেই আমি বের হয়েছি? রিক্সা করে গেলে যদি দেরিও হয় আমি রিক্সাতেই যাবো। তোমার আপত্তি থাকলে তুমি ট্যাক্সিতে যাও।
কাঁটাবনের যে ক'টা ফুলের দোকান আছে সবগুলোতেই গাজরা শেষ। পহেলা বৈশাখের আগের দিন এমন আকাল হবে জানলে তো আগেই কিনে রাখা যেত। অলক এবার খানিকটা ভয়ে ভয়ে বলে, চলো শাহবাগ গিয়ে দেখি ...
নওরিতার অগ্নিমূর্তি ধীরে ধীরে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, আর সেই উত্তাপে অলকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যায়।
শাহবাগে গাজরা পাওয়া না গেলেও রজনীগন্ধার গাজরা পাওয়া গেল, কিন্তু নওরিতা খুঁজছিলো কাঠবেলীতে তৈরি গাজরা। কাঠবেলী গাজরাগুলো খোপায় খুব ভালো মানায়, একদম মিশে থাকে।
- স্যার গাজরা শেষ. দুইটা রজনী গাজরা আছে, লইয়্যা লন, পরে এইডিও পাইবেননা।
বিক্রেতার কথা শুনে অলক নওরিতা একে অপরের মুখ দেখাদেখি করে। রজনী গাজরা নিয়েই নওরিতাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
গাজরা কিনে ধানমন্ডির একটা বুটিক হাউজে ঢুকে অলকের বেশ ভালো লাগলো, এই হাউজের সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় বিক্রি হয়, 'কাপল হাউজ' শাড়ী কিনলে সেটার সাথে ম্যাচিং করে পাঞ্জাবিও কিনতে হয়। নওরিতা একটা শাড়ি পছন্দ করে। সাদা জমিনে লাল আর সবুজ রঙের কম্বিনেশনে ব্রাশ করে একটা প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করা হয়েছে। বেশ পছন্দ হলো নওরিতার। যদিও দাম বেশ খানিকটা বেশি, মনে হচ্ছে আগুন দাম!
সকাল বেলা অলকের মেসেজে ঘুম ভাঙলো নওরিতার।
'এসো নীপো বনে... ছায়াবিথী তলে এসে ...করো স্নান , নবধারা জলে, এসো নীপ বনে' ... শুভ নববর্ষ। বাংলায় লেখা অলকের প্রথম এসএমএস পেয়ে নওরিতা ঠিক যতোটা চঞ্চল হয়েছিলো অলকের দ্বিতীয় মেসেজটা পেয়ে ততোটাই চুপসে গেলো সে।
নওরিতার লালচে মুখটা ক্রমেই রক্তিম হয়ে উঠে, ফ্রিজ থেকে বের করা গাজরা গুলো টেনে টেনে ছিড়ে ফেলে নওরিতা।
বৈসাবি উৎসব সম্পর্কে অলকের ধারণা শুধু খবরের কাগজ পড়েই, কখনও নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, গত রাতে শাহনুর ভাইয়ের এমন লোভনীয় প্রস্তাব ফেলতে পারেনি অলক। তপন ভাই আর শাহনুর ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই হলের ছাত্র, তপন ভাইয়ের পোস্টিং কাপ্তাই ফরেস্টে। এই মাসেই ওনার ট্রেনিং শেষ, তাই ফিরে আসার আগে বৈসাবি উৎসব দেখার লোভনীয় প্রস্তাব এলে অলক সেটা অগ্রাহ্য করতে পারে না। শাহনূর ভাই অবশ্য নওরিতাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় অলকের সাথে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে নওরিতার বাবার অনুমতির ব্যপারটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলেই অলকের হঠাৎ করেই স্বার্থপর হতে হলো।
পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদীবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি। ত্রিপুরা শব্দ 'বৈষৃ' থেকে 'বৈ', মারমা শব্দ 'সাংগ্রাই' থেকে 'সা',চাকমা ও তঞ্চঙ্গা শব্দ 'বিজু' থেকে 'বি', তিন জাতির ভাষার সংমিশ্রনণ হয়েছে 'বৈসাবি'। সাংগ্রাই উৎসবের প্রধাণ আকর্ষণই হলো জলকেলী খেলা, মারমাদের লোককাহিনী অনুসারে, অনেকের ধারণা ব্রহ্মরাজা সাগ্রা মাং প্রতি বছর একবার তার স্বর্গীয় রাজ্য হতে পৃথিবীর মানুষের আচরণ পরিদর্শনে নামেন। রাজার সম্মানে বছরের এই দিনটিতে তাই সবাই নিজেকে পবিত্র করে সাজায়। তরুণ তরুণীরা একে অপরকে জল ছিটিয়ে দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়, তাদের ধারণা এই জল তাদের পবিত্র করে তুলবে। মুছে যাবে অতীতের সব কালিমা, আর ব্রহ্মরাজা ভক্তদের এই আচরণের হিসাব পরলৌকিক বিচারের সময়, ভাগ্য লিপিতে উপস্থাপন করবেন।
কাপ্তাইয়ের গভীর অরণ্য যেখানে অলকরা বৈসাবি উৎসব দেখতে গিয়েছিলো সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিলোনা। তাই নওরিতার সঙ্গে কথা বলতে হলো ফিরে আসার দিন। দুই দিন নওরিতার ফোন যথারীতি বন্ধ। নিরুপায় হয়ে অলক ল্যান্ড লাইনে ফোন ঘুরায়। চারবার নিশ্চুপ থেকে অলক নওরিতার কণ্ঠ শুনতে পায়নি। পঞ্চমবারের চেষ্টায় নওরিতার কণ্ঠ শোনা গেলো।
- ফোন ধরছো না কেন?
- তুমি ফোন করছ বুঝতে পেরেছি বলেই ধরছিনা।
- এখন ধরলে যে?
- তুমি বেহায়া ফোন ধরছিনা জেনেও যে বার বার ফোন করছ সেই জন্য ধরেছি,
আবেগী স্বরে কথাগুলো বলতে নওরিতার কণ্ঠ কেঁপে যায়।
- আহা, শুনোই না আগে ...
- কি শুনবো? পাহাড়ী মেয়েদের নাচের গল্প, না গোসলের গল্প? পাহাড়ি ফর্সা মেয়েদের গায়ে ছেলেরা পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল, আর তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে সেই দৃশ্য গিলছিলে, সেই গল্প করবে তো? আমি মোটেও এই গল্প শূনতে আগ্রহী না।
-
নওরিতা ফোন রেখে দেয়। অলক আবারও ফোন করে
- নওরিতা, প্লিজ। তুমি যখন ছবিগুলো দেখবে, তোমারও ভালো লাগবে।
নওরিতা আবারও ফোন রেখে দেয়। অলক অনেক চেষ্টা করে গেল। কিন্তু নওরিতা একদমই ফোন তুলছে না।
হঠাৎ অলকের মোবাইলে নওরিতার জমে থাকা এসএমএস গুলো একে একে আসতে থাকে। এরমধ্যে একটি এসএমএস ছিল এইরকম ...
"তুমি অনেক স্বার্থপর অলক, অনেক স্বার্থপর"
ছবি কৃতজ্ঞতা : বিপ্লব রহমান।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১১:৩৫