بسم الله الرحمن الرحيم
মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৪
গত দুই পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত দুইটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ প্রমাণ করেছিলাম। যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই দুটি হাদীসই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত।
কিন্তু শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আরও সহীহ বা হাসান হাদীছ বিদ্যমান। এই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব।
তৃতীয় হাদীছ (حسن)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রঃ) থেকে বর্ণিত রসূল (সঃ) বলেছেন, শা’বানের পনের তারিখ রাতে মহান আল্লাহ স্বীয় সৃষ্টিজীবের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং নিজ বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তবে দু’জন ব্যতীত। হিংসুক এবং অন্যায়ভাবে হত্যাকারী।
উক্ত হাদীসটিঃ
১। ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে
২। ইমাম মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীব
৩। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদ
৪। শায়খ আলবানী তাঁর সিলসিলাতুল আহাদিসাস সহীহা
সংকলন করেছেন।
এ হাদীছ সম্পর্কে হাদীছ বিশারদগণের উক্তিঃ
প্রথম উক্তিঃ
আল মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেছেনঃ হাদীছটি ইমাম আহমদ (রহঃ) লায়্যিন (শিথীল) সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন।
( আত তারগীব ওয়াত তারহীবঃ খ-৪, পৃ-২৩৯ )
দ্বিতীয় উক্তিঃ
আল হাইসামী বলেনঃ হাদীছটি ইমাম আহমদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন। তার সনদে ইবনু লাহীআহ নামক জনৈক রাবী রয়েছেন, হাদীছে তার নির্ভরযোগ্যতা দুর্বল। এছাড়া উক্ত হাদীছের অবশিষ্ট রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )
হাফিয আল হাইসামী এর এই উক্তি দ্বারা বুঝা যায় যে, উক্ত হাদীছের সনদে ইবনু লাহীআহ ব্যতীত অন্যান্য সকল রাবী ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য। শুধু মাত্র ইবনু লাহীআহ সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণ প্রশ্ন তুলেছেন।
কে ইবনু লাহীআহ, নিম্নে তার পরিচয় এবং মুহাদ্দিছদের দৃষ্টিতে হাদীছ শাস্ত্রে তার অবস্থানও আলোকপাত করা হলোঃ
ইবনু লাহীআহ সম্পর্কে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্যঃ
আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীআহ ইবনে আকবাহ ইবনু ফাআন ইবনু সাওবান আল হাযরামী হাদীছ শাস্ত্রের একজন রাবী।
১। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসাঈ প্রমুখও তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
( অতএব, যারা ইবনু লাহীআহকে দুর্বল মনে করে এই হাদীসকে দুর্বল বলে রায় দেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের মতানুসারে তাহলে তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে ইবনু লাহীআহ কর্তৃক বর্ণনাকৃত হাদীসও দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাদের কাউকেই তো কখনো বুখারী শরীফের কোন হাদীসকে দুর্বল বলতে শুনি নি !! )
২। ইবনু সালাহ বলেনঃ ইবনু লাহীআহ বাহাত্তর জন তাবিঈর সাক্ষাত লাভ করেছেন।
( দেখুনঃ ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীবঃ ৫ম খঃ পৃঃ ৩২৭-৩২৮ )
৩। কোন কোন কট্টরপন্থী হাদীছ বিশারদ যেমনঃ ইবনু মঈন, আলী ইবনুল মাদীনী প্রমূখের মতে ইবনু লাহীআহ একজন দুর্বল রাবী। যথা এ সুবাদে ইবনু মঈন এর বক্তব্য হচ্ছেঃ
“ ইবনু লাহীআহ একজন যঈফ রাবী। তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে না। ”
( দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-২১; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৫ )
৪। আর আলী ইবনুল মাদীনী তাঁর সম্পর্কে বলেছেনঃ
“ আমাকে বিশর ইবনুস সিররী বলেছেনঃ যদি তুমি ইবনু লাহীআহকে দেখতে তাহলে তার প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে না। ”
( দেখুনঃ তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৬ )
৫। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস ইবনু লাহীআহকে ছিক্বাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
যেমনঃ ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেনঃ
“ অধিক হাদীছ বর্ণনা, সংরক্ষণ এবং নিখুঁত হাদীছের ক্ষেত্রে মিশরে ইবনু লাহীআহ এর সমকক্ষ আর কে হতে পারে? ”
( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-১৩; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৭; তাযকিরাতুল হুফফাজঃ খ-১, পৃ-২৩৮ )
৬। ইমাম ছওরী (রহঃ) বলেনঃ
“ ইবনু লাহীআহ এর কাছে রয়েছে হাদীছশাস্ত্রের মূলনীতি আর আমাদের কাছে রয়েছে শাখা-প্রশাখা। ”
( তাযকিরাতুল হুফফাজঃ খ-১, পৃ-২৩৯; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩২৬; সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-১৩ )
৭। ইবনু ওহাব বলেনঃ
“ আল্লাহর কসম, আমাকে সৎ ও সত্যবাদী আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীআহ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ”
( মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৭; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩২৬ )
৮। আহমদ ইবনু সালেহ বলেনঃ
“ ইবনু লাহীআহ ছিক্বাহ। তাঁর বর্ণিত যেসব হাদীছে মিশ্রণ রয়েছে সেই মিশ্রণকে প্রত্যাখান করা হবে। ”
( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১ )
সারকথাঃ
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন কোন কট্টরপন্থী মুহাদ্দিছ ইবনু লাহীআহকে দুর্বল আখ্যায়িত করলেও কিন্তু তাঁর দুর্বলতা এই পর্যায়ে নয় যে, তাঁর বর্ণিত হাদীছ একেবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। উপরন্তু বহু মুহাদ্দিছ তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন এবং তাঁর বর্ণিত হাদীছকে ‘হাসান’ স্তরের বিবেচনা করেছেন।
যেমনঃ হাফিয হাইসামী (রহঃ) বলেনঃ
“ … এখানে ইবনু লাহীআহ নামক একজন রাবী রয়েছে। একাধিক মুহাদ্দিছ তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-১, পৃ-১৬ )
অন্যত্র তিনি লিখেনঃ
“ … হাদীছটি ইবনু লাহীআহ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তবুও তার হাদীছ হাসান। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-১০২ )
( উল্লেখ্য এ দুর্বলতা, রাবী দুর্বল হওয়ার জন্য যে দুর্বলতা লাগে তা নয়, বরং যে দুর্বলতা সহীহ হাদীস ও হাসান হাদীসের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে, তা। এজন্যই অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ তাঁর হাদীছ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসকে হাসান বলেছেন। )
পর্যালোচনাঃ
শবে বরাত সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর এর উল্লেখিত হাদীছটির সনদে ইবনু লাহীআহ থাকায় যদিও কোন কোন মুহাদ্দিছ হাদীছটিকে অনির্ভরযোগ্য হাদীছ হিসেবে রায় প্রদান করেছেন। কিন্তু এ রায়টি সঠিক নয়, কারণ হাফিয হাইসামী এর উল্লেখিত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ইবনু লাহীআহ এর বর্ণনাকৃত হাদীছ হাসান পর্যায়ের। সুতরাং শবে বরাত সম্পর্কীয় উক্ত হাদীছটিও হাসান হিসেবেই বিবেচিত হবে। আর এ ধরণের হাদীছ শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। অতএব ফাযাইলে আমালের ক্ষেত্রে তো গ্রহণযোগ্য হবেই।
তৃতীয় উক্তিঃ
বর্তমানকালের হাদীছ পর্যালোচক আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানীও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর এর উক্ত হাদীছটিকে হাসান হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তাঁর ভাষায়ঃ
“ হাদীছটি সূত্রের দিক দিয়ে অগ্রহণযোগ্য নয়। (বিশেষ করে অন্য হাদীছের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়ার কারণে) এবং হাইছামী বলেছেনঃ ইবনু লাহীআহ অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া হাদীছটির বাকী রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। আর মুনযিরী বলেছেনঃ তাঁর সনদ অনির্ভরযোগ্য। আর আমি বলি, রশীদ ইবনু সাদ ইবনু হাই হাদীছটিকে সমর্থন করেছেন। ইবনু হাইওয়িয়াহ স্বীয় হাদীছে এটিকে পেশ করেছেন। সুতরাং হাদীছটি হাসান। ”
( সিলসিলাতুল আহাদিসাস সহীহাঃ খ-৩, পৃ-১৩৬ )
চতুর্থ উক্তিঃ
সময়কালের হাদীছ পর্যালোচক মুহাক্কিক শায়খ যাগলূল বলেনঃ
“ হায়ছামী আলোচ্য হাদীছটিকে মুসনাদে আহমদ হতে বর্ণনা করে বলেন, এর সূত্রে ইবনু লাহীআহ আছেন। যিনি হাদীছের ব্যাপারে দুর্বল। অন্য সকল রাবী নির্ভরযোগ্য এবং শায়খ আলবানী বলেন, হাদীছটি হাসান (তথা সহীহ) এবং ইবনু লাহীআহকে হাফেজ আসকালানী সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য বলেছেন। কাজী আল মিসরী বলেন, হাদীছটি ইবনে লাহীআহ এর দুর্বলতার কারণে সহীহের স্তরে পৌঁছেনি। বরং সেটি হাসান হিসেবে সাব্যস্ত। ”
( দেখুনঃ শরহে আলফিয়্যাতুল ইরাক্বীঃ খ-১, পৃ-২২০ )
পঞ্চম উক্তিঃ
মুসনাদে আহমদে উল্লেখিত উক্ত হাদীছ সম্পর্কে শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত এভাবে মন্তব্য করেনঃ
“ হাদীছটি অন্যান্য হাদীছের সহযোগিতায় সহীহের স্তরে পৌঁছেছে। সহযোগী হাদীছগুলো প্রত্যেকটি সূত্রের দিক দিয়ে সমস্যা থাকলেও সবগুলোর সমষ্টি হাদীছটিকে সহীহ ও শক্তিশালী করে তুলেছে। ”
( মুসনাদা আহমদঃ খ-১১, পৃ-২০৭ )
সার কথাঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছটি হাসানের অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ এই হাদীসটিকে হাসান হওয়ার ব্যাপারে সত্যায়ন করেছেন। তাই শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত এই হাদীসটিকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।
আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
প্রথমত, উপরে বর্ণিত হাদীসটির সনদ নিজে থেকেই হাসান পর্যায়ের।
দ্বিতীয়ত, হাদীসটির সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীসটি হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে।
অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসরাই এই হাদীসের তাহকীক করেছেন এবং একে হাসান বলেছেন।
অন্যদিকে হাদীসের তাহকিক তথা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সালাফী/আহলে হাদীছ ভাইরা যার সবচেয়ে বেশি ভক্ত, যার কিতবাদি অনুবাদ করে আপনারা প্রচার করে থাকেন, সময়কালের বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ নাসিরউদ্দীন আলবানীও (রহঃ) শবে বরাতের এই হাদীসকে হাসান বলেছেন।
আবার তাঁরই শিষ্য বর্তমান যুগের খ্যাতিমান হাদীছ পর্যালোচক শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্বও এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
এমনকি এ হাদীসটিকে আপনাদের সবচেয়ে বড় গণ্যমান্য ইমাম, শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া তদীয় “ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম লি মুখালাফাতি আসহাবিল জাহীম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং বর্ণনাকারীগণকে বিশ্বস্ত বলেছেন।
তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন আপনারা বার বার বলেন যে, শবে বরাতের ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই ??
এখন সালাফী বা আহলের হাদীসের ঐসব বন্ধুদের প্রতি দাওয়াত রইল, আপনারা আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। আমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের (রহঃ) অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন না। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?
আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
শেষ কথাঃ
যদি অন্যান্য রাতের উপর এ রাতের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই থাকবে, তবে বিশেষভাবে এই রাতের কথা উল্লেখ করারই বা কি প্রয়োজন ? শুধু এই রাতকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই অন্যান্য রাতের উপর এর বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়।
উপরের হাদীস থেকে স্পষ্টতই এটা প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রে আল্লাহ পাক তাঁর বিপুল সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন। যে রাত্রে আল্লাহ বিশেষভাবে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন, সেই রাতে কাকুতি মিনতি করে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা বা যে কোন দোয়া করার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কোন ভাল আমলের মাধ্যমে দোয়াটিকে শক্ত করা যাতে দ্রুত কবুল হয়। বুখারী শরীফের তিন জন যুবকের কাহিনী হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যারা পাহাড়ের গুহাতে আটকা পড়ে গিয়েছিল। পরে একজনের পরামর্শে প্রত্যেকের ভাল আমল উল্লেখ করে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মুক্ত করেন। তাছাড়া অনেক হাদীসেই নফল নামায পড়ে দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করে দোয়া করা, জিকির আযকার করে দোয়া করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং মধ্য শাবানের এই রাতে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সালাত, যিকির, কোরআন তিলাওয়াত করাও প্রমাণিত হয়। এরপরও যদি কেউ বলে থাকেন যে, এই রাতে কোন ইবাদত করা যাবে না, তাহলে তা তার নিজের মনগড়া কথা বা প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়।
এজন্যই বহু ইমামগণই এ রাতের নফল ইবাদত করাকে মুস্তাহাব বলেছেন এবং নিজেরাও বেশি বেশি ইবাদতে লিপ্ত ছিলেন। যেমনঃ ইমাম শাফিঈ, ইমাম নববী, ইমাম বাযযার, ইমাম উকায়লী, ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সহ আরও অনেকে যার বিবরণ সামনে আরও আসবে ইনশাল্লাহ।
অতএব, যারা এ কথা বলে থাকেন যে, শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই, এর ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই, তারা রসূলের (সঃ) হাদীসের নামে মিথ্যাচার করেন এবং উম্মতকে রসূল (সঃ) এর সুন্নত ও নেক আমল থেকে দূরে সরে রাখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই।
এরকম একটি ফযীলতপূর্ণ রাত পেয়েও যে ইবাদতে কাটাতে পারল না, সে চরম দুর্ভাগা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
এই আয়াত থেকেই বুঝা যায়, আমাদের বেশি বেশি ইবাদত করা প্রয়োজন। উপরন্তু যদি ফযীলতপূর্ণ রাত পাওয়া যায়, তাহলে বেশি বেশি ফযীলত পাওয়ার জন্য ঐ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
( চলবে ইনশাল্লাহ )
( পররর্তী পর্বঃ হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৫ )
১১ তম পর্বঃ