somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঞ্চিত পিতার শেষ চিঠি

১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তুমি কেমন আছ একথা জিজ্ঞাসা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে করছি। তুমি ভাবছ হয়ত তোমার বাবা আগের মত তোমায় ভালোবাসে না। যদি এটা ভেবে থাক তবে তোমার সেই ছোট্টবেলার মত আরেকটি ভুল করলে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তুমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো আছ কেননা আমার দোয়া যার সাথে সর্বদা জড়িয়ে থাকে সে খারাপ থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করিনা। আমরা বউমা এবং প্রিয় দাদুভাইয়েরাও ভালো আছে বলে বিশ্বাস। আমি কোন মেয়ের বাবা হতে না পারলেও তোমাকে বিবাহ দিয়ে যে লক্ষ্মী বউমাকে পেয়েছিলাম তাকে কোনভাবেই কষ্ট দিবে না। লক্ষ্মী মেয়েটি আমার মেয়ের শুণ্যস্থান পুর্ণ করে দিয়েছে! আমার নাতী-নাতনীদের অনেক অনেক আদর দিও এবং তাদের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখবে না। তোমার হতভাগ্য-হতদরিদ্র জন্মদাতা তোমার চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারেনি কিন্তু তুমি তো গরীব নও। সুতরাং ছেলে-মেয়ের কোন শখ যেন অপূর্ণ না থাকে। তোমাদের দোয়ায় আমিও অনেক ভালো আছি। পাশের রুমের গণি মিয়া আমার সূখ দেখে ঈর্ষা করে কেননা তুমি প্রতি বছর দু’ইবার আমার কাছে ছুটে আস। তোমার ব্যস্ততা রেখে তোমাকে আসতে বারবার নিষেধ করি তারপরও তুমি কেন আস তা আমি বুঝতে পারি না। এটা ভেবোনা যে, তুমি না আসলে আমি তোমায় ভুলে যাব কিংবা কম দোয়া করবো বরং তোমাদের প্রতি দোয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কেননা দিন দিন যেভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছি তাতে আমার পৃথিবীটা সংকুচিত হতে হতে আমার এক চোখ ভাঙা চশমাটির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফসুস বেচারা গণি মিঞার জন্য! ওর সন্তানগুলো ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর একবারও খোঁজ নেয়নি; শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া।

প্রিয় পুত্রধন! জীবন সায়াহ্নে এসে বারবার অনুশোচনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথাও যেন আমি চরম ভুল করেছি। তোমাকে লালন-পালন করতে গিয়ে কোথায় যেন আমি আমার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারিনি। তোমার মা আর আমি তোমাকে বাইরে রেখে জীবনের কোন পরিকল্পনা সাজাই নি অথচ আজ যেন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। তোমার কাছে হয়ত এটাই আমার শেষ চিঠি তাই কিছু কথা বলে যাওয়া আবশ্যক। এত তাড়াতাড়ি মরে যাবো সেটা মনে হচ্ছে না কেননা আমি চাইলেই তো আর মৃত্যু আমাকে ধরা দেবে না কিন্তু লিখতে বসলে চোখ যেভাবে ঝাপসা হয়ে আসে, হাত যেভাবে কাঁপতে শুরু করে কিংবা মস্তিষ্ক যেভাবে আমার বিরুদ্ধাচারণ করে তাতে তোমাকে আর লিখতে পারবো বলে মনে হয়না। তাই জীবনের শেষ কথাগুলো আজকেই বলে দিব। ভেবোনা, আমি তোমাকে কৈফিয়তের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবো। মরন সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, সন্তান হিসেব তুমি ‍সুসন্তানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও আমি পিতা হিসেবে মোটেও সফল নই। বৃদ্ধাশ্র্রম নিয়ে সমাজে বহু ধরণের খারাপ কথা প্রচলিত থাকলেও আমি সেটা মনে করিনা। তুমি আমাকে জোড় করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাও নি বরং আমিই তোমার চোখের জলের বিরুদ্ধাচারণ করে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আব্বু, তোমার হয়ত মনে নাই কিন্তু শুধু তোমার লেখাপড়ায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেই কথা ভেবে আমার পক্ষের প্রায় সকল আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক শিথিল করে ফেলেছিলাম। তোমার মা তোমার নানা-নানীর একমাত্র মেয়ে হয়েও তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল শুধু তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায়। আমি এবং তোমার মা-আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছি। দেশের মাত্র কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম যদি উচ্চারিত হয় তবে সেখানে আমাদের সোনমানিকের নামটিও উচ্চারিত হয়। এটা কি আমাদের কম আনন্দের-কম পাওয়া। এত হিসেব করে তোমাকে মানুষের মত মানুষ করা এই বৃদ্ধ যদি আজ আমার দাদুভাইদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অন্তরায় ঘটায় তবে সেটা বেমানান বটে!

এখানে যে ছেলেটা আমাদের দেখাশুনা করে সে ছেলেটার মত ছেলে খুব কম দেখা যায়। ওর সম্পর্কে বললে তোমার মনে হবে এই জগতেও এমন বোকা ছেলে আছে! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কাকা! কিছু লাগবে? ওর আচরণে তোমার অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যের শূন্যতা কেমন যেন পূণ্য হয়ে যায়। ছেলেটা খুব গরীব। দিনরাত পরিশ্রম করে এখান থেকে যা মাইনে পায় তা দিয়েই ওর বাবা-মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি; আমার মত অক্ষম-অলসের এর বাইরে তো আর কোন কাজ থাকে না। আমার ইচ্ছা হয় ওকে কিছু বাড়তি টাকা দেই। কিন্তু আমার সে সাধ্য তো নাই। ছেলেটাকে বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে। এ কথাশুনে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেছে, রক্ত বিক্রি করে হলেও বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখবে; কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমে দিবে না। ছেলেটার কথা শুনে ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্ষণিক পরেই বুঝলাম আমি হয়ত আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছি! তাই এ নিয়ে আর ও ছেলেটার কাছে কিছু বলতে যাইনি। অল্পশিক্ষিত একটি ছেলে তার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবছে সেটা কেবল আবেগের কথা! তোমরা যারা উচ্চশিক্ষিত তারা আবেগকে প্রশ্রয় দিবে কেন?

আব্বু! আগামী বার আমাকে যদি দেখতে আসো তবে আমার কলিজারটুকরো প্রাণপ্রিয় দাদুভাইদের নিয়ে এসো। আমি দেখতে চেয়েছি শুনলে ওরা আসতে চাইবে। বউমাকে এতদূর আনার দরকার নাই। মামনী আমার গরম সহ্য করতে পারে না। জানি দাদুভাইদেরও কষ্ট হবে। কিন্তু জীবনে এই শেষবার। আর কোনদিন ওদের দেখতে চাইবো না বলে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না কেননা দিন যত সামনে এগুচ্ছে ততোই আমার আচরণগুলো শিশুদের মত হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে যদি কখনো দাদুভাই কিংবা বউমাকে দেখতে চাই তবে সেটা আমার শিশু সূলভ খামখেয়ালী ভেবে মূল্যায়নের বাইরে রেখো। আসার সময় বাসা থেকে কিছু রেঁধে আনবে না। এখানে যে খাবার দেয় তার তুলনায় বাসার খাবারগুলো অনেক খারাপ!

অনেক কথাই লেখার ছিল কিন্তু আর কিছুই লিখতে পারলাম না। কোথা থেকে একটা অন্ধ পোকা এসে আমার চোখের মধ্যে ঢুকে পড়লো! কিছুটা যন্ত্রনাও হচ্ছে বটে। অক্ষমবাবাকে ক্ষমা করো। তোমার সন্তানদের জন্য তুমি যেন আমার মত অক্ষম বাবা না হও তার চেষ্টা করো। কয়েকদিন হল তোমার মা আমায় খুব জ্বালাচ্ছে। তাকে হারানোর ১৫ বছর পর এমনটা কেন ঘটছে তা বুঝতে পারছি না। স্বপ্নে সে কেবল ডেকেই যাচ্ছে। আমার আরও অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে এবং বৃদ্ধাশ্রমের খালি ঘরগুলোতে কারা আমার বন্ধু হয় তা দেখতে সাধ হয় কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হবে না বোধহয়! আমি মারা যাওয়ার পর, তোর মায়ের পাশেই আমাকে কবর দিও। এতে কিছুটা যায়গা নষ্ট হবে ঠিক কিন্তু তোমার মাকে ছেড়ে আমি দূরে থাকতে পারবো না। আমার এ আব্দারটুকু রেখো। রাখবে তো? আমায় ক্ষমা করে দিও।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:০৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×