বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সময়ের সবচেয়ে সাহসী, সঠিক, দূরদর্শী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত (প্রথম পর্ব)।
সাইয়িদ রফিকুল হক
দেশে বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের কথা শুনে একটি গ্রুপের মাথা ঘুরে যায়। আর খবরটা শোনামাত্র এরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাহলে, এতোদিনে এদের কালোথাবার কালোসাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়বে? তারা কালবিলম্ব করে বসে না থেকে সঙ্গে-সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ে। আর মাঠে নামে তাদের আরও যতো দোসর ও সেবাদাস। এরা একসঙ্গে ‘ফেসবুকে’ ভুয়া-পেইজ খুলে বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের বিরুদ্ধে অমনি শুরু করে দেয় তাদের বস্তাপচা, মনগড়া, আবোলতাবোল, আজেবাজে, আলতুফালতু ও উদ্ভট গালগল্প। আর এরা বিজ্ঞের মতো এমন সব আজগুবি খবর পরিবেশন করতে থাকে যে, এতে দেশের একশ্রেণীর দুর্বল-ঈমানদারগণ ভয়াবহ ঈমানীসংকটে ভুগতে থাকে। তারাও বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের বিরোধিতা করতে শুরু করে দেয়। আসলে, এরা সবাই একই মানসিক-রোগে রোগাক্রান্ত।
সাধারণ মানুষের ঈমান একটু দুর্বলই থাকে। আর এরা সবসময় ‘হুজুগে বাঙালি’। একটা খবর শুনলে অমনি সেটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোনো প্রয়োজনবোধ করে না। এরা মিখ্যাখবর প্রচারের সময় হয়ে ওঠে একেকজন বাঘা-বাঙালি। আর এরাই সত্যখবর শুনলে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে হয়ে যায় ভিজে বিড়াল। এই জাতির দুর্ভাগ্যের শেষ নাই। একটার সমাধান করতে-না-করতে আরেকটি দুর্ভাগ্য এসে আমাদের দরজায় করাঘাত করতে থাকে। আর সবখানে সেই একই-গোষ্ঠী, একই-শত্রুশ্রেণী, আর বাংলাদেশবিরোধী-চিহ্নিত-অপশক্তি।
বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-রেজিস্ট্রেশনপ্রক্রিয়া আর কিছু নয়—চারটি টিপসই মাত্র—আর এটি আধুনিকযুগের বৈজ্ঞানিক-প্রক্রিয়ার ডিজিটাল-টিপসই মাত্র। আর এতেই দেশে এতো হৈচৈ! বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের কথা শুনে দেশের একটি চিহ্নিত-পক্ষ এমন ভাব করছিলো: যেন দেশটা আজই রসাতলে যাচ্ছে। আসলে, এদের ভালো-মন্দ বোঝার কোনো ক্ষমতা নাই। এরা সবসময় হুজুগে বাঙালি। আর ‘হুজুগে পাকিস্তানীও’ বটে। এরা কখনও বাংলাদেশের ভালো চায় না। তাই, দেশের ভিতরে ভালো কোনোকিছু হতে দেখলে তাদের মাথ্যাব্যথা শুরু হয়ে যায়। আর দেশের সেই ভালোকাজটি থামানোর জন্য, আর তা বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে তারা তাদের সবরকমের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।
বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীরা সবসময় নাগরিকদের অধিকার-লংঘনের কথা প্রচার করছিলো। আসুন, এবার তাদের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের কথাগুলো আগে জেনে নেই। আর আসল-সত্য কী তাও আমরা এক্ষুনি জানবো।
১. ষড়যন্ত্রকারীরা বলছে: “আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্টসমূহ মোবাইলফোন-কোম্পানীগুলোর মাধ্যমে তা বিদেশীদের হাতে চলে যাবে। আর এতে করে তারা (বিদেশীরা) আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করবে।”
আসলে, এসব ডাহা-মিথ্যা-কথা। বিদেশীদের বুঝি আর খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নাই। তারা আমাদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে এতোকাল পরে ধান্দাবাজি করবে! তাছাড়া, অনেক দেশের ভিসাসংগ্রহকালে এদেশের অনেকজনই ইমিগ্রেশন-সেন্টারে গিয়ে মনের সুখে যথেচ্ছাভাবে টিপসই দিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরে। তখন বুঝি ভয় থাকে না? একটি সত্যকথা শুনে রাখুন: এখনও বিশ্বের প্রভাবশালী-রাষ্ট্রের ভিসাসংগ্রহকালে বিদেশযাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে সেখানে টিপসই দিতে হয়।
২. ষড়যন্ত্রকারীরা বলছে: “মোবাইল-কোম্পানীগুলোর হাতে আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট চলে যাচ্ছে! এটা কতবড় একটা বিপদের কথা! আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আমাদের দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বাধাগ্রস্ত হবে। নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে ইত্যাদি। ইত্যাদি। ইত্যাদি।”
আসলে, এই দেশে আবোলতাবোল কথা বলার মতো মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আর এগুলো এখন আরও বাড়ছে। বিদ্যাবুদ্ধি না থাকলেও দেশে এখন অনেকেই ‘বুদ্ধিজীবী’ সাজতে চাচ্ছে। কিন্তু এরা কখনও বুদ্ধিজীবী হতে পারছে না। আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখনও কোথাও যাবে না। আর এটা নিয়ে কখনওই শংকার কিছু নাই। এটি নিরাপদেই থাকবে। কাজেই, যারা বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের বিরোধিতা করছিলো বা এখনও করছে, তারা নানাভাবে তাদের নানান মুরুব্বীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেশের ভিতরে একটি অনাসৃষ্টির অশুভ-পাঁয়তারা করেছে, এবং এখনও তা করছে। কিন্তু এরা কখনও সফলকাম হতে পারবে না, ইনশা আল্লাহ।
৩. ষড়যন্ত্রকারীরা বলছে: “মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের জন্য বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ নেওয়াটা অযৌক্তিক। এটা আমাদের দেশে কখনও ছিল না। আমরা তো আগে কখনও এমনটা করিনি। না-না, এতে আমাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে ইত্যাদি। ইত্যাদি। ইত্যাদি।”
আসলে, এসব অপপ্রচারকারীদের বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দুঃসংবাদ মাত্র। এরা হয়তো ভুলে গেছে: ২০০৮ সালে, ‘সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক-সরকারে’র আমলে আমরা আমাদের ভোটার আইডিকার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকালে অনায়াসে, সহজে, আর বিনাবাক্যব্যয়ে টিপসই দিয়েছি। কই তখন তো কেউ কোনোকিছু বলার সাহস পায়নি। আর এখন ‘জাতীয় প্রয়োজনে’ ও ‘জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে’ আঙ্গুলের ছাপ দিতে এতো সন্দেহ কেন? এতো দ্বিধাগ্রস্ত কেন? আর এতো ভয়ই বা কেন?
৪. ষড়যন্ত্রকারীরা বলছে: “না-না, এটা মানা যাবে না। আর পাকিস্তান ছাড়া তো আর-কোনো দেশ এটি করছে না। আর এই সরকার তো পাকিস্তানকে দেখতে পারে না, তবে তারা কেন পাকিস্তানের নীতি অনুসরণ করবে!”
আসলে, এটা আরও ভয়ানক গুজব। বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনপ্রক্রিয়া পাকিস্তানের কিংবা পাকিস্তানীদের বাপের সম্পত্তি নয়, কিংবা ওদের আবিষ্কৃত কোনো পদ্ধতিও নয়। বর্তমানে নাইজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশেও এই ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে। আর পাকিস্তান করছে, তাই কী হয়েছে? আমরা আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব করছি। তাতে কার কী? আসলে, যারা পাকিস্তানের কথা বলে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়, তারা আসলেই পাকিস্তানের দালাল ও এই দালালবংশের প্রকৃত-উত্তরাধিকারী।
একজন অতিউৎসাহী-ষড়যন্ত্রকারী তো বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রপূর্বক এই আধুনিকপদ্ধতি বাতিলের আদেশ চেয়ে (খারিজ করে দেওয়ার দাবিতে) মহামান্য হাইকোর্টে রিট-দায়ের করে বসলো। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট তার অবৈধ-রিট খারিজ করে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করলেন গত ১৪ই মার্চ, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ। এভাবে, সকলপ্রকার ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর বারবার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে এই বাংলার বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আর সবসময় আমাদের একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ইনশা আল্লাহ, বিজয় আমাদেরই হবে।
আসুন, এবার দেখি কারা, কেন এই বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধন করতে অপরাগতাপ্রকাশ করছে কিংবা সরাসরি এর বিরোধিতা করছে।
১. যাদের মনে অপরাধের চিন্তাভাবনা আছে, আর এখনও যারা অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে আসেনি, তাদের কাছে এই বায়োমেট্রিক-পদ্ধতি কিছুতেই ভালো লাগছে না। আর যারা সবসময় রাষ্ট্রবিরোধী-অপকাণ্ডে নিয়োজিত, নির্বাচিত-সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আর সর্বপ্রকার অপরাধমূলক অপকর্মে সদাপ্রস্তুত—তারা এখন ভয়ানক বিপদে পড়ে গেছে। কারণ, এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট সহজেই তাদের শনাক্ত করে ফেলবে। তাই, তাদের ভয়টা একটু বেশিই।
২. যারা রাষ্ট্রবিরোধী-অপতৎপরতায় লিপ্ত হবে, কিংবা যাদের রাষ্ট্রবিরোধী-অপতৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা বা সম্ভাবনা আছে তারা কিছুতেই তাদের সবগুলো মোবাইল-সিম বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে নিবন্ধন করতে নারাজ। তার কারণ, তারা তাহলে, দেশে আন্দোলনের নামে গাড়িতে পেট্রোল-বোমা মারবে কীভাবে? তাদের ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা এখন শতভাগ। তাই, তারা শংকিত। তাই, একশ্রেণীর অপরাজনীতির ধারক-বাহকরা এই বায়োমেট্রিক-পদ্ধতিতে মোবাইল-সিম-নিবন্ধনের প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে পারছে না। এতে তাদের সন্ত্রাসী-ক্যাডাররা হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হতে ভয় পাবে। আর তারা এগুলো চালাতে না পারলে তাদের অপরাজনীতি চলবে কীভাবে?
৩. যারা প্রেমিকাকে ধোঁকা দিতে সবসময় অভ্যস্ত, আর প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমের ভান করে চুটিয়ে প্রেম করছে, আর তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে তার থেকে সরে যাচ্ছে, তাদের জন্য এটি এক আপদবিপদ। এতোদিনে তারা খুব নিরাপদে ছিল। একটি মেয়ের সঙ্গে ছয়মাস বা তিন মাস ধরে প্রেম করে তার সর্বস্ব লুটে তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। মেয়েটির সঙ্গে সে এখন কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। মেয়েটি তাকে কখনও খুঁজে পাবে না—কারণ, সে একটি ভুয়া-সিম দ্বারা এতোদিন মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগরক্ষা করে চলছিলো। যদি তার কয়েকটি অনিবন্ধিত মোবাইল-সিম থাকে তাহলে তার কত লাভ! আর এটি দেশের একশ্রেণীর ভণ্ডপ্রেমিকাদের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
৪. যারা পরকীয়া-প্রেমে বেশি উৎসাহী। তাদের জন্য অনিবন্ধিত মোবাইল-সিম স্বর্গের চাবি। একশ্রেণীর বিপথগামী ভুয়া-সিম (অনিবন্ধিত) দ্বারা নর-নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে, আবার তা স্বার্থগত কারণে ছিন্নও করে। এরা তাদের কোনো পাপের প্রমাণ রাখতে চায় না। তাই, তাদের কাছে অনিবন্ধিত-সিম এতো বেশি জনপ্রিয়।
৫. একশ্রেণীর মানুষের কাছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে লেনদেন থেকে শুরু করে সকলপ্রকার ব্যবসায়িক কাজেকর্মে যে-কাউকে প্রতারণা করার জন্য তাদের কাছে একটি অনিবন্ধিত-সিম বেশ কার্যকর। আর তারা এর দ্বারা সামাজিক ও রাষ্ট্রিকভাবে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে।
ভদ্রলোক, ভালোমানুষ আর সুনাগরিক সবসময় রাষ্ট্রের সম্পদ। আর তারা সবসময় রাষ্ট্রের আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের হাতে যে দুই-চারটা মোবাইল-সিম আছে তা-ও তারা অনায়াসে নিবন্ধন করতেই চায়। আর তারা তা যথাসময়ে নিবন্ধনও করেছেন। কারণ, তাদের মনে কোনো অসৎউদ্দেশ্য নাই। তারা একেবারে পরিষ্কার। আর তারা বিশুদ্ধ-মানুষ।
আমাদের দুর্ভাবনা শুধু: যাদের মনে খুব বেশি ময়লা জমেছে, তাদের নিয়ে। তারা এখন সত্যি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মোবাইল-সিম-নিবন্ধিত হলে তার তো আগের মতো অবৈধ-কাজকর্ম আর চলবে না।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৭/০৪/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৪৭