আমরা কিছু দিন হল চট্টগ্রামে এসেছি। বড় পাহাড় ঘেসে ছোট টিলার উপর দোতলা বাড়ি। আমাদের বাসা দোতলায়। এখানে এই একটাই দোতলা। আর সব বাড়িগুলো একতলা বা টিনশেড। বাসা থেকে অনেক দুর পর্যন্ত পাহাড়, বাড়ি, ঘর, নিচু সমতলের কৃষি কাজ, পাহাড়ের ঢালের কৃষি, কাঠ-ফল-ফলাদি গাছ দেখা যায়। চারদিকে সবুজ আর মায়াবী নিরবতার হাতছানি। অল্প দিনের মধ্যেই অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ক্লাশ, খেলতে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা যা কিছুই হউক, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। মায়ের কড়া শাসনের মধ্যে থেকে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় বের করা কঠিন। কোথায় যাচ্ছি, মাকে বলে বের হতে হয়। মা হিসাব করে রাখেন, কোথায় কতক্ষণ লাগতে পারে। চলাফেরার প্রতিটি মুহুর্ত মায়ের হিসাবে ধরা পড়ে। কোন কারণে কলেজে ক্লাশ না হলে বা হঠ্যাৎ কোচিং ক্লাশ বন্ধ থাকলে দল বেঁধে বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ খুঁজি। সুযোগ বুঝে দল বেঁধে এই বন্ধু, ওই বন্ধুর বাড়ি যাওয়া, এটা ওটা করা, কিছু দুষ্টামি এবং খেলাধুলা এসব করি। ক্রিকেটে ব্যাটিং-এ আমার প্রশংসা অনেক বন্ধু করে থাকে। উইকেট কীপার হিসাবে সবুজ খুব ভাল। বোলিং-এ শ্যামল ভাল করে সব সময়।
আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে একটা একতলা বাড়ি। আমার রুমের জানালা বা পাশের ব্যালকনি থেকে বাড়িটি খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। বাড়িটিতে বেশ সুন্দর গাছ-গাছালী এবং ফুলের বাগান। বাগানের দু'তিন জায়গায় সুন্দর বসার চেয়ার, শেড, দোলনা। আমাদের বাসায় বসে প্রতিদিন ওই বাড়ি থেকে সকাল, বিকাল বা রাতে প্রখর, সুতীব্র, নিঃসীম বেহালা বাদন শুনতে পাই। কি এক অজানা টানে বেহালা বাজনা শুনতে কান খাড়া হয়ে যায়। বেহালার অদৃশ্য সূর প্রবাহ কেমন যেন হাতছানি দিয়ে টানে, আর এই সুরের স্রোতের প্রবলতা এবং মোহনীয়তা কি যেন বলার জন্য ডাকে আমি বুঝতে পারি না। দিন যায়, মাস যায়, আর আমার আকর্ষণ বাড়তে থাকে এই বেহালা বাদন-এর প্রতি। সত্য, সুন্দর আর সুতীক্ষ্ণ রেখায় প্রতিটি বাজন আমার কানে – বুকে বিঁধে। জানালা, বারান্দা, বা ছাদ কোথাও কাউকে দেখা যায় না। মনে মনে বেহালা বা বেহালা বাদককে দেখার তীব্র ইচ্ছা জমতে থাকল। মনের কথা মনেই জমছে। কাউকে বলছি না। এসময় একদিন মা-ই বলল, পাশের বাড়িতে মলি নামে একটি মেয়ে থাকে। বছর দশেক আগের কথা। মলির চাচা তাঁর ব্রিটিশ বউকে নিয়ে ইংল্যান্ডে থাকতেন। একদিন তাঁরা দেশে আসলেন এবং মলি, ওর মা-বাবা এবং চাচা-চাচি সবাই মিলে নিজেদের গাড়ী করে কেওকারাডাং দুর্গম পাহাড়ি পথে যাচ্ছিলেন। হঠ্যাৎ গাড়ীসহ পাহাড়ি প্রায় দুই হাজার ফুট নীচে গভীর খাদে পড়ে গেলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের কেওকারাডাং দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বহু খোঁজ, ডুবুরী দিয়ে খোঁজা। পুকুর আয়তনের খাদ ছিল এত গভীর যে মানুষ, গাড়ী কোনটিরই হদিস পাওয়া গেলো না। এসময় মলি আর ওর চাচি ছিটকে পড়ে বেঁচে গেছিল। ওরা দুজনও অজ্ঞান ছিল বেশ কতদিন। এসময় মলি তার দৃষ্টি শক্তি হারায়। ব্রিটিশ চাচি দেশে ফিরে গেলেন না। মলির সাথে রয়ে গেলেন। মলি বড় হচ্ছে। চাচি ভায়োলিন বাজাতেন। মলিকে ভায়োলিন বাজানো শেখালেন। বেহালা হয়ে গেলো দুজনের বড় বন্ধু। বছর খানেক হল ব্রিটিশ চাচি মারা গেছেন। সতেরো বছরের কিশোরী মলি খুব একা। বন্ধুদের গল্পে কখনো মলি বা ভায়োলিনের কথা আসেনি। হয়তো মলির সাথে কারো যোগাযোগ নাই। সবার বাহিরে থাকছে মলি। মা-কে বললাম, একদিন মলিকে দেখে আসা যায় কি না? মা বলল, তোর বন্ধুদের সাথে নিয়ে চল। তাহলে সে অনেক বন্ধু পাবে। একদিন খেলা শেষে বন্ধুরা মিলে গেলাম মলির বাড়িতে। মা-কেও সাথে নিলাম। মলিকে আমাদের পরিচয় দিলাম। ওর সাথে কথা হল। অনেক কথা। ওর সম্পর্কে জানা। আমাদের কথা ওকে বলা। ঘরের ভিতরেই মলি হাঁটে, খেলে, গান গায়, টিভি-রেডিও শোনে আর বেহালা বাজায়। ওর কথায় শব্দ চয়ন, যুক্তি, স্পষ্ট উচ্চারণ, ধারাল বাক্য, দৃঢ়তা, আচরণিক প্রখরতা আমাদেরকে মুগ্ধ এবং আকর্ষিত করে। আমরা মলি-র বন্ধু হলাম। ওকে আমাদের খেলার সাথী করলাম। আমাদের খেলা সে মাঠের পাশে বসে উপভোগ করে। ভায়োলিনের সুর নিয়ে আমি বাসায় কয়েক দিন কথা বলছি দেখে বাবা আমার আগ্রহ বুঝলেন এবং একটি বেহালা কিনে দিলেন। আমার অনুরোধে মলি আমাকে ভায়োলিন বাজানো শেখাতে শুরু করল। বেহালা বাজানোর কতগুলো টেকনিক, যেমন, ব্রিজের প্যারালাল তারের উপর আলতো করে মাথার দিকে বো’র অবস্থান, চাপ বজায়, ভুমির সমান্তরালে ধরে বেহালা বাজানো, বাঁ কাঁধের হাড়ের উপর চিন রেস্ট রেখে বাঁ চোয়ালে ছুঁইয়ে রাখা, বেহালার মাঝ বরাবর নিচের দিকে কনুই রাখা এবং কতটুকু দুরত্তে বা অবস্থানে আঙ্গুল রাখলে সঠিক নোট বাজবে এসব বিষয়গুলো আমি ওর কাছ থেকে শিখি।
মা একদিন পত্রিকায় দেখলেন গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন ফ্লোরিডার বাসিন্দা মেরি অ্যান ফ্রাঙ্কো। শিরদাঁড়ায় এমন চোট পেয়েছিলেন যে তিনি অন্ধ হয়ে যান। ২০ বছর ধরে দৃষ্টি ফিরে পেতে চেষ্টা করে সমাধান পাননি। এসময় বাড়িতে হাঁটহাঁটির সময় ফ্লোর টাইলসে পা আটকে পিছন দিকে পড়ে যান ফ্রাঙ্কো। ফের কাঁধের কাছে ‘স্পাইনাল কর্ড’-এ গুরুতর আঘাত পান। এর জন্য কাঁধে অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রোপচারের পর জ্ঞান ফিরতেই ফ্রাঙ্কো বুঝতে পারেন তার চারপাশে থাকা সমস্ত জিনিসই তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ডাক্তারের ধারনা গাড়ি দুর্ঘটনায় ফ্রাঙ্কোর শিরদাঁড়ার আঘাত কোন ভাবে তার চোখের ধমনীতে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু নতুন করে শিরদাঁড়ায় চোট পাওয়া চোখের শীরা ও ধমনীতে ফের রক্ত প্রবাহ শুরু হয়। ফ্রাঙ্কো দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায়। মা ভাবতে শুরু করলেন, মলির ক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে। তিনি তাকে দড়ি লাপ খেলা শেখাতে শুরু করলেন। পাড়ার অন্য মেয়ে বন্ধুরাও ওর সাথে দড়ি লাপ খেলে। দড়ি লাপে প্রতিযোগিতা করে। মলিও দড়ি লাপে বেশ আনন্দ পায়। ক’দিন পর রুমের ভিতর বল খেলতে দিলেন। প্রথমে একা, তারপর, দুই-তিনজন বান্ধবীসহ। মা-এর স্বপ্ন একদিন, মলি হয়ত ফ্রাঙ্কো-র মত দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে।
দিন যায়। মাস যায়। অনেকে মলির বন্ধু হয়ে গেলো। মলির বেহালার সুরে এসেছে উচ্ছলতা, চঞ্চলতা, উদ্দীপনা আর আবাহন। মা মলিকে নিয়ে আমার চেয়ে বেশী ভাবে, বেশী আনন্দ পায়। ওকে আমার চেয়ে বেশী আদর করে। মলির খাবার, পোশাক, ঘুমানো, মন ভালো, মন খারাপ, জ্বর, কাশী এসব নিয়ে যত ভাবনা, আমাদের কথা নিয়ে কোন ভাবনা-চিন্তা নাই। আমাদের মা কি করে মলির মা হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না। আমার হিংসা হয়। মা-এর কাছ থেকে যত্ম পাওয়ার কৌশল জানে মলি। মা সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তসবিহ হাতে বাড়ির বাহির হতে হতে কাজের বুয়াকে বলেন, সবার নাস্তা রেডি করো, আমি একটু রাস্তায় হাঁটব, আর দেখে আসব মলির নাস্তার কি হয়েছে। আমাদের কারো অসুস্থতায় বাবাকে বলবেন ডাক্তার দেখানো বা ঔষধ দেওয়ার জন্য। আর মলির জ্বর হলে নিজে ফোন করে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাবেন। যত্ন নিবেন। মলির জ্বর, ভালো চিকিৎসা দরকার, ডাক্তার আরো যত্নশীল হলে ভালো হত - এই সব বলে হই চই ফেলে দিবেন। একদিন মলিসহ সবাই খাবার খাচ্ছি। মা মলিকে খাবার খাইয়ে দিলেন, আর আমরা খেলাম কি খেলাম না, সেদিকে নজরও দেয়নি। মলি যেন একটি ছোট শিশু – নিজের ছোট শিশুর মত মলির যত্ন নেন তিনি।
এর মধ্যে একদিন মা মলিদের বাসায়। সাথে এখানকার স্থানীয় কয়েক জন বয়স্ক মহিলা। গল্প করছেন। পাশে মলি বসে আছে। হঠ্যাৎ একজন বিদেশী আর এক বাঙ্গালী ভদ্র মহিলা ঢুকলেন মলিদের বাসায়। ঢুকেই মলিকে জড়িয়ে ধরলেন। শব্দ ছাড়া চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। স্থানীয় মহিলারা এগিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন। কেউ চিৎকার দিয়ে উঠলেন, এ যে মলির মা। কেউ বলল, বৌ মা, তুমি ! আবার কেউ বলল, বড় বউ তুমি কোথা থেকে এলে! মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। ক্ষনেকে মা স্থির হলেন। কি হয়েছে ভাবতে শুরু করলেন। এসময় দেখলেন মলি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নতুন মহিলাকে মা বলে জড়িয়ে ধরল। মা অনেকটা অপ্রস্তুত। মলি বলে উঠল, আমি জানতাম, মা, তুমি ফিরে আসবে। আমাকে একা রেখে তোমরা চলে যেতে পারো না। মলির মা মলিকে আরো বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। শব্দহীন কান্নায় শব্দ হতে শুরু করল। তিনি বললেন, জনসন আমাকে পাহাড়ি রাস্তার পাশে পেয়ে তুলে নিয়ে গেছিলো। দেশে বিদেশে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে তোর কাছে আমি ফিরে এসেছি। মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন – মলি ওর মা পেয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:০০