.
.
.
কখনো কখনো এমন হয় আমি বুঝতে পারিনা কোথায় 'আমি'। আমি কি বেঁচে আচি নাকি মৃত। দিনের বেশিরভাগ সময়ে অতল নি:শব্দের মাঝে যখন নিজের হৃদপিন্ডের বিট শুনি তখন মনে হয় এইতো আমি বেঁচে আছি। যখন সংজ্ঞাহীন আমার মাঝে খুব উদবিগ্ন আমাকে আবিষ্কার করি তখন মনে হয় আমি বেঁচে আছি। যখন প্রবলভাবে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে পৃথিবীর কাছে কিন্তু আমি চাইনা, চাইতে পারিনা, তখন আমি অনুভব করি আমি বেঁচে আছি। আবার যখন চারপাশের সবাইকে আমার অনেকদিনের জমানো কথা, অনুভূতিগুলো জানাতে চেয়ে পারিনা, যখন আমার নির্জীব খোলসকে সবাই দেখে কিন্তু আমি কাউকে আমার অন্তরে প্রবেশ করাতে পারিনা তখন মনে হয় আমি মৃত কোন প্রেতাত্বা। যেন দূর পাহাড়ের চুড়ায় দ্যা থিংকার এর ভংগিতে বসে চেনা-পরিচিত সবাইকে পর্যবেক্ষন করছি কিন্তু তাদের আর আমার মাঝে সসীম-অসীমের এক অদৃশ্য লাইন টানা, যেটা আমি কখনো অতিক্রম করতে পারিনা।
অনেকে দিন গুণে, আমি আমার দিন গুনারও প্রয়োজন বোধ করিনা কারণ আমার কোন তাড়া নেই। আমাকে নিজ হাতে খেতে হয়না, দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য কাজগুলোও করতে হয়না। আমি ঘুমাই অনেক! কিন্তু কখন ঘুমাই বা কখন জেগে থাকি সেটা আলাদা করতে পারিনা বেশিরভাগ সময়ে। কারণ আমার স্বপ্ন বা দু:স্বপ্নরা আমি জেগে আছি কি ঘুমিয়ে রয়েছি সেটা খেয়াল করেনা, সহজ করে বলতে গেলে তারা আমাকে পাত্তা দেয়না। তাদের সে গরজও নেই, অনেক কিছুর মত তারাও আসতে হয় বলে আমার কাছে আসে। যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকিনা অথবা স্বপ্নে দেখিনা তখন আমার অপলক দৃষ্টিতে দৃশ্যমান থাকে একটা ধুসর বা ক্রিম রঙয়ের দেওয়াল। দেওয়ালের মাঝামাঝি একটা পেইন্টিং, যেটা আমার দৃষ্টিসীমায় থাকলেও চোখে তেমনভাবে পড়েনা। পেইন্টিং এর উপরে একটা দেওয়াল ঘড়ি। ঘড়িটা দেখে আমি ভিতরে ভিতরে হাসি, কারণ ওটা দেখে আমি বুঝতে পারিনা সকাল সাতটা বাজল নাকি সন্ধ্যা। আমার সীমানায় কোন মানুষ আসলে তাকেও টাইম জিজ্ঞেস করতে পারিনা অথবা বলতে পারিনা ঘড়িটা বদলিয়ে ওটার স্থলে একটা ডিজিটাল ঘড়ি রাখতে।
প্রায় প্রতিদিনই আমার ভিজিটর আসে। অনেকে শুধু পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে এটা-ওটা বলেন, আমি শুনি আর হাসি, এদের কাছে আমার দৃষ্টি সীমানা সম্বন্ধে কোন আইডিয়া থাকেনা। অনেকে আমাকে ছুঁয়ে দেখেন, তাদের ছোঁয়া পেয়ে আমারও ইচ্ছে হয় তাদের ছুঁয়ে দিতে, ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হয়। অনেক ভিজিটরের মাঝে দুজন ভিজিটরের কথা না বললেই নয়। দু'জনই মহিলা। দু'জনই আমার রুমে এসে যা করে, যা বলে তা প্রতিদিন প্রায় একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি। প্রথমজন একটা চেয়ার টেনে পাশে বসে আমার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে নিবে। আমার চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার গাল গড়িয়ে পানি পড়বে, সামলে নিয়ে আমাকে কিছু পজিটিভ কথা শোনাবে। আমার পেছনে মনে হয় একটা জানালা আছে, দ্বিতীয় মহিলা এতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে এবার প্রথমজনের চেয়ারে বসবে। আমার দিকে রাজ্যের অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকবে মিনিট বিশেক, এরপর আমার গালে তার দু'হাত রেখে মাথাটাকে সোজা করে দিবে, আবার আমি আমার ফিক্সড দৃষ্টিসীমানা খুঁঝে পাব। ওহ আচ্ছা, মহিলাদ্বয় রুম থেকে বের হওয়ার পর একজন ভদ্রলোক আসবেন, তিনি কখনো আমার দৃষ্টি সীমায় আসেননি এই পর্যন্ত, আমার ব্লাইন্ডসাইটে দাঁড়িয়ে আমাকে অনেক কথা বলেন, আমি সব শুনি। যাওয়ার সময় তার হাতের রুমাল দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেন আমি খুব টের পাই।
আমার রুমে যে দু'জন সেবিকার পালা করে ডিউটি পড়ে তাদের সাথে মাঝে মাঝে আলাপ করতে ইচ্ছে হয়, তাদের মন থেকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে। দু'জনই দেখতে প্রায় একই রকম, যেহেতু সময় নিয়ে আমি কনফিউজড থাকি তাই তারা কে কোন জন আমি চিনতে পারিনা। খুব কম সময়ই তারা আমার দৃষ্টিসীমায় আসে, শুধু আমার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের সময় কখনো আমার চোখাচোখি হয়ে গেলে দুজনেই একটু বিনয়ী হাসি হাসে। যেন আমাকে জিজ্ঞেস করে, "ইজ এভরিথিং অলরাইট, স্যার?"। বাকিটা সময় একজন আমার পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় বাইরের পৃথিবী দেখে, কি আছে সেখানে? একটি জানালা, তার বাইরে বয়ে যাওয়া নদী, নদীর নীল জলে একটা একটা গুনে নেওয়া যায় এমন ঢেউ, নদীর ওপারের গাছপালা। কি জানি- হয়তো ওপাশে শহরের ব্যস্ত সড়ক, হাজার হাজার গাড়ির ছোটাছোটি। অন্যজন সারাক্ষণ মেতে থাকে ব্ল্যাকবেরি নিয়ে, সারা কক্ষে পাইচারি করতে করতে দু'হাতে টাইপ করে চলে, অনেকসময় হেসে কুটি কুটি হয়, অনেক সময় কপট রাগ, বিবি-ম্যাসেঞ্জারের ওপার একইভাবে টাইপ করতে থাকা অশরীরি'র প্রতি।
ইদানিং আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে- আমি আরোগ্য চাই না। তোমরা আমার দৃষ্টিসীমায় একটা জানালা এনে দাও। বাদামী রংয়ের উডেন প্রিন্ট টাইলস এর মেঝে আর ধুঁসর রংয়ের দেওয়াল দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। আমারও অন্য সবার মত একটা জানালা থাকবে, জানালায় আসমানি রংয়ের পর্দা থাকবে। জানালার ওপাশে সেই তীক্ষ্ণ ডেউ এর নদীটা থাকবে, আমি নদীর ডেউগুলো গুণব আর মনের খাতায় লিখে রাখবো। নদীর ওপারে গাছগুলোর পাতার রং কখন পরিবর্তন হচ্ছে সেটা দেখে বছর গুনব। রাত নামলে আকাশে তারাদের পথ চিনিয়ে দিব। সে অভিমানী মেয়েটার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কান্না আড়াল করা দেখব অথবা সারাক্ষণ জানালায় তাকিয়ে থাকা ঐ সেবিকাকে দেখে কিছুটা উষ্ণতা ছড়াবে জমাট আমার মানুষ হৃদয়ে।