সকাল ৮:৩০ থেকে রাত ৮:০০ পর্যন্ত, প্রতি ৩০ মিনিটের কি কাজ, এমন itinerary করে যাওয়া। মনটা খচখচ করছিলো, এত কাছে থেকেও যদি Skybridge আর Observation Deck দেখে যেতে না পারি, তবে ভ্রমণটাই বৃথা। Boring meeting কি আর আর্কিটেক্টদের ভাল লাগে? বিশেষ করে, যেখানে সবার প্রিয় নায়িকা Catherine Zeta-Jones এর অ্যাকশান রয়েছে!
জানি জানি, হাজার হাজার লোক পেট্রোনাস ঘুরে গিয়েছেন। এই সামু ব্লগেও এর আগে টুইন টাওয়ার নিয়ে অনেক পোস্টই পড়েছে। কিন্তু সময়ই হচ্ছিলো না। তাছাড়া হোস্টরাও বললেন, ওখানে টিকিট পাওয়া মুস্কিল। সকাল ছ’টা থেকে লাইন পড়ে। সাড়ে আটটায় বিক্রী শুরু; ন’টার মাঝেই সবশেষ হয়ে যায়। নেটে ঘাটাঘাটি করলাম। সেখানেও দেখি লম্বা লাইনের কথা। কিন্তু আমি বাংলাদেশী! এত সহজেই হতাশ হওয়ার পাত্র নই। ঠিক করলাম সকাল ছ’টায়ই লাইনে দাড়াবো।
ব্যস্, পরদিন ভোররাতে বেকুবের মত ট্যাক্সি নিয়ে বান্দা হাজির। আমার বোকামী দেখে মেয়ে সিকিউরিটি গার্ডরাও বিস্মিত। টিকেট কিনতে মূল লবি দিয়ে ঢুকে, escalator দিয়ে এক ধাপ নীচের concourse hall এ যেতে হবে। কপাল ভাল, সেখানের ফিটনেস সেন্টারে যাবার জন্য এক মালয়েশিয়ান সুন্দরী, ট্যাব নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার সাথেই দু’এক কথা হোল। সাতটার দিকে ফিটনেস সেন্টার খুললে অনেক মেম্বারেরই আগাগোনা বাড়লো। সেখানেই Open to All এক কফি শপ রয়েছে। সেটার সেলস্ গার্লবৃন্দও একে একে আসা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর সাহস করে জিজ্ঞেশ করলাম নাস্তাটাস্তা কিছু পাওয়া যাবে কিনা? তারা কেবল গোছগাছ্ করছিলো। আমার জন্য দ্রুত হাত চালিয়ে খুব সাদামাটা এক বার্গার বানিয়ে দিলো। তাদের সাথেই সামান্য গল্প গুজবে সময় কাটিয়ে আবার লাইনে। টিকেট কাউন্টারটি টাওয়ার – ১ এর নীচে, তবে শুধু টাওয়ার – ২ ভিসিট করা যায়।
সাড়ে সাতটায় এক ভারতীয় হাজির। ব্যাটা এক ট্রাভেল এজেন্সীতে কাজ করে। তারা টিকেট কাটার বিনিময়ে ১৫ রিংগিত করে নেয়। সে জানালো অনলাইন ই-টিকেটিং চালু হবার পর, এখন আর তেমন একটা লাইন পড়ে না। তাই ৮টার দিকে এলেও টিকেট পাওয়া যায়। ব্যাটা আবার ঘড়েল। সে তাকে টিকেট কাটায় হেল্প করতে বললো। একজন ৫টি পর্যন্ত টিকেট নিতে পারে। সে নেবে ৮টা। সেক্ষেত্রে তাকে অত টিকেট দেয়া হবেনা। কিন্তু আমরা দু’জন যদি একসাথে টিকেট নেই তবে কোন অসুবিধা নেই।
মোটামুটি পো’নে আটটায় লোকজন আসা শুরু হোল। প্রথমেই এক কিশোর-কিশোরী যুগল। তাদের হাসি হাসি মুখ আর আনন্দ দেখে মন খুশীতে ভরে গেল। এরপর এক দঙ্গল রাশান। এরা আবার ইংরেজী জানেনা। ঠেলা সামলা! তাদের সামান্য সাহায্য করে আমি গর্বিত।
এরপর টিকিট কাটার পালা। আমার কোটার অতিরিক্ত ৪টি টিকিট ঐ ইন্ডিয়ানকে দিয়ে দিলাম। অবশেষে ভেতরে যাবার পালা। প্রতি আধ ঘন্টার স্লটে ৪০টি করে টিকেট থাকে। এই ৪০ জনকে আবার কালার ট্যাগিং করে দু’ভাগে ভাগ করে নেয়া হয়। প্রথম বিশজন যাবার ৭/৮ মিনিট পর পর পরের দলগুলোকে পাঠানো শুরু হয়। এ সময় আক্ষরিক অর্থেই এক সুন্দরী স্বর্ণকেশী নীলনয়না হাজির। সে প্রথমেই সেই সাদা চামড়াগুলোর সাথে কথা বললো। কয়েক মুহূর্তের বাক্য বিনিময় আমি উপভোগ করলাম। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে সে তাদের জিজ্ঞেশ করলো –
Do you speak English?
Niet
Ooops!
আহ্! আবার আমার পালা। এবারেতো আমি আহ্লাদিত। বাড়ী ফিরে যখন ঘটনায় অনেক রং চড়িয়ে বর্ণনা দিলাম, তখন গিন্নী মুখ টিপে এক মিষ্টি স্মিত হাসি উপহার দিয়ে আমার মন ভরিয়ে দিলো।
যাহোক, প্রথমেই সিকিউরিটি স্ক্যানিং পার হবার পালা। সাথের খাবার দাবার সব জমা রাখা হয়। এরপর ছবি তোলা হোল। তারপর hologram এ ভ্রমণের ছোট্ট বর্ণনা। এবার লিফটে ওপরে রওনা। LED’তে ওঠা-নামার ভিডিও দেখানো হয়। বড় লিফটে Level – 41। সেই স্কাইব্রীজ! ১৭০ মি. উঁচুতে। দশ মিনিট থাকার অনুমতি। এখানে টুইন টাওয়ারের একেকটা বিল্ডিং দশ ইঞ্চি পর্যন্ত ডিফ্লেক্ট হতে পারে। যারা কুয়ালালামপুর টাওয়ারের অবজারভেশান ডেকে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই বাইনোকুলারে দেখেছেন বাতাসে টুইন টাওয়ারের দুলুনী। ডানে বায়ে ওপর থেকে নীচে দেখা আর ছবি তোলা, আর ক্ষেত্রবিশেষে অন্যকে ছবি তুলতে সাহায্য করা, ব্যস কাজ এটুকুই। আপনার সাথে যদি roaming SIM থাকে তবে ওখান থেকে বাংলাদেশে প্রিয়জনকে ফোনে বলতে পারবেন ‘আমি এখন skybridge এ’। ২৫ রিংগিতে এক সপ্তা সক্রিয় থাকবে এমন SIM এয়ারপোর্টেই কিনতে পাবেন। বাইরে আরো ভাল দামে পাবেন।
৭/৮ মিনিট পর দ্বিতীয় দল হাজির। ট্যুর গাইড খুঁজে খুঁজে প্রথম দলের সবাইকে একত্র করলো। এরপর আবার লিফটে ৮৩ তলায়। এরপর ছোট ছোট দু’টি লিফট। ওগুলোতো সবাই একবারে ৮৬ তলায়, ৩৭০ মি. উঁচুতে। এখানেও অনেকগুলো বাইনোকুলার রয়েছে। তবে ওগুলোতে বেশী সময় না দিয়ে স্বচক্ষে দেখাই ভাল। নীচের টিকেট কাউন্টার আর এই ডেকে রয়েছে বিশেষ ডিসপ্লে। যেখানে টিকেটটাকে বিশেষ অ্যাঙ্গেলে ধরলে একটা 3D মডেল স্ক্রীনে চলে আসে। বাচ্চাদের জন্যও রয়েছে কিছু আকর্ষণ। এখানে ট্যুর গাইড পরিস্কার ভাবেই জানিয়ে দেয় যে এটাই ভিজিটরদের সর্বোচ্চসীমা। এর ওপরে একটা মিটিং রুমের ফ্লোর রয়েছে, আর তার ওপর একটা মেকানিকাল ফ্লোর।
মিনিট ১৫ পর গাইড আবারো ২০ জনকে একত্র করে আবার ৮৩ তলায় নিয়ে আসে। এখানে কিছু সময় থাকা যায়। কিছু সুভেনির কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা মেশিনে পাঁচ রিংগিট নোট দিলে পেট্রোনাসের ছবি ছাপা হয়ে বেড়িয়ে আসে। সেন কয়েন দিলে মেশিনে সেটাকে টেনে একটু লম্বা করে তার পর টুইন টাওয়ারের ছবি এমবোস্ করে দেয়।
এরপর সোজা আবার আগের মাটির নীচের concourse hall। এর গিফট শপে কেনা কাটা বা ছবি তোলার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়। আপনি ছবি তুললে ওখানের কর্মীরা হাসিমুখে পোজ দেয়।
আর্জেন্টনায় জন্মগ্রহণকারী, বর্তমানে অ্যামেরিকান César Pelli, এই বিল্ডিংয়ের আর্কিটেক্ট। এ কাজের জন্য তিনি ২০০৪ এ আগা খান অ্যায়ার্ড জেতেন। National University of Tucumán এ স্থাপত্য বিদ্যায় হাতেখড়ি। এখানে পড়তে পয়সা লাগেনা। এরপর বনেদী University of Illinois at Urbana-Champaign পড়াশোনা শেষ করে বিখ্যাত আর্কিটেক্ট এইরো সারিনেনের প্রতিষ্ঠানে চাকরী শুরু করেন। এখানে তিনি TWA Terminal Building প্রজেক্টে জড়িত ছিলেন। তার এক ছেলেও সফল আর্কিটেক্ট। আহ্! আমি যদি এমন একটা কাজের সুযোগ পেতাম! ছেড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা আর কি।
ভাবতে অবাক লাগে, কেবল চক পাউডার দিয়ে, খালি হাতে এক লোক এই দালানের চূড়ায় উঠেছে। পাগল কাহাকে বলে কত প্রকার ও কি কি!
ফরাসী Spider Man, Alain Robert ১৯৯৭’তে প্রথম চেষ্ট করেন। সেবার পুলিশ তাকে ৬০ তলায় গ্রেফতার করে। এর দশ বছর পর, ২০০৭ এ তিনি আবারো চেষ্টা করেন এবং আবারও ধরা খান। তবে গ্রেফতারের আগে তিনি হাতের মালয়েশিয়ান জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেন এবং সমবেত জনতা, অগ্নি-দল, মিডিয়া, সবার বাহবা কুড়ান। সবশেষে ২০০৯’য়ের ১ সেপ্টেম্বর তিনি সকাল ৬’টায় শুরু করে ৭:৪০ এ চূড়ায় ওঠেন। কিন্তু বেরসিক পুলিশ ২০০০ রিংগিত জরিমানা আদায় করে।
পেট্রোনাসের তথ্যে নেট বোঝাই। বিবিসি সহ অনেক ডকুমেন্টারীও আছে। একান্ত আগ্রহী হলে কেউ গুতাতে পারেন -
ভ্রমণের অফিসিয়াল সাইট
Petronas Towers
César Pelli
Alain Robert
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:২২