(লেখকরা কেন লিখেন? এ বিষয়ে বিনয় ঘোষের একটি চমৎকার লেখা পড়লাম লেখা পড়লাম। ভাল লাগল। শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ বইয়ের সংযোজন অংশ। তাই ব্লগার বন্ধুরাও কেন লিখেন তা যাতে তারা যাচাই করতে পারেন সে উদ্দেশ্যেই লেখাটি হুবহু তুলে দিলাম। লেখাটি মোটামুটি বড়। তাই কয়েকটা পর্বে ভাগ করে দিচ্ছি। আশা করি সবার ভাল লাগবে। আজ প্রথম অংশ লিখলাম। ধারাবাহিকভাবে পুরো লেখাটাই দেয়ার আশা রাখি।)
কেন লিখি? কেন ছবি আঁকি? কেন গান গাই? একই প্রশ্ন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে, যদি অবশ্য উত্তর ঠিকমতো দিতে হয়, অনেক কথা বলতে হয়। বেশী কথা একটি ছোট নিবন্ধের মধ্যে বলা সম্ভব হবে না, তাই অল্প কথায় বিষয়টা নিজে লেখক হিসেবে বুঝতে এবং অন্যদের পাঠক হিসেবে বোঝাতে চেষ্টা করব। চেষ্টা সফল হবার সম্ভাবনা কম কারণ অল্প কথায় গুরুবিষয় বলতে গেলে ভুল বুঝাবার সম্ভাবনা বেশি।
গত প্রায় চল্লিশ বছরের লেখক-জীবনে খুব কম করেও অর্ধশতাধিক লেখক চিত্রশিল্পী ও সুরশিল্পীদের সঙ্গে বিভিন্ন পরিবেশে এই বিষয়ে আলাপ-পরিচয় করে দেখেছি, একজনের উত্তরের সঙ্গে অন্যের উত্তরের বিশেষ মিল নেই। মিল না থাকলেও উত্তরগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদল লেখক-শিল্পী মনে করেন যে সাহিত্য-শিল্পের চর্চা করে অর্থাৎ লিখে বা ছবি এঁকে বাইরের কোলাহল দায়-দায়িত্ব চিন্তাভাবনা ইত্যাদি থেকে বেশ পালিয়ে যাওয়া যায়। নিজের একটি নিভৃত নির্জন কোণ বেছে নিয়ে সেখানে বসে মনের মতো লেখা যায়, ছবি আঁকা যায়। আর একদল বলেন, না তা যায় না, নিভৃত নির্জন কোণ তৈরি করা যায় না। বাইরের কোলাহল থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় না। বাইরের দায়দায়িত্ব চিন্তাভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নির্জণ কোণে তারা হামলা করে। জেগে ঘুমাবার চেষ্টা করলে কেবল দুঃস্বপ্ন দেখতে হয়, আর বারংবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অতএব পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। কোথায় পালাবো? এই এক হতে পারে যদি মানুষের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে, বহুদূরে এমন কোনো গভীর জঙ্গলে চলে যাই, যেখানে মানুষের বসবাস নেই, মানুষের সমাজ নেই, তাহলে নির্জন কোণে বসে লেখা যায়, ছবি আঁকা যায়। কিন্তু তখন আবার সমস্যা দেখা দেবে, কি লিখব, কাকে নিয়ে লিখব? বন মানুস? বুনো শুয়োর? বন্য ভাল্লুক? বানর-হনুমান? তাই এঁরা বলেন যে সমাজ থেকে, মানুষের কাছ থেকে পালাবার উপায় নেই। সমাজ ও মানুষের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এবং তার ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত হলেও লক্ষ্য হবে জয়ী হওয়া।
এই দুই দলের বক্তব্যের উত্তরে প্রথমেই বলা যায়, পলায়ন যে কেবল গভীর জঙ্গলে অথবা হিমালয়ের পাদদেশে করা যায় তা নয়, পাগল হয়েও পালানো যায়, মৃত্যু বরণ করেও পালানো যায়। যারা সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়ে জয়ী হবার কথা বলেন তারাও বিলক্ষণ জানেন যে অস্ত্রশস্ত্র্ ছাড়া সংগ্রাম করা যায় না এবং কলমকে যতই আমরা তলোয়ারের চেয়ে শক্তিশালী বলি না কেন, যখন কোনো সৈনিক তলোয়ার নিয়ে সেই শক্তিশালী লেখনী ধারককে শিরচ্ছেদ করতে আসে তখন কলম দিয়ে তা প্রতিরোধ করা যায় না, তলোয়ার দিয়ে করতে হয়।
কিন্তু কেন লিখি তার উত্তর এর মধ্যে পাওয়া গেল না। পালিয়ে যাওয়া অথবা আত্মচিন্তায় বুঁদ হয়ে থেকে সেই ভাব প্রকাশ করা যদি লেখার উদ্দেশ্য হয় তাহলে LSD বা যে কোনো ট্র্যাঙ্কুলাইজার খেয়ে তা করা যেতে পারে। তার জন্য লিখতে হবে কেন? সংগ্রাম যদি করতে হয় তাহলে অস্ত্র নিয়ে তা করাই ভাল, লেখনীর প্রয়োজন কি? কাজেই আমরা লিখি অন্য কোনো কারণে। আমরা মানুষ, মানুষের মধ্যে বাস করি, মানুষ হিসেবে সামাজিক পরিপার্শ্ব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, চোখে দেখি, কানে শুনি, বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। যা কিছু এই ভাবে আমরা মানুষ হিসেবে মানুষের মধ্যে থেকে গ্রহণ-বর্জন করি, তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা লিখে প্রকাশ করতে চাই। মুখে প্রকাশ করলে কথক কবিয়াল বা আধুনিক বক্তা হতে হত। লিখে প্রকাশ করি বলেই আমরা লেখক। প্রকাশ করি এই জন্য যাতে পাঠকরা আমার মনের ভাবানুভাব, আমার অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতাকে বিচার রীতি ও ভঙ্গি ইত্যাদি জানতে পারে, অর্থাৎ Communicate করাই লেখকের উদ্দেশ্য। 'The writer is, par excellence, a mediator and his commitment is to mediation.' (Sartre). (চলবে)