ভাই ভাই ভাই আমার বোতল ভরা ডাইল
পকেট ভরা গাঞ্জা আমি
নেশায় বেশামাল
তোমরা দেখছোনি আমার জীবন
আসিতেছে মরন
যে ঠোঁটেতে ছিল আগে প্রিয়ারই ছোয়া
সেই ঠোঁটেতে আজ কেন গাঞ্জারই ধুঁয়া
তোমরা দেখছোনি আমার জীবন
আসিতেছে মরন
যে হাতে তে ছিল আগে কলেজেরই ফাইল
সেই হাতে তে আজ কেন বোতল ভরা ডাইল
তোমরা দেখছোনি আমার জীবন
আসিতেছে মরন!!!
রাতের আকাশে আজ চাঁদ নেই। কয়েক টুকরো মেঘ চাঁদটাকে আড়াল করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাসে রাস্তার ধুলোবালি উড়াউড়ি করতে লাগলো। মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে মনে হয় কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রবল বেগে বৃস্টি নামবে। এলোমেলো পায়ে গুন গুন করতে করতে ছেলেটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। নিজের কানেই সুরটা কেমন যেমন বেখাপ্পা লাগছে। তাতে কি আসে যায় সে একমনে গুন গুন করে চলেছে। একটু আগে সোহেলের বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে সোজা হাঁটা ধরেছে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করতে পারেনি। কারন তার যাবার জায়গা খুব নির্দিষ্ট। বাসা এবং কাছের ২/৩ টা বন্ধু ছাড়া সে খুব একটা কারো সাথে এখন আর মিশে না কথাও বলে না। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাসায় যাবার কোন তাড়া নেই আর গেলেও তেমন কোন লাভ নেই। বাসার কেউই তার সাথে ঠিকভাবে কথা বলবে না। যেদিন থেকে সে নেশা করা শুরু করেছে সবাই যেন অনেক দূরে সরে গেছে। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে নেই যে যার কাজে নিয়ে ব্যস্ত যেন সংসারে সে এক উটকো ঝামেলা এটা সে নিজেও বুঝে। মধ্যবিত্ত পরিবারের যে ছেলের এখন ক্যারিয়ার গুছানোর কথা সেই ছেলে এখন নেশা করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে তার পরিবারের জন্য। সে পড়াশুনায় ভালো ছিল ক্যারিয়ারের প্রতিও ফোকাস ছিল কিন্তু প্রলয়ংকারী এক ঝড়ে তার জীবনের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।
রাস্তার পাশে ধপ করে বসে পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মনের সুখে টান দেয়। নায়লা বলেছিল সে যেন সিগারেট ছেড়ে দেয়। নায়লাকে কথা দেয়নি ঠিকই কিন্ত সে চেষ্টা করছিলো কিভাবে সিগারেট ছেড়ে দেয়া যায়। সে আসলে সিগারেট পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নায়লাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল তাই সিগারেট ছেড়ে দেয়ার কথা আসলে চুপ করে থাকতো। তার জীবনে নেশা বলতে দুটো জিনিস ছিল এক নায়লা আর দুই সিগারেট। নায়লা এখন আর তার জীবনে নেই সে এখন অন্য কারো আর তাইতো তিলকের জীবনে এখন সিগারেটের সাথে সাথে অনেকগুলো নেশা যোগ হয়েছে। সে নায়লাকে পুরোপুরি ভুলে যেতে চায়। যেন তার জীবনে নায়লা নামের কারো অস্তিত্ব ছিল না কখনো।
মামা কই যাইবেন? কেউ একজনের ডাকে সচকিত হয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে এক রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আপনমনে বলতে লাগলো আমার কি কোথাও যাবার কথা ছিল? ভেতর থেকে কোথাও যাবার তাড়া অনুভব না করে সে অসহায় চোখে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলো। মামা কি বেনসন সিগারেট টানতেছেন? হুম করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা সিগারেট সে রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিল। লোকটা হতচকিত হয়ে বাড়িয়ে নেয়া সিগারেট টা হাতে নিয়ে ধরাল। তারপর একটা টান দিয়ে পরিতৃপ্তির হাসি দিয়ে তিলককে বলতে লাগলো, আমার নাম জগলু মিয়া, চলেন মামা রিক্সা দিয়া আপ্নেরে একটু ঘুরাইয়া নিয়া আসি টেকা দিতে হইবো না। আসল কথা কি জানেন মামা? আমার মনডা আইজকা ভালা না। ফুলিরে ওর বাপে জোর কইরা আবুইল্লার কাছে বিয়া দিয়া দিছে। আমি যে রিক্সা চালাই ওই গ্যারেজের মালিক হইলো গিয়া আবুইল্লা। ঠিক করছি ওই শালার রিক্সা কাইলা থেইকা আর চালামু না। আমার কিছু জমাইন্না টেকা আছে ফুলিরে বিয়া করমু দেইখা জমাইছিলাম এখন তো আর ওই টেকার কোন দাম নাই। ফুলির খুব শখ আছিলো বিয়ার পর আমারে লইয়া সমুদ্দুর দেখতে কক্সোবাজার যাইবো। বাইচ্চা পুলাপানের লাহান সমুদ্দুরের গফ করতো আর খুশিতে হাত তালি দিত। ওর এই খুশি দেখলে আমার পরানডা জুড়াইয়া যাইতো। কথাগুলো বলতে বলতে সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। তিলক প্রথমটায় কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তারপর সে ডিসিশান নিলো সে চুপ করে থাকবে লোকটা কাঁদুক কারন কাঁদলে মানুষের কস্ট কমে যায়। সে নিজেও অনেকবার কাঁদার চেস্টা করেছে কিন্তু কোনভাবেই সফল হতে পারেনি। কান্নাটা বুক থেকে গলা পর্যন্ত এসে আটকে যায়। সে দম নেয়ার জন্য হাঁশফাঁশ করে মনে হয় কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। চোখ থেকে কয়েকফোটা জল নিশব্দে গড়াতে থাকে। এক এক সময় মনে হয় চিৎকার করে উঠে কিন্তু সে বরাবরই ব্যর্থ।
রনি বড়লোক বাবা মায়ের অতি আদরের ছেলে। বাবা বড় শিল্পপতি এবং মা সারাদিন সমাজ সেবা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। রনি ছোটবেলা থেকে বাবা মা কে খুব একটা কাছে পায়নি। সে নিজের মত করেই বড় হয়েছে। বাবা মায়ের আদর বলতে কাড়ি কাড়ি টাকা এবং প্রতি জন্মদিনে নতুন নতুন গাড়ি পেয়েছে। শহরের নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে রেজাল্টের যাচ্ছেতাই অবস্থা। সারাদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে হই হুল্লোড় করে কাটায়। এযুগে বন্ধু বান্ধবের সাথে চলতে গেলে একটু আধটু নেশা না করলে নাকি চলে না, পোলাপাইন ক্ষেত ভাবে। তাই সে ও মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবের সাথে পার্টি করে বেড়ায়। কয়দিন হল তার গারলফ্রেন্ডের সাথে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। গতকাল সে তার গালফ্রেন্ডকে ৩/৪ বারের মত কল করেছে কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেনি এবং সাথে সাথে মোবাইল অফ করে দিয়েছে। আজকে সে আবার ফোন করলো এবার একবারের চেস্টাতেই সামিয়াকে পাওয়া গেলো।
-ইয়েস্টারডে আই কলড ইয়্যু ৩/৪ টাইমস ইয়্যু ডিডনট রিসিভ এন্ড আফটার ড্যাট ইয়্যু টারন্ড ওফ ইয়্যুর সেল। হোয়ের দ্যা হেল ওয়্যার ইয়্যু?
--লিসেন রনি আই এম নট বাউন্ড টু টেল ইয়্যু এনিথিং।
-হাহাহা ইয়্যু ওয়্যার উইদ দ্যাট বিস্ট এন্ড ইয়্যু স্টিল লাভ হিম। এম আই রাইট?
--ইয়েপ আই ড্যু লাভ হিম এন্ড স্টিল ওয়ান্ট হিম ইন মাই লাইফ। কুড ইয়্যু প্লিজ লিভ আস এলোন?
ইয়্যু বিচ!!! জাস্ট গো টু হেল!!!
টুট টুট!!! লাইন কেটে গেলো এবং এক আছাড়ে মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেললো। ইয়াবার নেশায় এই এক সমস্যা মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকে। কি বলতে কি বলে ফেলে এর ঠিক থাকে না। বলতে গেলে নিজের মেজাজের উপর কোন কন্ট্রোলই থাকে না। এরপর আরেকটা মোবাইল থেকে রবিনকে ফোন করে বললো ডুড আজকে একটা পার্টি এরেঞ্জ কর স্পন্সর আমি করবো মনটা ভালো লাগছে না। রবিন ঘটনা শুনে বলে রোমিও হয়ে গেলি নাকি? একটা গেলে ১০ টা আসবে তুই দেখি সেই নাইন্টিনথ সেঞ্চুরীর মেন্টালিটি নিয়ে পড়ে আছিস। জাস্ট চিল বাডি। সন্ধ্যায় বাসায় চলে আয় আজকে তোর মন ভালো করে দিবো। এভাবে কয়দিন রবিনের বাসায় যাতায়াত করতে করতে সে মোটামুটি এডিক্টেড হয়ে যায়। রবিনের বাসায় শুধু ছেলেরা নয় মেয়েরাও আসে পার্টি করতে।
নাবিলার সাথে রনির পরিচয় রবিনের বাসায়। একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি চলে আসে অল্পদিনের মধ্যে এবং দুজনের খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে একের পর এক ইয়াবা গালানোর পর রবিন হঠাৎ করে একটা ভদকার বোতল বের করে এনাউন্স করে দিজ বট্যল ইজ ফর আওয়ার নিউ কাপল রনি এন্ড নাবিলা। চিয়ার্স !!! রনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রবিনের দিকে তাকায় যেন কেউ তাকে এক ধাক্কায় ১০ তালা বিল্ডিং থেকে ফেলে দিয়েছে। আফটার সামিয়া লেফট হিম, হি ডাজেন্ট বিলিভ ইন লাভ এনিমোর, হি জাস্ট হেট কমিটমেন্ট, ইট সাক্স। রবিন হাসি হাসি মুখে একবার রনি এবং আরেকবার নাবিলার দিকে তাকায়। সবাই ওদের দুজনের ঘনিস্টতার ব্যাপার জানে তাই আজকের এই আয়োজন। রনি কমিটমেন্টে বিলিভ না করলেও নাবিলাকে তার ভালোই লাগে সে টপাটপ ৪ পেগ ভদকা মেরে দিয়ে নাবিলা, রবিন এবং আরো ২ টা ফ্রেন্ডকে নিয়ে বের হয়ে যায়। আজকে তার মন অনেক খুশি বন্ধুরা কত ভালো বিশেষ করে রবিন। প্রচন্ড গতিতে গাড়ি ছুটে চলেছে উদ্দেশ্যহীন পথে। বন্ধুরা দুস্টামি করে নাবিলা আর রনির উদ্দেশ্যে গান গাইতে লাগলো।
চলে গেছো তাতে কি?
নতুন একটা পেয়েছি
তোমার চেয়ে অনেক সুন্দরী।
রনিও গুন গুন করে গাইছে এবং আড়চোখে নাবিলাকে দেখছে।
তিলক আজকে সকালে আবার ঝাক্কি খেয়েছে। মাংগো জুসের সাথে অনেক ধরনের ঘুমের অষুধ এবং চিনি মিশিয়ে অনেক্ষন ধরে ঝাঁকাতে হয় তাই এর নাম ঝাক্কি তবে ফান্টু নামেই এটা বেশি পরিচিত। খেতে খুবই সুস্বাদু এবং এর নেশাটাও ভিন্নরকমের। খাওয়ার পর কয়েক ঘন্টা চেতনা থাকেনা বললেই চলে আর এর পূর্ন ক্রেডিট ডিজোপেন এর প্রাপ্য। এরপর চেতনা ফিরলেও মাথাটা খুব একটা কাজ করে না। শরীরটা হাল্কা হয়ে যায় মনে হয় হাওয়ায় ভাসতেছে ।
সে এখন জগলু মিয়ার রিক্সায় বসে আছে। জগলু মিয়ার মনে অনেক দুঃখ। সে অনবরত বকবক করে যাচ্ছে। তিলকের শুনতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। খানিক বাদে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে, মামা আপনে কোন কথা কন না কেন? আপ্নের কি মন খারাপ? তিলক কি বলবে ভেবে পায় না আসলে সে কাউকে বুঝতে দিতে চায় না যে তার মন খারাপ। নায়লাকে সে এখনো আগের মতোই ভালবাসে। আগের চাইতে অনেক বেশিই মিস করে কিন্তু সে নায়লাকে ভুল করেও ফোন দেয়না। কারন সে চায়না সে কস্ট পাচ্ছে এটা নায়লা জানুক। এতে হয়তো নায়লার খারাপ লাগতে পারে তিলকের জন্য। নায়লা হয়তো প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্বেও তিলকের সাথে ফোনে ২/৪ মিনিট কথা বলবে কিন্তু তিলক ওর সহানুভূতি চায় না। নায়লা ভালো আছে, সুখে আছে শুধু শুধু ওকে এর মাঝে জড়ানোর কোন মানেই হয়না। তিলক চাইলেও এখন আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। এক দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে যাবে জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত। তিলক ধরে নিয়েছে এটা তার নিয়তি আর নিয়তির টানেই এখন সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জগলু মিয়ার রিক্সায় বসে আছে।
অনেক্ষন পর তার খেয়াল হল জগলু মিয়া তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্ত সেটা সে ভুলে গেছে। ঝাক্কি খেলে এমনই হয় কিছুই মনে থাকে না কিন্তু সবকিছু ভুলে গেলেও নায়লার কথা তার প্রতি মুহূর্তেই মনে পড়ে কিছুতেই ভুলতে পারে না এবং তখন তার বুকের বাম পাশে একধরনের চিন চিন ব্যথা অনুভব করে। জগলু মিয়া এবার তাকে জিজ্ঞেস করলো, মামা গাঞ্জা খাইবেন? মনডা ভালা লাগতাছিলোনা হের লাইগা একটা পোটলা কিন্না দুইডা স্টিক বানাইছি। একটা খাইছি এখনও আরেকটা রইয়া গেছে। একলা একলা খাইতে ভাল্লাগেনা চলেন দুইজনে মিল্লা খাই। তিলক হাত বাড়িয়ে বলে দাও মামা ধরাই। জগলু তিলকের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে স্টিকটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে আমি আগেই বুঝছিলাম মামারও মন খারাপ নাইলে কওয়ার লগে লগে রাজি হইতেন না। তিলক চুপচাপ স্টিকটা ধরিয়ে টানতে লাগলো। অর্ধেকটা শেষ করে জগলু মিয়ার দিকে সে বাকিটা বাড়িয়ে দেয়। জগলু মিয়া গাঞ্জা টানতে টানতে গান গাইতে লাগলো----
সুখে থাকো প্রিয়া সুখে থাকো
রংগিন ঠিকানারই সপন দেখো
আমি চাইনা তোমারই জীবন
পুরা গাঞ্জার পোটলারই মতন।
গান গাইতে গাইতে সে আবার কঁদতে লাগলো। তিলক ভেবে পায়না একটা মানুষ কিভাবে একই সাথে হাসতে হাসতে গল্প করতে পারে আবার অঝোর ধারায় কাঁদতেও জানে। হঠাৎ করে পেছন থেকে প্রচন্ড ধাক্কায় রিক্সাটা দুমড়ে মুচড়ে ১৫/২০ হাত দূরে গিয়ে পড়ে। জ্ঞান হারানোর আগে তিলক শুধু এটুকু বুঝতে পারে সে তুলার মত উড়তে উড়তে আইল্যান্ডের উপড় আছড়ে পড়ছে এবং জগলু মিয়ার বাবাগো মাগো মইরা গেলাম গো আত্নচিৎকার শুনে।
রনি গান গাইতে গাইতে নাবিলাকে যখন দেখছিলো তখন কিছুক্ষনের জন্য একটু অন্যমনষ্ক হওয়ায় সে সামনের রিক্সাটা খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল করলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে নিজেদের প্রান বাঁচাতে রিক্সাটা দুমড়ে মুচড়ে গাড়িটা পাগলা ষাড়ের মত প্রচন্ড বেগে এগিয়ে যেতে লাগলো। রনির নেশাটা যেনো ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো এবং স্টিয়ারিং ধরে কাঁপতে লাগলো। পিছন থেকে ফ্রেন্ডরা বলে যাচ্ছে দোস্ত কুইক কেউ যেনো ধরতে না পারে।
লোকজন ধরাধরি করে তিলক এবং জগলু মিয়াকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসে। জগলু মিয়ার একটা পা ভেঙ্গে গেছে এবং শরীরের ৪/৫ জায়গার চামড়া ছিলে গেছে। তিলকের অবস্থা আশংকাজনক এখনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাকে সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হয়েছে। যারা ওদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেছে তারা তিলকের মোবাইল থেকে তার বাসায় খবর দিয়েছে। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা , রিলেটিভ এবং কিছু বন্ধু বান্ধব ভীড় করেছে এর মধ্যে কেউ কেউ কাঁদছে। বাকিদের চেহারা থমথমে অবস্থা বিরাজমান। এর মধ্যে কেউ কেউ রক্তের খোঁজে একে ওকে অনবরত ফোন করে যাচ্ছে। অপারেশন শেষ হয়েছে কিন্তু জ্ঞান এখনো ফিরেনি ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারছে না। তিনদিন পর তিলককে সেন্ট্রাল হসপিটালে ট্রান্সফার করা হয়। এর মধ্যে রিপোর্টে নতুন এক তথ্য বের হয়ে এসেছে সেটা হল দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় তিলকের লিভারের অবস্থা খুব খারাপ তার উপর এক্সিডেন্টে মারাত্তকভাবে আহত হয় যে কোন সময় খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
রনি অনেক কস্টে স্নায়ু ঠিক রেখে সবাইকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। এরপরের ব্যাপারটা খুবই অকল্পনীয় সে কাঁদতে লাগলো। আজকে তার অসাবধনতাবশত দুজন মানুষকে সে মৃত্যুর দরজায় ঠেলে দিয়েছে। সে নিজেকে কোনভাবেই ক্ষমা করতে পারছে না। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি সকাল হতেই সে পত্রিকার খোঁজে নিচে নেমে আসে। বাসায় ৩/৪ টা পত্রিকা রাখা হয় সে সবগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলো। তার বাবা মা এত সকালে ছেলেকে এভাবে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো। যেই ছেলেকে দুপুর ১২ টায়ও টেনে ঘুম থেকে উঠানো যায়না। সেই ছেলে সকাল না হতেই বসে বসে পত্রিকা পড়ছে। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে করতে নিজেদের কাজে ফিরে গেলো। রনি সবগুলো পত্রিকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথায় গতকাল রাতের এক্সিডেন্টের কোন খবর পেলো না।
এরপর সে তাড়াতাড়ি উঠে ঢাকা মেডিক্যালের দিকে পা বাড়াল কারন সে এতটুকু জানে এক্সিডেন্টের কোন রোগীকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হয় কিন্ত ওখানে তো সারাদিনে কত রোগী আসে সেখানে সে তাদের খুঁজে বের করবে কি করে এটা ভাবতে ভাবতে সে ঢাকা মেডিক্যালের সামনে এসে দাঁড়ায়। হটাৎ করে তার মধ্যে একটা ভয় কাজ করে কেউ যদি বুঝে ফেলে এক্সিডেন্টটা তার দ্বারাই হয়েছে তবে তার আর রক্ষা নেই। তারপরও সে সাহস করে গতকাল রাতের সাহায্যকারী সেজে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো রিক্সাওয়ালার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি কিন্তু রিক্সার প্যাসেঞ্জারের অবস্থা খুব খারাপ তাকে এখান থেকে ট্রান্সফারের চিন্তা ভাবনা করছে কিন্তু রোগীর অবস্থা এতই খারাপ যে তারা এখনো কোন ডিসিশানে পৌঁছাতে পারছেনা।
তিলকের আস্তে আস্তে জ্ঞান আসলো এবং অবস্থা একটু ভালোর দিকে। কিছুদিনের মধ্যে সে রিকভার করতে শুরু করলো যেটা ডাক্তার মোটেও ঠিকভাবে নিতে পারছেনা কারন এধরনের রোগীদের এই সময়টা খুব খারাপ যখন তখন অবস্থার অবনতি হতে পারে তারপরও ডাক্তার তিলকের প্রচন্ড জীবনীশক্তি দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছে কারন এমনটা খুব রেয়ার। এত সহজে কোন রোগীকে সেরে উঠতে তিনি খুব কমই দেখেছেন। গভীর রাতে তিলককে আইসিইয়্যু থেকে বের করে মাত্র কেবিনে আনা হয়েছে। এখনো পরিবারের কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয়নি। পাশে একজন নার্স রয়েছে। পরিচিত জনেরা জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। কেউবা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। তিলক কোন রকমে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝার চেস্টা করলো সে বেচে আছে নাকি মরে গেছে। সে যে বেচে আছে এটা বুঝতে পারলো যখন সে একজন নার্সকে হাসিমুখে এগিয়ে আসতে দেখলো তারদিকে। তিলক কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু প্রতিটা শব্দই ঠোঁটের কাছ পর্যন্ত এসে আটকে গেলো। ফিসফিস করে অস্পষ্টভাবে কিছু বললো ঠিকই কিন্তু নার্স বেচারি কিছুই বুঝতে পারলো । ঘন্টাখানেক পর তিলক কোনরকমে ইশারা ইঙ্গিতে একটা কলম এবং কাগজ চাইলো যেটা অনেক চেস্টায় নার্সটিকে বুঝানো গেলো। অনেক্ষনপর কাঁপা কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলো। লেখার পর কোন রকমে কাগজটা ভাঁজ করে বালিশ চাপা দিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই লিভার ড্যামেজ হয়ে তিলক কাউকে কিছু না বলে নিশ্বব্দে সবাইকে ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো।
জগলু মিয়া সুস্থ হতেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিলকের খোঁজে বের হয়ে গেলো কিন্তু সে সব যায়গা থেকে ব্যর্থ হয়ে শেষমেষ কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে চট্টগ্রামের টিকিট কেটে প্লাটফর্মে বসে রইলো। পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। এক ফুলি ছিল যাকে নিয়ে তার হাজার হাজার স্বপ্ন ছিল কিন্তু এখন সে আরেকজনের স্ত্রী। ফুলিকে নিয়ে কক্সবাজারে যাবার স্বপ্ন ছিল সেটা পূরন হয়নি। ফুলি নেই তো কি হয়েছে সে একাই যাবে ফুলির স্বপ্ন পূরন করতে। জগলু ঠিক করলো তার তো আপন বলতে কেউ নেই সে একলা মানুষ সেখানে গিয়ে কোন একটা কাজ জুটিয়ে থেকে যাবে আর কখনো ঢাকা শহরে ফিরে আসবে না। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে তার ঘোর কাটলো এবং কয়েক ফোটা নীরব অশ্রু বিসর্জনের পর জগলু মিয়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনের দিকে এগোতে লাগলো।
এক্সিডেন্টের পর থেকে সব বন্ধুদের সাথে রনির যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ। রনির সবগুলো মোবাইল বন্ধ এবং বাসায় ফোন করে কখনো তাকে পাওয়া যায়না। বন্ধুরা ভাবলো রনি বোধহয় নতুন কোন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মুখোর হয়ে আছে তাই ওদেরকে এভোয়েড করছে। কিন্তু কেউ জানে না ওইদিনের এক্সিডেন্টের পর থেকে রনির মধ্যে একধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সে প্রতিদিন সকাল বেলা হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে আসে। সে নিজেকে কোন ভাবেই ক্ষমা করতে পারে না।
তিলকের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে শুনলে সে পুলকিত হচ্ছে এবং সে ঠিক করে নিয়েছে তিলক সুস্থ হয়ে উঠলে সে নিজেই তার সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিবে এবং এক সময় এক্সিডেন্টের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিবে। ক্ষমা না পেলেও সারাজ়ীবন তিলকের অনুগত হয়ে থাকবে। এর মধ্যেই সে তিলকের বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয়ে তিলক সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছে। একদিন সকালে সে হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। সে দেখতে পায় তিলকের নিথর দেহটা এম্বুলেন্সে উঠানো হচ্ছে। পেছনে কয়েকজন আহাজারি করে কাঁদছে। রনি নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে উঠে তার চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে নামছে। সে নিজ হাতে একজন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে নিজেকে সে কোনদিন মাফ করতে পারবে না। এম্বুলেন্সটা চলে যাবার পরও সে ওখানে বসে রইলো কিছুক্ষন পর একজন নার্স হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাগজ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো মনে হচ্ছে সে কাউকে খুঁজছে। কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাবে ঠিক তখনই রনিকে দেখতে পেলো। তিলকের রুমের আশে পাশে তিনি এই ছেলেটিকে অনেকবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। তিনি রনির হাতে কাগজটি বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো আপনার বন্ধু কালকে রাতে কাগজে কিছু লিখে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিলো। মাত্র বিছানা গুছাতে গিয়ে দেখতে পেলাম তাই নিয়ে আসলাম বলে কাগজটি রনির হাতে দিয়ে চলে গেলো। রনি কাগজটির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কাগজটি খুলে সে দেখতে পেলো সেখানে কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা লাইন লেখা---
ভালবাসা মানে তোমায় না পাওয়া
ভালবাসা মানে তোমায় পেয়েও হারানোর ব্যর্থতা
ভালবাসা কল্পনার সাগরে ডুবে যাওয়া
ভালবাসা বাস্তবতার পথ ধরে হেঁটে যাওয়া
তোমায় ভেবে কাটে রাতের নিস্তব্ধতা
উকি দেয় চাঁদ, পথ হারাও তারার মেলায়
যদি কখনো বুঝতে পারো ভালবাসি তোমায় এতটা
তবে তাতেই হবে আমার জীবনের পূর্নতা....!!!
গল্পঃ "অসমাপ্ত ভালবাসা!!!" (ডেডিকেটেড টু দোজ হু হ্যাভ লস্ট দেয়ার লাভড ওয়ান!!!)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৮টি মন্তব্য ৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন