প্রায় বছরখানেক আগে একটি গল্প ছিল। গল্পের নায়ক ছিল, আবার নায়িকাও ছিল। সেই গল্পের শুরু ছিল, আবার যথারীতি গল্প শেষও হয়েছিল। কিন্তু গল্পের রেশ এখনো রয়ে গেছে। আজ সেই গল্প নতুন করে শোনাতেই আবার এই লিখতে বসা। লেখালেখি ছেড়েছি অনেগুলো বছর কেটে গেলো। এতদিনে গল্পরা আমাকে বিদায় জানিয়ে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়েছিল। আজকে শহুরে কাকডাকা ভোরে জানালায় দাঁড়াতেই দেখি গল্পেরা ফিরে এসে মন খারাপের দ্বারে বসে আছে। আজ আমার গল্পেরাই শোনাবে পুরনো এক গল্প। পুরনো ট্রাঙ্ক ঘেটে সেই নোটখাতা বেরিয়ে এসেছে, কলম ছুটেছে আজ নোটখাতার বুকে ফসলি জমিতে লাঙলের ন্যায়। আমার জমিনে আবার শব্দের চাষ। আজ তবে শুরু হোক গল্পের ছুটে চলা!
নুশা নামের এক তরুণীর সাথে গল্পের নায়কের দেখা হয়েছিল অনেকটা স্বপ্নের মত করেই। সেদিন রোদ মাখা আকাশের নীচে হেঁটে চলেছে নায়ক। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ি দেখা তার একটি শখের মত। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে তাই হাঁটতে থাকে ফুটপাথ ধরে। এমনি করে সেদিন সে হন্টনে ব্যস্ত। হতচ্ছাড়া এক কাক উপর থেকে সহাস্যে তার শার্টে ক্রিয়া সম্পাদন করে দিলো। সে আশে পাশে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে এহেন পরিস্থিতিতে কি করা যায় সে কথা তাহার জানা নেই। তখনি পেছন থেকে এক তরুণী এসে সামনে দাঁড়ালো। নায়কের চশমার ভেতরের অসহায় দুটি নিরীহ চোখ হয়ত সে বুঝতে পেরেছিল। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে গল্পের নায়কের হাতে দিয়ে বললো, "ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন? মুছে ফেলুন।"
সিনেমায় দেখেছি নায়ক নায়িকার ধাক্কায় নায়িকার হাতের বই পড়ে যায়, নায়ক তা তুলে দেয় আর তাকায় নায়িকার দিকে। এভাবেই প্রথম পরিচয়। কিন্তু বাস্তব জীবনের গল্পে কাক ছিল নায়ক নায়িকার প্রথম দেখার কারন। নায়ক সেদিন মনে মনে বলেছিল, "কাক ভাইয়া, বাকি জীবন তোমার প্রতি গ্রেটফুল থাকলাম।"
গল্পটা হয়তো এভাবেই এটুকুতেই শেষ হতে পারতো কিন্তু বিধাতা উপর থেকে মুচকি হাসেন তখনি। আর তাইতো কয়েকদিন পর ভার্সিটির ক্যাফেতে ঢুকতে গিয়ে আবারও দেখা হয়ে গেলো তাদের। গল্পের নায়ক ভদ্রতা মিশ্রিত একটা হাসি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “কেমন আছেন? সেদিনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।“ মেয়েটা খুব সিম্পলি জবাব দিল, ‘ইটস ওকে! নেক্সট টাইম থেকে রাস্তায় একটু সাবধানে চলবেন। নায়িকা একটু শাষন মিশ্রিত কন্ঠে বলে চললো বাই দ্যা ওয়ে আপনি কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সদ্য দেবদাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।“ নায়ক তখন মেয়েটার কাছ থেকে এসব কথা শোনার পর কি বলবে ভেবে না পেয়ে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক সম্মতি জানিয়ে সেদিনের মত কেটে পড়লো।
তারপর আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো দক্ষিণের বাতাস হিমালয়ে মিশে, এভাবে একদিন আবারও ভার্সিটির সামনে তাদের দেখা হয়ে গেলো। গল্পের নায়ক ছেলেটি দেখলো মেয়েটি ভার্সিটির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবলো হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে তাই কথা বলবে না বলে ঠিক করলো কিন্তু কিসের যেন টানে সে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং সাধারন একটা হাসি দিয়ে বলে, “আপনার সাথে দু'দিন দেখা হলো আপনার নামটাও জানা হল না। আমি তুহান আর আপনি?” মেয়েটি ছোট করে হেসে চোখে তাকিয়ে বললো,“আমি নুশা।“
এভাবে পরিচয় পর্ব থেকে আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে খুব ভালো একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে ওদের কথা হত না। এভাবে কথা হতে হতে তারা একজন একজনের প্রতি দূর্বল হয়ে যায়। তুহান সম্পর্কটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলেও নুশা কেন জানি সেটা চাইতোনা যার কারন তুহানের জানা ছিল না। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর নুশা বলে আমার অনেক রাগ তুমি সেটা কখনও মেনে নিতে পারবেনা আর তোমার সাথে আমার সম্পর্কটাও বেশিদিন টিকবেনা। এর চেয়ে আমরা যেমন আছি তেমনই থাকি সেটাই ভালো নয় কি? পরে কষ্ট পাবার চেয়ে এখনই সাবধান হয়ে যাই। কিন্তু তুহান এটা মানতে চাইতো না সে নুশাকে বুঝাতে লাগলো আমি তোমাকে সর্বক্ষন সাপোর্ট দিবো। আমরা একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসি আমাদের জীবনে এমন কিছুই হবে না কখনও। যদি হয়ও আমরা দুজনে মিলে সবকিছু ঠিক করে ফেলবো। অবশেষে মেঘ গলে যায়, শান্ত শীতল বারিধারায় ভিজে প্রেম নামের শব্দ। তুহান এবং নুশার ভালবাসার শুরু এখানেই।
রিলেশনের পর প্রথম যেদিন ওদের দেখা হয়েছিল সেদিন ওরা রিক্সায় করে বের হয়েছিল। তুহান তখন নুশাকে বলে যে আমার পকেটে হাত দাও তো দেখি। নুশা হাসতে হাসতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা আংটি বের করে আনে। তুহান নুশার দিকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আংটিটা নুশার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলে এ্যান্জেনমেন্ট করিয়ে ফেললাম আর যেতে দিবো না কখনো। নুশা হাসতে হাসতে বলে শিকল দিয়ে তো আর বেঁধে রাখোনি আমি চলে যাবো। তখন দুজনেই হাসতে থাকে। পরে যখন আবার বের হয় এবার তুহান নুশাকে বোটিংয়ে নিয়ে যায়। আগের দিনের মতোই পকেটে হাত দিতে বলে যথারীতি নুশা পকেটে হাত ঢুকায় এবং এবার একটা পায়েল বের হয়ে আসে। এবার তুহান ভিলেন মার্কা একটা হাসি দিয়ে পায়েলটা নুশার পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলে এবার পায়ে শিকল পরিয়ে দিলাম এখন দেখবো আমায় ছেড়ে কি করে যাও। এইতো ভালোবাসা তাই না? কিন্তু শুরুতেই বলেছিলাম, বিধাতা তখন মুচকি হেসেছিলেন।
যতদিন যেতে থাকে ভালবাসা যায় বেড়ে এবং তার সাথে সাথে এক্সপেক্টেশনও বেড়ে যেতে থাকে। নুশা খুব সিরিয়াস টাইপের স্টুডেন্ট সে পড়াশুনা নিয়ে অনেক ব্যাস্ত হয়ে পড়লো এবং সে আগের মত হুটহাট করে দেখা করা রাতজেগে কথা বলা কমিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু একসাথে এত সময় কাটানোর পর তুহান এক মুহূর্তও ওকে ছাড়া থাকতে পারতো না। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে নুশার মুখ থেকে গুড নাইট না শোনার আগ পর্যন্ত তার ঘুম কিছুতেই আসতে চাইতো না। নুশার কাছে তুহানের এই ব্যাপারগুলো অনেক বেশি ছেলেমানুষী বলে মনে হত। এক সময় তুহানের উপর নুশার বিরক্তি চরম আকারে ধারন করলো। হুটহাট করে ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়া লেগেই থাকতো। একটা সময়ের পর নুশা ফিল করতে লাগলো তুহানের জন্য তার হৃদয়ে আর কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। সে তুহানকে নিয়ে আর কিছুই ফিল করেনা। নুশা আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। তুহান নুশাকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে একটু ধৈর্য্য ধর। ভেঙ্গে যাওয়া আয়না যেমন জোড়া লাগেনা ঠিক তেমনি ভাঙ্গা মনও জোড়া লাগেনা।
তুহান নুশাকে বুঝায় তুমি সময় নাও, আবারও ভেবে দেখ এবং আমাকে জানাও। নুশা সময় নিতে নিতে তুহানের কাছ থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যায় যেখান থেকে তার ফিরে আসা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তুহানকে তার অনেক বেশি অপরিচিত মনে হতে লাগে। ওদের মধ্যে ব্রেকআপ না হলেও আস্তে আস্তে ওদের কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। তুহান অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে আবারও নতুন আলোকে নুশা তার জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু আশা সে তো মরিচিকা নুশা দূরে যেতে যেতে একসময় তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও তাকে ফিরে পায় না তুহান। তখন তুহান বুঝতে পারে-
"Love is being able to say, "I'll let you go if that's what would make you happy."
এমনি করে তুহানের ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ হয় সে সিদ্ধান্ত নেয় এমবিএ করতে দেশের বাহিরে চলে যাবে। দেখতে দেখতে যাবার সময়ও ঘনিয়ে আসে। তুহান নুশার মোবাইলে অনেক চেষ্টা করেও নুশাকে পায়না। তুহান মনে প্রানে বিশ্বাস করতে চাইতো তার যাবার কথা শুনলে নুশা হয়তো তাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। সে কোন ভাবেই নুশার সাথে কন্টাক্ট করতে পারে না। নুশাকে অনেকগুলো মেইলও করে যার জবাব সে এখনও পায়নি। শেষমেষ যেদিন তুহান চলে যাবে তখন শেষবারের মত নুশাকে আরেকটা মেইল লিখতে বসে,
“আমি ভাবতাম তুমি একদিন ফিরে এসে বলবে এতদিন তোমাকে অনেক মিস করেছি। কেন আমার সাথে এমন কর? তুমি জানোনা আমার রাগ একটু বেশি। তুমি কেন আমাকে যেতে দিলে? কেন আমাকে আটকালে না? সব সময় আমি যেভাবে চাইবো সেভাবে হবে নাকি? তোমার শাস্তি হল ২ মিনিটের মধ্যে আমার জন্য আইসক্রীম নিয়ে আসবে। আমার অনেক আইসক্রীম খেতে ইচ্ছে করছে। না আনতে পারলে তোমাকে কখনই মাফ করবো না এটা বলে হাসতে থাকবে।”
জানো আমি এখন ঘুমের জন্য কাঁদি। তোমায় ছাড়া আমার প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত বিষন্নতার খোলসে আবদ্ধ। আমি একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই। কারন আমার জেগে থাকতে ভয় হয়। তোমায় ঘিরে যত স্বপ্ন তোমার সাথে ঘটে যাওয়া হাজারও স্মৃতি একটু সময়ের জন্য হলেও ভুলে থাকতে পারবো।
"Sleeping is nice. You forget about everything for a little while."
আমি যা চিন্তা করি তা কখনও হয়না। একটা সময় ছিল আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। কারন আমার জীবনের কোন স্বপ্নই পূরন হয়না না। তুমি যখন আমার জীবনে এলে সেই আমি কেমন করে জানি স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। মনে হতে লাগলো একদিন স্বপ্নটাকে সত্যি করে পাবো তোমায় পথের শেষে। ঐ যে বললাম আমার সব স্বপ্ন কখনও পূর্ণতা লাভ করে না আর তাইতো তুমি গেলে এক দিকে আর আমি হারালাম অপরদিকে। জানো, প্রথম প্রথম তোমার উপর প্রচন্ড রাগ লাগতো। অনেক অভিমান জমে ছিল তোমার জন্য। তারপর মনে হতে লাগলো তুমি আসলে আমার সাথে ভালো নেই। এখন মনে হয় আমি আসলে ব্যর্থ। আমি তোমাকে সুখি করতে পারিনি কখনও। তুমি যদি আমার সাথে সুখিই হতে না পারো তবে কেন আমার সাথে থাকবে? আমিই বরং তোমায় মিছে মায়ায় জড়াতে চেয়েছিলাম। আমি তোমাকে কখনও ভালো রাখতে পারিনি। পারিনি কখনও নিজের ফ্যামিলিকে খুশি করতে। আর তাইতো কাপুরুষের মত তোমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো সবসময়...!!!”
তুমি আমার হাসিটা খুব পছন্দ করতে। আমি এখনও হাসি। কিন্তু সে হাসির মধ্যে কৃত্যিমত্তার ছাপ স্পষ্ট। আরেকটা কারন আছে অবশ্য সে হাসির সেটা কি জানো? কারন আমি আমার হৃদয়ের নীল নীল ক্ষতগুলো কাউকে দেখাতে চাইনা। ওগুলো আমি যত্ন করে তুলে রেখেছি তোমার জন্য।
"Smile. Let everyone know that today, you're a lot stronger than you were yesterday. "
পর পর দুই বার মেইলের লেখাগুলো পড়ে তুহান। বাইরে কোথাও ভীষণ শব্দে বাজ পড়ে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াতেই বিজলির রেখা চোখে বাধে তার। ঝড়ো বৃষ্টি শুরু হয় বাইরে। লোডশেডিংয়ে অন্ধকার হয়ে যায় সমস্ত শহর। জানালা থেকে যেয়ে আর আলো জ্বালাতে ইচ্ছে হয় না তার। বাতাসের শো শো শব্দের সাথে সাথে হৃদয়ের খুব গহীন থেকে একটি শুন্যতা ব্যাথা দেয় খুব। বাইরে নারিকেল গাছের পাতারা প্রানপনে লড়ে যাচ্ছে ঝড়ের সাথে। একটি বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ে তার গালে। নিজের অজান্তেই আওড়ে যায় অনেক দিন আগে লেখা একটি কবিতা,
যেদিন আমি থাকবো না-
সেদিন যদি ইচ্ছে হয়,
খুঁজে নিও আমাকে
বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির মাঝে
খুঁজে নিও বর্ষার মেঘলা আকাশে,
আকাশী মেঘের মাঝে
পূর্ণিমা রাতে
রূপার থালার মত চাঁদ হয়ে
মেঘলা আকাশে
সাতরঙ্গা রংধনু হয়ে
বেঁচে রব আমি।
ইচ্ছে হলে খুঁজে নিও
শ্রাবনের বৃষ্টির মাঝে
সেখানে থাকবো আমি অঝোর ধারায়
সুখের হাজারো স্মৃতিতে
ভেসে যাওয়ার আনন্দের মত
তোমাদেরর সাথে ঘটে যাওয়া
হাজারো স্মৃতির ভীড়ে
আমি থাকবো।
যদি ইচ্ছে হয়,
মনে পড়ে আমায়
তবে খুঁজে নিও!!!