যাকাতের মাসায়েলের বিবরণ :
যাদের উপর যাকাত ফরয :
প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন সকল ‘সাহেবে নিসাব’ মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। কোন ব্যক্তি মৌলিক প্রয়োজনীয় উপকরণাদি ব্যতীত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসেবে পরিপূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বৎসরের যাকাত প্রদান করা ফরয। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্থ হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তার উপর যাকাত ফরয হবে। যাকাত ফরয হওয়ার পর যদি কোন ব্যক্তি যাকাত প্রদান না করে টাকা খরচ করে ফেলে, তাহলেও তাকে তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে। নাবালেগ ও পাগলের উপর যাকাত ফরয হবে না। কারণ, তাদের উপর শরীয়তের বিধান আরোপিত হয়না। তবে যদি কোন মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি নিসাবের মালিক হওয়ার সময় এবং বৎসর পরিপূর্ণ হওয়ার সময় সুস্থ থাকে, কিন্তু মধ্যবর্তী সময় মস্তিষ্ক বিকৃতির শিকার হয় তাহলেও তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে।
মৌলিক প্রয়োজন কি :
মৌলিক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের যাকাত হয় না। মৌলিক সম্পদ বলতে বুঝায়, বসবাসের ঘর, ঘরের আসবাব-পত্র, তৈজসপত্র, গৃহস্থালীর সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, পেশাগত সামগ্রী, কারখানার যন্ত্রপাতি, যোগাযোগের বাহন, পড়াশুনার বই-পুস্তক (যা বিক্রয়ের জন্য নয়) ইত্যাদি।
যাকাতের নিসাব :
যাকাতের নিসাব বলতে বুঝায়, মূলধনের সেই সর্বনিম্ন পরিমাণ, যার উপর শরীয়ত যাকাত ফরয করে। যে ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ মূলধন থাকবে তাকে ‘সাহেবে নিসাব’ বলা হয়।
স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭ ১/২ভরি) কিংবা রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২ ১/২ তোলা) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোন একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ টাকা-পয়সা বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে। কোন ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্রমাসের হিসেবে এক বৎসর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে, তাহলে তার উপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাতরূপে প্রদান করা ফরয।
মনে রাখতে হবে, বৎসরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরী। বৎসরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও যাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের উপর এক বৎসর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের উপর বৎসর অতিবাহিত হওয়া শর্ত।
অতএব, বৎসরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ থাকলেও বৎসরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে ঐ বেশি পরিমাণের উপরও যাকাত প্রদান করতে হবে। বৎসরের যেকোন অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ একবৎসর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। যাকাত ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের উপর বৎসর অতিক্রম করা শর্ত। যাকাত, যাকাতুল ফিতর, কুরবানী এবং হজ্ব এ সকল শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সাথে সম্পৃক্ত।
যে সব সম্পদের উপর যাকাত নেই :
জমি, বাড়ি-ঘর, দোকান ঘর, কারখানা, মূলধন-যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ি, নৌকা, জাহাজ, লঞ্চ, বিমান ইত্যাদি।
যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ি, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহপালিত পশু-পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির যাকাত হয় না। ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত টাকার উপরও যাকাত ফরয নয়।
ডেইরী ফার্মের পশুর উপর যাকাত নেই। অবশ্য ডেইরী থেকে উৎপাদিত বস্তুর উপর যাকাত ফরয হবে। মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য জিনিস কেউ যদি শখ করে ঘরে রাখে তার উপরও যাকাত নেই। চৌবাচ্চায় বা পুকুরে পোষা সৌখিন মাছের উপর যাকাত নেই।
যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরয :
১. স্বর্ণ-রূপা।
২. নগদ অর্থ।
৩. বাণিজ্যিক পণ্য।
৪. মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু।
৫. উশর আরোপিত ফসল।
৬. হাউজিং ব্যবসার জমি, প্লট, ভবন, এ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদির ব্যবসার
সম্পদ হিসেবে যাকাত হবে।
৭. মান্নত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মহরের জমাকৃত টাকা, হজ্ব ও কুরবানীর
জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বৎসরান্তে যাকাত দিতে হবে।
যাকাত ফরযকৃত সম্পদের যাকাতের বিস্তারিত বর্ণনা
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত :
যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম (৭ ১/২ ভরি) স্বর্ণ বা ৫৯৫ গ্রাম (৫২ ১/২ তোলা) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত , স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত যে কোন বস্তু হোক সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে।
হীরা, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসাবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার যাকাত দিতে হবে। অলংকার সহ সকল প্রকার স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে।
নগদ অর্থের যাকাত :
নগদ অর্থ টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোষ্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মুদ্রা(নগদ, এফসি একাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড) কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখীমাল) প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি, (জমাকৃত কিস্তি) কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা পোষ্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কীম কিংবা নিরাপত্তা মূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতি বৎসর যথা নিয়মে প্রদান করতে হবে।
অনুরূপভাবে চাকুরীজীবির প্রভিডেন্ট ফান্ডে নিজ বেতন থেকে জমা করা অংশের জমাকৃত অর্থের যাকাত ও প্রদান করতে হবে। কর্তৃপক্ষের অংশ কেবল মাত্র হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে। পেনশনের টাকা ও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে।
শেয়ারের যাকাতের বিবরণ :
শেয়ার হচ্ছে কোম্পানীর মূলধনের উপর মালিকানার অংশীদারীত্বের অধিকার। শেয়ারের ক্ষেত্রে যারা লভ্যাংশ অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয় বরং শেয়ার ক্রয় করেছেন শেয়ার বেচা-কেনা করে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে, তারা শেয়ারের বাজার দর ধরে যাকাত হিসাব করবেন।
আর শেয়ার ক্রয় করার সময় যদি মূল উদ্দেশ্য থাকে লভ্যাংশ অর্জন করার এবং প্রয়োজনে শেয়ার বিক্রি করে দিবে, তাহলে যাকাত হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দরের যে অংশ যাকাত যোগ্য অর্থ সম্পদের বিপরীতে আছে তার উপর যাকাত আসবে, অবশিষ্ট অংশের উপর যাকাত আসবে না।
উদাহরণ- শেয়ারের বাজার দর ১০০টাকা, তার মধ্যে ৬০ ভাগ কোম্পানীর বিল্ডিং, মেশিনারিজ ইত্যাদির (ফিক্সড এসেট) বিপরীতে, আর ৪০ ভাগ কোম্পানীর নগদ অর্থ, কাচাঁমাল ও তৈরী মালের (কারেন্ট এসেট) বিপরীতে, তাহলে যাকাতের হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দর অর্থাৎ ১০০ টাকার ৬০ ভাগ বাদ যাবে। কেননা সেটা এমন অর্থ সম্পদের বিপরীতে যার উপর যাকাত আসেনা। অবশিষ্ট ৪০ ভাগের উপর যাকাত আসবে। এ রূপ ক্ষেত্রে শেয়ারের যাকাত হিসাব করার সময় শেয়ার প্রদানকারী কোম্পানীর নিকট থেকে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে উক্ত কোম্পানীর মোট নীট সম্পদের মধ্যে যাকাত যোগ্য সম্পদের শতকরা হার জেনে নিয়ে যাকাত দিতে হবে।
যদি শেয়ার হোল্ডারদের পক্ষে কোম্পানীর হিসাব জানা সম্ভব না হয়, তবে শেয়ার হতে উপার্জিত মোট বার্ষিক আয় বা লভ্যাংশের উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
বানিজ্যিক সম্পদের যাকাত
১. ব্যবসার নিয়তে ক্রয়কৃত, উৎপাদিত বা প্রক্রিয়াধীন,কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী, আমদানী রপ্তানী পণ্য ও মজুত মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের উপর সর্বসম্মতভাবে যাকাত ফরয। এমনকি ব্যবসা বা পরবর্তীতে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি, দালান অথবা যে কোন বস্তু বা মালামালের মূল্যের উপরও বাজার দর হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।
২. হাউজিং ব্যবসার জমি, প্লট, ভবন, এপার্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।
৩. বিক্রির উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস, হাস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেনু-পোনা ইত্যাদির ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।
৪. বিক্রির উদ্দেশ্যে নার্সারীর বীজ, চারা, কলম ইত্যাদির ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।
৫. ভাড়ায় নিয়োজিত ঘর-বড়ী, দালান-কোঠা ইত্যাদির বার্ষিক ভাড়া বাবদ উপার্জিত নীট আয়ের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে।
৬. ব্যবসার দেনা, যেমন বাকীতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরী, ভাড়া, বিদ্যুত-গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
৭. অন্যদিকে বাকী বিক্রির পাওনা, মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয়ের উদ্দেশ্যে অগ্রিম প্রদান, এলসি মার্জিন ও আনুসাঙ্গিক খরচ, ফেরত যোগ্য জামানত, ভাড়ার বিপরীতে অগ্রীম ইত্যাদি যাকাতের হিসাবে আনতে হবে।
৮. অংশীদারী ব্যবসার সামগ্রিক স্টক এবং নগদ তহবিলের উপর যাকাত হবে না। বরঞ্চ প্রত্যেক অংশিদারের অংশ এবং মুনাফার টাকার উপর যাকাত ফরয হবে। যদি এ অংশ এবং তার মুনাফা নিসাব পরিমাণ হয় তা হলে যাকাত ফরয হবে নতুবা হবে না।
ঋণ ও যাকাতের বিবরণ
ঋণ দাতার উপর যাকাত
১. আদায় যোগ্য ঋণের উপর ঋণ দাতাকে বছরান্তে যাকাত দিতে হবে।
২. আর আদায় অযোগ্য বা আদায় হবার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ যাকাতের হিসাবে আসবে না। যদি কখনও উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবল মাত্র এক বৎসরের জন্য উহার যাকাত দিতে হবে।
ঋণগ্রহীতার উপর যাকাত
১. ঋণগ্রহীতার ঋণের টাকা মোট যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণ গ্রহীতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থাবর সম্পদ (যেমন অতিরিক্ত বাড়ী, দালান, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ী ও আসবাব পত্র ইত্যাদি) থাকে যা দ্বারা এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম, তবে উক্ত ঋণ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
২. স্থাবর সম্পদের উপর কিস্তি ভিত্তিক ঋণ (যেমন হাউজিং লোন ইত্যাদি) যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
৩. ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহীতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থাবর সম্পদ থাকে, তবে উক্ত ঋণ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
৪. শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণ গ্রহীতর মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থাবর সম্পদ থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায়, তবে যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
৫. যদি অতিরিক্ত স্থাবর সম্পদের মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয় , তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকী ঋণের টাকা যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। মুলতবি ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
পশুর যাকাতের বিবরণ
পশুর উপর যাকাত ফরয হওযার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে।
১. প্রত্যেক প্রজাতির পশুর সংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে নিসাব পরিমাণ হতে হবে।
২. এসব পশু মালিকের মালিকানায় পূর্ণ এক বছর থাকতে হবে।
৩. এসব পশু সায়েমা বা বিচরণশীল হতে হবে। অর্থাৎ বছরের অধিকাংশ সময় রাখাল বিহীন মুক্তভাবে বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
৪. এ পশু মালিকের কোন কাজে (জমি চাষ, ক্ষেতে খামারের সেচ বা বোঝা বহন ইত্যাদি ধরনের কাজে) নিয়োজিত হবে না।
* যাকাতের বেলায় গরু মহিষ এক প্রজাতি আর ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক প্রজাতি হিসেবে গণ্য হবে।
পশুর যাকাতের নিসাব
* উটের সর্বনিম্ন নিসাবের সংখ্যা পাঁচটি।
* গরু মহিষের সংখ্যা ত্রিশটি।
* ছাগল-ভেড়া, দুম্বার সংখ্যা চল্লিশটি।
ডেইরী ফার্মে পালিত দুধ উৎপাদনকারী পশু গাভী, ছাগল এবং ডিম উৎপাদন কারী পাখি হাস-মুরগী এবং পোনা উৎপাদনকারী মাছ ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তবে উৎপাদিত পশুর দুধ, হাস-মুরগীর ডিম এবং মাছের পোনার উপর যাকাত ফরয হবে। এছাড়া যদি স্বয়ং গরু ছাগল, মাছ মুরগীই বিক্রির উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ব্যবসার পণ্য হিসাবে বাজার মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে।
যাকাত প্রদানের খাত সমূহ
যারা যাকাত পাবে :
যাকাত কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে বা কারা যাকাত পাবার যোগ্য হবে তা মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
اِنَّـمَا الصَّدَ قتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسكِيْنَ وَالْعمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْـمُؤَلَّفــَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِى الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِى سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ- فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ
“নিশ্চয়ই সাদকা (যাকাত) তো-
১। ফকীর দরিদ্রদের,
২। মিসকীন সহায় সম্ভলহীনদের,
৩। যাকাত আদায় ও বন্টনের কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের,
৪। তাদের জন্য যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য,
৫। দাস-দাসীদের দাসত্ব মুক্তির জন্য,
৬। ঋণভারে আক্রান্ত লোকদের জন্য,
৭। ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে,
৮। মুসাফিরদের জন্য। আল্লাহর পক্ষথেকে অবশ্য পালনীয় ফরয। এবং আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং মহাজ্ঞানী”। { সূরা আত তাওবা-৬০।}
এ আয়াতে যাকাতের আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে। যাকাত এ আট খাতেই ব্যয় করা যেতে পারে তার বাহিরে নয়।
যাকাতের খাত সমূহের বিস্তারিত বিবরণ
১. ফকীর
ফকীর বলতে সে সব নারী পুরুষকে বুঝায় যাদের জীবন ধারণের জন্যে অপরের সাহায্য সহযোগীতার উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে ঐসব দু:স্থ, অভাবগ্রস্ত, অক্ষম অপারগ ব্যক্তি শামিল যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে আর্থিক সাহায্যের হকদার। যেমন :
ক. জীবিকা অর্জনে অক্ষম ব্যক্তি, পঙ্গু, এতিম শিশু, বিধবা, স্বাস্থহীন, দূর্বল, বেকার এবং যারা দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এবং দরিদ্র শিক্ষার্থী। এমন লোকদেরকে সাময়িকভাবে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে এবং তাদের জন্য স্থায়ী ভাতাও র্নিধারণ করা যেতে পারে।
খ. এদের মধ্যে গরীব আত্মীয়-স্বজন ও গরীব প্রতিবেশী অধিক হকদার।
গ. কর্মঠ গরীবদেরকে আত্ম-র্কমসংস্থানের সহায়তা করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যাকাতের র্অথ ব্যয় করা যায়।
২. মিসকীন
মিসকীন বলতে ঐ দরিদ্র সম্ভ্রান্ত ও ভদ্রলোককে বুঝায়, যিনি খুবই দু:স্থ ও অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্বেও তার আত্মসম্মানবোধ তাকে সাহায্যের জন্য অপরের নিকট হাত পাততে দেয় না এবং যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেও তাকে অভাবগ্রস্ত মনে হয় না। ফকীর ব্যক্তির তুলনায় সে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য।
৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী :
এরা হচ্ছে ঐ সব লোক যাদেরকে সরকার যাকাত, উশর আদায় করা, তার রক্ষণাবেক্ষণ করা, বন্টন করা এবং তার হিসেবপত্র সংরক্ষণ করার জন্য নিযুক্ত করেছে। তারা সাহেবে নিসাব হোক বা না হোক তাদের বেতন যাকাত থেকে দেয়া যাবে।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বা যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য
ক. এরা হলো নওমুসলিম যারা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাদেরকে ইসলামের পথে টিকে থাকার জন্য দান।
খ. এদের মধ্যে আরেকদল লোক আছে যাদের সম্পর্কে আশা করা যায় যে, তাদের মন ইসলামের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। একটু আর্থিক সাহায্য পেলে তারা আরো দ্রুত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে।
গ. আর একদল লোক ও এদের মধ্যে আছে, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, টিকেও আছে। এদেরকে যাকাতের খাত থেকে দান করলে তারা নিজের সাবেক জাতির কাছে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে যে, ইসলাম গ্রহণ করে ঠকেনি, বরং তাদের জাতিরা বুঝবে ইসলাম গ্রহণকারীরা পরস্পর কত দরদী এবং অভাবগ্রস্তদের অভাব দূর করার জন্যে তারা কত তৎপর। ইসলামের এ মানবতাবোধ দেখে তাদের মনও ইসলামের দিকে এগিয়ে আসবে।
অবশ্য ফিক্হবিদদের মধ্যে এ বিষয় মতভেদ আছে যে, ইসলামের বিজয় যুগ এসে যাওয়ার পর “মুয়াল্লিফাতে কুলুবুহুম” দেরকে যাকাত থেকে দান করার হুকুম রহিত হয়ে যাবে কিনা। কিন্তু এটা সত্য যে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মসূচী বাস্তবায়নের কাজ করতে গিয়ে প্রত্যেক যুগেই এমন অবস্থার সম্মূখীন হওয়ার সম্ভাবনা বরাবরই রয়েছে যে, একদল লোককে সাহায্য করার প্রয়োজন হবে। অতএব, প্রয়োজন বোধে এই খাতের যাকাত কিয়ামত পর্যন্তই চালু থাকবে। { তাফসী ফী যিলালিল কুরআন-(বাংলা সংস্করণ)১৫৩-১৫৪পৃষ্ঠা।}
৫. দাস মুক্তি ঃ শৃংখলমুক্তকরা (দাসমুক্ত করা) দাস প্রথার বিলুপ্তির সাথে সাথে এ খাতের ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে গেছে।
৬. গারেমীন বা ঋণগ্রস্তদের জন্য যাকাতের অর্থদান করা
ক. যে সব লোক ঋণের বোঝায় পিষ্ট হয়েছে এবং নিজেদের প্রয়োজন পূরণের পর ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম নয়। বেকার হোক, অথবা উপার্জনশীল এবং এতো
সম্পদ নেই যে কর্জ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ মাল তার কাছে থাকবে। তাদেরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।
খ. ঋণগ্রস্তদের মধ্যে তারাও অন্তর্ভূক্ত যারা কোন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কোন ক্ষতি পূরণ অথবা জরিমানা দিতে হয়েছে, অথবা ব্যবসা-বানিজ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
গ. মৃত ব্যক্তিদের ঋণও পরিশোধ করা যায়।
৭. ফী সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর পথে
এর অর্থ হলো আল্লাহর পথে জিহাদ। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মধ্যে সে সমুদয় চেষ্টা চরিত্র শামিল যা মুজাহিদগণ কুফরী ব্যবস্থাকে নির্মূল করে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে করে থাকেন। সে চেষ্টা সাধনা কলমের দ্বারা হোক, হাত, মুখ অথবা তরবারী দ্বারা হোক অথবা কঠোর শ্রমসাধনার দ্বারা হোক ফি সাবিলিল্লাহ দ্বারা সেটাই বুঝানো হয়েছে। অতএব, দ্বীনে হক কায়েম করার জন্যে, তার প্রচার ও প্রসারের জন্য, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে যারা উপরিউক্ত পদ্ধতিতে চেষ্টা সাধনা করে তাদের যাতায়াত খরচ, যানবাহন, অস্ত্রসস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম সংগ্রহ করার জন্যে যাকাত থেকে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
এমনি ভাবে ফিক্হবিদগণ দ্বীনী শিক্ষার্থীদেরকেও এ খাতের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য এ খাতটি পূর্ববর্তী সব খাত থেকে উত্তম। তার কারণ হলো এতে দুটি ফায়দা আছে।
১.গরীব-নি:স্বের সাহায্য।
২. অন্যটি ধর্মীয় সহায়তা করা।
৮. ইবনুস্ সাবীল তথা মুসাফির
মুসাফিরের সফরকালীন প্রয়োজনীয় রসদপত্র ও রাহা খরচ শেষ হয়ে গেলে এবং তা সংগ্রহের ব্যবস্থা না থাকলে সে যাকাত নিতে পারবে, যদিও বাড়ী-ঘরে সে যথেষ্ট সম্পদশালী। অনুরূপ দেশে থেকেও যে নিজের ধন-সম্পদ থেকে অনুপস্থিত, কোন কারণে তা ব্যবহার করতে পারছে না। যেমন কোন ব্যবসায়ী যদি লোকদের নিকট টাকা পাওনা থাকে, কিন্তু সে তা আদায় করতে পারছে না, কিছুই ফেরত পাচ্ছে না, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা জায়িয । সে কার্যত ফকীর এবং ইবনুস সাবীলের মতোই।
ছিন্নমূল মানুষ যারা ফুটপাতে কিংবা গাছ তলায় বা খোলা আকাশের নীচে কোন রকম একটু আশ্রয় বানিয়ে নিয়েছে, এধরনের লোকদের আবাসন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় পূরণের ব্যবস্থার জন্য।
যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না ঃ
সাত প্রকার লোকদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না। তাদেরকে দিলে যাকাত আদায় হবে না। মনে রাখতে হবে যে, যাকাত দেওয়া যেমন শরীয়তের বিধান, অনুরূপ যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকেই যাকাত দেওয়াও শরীয়তের বিধান। সঠিক পাত্রে-যাকাত প্রদান না করলে যাকাত পরিশোধ হবে না।
সাত প্রকার লোকদের পরিচয় :
১. সাহেবে নিসাব ধনী ব্যক্তির জন্য যাকাত খাওয়া বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়িয নয়।
২. হযরত মুহাম্মদ সা. এর প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করা জায়িয নয়। একমাত্র সাধারণ দানের অর্থ দ্বারাই তাদের খেদমত করা জরুরী।
৩. অমুসলিম ব্যক্তিও যাকাত লাভের অনুপযুক্ত। প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা যাবে, তবে তা যাকাত থেকে নয়।
৪. ধনী ব্যক্তির আপন দরিদ্র পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, তথা উর্ধ্বস্থ সকল নারী-পরুষ কে যাকাত দেয়া বৈধ হবে না।
৫. ধনী ব্যক্তির আপন পুত্র-কন্যা, নাতি -নাতনী ও অধ:স্তন সকল নারী পুরুষকে দেয়া বৈধ নয়।
৬. সাহেবে নিসাব ধনী স্বামী নিজ স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারবে না।
৭. অনুরূপ সম্পদশালী স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না।
শেষোক্ত চার ধরনের আত্মীয়কে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের ভরণ-পোষন ও দেখা- শুনা করা প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য বিধায় যাকাত না দিয়ে অন্য অর্থ দিয়ে সে কর্তব্য পালন করতে হবে।
পক্ষান্তরে উপরোক্ত চার ধরনের আত্মীয় ব্যতীত অন্যান্য সকল আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া অতি উত্তম ও বেশি সওয়াবের বিষয়। এর দ্বারা একদিকে দরিদ্রতা দূরীকরণে সহযোগীতা এবং অপর দিকে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা হয়।
যাকাতের বিভিন্ন মাসায়েল
যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত সাতটি
১. মুসলমান হওয়া।
২. নিসাবের মালিক হওয়া।
৩. নিসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া।
৪. ঋণগ্রস্ত না হওয়া।
৫. মাল এক বছর স্থায়ী হওয়া।
৬. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া।
৭. বালিগ হওয়া ।
যাকাত আদায় সহীহ হওয়ার শর্ত ছয়টি
১. যাকাতদাতা মুসলমান হওয়া।
২. যাকাতের মাল আলাদা করার সময় অথবা যাকাতের হকদারকে দেয়ার সময় যাকাত দেয়ার নিয়ত করা জরুরী।
৩. নির্দিষ্ট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা।
৪. যাকাত দেবার সময় যাকাত গ্রহণকরীকে তার মালিক বানাতে হবে।
৫. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া, মস্তিস্ক বিকৃত অথবা পাগল যাকাত দিলে তা হবেনা।
৬. বালিগ হওয়া, নাবালিগ শিশু যাকাত দিলে তা হবে না।
যাকাত ফরয হওয়া সংক্রান্ত আরো কিছু মাসায়েল
১. হারানো মাল হস্তগত হওয়ার পর বিগত সময়ের যাকাত দিতে হবে না।
২. বছরের শরু এবং শেষে নিসাবের মালিকের উপর যাকাত ফরয হবে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাল না থাকা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না।
৩. গ্রেফতার কৃত ব্যক্তির প্রতিনিধিই তার পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করবে।
৪. সাহেবে নিসাব মুসাফিরের উপর যাকাত ফরয। তার সফর তাকে যাকাতের হকদার বানায় এবং মালদার হওয়া তার উপর যাকাত ফরয করে।
৫. কেউ কাউকে কিছু দান করলো। তা যদি নিসাবের পরিমাণ হয় এবং এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে তার যাকাত ফরয হবে।
৬. রেহেন বা বন্ধকী মালের উপর যাকাত ফরয হবে না বন্ধক দাতা ও বন্ধক গ্রহীতা কারো উপর নয়।
যাকাত আদায়ের কিছু মাসায়েল
১. যাকাত দেয়ার সময় হকদারকে বা যাকাত গ্রহীতাকে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এটা যাকাত। বরং উপহার, বাচ্চাদের জন্যে তোহফা বা ঈদের উপহার বলে দেয়াও জায়েয। তবে যাকাত আদায়ের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, যাকাত দাতা মনে মনে যাকাত দেয়ার নিয়ত করবে।
২. কেউ এ আশায় যদি অগ্রিম যাকাত দেয় যে, সে সাহেবে নিসাব হয়ে যাবে, তাহলে এমন ব্যক্তির যাকাত হবে না। এ ব্যক্তি যে সময় সাহেবে নিসাব হবে এবং বছর পূর্ণ হবে, তখন তাকে আবার যাকাত দিতে হবে। তবে যে ব্যক্তি সাহেবে নিসাব আছে, এমন ব্যক্তি বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেও অগ্রিম যাকাত দিতে পারে। মাসিক কিস্তিতে ও দেয়া জায়িয।
৩. যাকাত এমন মাল দ্বারা পরিশোধ করতে হবে, যার আর্থিক মূল্য আছে এবং যা শরীয়তে মাল হিসেবে স্বীকৃত। যাকাত মধ্যম মানের মাল দ্বারা আদায় করা উচিৎ।
৪. যাকাত এর হকদার কোন এক ব্যক্তিকেও দেয়া যায় এবং কোন সংগঠন বা সংস্থাকে ও দেয়া যায়। স্বয়ং এ ধরনের কোন সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যা যাকাত ব্যয় করার উপযোগী, যেমন ইয়াতীমখানা, দু:স্থদের জন্যে বিনা মূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৫. অভাবগ্রস্তদেরকে যাকাত খাত থেকে কর্জে হাসানা দেয়া ও জায়িয। তাদের অবস্থার উন্নয়ন এবং তাদের আপন পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে এটি অতি উত্তম কাজ।
৬. যে সব আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়িয তাদের কে দিলে দ্বিগুণ ছওয়াব পাওয়া যাবে। এক যাকাত দেয়ার এবং দ্বিতীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ছওয়াব।
৭. বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যাকাত গ্রহণ করতে যদি লজ্জাবোধ করে অথবা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্বেও যাকাত নেয়া খারাপ মনে করে,তাহলে তাদেরকে যাকাত দেয়ার উৎকৃষ্ট উপায় হলো কোন ঈদের পূর্বে অথবা বিয়ে শাদীতে সাহায্য বা উপটৌকন স্বরূপ অথবা অন্য কোন প্রকারে যাকাত তাদেরকে পৌঁছে দিতে হবে।
৮. কোন ব্যক্তি নিজের কোন আত্মীয় বন্ধু অথবা যে কোন লোকের পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। যেমন স্বামী তার স্ত্রীর গহনা প্রভৃতির যাকাত নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিলে স্ত্রীর যাকাত দেয়া হয়ে যাবে। একবার নবী করীম সা. তার চাচা হযরত আব্বাস রা. এর পক্ষ থেকে যাকাত দিয়েছিলেন।
৯. যাকাত আদায়ের জন্যে এটাও শর্ত যে, যাকে যাকাত দেয়া হবে তাকে যাকাতের মালিক বানিয়ে দিতে হবে এবং যাকাত তার হস্তগত হতে হবে।{ সহীহ মুসলিম্}
কোন সংস্থা বা বয়তুলমালকে যাকাত দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে যাকাত সংগ্রহ বা আদায় কারীকে দিয়ে দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়। তার পর বায়তুলমাল বা যাকাত আদায়কারীর দায়িত্ব এসে গেল। যাকাত দাতার এ দায়িত্ব নয় যে, হকদারকে পুনরায় মালিক বানিয়ে দেবে।
১০. যে এলাকার যাকাত সে এলাকায়ই বন্টন করা ভালো। তবে বিশেষ প্রয়োজনে অন্য এলাকায় ও দেয়া যায়। যেমন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অন্য- এলাকায় বাসকরে এবং তারা অভাবগ্রস্ত অথবা অন্য এলাকায় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। তবে এটা খেয়াল রাখা জরুরী যে এলাকার কোন দুঃস্থ লোক যেন একে বারে বঞ্চিত না হয়।
১১. চাঁদ মাস অনুযায়ী যাকাত হিসেব করে দিয়ে দেয়া ভালো। তবে সৌরমাস হিসেবেও যাকাত দেয়া যায়। রমজান মাস যেহেতু অধিক সওয়াব ও নেকীর মাস সেহেতু যাকাত রামাজান মাসে দেয়া সবচেয়ে উত্তম। তবে এটা যাকাত আদায়ের কোন শর্ত বা ওয়াজিব নয়।
যাকাতের হার এর মাসায়েল
১.স্বর্ণ-রৌপ্য, ব্যবসার মাল, ধাতু মুদ্রা, টাকার নোট, অলংকার প্রভৃতির শর্তকরা (২.৫%) আড়াই ভাগ হারে যাকাত দিতে হবে।
২.স্বর্ণ রৌপ্য অথবা অলংকারের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ স্বর্ণ অথবা রৌপ্য যাকাত হিসেবে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু এটা জরুরী নয় যে স্বর্ণ রৌপ্যই যাকাত হিসেবে দিতে হবে। তার মূল্য হিসেব করে নগদ অর্থও দেয়া যেতে পারে অথবা কাপড়/অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দ্বারা দেয়া যেতে পারে।
৩. নগদ অর্থ এবং ব্যাবসায়ের মালের মূল্য যদি স্বর্ণ অথবা রৌপ্যের কোন একটির নিসাব পরিমাণ হয়, তা হলে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।
৪.স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকারাদিতে যদি অন্য কোন ধাতু মিশ্রিত থাকে এবং তার পরিমাণ যদি স্বর্ণ রৌপ্যের কম হয়, তাহলে তা ধর্তব্যের মধ্যে হবে না। আর যদি তার মধ্যে স্বর্ণ রৌপ্য কম থাকে তাহলে শুধু স্বর্ণ-রৌপ্যের হিসেব করে নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে।
৫. কারো নিকট কিছু স্বর্ণ এবং কিছু রৌপ্য আছে। তার মধ্যে যেটারই নিসাব পূর্ণ হবে তার সাথে অন্যটার মূল্য হিসেব করে শর্তকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। তবে গরীব লোকদের যাতে উপকার হয় সে নিসাব অনুযায়ী হিসেব করা উত্তম।
যাকাতের অর্থ ব্যয়ের কিছু মাসায়েল
১. এটা জরুরী নয় যে কুরআনে বর্ণিত ৮টি খাতের সবখানেই যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হবে। বরং প্রয়োজন অনুসারে ও সুযোগ-সুবিধা মত যে যে খাতে যতটা ভাল মনে করা হবে ব্যয় করা যেতে পারে। এমনকি যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোন একটি খাতে সমুদয় অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
২. যাকাত ব্যয় করার যেসব খাত, উশর ও সদকায়ে ফিতরেরও সেই খাত। নফল সদকা অবশ্যই দাতার ইখতিয়ারাধীন।
যাকাতের আরো কিছু মাসায়েল
১. আপনার থেকে কেউ টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু তার বর্তমান অবস্থা এমন যে, সে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এখন যদি আপনি আপনার যাকাতের মধ্যে উক্ত ঋণ কেটে নেন তাহলে আপনার যাকাত আদায় হবে না। এক্ষেত্রে উত্তম ও সঠিক পন্থা হলো, আপনি যদি প্রথমে ঋণের পরিমাণ টাকা তাকে দিয়ে দেন অতঃপর তার কাছ থেকে আবার ঋণ হিসেবে আদায় করে নেন, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
২. বাসা-বাড়িতে কাজের জন্য যেসব চাকর-চাকরানী, বুয়া প্রভৃতি থাকে কাজের পারিশ্রমিক ও বেতন হিসেবে তাদেরকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। বেতন দেয়ার পর যাকাতের থেকে দেয়া যেতে পারে যদি সে যাকাতের হকদার হয়।
৩. দুস্থ অভাবগ্রস্তদের যাকাত হিসেবে নগদ টাকা দিয়ে দেয়া জরুরী নয় বরং কাপড়-চোপড়, ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় যেকোন জিনিস দ্বারা যাকাত আদায় করা যাবে।
৪. অভাবগ্রস্ত দুধমাতাকে দুধপুত্রের পক্ষ থেকে বয়স্ক হওয়ার পর যাকাত দেয়া জায়িয।
৫. কাউকে হকদার মনে করে যাকাত দেয়ার পর জানা গেল যে, সে সাহেবে নিসাব অথবা হাশেমী সাইয়্যেদ, কিংবা অন্ধকারে যাকাত দেয়ার পর জানা গেল যে, সে এমন কোন আত্মীয় যাকে যাকাত দেয়া জায়িয নয়। এমতাবস্থায় যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্যি যে নেবে সে যদি হকদার না হয়, তাহলে নেয়ার পর তার ফেরত দেয়া উচিৎ।
৬. পুরস্কার বা হাদিয়া হিসেবে পাওয়া অর্থ নিসাব পরিমাণ হলে এবং তাতে একবছর পূর্ণ হলে তাকে যাকাত দিতে হবে।
৭. যাকাতের নিয়ত ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি সারা বছর বিভিন্নভাবে দান খয়রাত- করতে থাকলো। তাহলে বছর শেষ হওয়ার পর ওসব দানকৃত মাল যাকাতের হিসেবে গণ্য হবে না।
৮. যাকাতের টাকা মানি অর্ডার/ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও হকদারের নিকট পাঠানো যায়। এতে মানি অর্ডার ফিস বা ব্যাংকে প্রেরণের কমিশন যাকাত থেকে দেয়া জায়িয।
ইনশা আল্লাহ ধারাবাহিক ভাবে চলবে.............
১ম কিস্তি
Click This Link
২য় কিস্তি
Click This Link
৩য় কিস্তি
Click This Link