Book Review: Power of Habit-Part Two -Chapter Six: The Power of Crisis
পাওয়ার অফ ক্রাইসিসঃ দুর্যোগ থেকে প্রতিষ্ঠানের নেতারা কিভাবে নতুন কার্যকর অভ্যাস তৈরি করেন
রোড আইল্যান্ড (Rhode Island ) হাসপাতালে একজন ৮৬ বছর বয়স্ক রোগী আসেন যিনি তিন দিন আগে যিনি বাসায় পড়ে গিয়েছিলেন, তারপর থেকে তিনি জেগে থাকতে পারছিলেন না এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন। মস্তিষ্কের স্ক্যান থেকে দেখা যায় তার মাথায় রক্তপাত হয়েছে (subdural hematoma) এবং তার জীবন বাচাতে হলে দ্রুত অপারেশন করে জমে থাকা রক্ত বের করে ফেলতে হবে। ওই সময় রোড আইল্যান্ড হাসপাতালের একটি দূর্ণাম ছিল, তা হলো সেখানে ডাক্তার আর নার্সদের মধ্যে একধরনের শ্ত্রতা ছিল, ক্ষমতার দ্বন্দ ছিল। সার্জারির আগে পুরো প্রক্রিয়া কাগজে লিখে ফেলা হতো, যেখানে রোগীর অভিভাবকের সম্মতিসুচক স্বাক্ষর নেয়া হতো। ডাক্তারের সহকারী নার্সের দ্বায়িত্ব ছিল সার্জারির আগে পুরো জিনিষটা আরেকবার চেক করা এবং তার কাছে কোন সন্দেহ হলে তিনি টাইম আউট ঘোষনা করে ব্যাপারটা আবার ডাক্তারকে দিয়ে পুনঃ পর্যালোচনা করাতে পারতেন। কোন কোন ডাক্তার বিষয়টা সহজ ভাবে নিতেন না। এখান থেকে ব্যাপারটা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে এবং কিছু অলিখিত অভ্যাস তৈরি হয়। যে সমস্ত ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সহযোগিতা পাওয়া যেত না সেরকম অনেক ক্ষেত্রে নার্সরা একধরনের আপোষের মধ্যে দিয়ে যেতেন। ডাক্তারদের একগুয়েমি এবং অসহযোগিতার মানদন্ড বিবেচনায় নার্সরা ডাক্তারদের ছদ্মনাম দেন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য একধরনের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক করে নেন, যাতে তারা কোন ডাক্তারকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে সে বিষয়ে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করতে পারেন। আগত এই রোগির অপারেশন রুমে সাহায্যকারী নার্স সার্জারির আগে ডাক্তারকে জানান মাথার কোন দিকে অপারেশন করতে হবে তা লিখিত ফর্মে উল্লেখ নাই এবং তিনি টাইম আউট ঘোষনা করে আরেকবার রিভিউ করার অনুরোধ করেন। ডাক্তার রাজী হন না, এমনকি তিনি স্ক্যান ছবি আরেকবার দেখতেও অস্বীকার করেন। তিনি বলেন আমি স্ক্যান রিপোর্ট দেখেছি এবং রোগীর জীবন বাচাতে দ্রুত অপারেশন করা দরকার। তিনি মাথার খুলির এক দিকে কেটে দেখেন সেখানে কোন জমাট রক্ত নাই, অর্থাত তিনি ভুল দিকে অপারেশন করেছেন। তিনি এই দিক জোড়া লাগিয়ে অপর সাইড অপারেশন করেন এবং হেমাটোমা অপসারন করেন। দুই সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। হাসপাতাল কতৃপক্ষ জরিমানা দিয়ে হাসপাতাল বিষয়টি সেটল করেন। সমসাময়িক সময়ে এই হাসপাতালে এরকম অনেক ভুল অপারেশন এর উদাহরন পাওয়া যায়।
এই হাসপাতালে যে অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল তা কোন পরিকল্পনা করে করা হয়নি। বরং ডাক্তার আর নার্সদের দ্ন্দ্ব থেকে অপরিকল্পিত অভ্যাস তৈরি হয় যেটা সাময়িক শান্তিপুর্ণ সহাবস্থান নির্দেশ করে। আসলে সেটাকে একটা বিষাক্ত সংস্কৃতি কিম্বা অভ্যাস বলা যায় যার আবশ্যাম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে দুর্ঘটনা বা ক্রাইসিস।
১৯৮২ সালে নেলসন এবং উইন্টার (Nelson and Winter) একটি বই প্রকাশ করেন an evolutionary Theory of Economic Change নামে, যেটা দ্রুতই সংগঠনের স্ট্রাটেজি এবং অভ্যাসের ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ তৈরি করে। তাদের ভাষ্য মতে সাধারনত মনে করা হয় একটা সংগঠন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সংগঠন পরিচালিত হয় কিন্তু সেটা আসলে ঠিক নয়। বরং একটি সংগঠন চলে দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা সংগঠনের অভ্যাস থেকে যেটা আবার তৈরি হয় অসংখ্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত/অভ্যাস থেকে। নেলসন এবং উইন্টারের মতে সংগঠনের অভ্যাস একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। এটা ছাড়া একটা সংগঠণ তার কাজ করতে পারে না। এই অভ্যাসগুলো অনেক সময় নিয়ে অলিখিতভাবে তৈরি করে। এটা এক ধরনের সাংগঠনিক স্মৃতি তৈরি করে যার জন্য একজন কর্মীকে বার বার বিক্রির দক্ষতা শিখতে হয়না কিম্বা একজন ডিভিশন প্রধান চলে গেলে কর্মীদের মধ্যে অস্বাভাবিক ভীতি তৈরি করে না। সবচে গুরুত্বপুর্ন হচ্ছে এই নিয়ম/অভ্যাসের ফলে একাধিক প্রতিদ্বন্দী ব্যাক্তি বা সংগঠনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এক ধরনের সন্ধি স্থাপিত হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান একটি সুখী পরিবার নয়। এখানে কর্মী/কর্মকর্তা/ব্যবস্থাপকগণ ক্ষমতা ও সুনাম কুড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতা করেন, নিজের কর্মদক্ষতা ভালো দেখানোর জন্য প্রতিদন্দিতা করেন। বিভিন্ন ডিভিশন রিসোর্স পাবার জন্য প্রতিযোগিতা করে, কোথাও কোথাও হয়ত অন্তর্ঘাতের চেষ্টাও থাকে। এটা একটা সুখি পরিবারের মত নয় বরং এক ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র। এরপরও প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তার কারন হচ্ছে এক ধরনের ঘটে চলা ইঙ্গিতের (Cue) বিপরীতে কাজ (Routine) সম্পন্ন হয় তাতে পুরস্কারও (reward) পাওয়া যায় (অভ্যাস চক্র কাজ করে, কোম্পানিতে একটী কার্যকর অয়াস তৈরি হয়, কোম্পানি লাভজনক ভাবে চলে) । অর্থাত এক ধরনের প্রাতিষ্ঠাণিক অভ্যাস তৈরি হয়, যার বিনিময়ে যুদ্ধরত প্রতিপক্ষগুলোর মাঝে একধরনের সাম্য বিরাজ করে এবং কোম্পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়।
মনে করুন আপনি একটা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। একজন নতুন সহকর্মী যে কিনা সদ্য যোগদান করেছে সে আপনার কাছে এই প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের পরামর্শ চাইলো। আপনি কি তাকে কোম্পানির কাজের পদ্ধতির যে মান্যুয়াল আছে সেটা ধরিয়ে দিবেন? আপনি যদি তার প্রতি আন্তরিক হন তাহলে সম্ভবত আপনি সেটা করবেন না, বরং প্রতিষ্ঠানের অভ্যাসের ফলে সৃষ্ট অলিখিত নিয়মগুলি তাকে বলবেন। আপনি তাকে জানাবেন কে এখানে বিশ্বস্ত, অপরকে সাহায্য করে, কোন সেক্রেটারী তার বসের চেয়ে বেশি ক্ষমতা দেখায়, এখানকার আমলাতান্ত্রিকতা কিভাবে দূর করে সে তার কাজ বের করে আনতে পারবে ইত্যাদি। অর্থাৎ আপনি তাকে কিন্তু সেগুলিই বলবেন যেটা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস, যেটা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার দৈনন্দিন কর্ম সম্পন্ন করে।
১৯৮৭ সালের নভেম্বরে লন্ডনের কিংস ক্রস সাবওয়ে স্টেশনে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। ঘটনার শুরুতেই একজন যাত্রী একজন কর্মীকে জানায় নীচে একটি টিস্যু পেপারে তিনি আগুন জ্বলতে দেখেছেন। উক্ত কর্মী নীচে গিয়ে আগুন নিভিয়ে তার দ্বায়িত্বে ফিরে যায়। আগুন কেন লাগলো কিম্বা আগুনের উৎস বের করে নিভানোর কোন চেষ্টা তিনি করেন নি। তিনি যে ডিপার্ট্মেন্টে চাকরি করতেন তাতে আগুন নিভানো তার দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সেখানকার অলিখিত নিয়ম (প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস) ছিল শুধু কর্মীরা নয়, উপরের স্তরের বসেরাও একে অন্যের কাজের নির্ধারিত সীমা মাড়াতো না। সেজন্য অপারেশন পরিচলকের এটা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না যে তার ডিপার্ট্মেন্টের কর্মীরা অগ্নিনির্বাপন এবং ইভাকুয়েশন এর ব্যাপারে যথাযথ ট্রেনিং পেয়েছে কিনা। নীচে আগুন বাড়তে থাকে, আরো কয়েকজন যাত্রী আগুন রিপোর্ট করে। সেফটি ইন্সপেকটর অবশেষে ব্যাপারটা জানতে পারে এবং আগুন নিভাতে সচেষ্ট হয়। তবে এখানকার অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী তখনো তিনি ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করেন নি। একজন পুলিশ আগুন দেখতে পেয়ে তার উপরের অফিসারের কাছে রিপোর্ট করেন এবং তিনি ফায়ার ব্রিগেড ফোন করেন। ফায়ার ব্রিগেডেরও অলিখিত নিয়ম ছিল কোন জায়গায় আগুন নেভাতে হলে তারা কোন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হোস পাইপ ব্যাবহার না করে তারা ঐ স্থানের পাবলিক এলাকার ফায়ার ব্রিগেডের স্থাপিত হোস পাইপে সংযোগ দিয়ে আগুণ নিভাবেন। এখানেও তারা মেট্রো স্টেশনের হোস পাইপ ব্যবহার না করে পাশের পাব্লিক এলাকার হোস পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করে। দীর্ঘ ছয় ঘন্টার চেষ্টায় তারা আগুণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এই ঘটনায় ৩১ জন মানুষ মারা যায়। ঐখানে কোন একক ব্যক্তি আগুন নিভানোর দ্বায়িত্ব নেয়নি।
এর আগে আমরা বিষাক্ত অভ্যাসের কথা বলেছিলাম, রোড আইল্যান্ড হাসপাতালের উদাহরনে।এই সাবওয়ে স্টেশনের ক্ষত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু ঠিকমতই চলছিল, প্রতিদ্বন্দী বিভাগগুলি অপরিকল্পিত অভ্যাসের মাধ্যমে একধরনের সন্ধি বা সাম্যবস্থানের তৈরি করেছিল কিন্তু অগ্নি দুর্ঘটনাটি দেখিয়ে দিল এটি আসলে কোন ভাল অভ্যাসের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। পরবর্তী তদন্তে দেখা যায় এখানে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুকি সবাই জানত, এমনকি ফায়ার ব্রিগেডও দুই বছর আগে চিঠি দিয়ে ঝুকির কথা জানিয়েছিল, কিছু উদ্যোগ নেয়াও হয়েছিল কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
রোড আইল্যান্ড হাসপাতালে আরো কিছু ভুল অপারেশনের পর বিষয়টা নিয়ে মিডিয়ায় হই চই শুরু হয়। ভুল শোধরানোর আগের অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হলেও আবারও উদ্যোগ নেয়া হয়। একদিন সব অপারেশন বাদ দিয়ে সমস্ত ডাক্তার সেবিকাদের নিয়ে কর্মশালার উদ্যোগ নেয়া হয় যেখানে ফোকাস এরিয়া ছিল টিমওয়ার্ক, নার্স ও সহকারিদের ক্ষমতায়ন নিয়ে। নিউরো সার্জারির প্রধান পদত্যাগ করেন, নতুন নেতৃত্ব পদে আসেন। প্রসেস রিডিজাইন করার জন্য ৩য় পক্ষকে নিয়োগ দেয়া হয়। সার্জারির আগে চেক লিস্ট চেকিং এবং টাইম আউটের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হয়। সার্জারি রুমে ভিডিও স্থাপন করা হয় যেটার জন্য আগে কেউ রাজী হয় নি। ক্রাইসিস সবাইকে নতুনত্ব গ্রহন করার ব্যাপারে সাহায্য করে। ডাক্তাররাও তাদের প্রায় ভুলগুলো (near miss) খোলামেলা আলোচনা করেন এবং নতুন পদ্ধতিকে স্বাগত জানান। অভ্যাস বদলিয়ে যায়। অন্যান্য হাসপাতালও তাদের অনুসরণ করা শুরু করে। ভুল অপারেশনের সংখ্যা নাই হয়ে যায়।
ভাল নেতৃত্ব থাকলে তারা ক্রাইসিস থেকে নতুন অভ্যাস তৈরি করেন। নাসা ( NASA) অনেকদিন থেকে নিরাপত্তা বিষয়গুলি উন্নত করার চেষ্টা করছিল কিন্তু ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনার আগে তারা কিছু করতে ব্যর্থ হন। এয়ারলাইন্সের পাইলটেরা ককপিট ডিজাইন বদলানোর কথা বলেছেন অনেক দিন যেটা বাস্তবতা পায় ১৯৭৭ সালে স্পেনের টেনেরিফি দ্বীপে বিমান দুর্ঘটনার পর যেখানে ৫৮৩ জন মানুষ নিহত হন। লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশনে আগুন লাগবার পর এখন নিয়মও (প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস) বদলানো হয়েছে। প্রত্যেক স্টশনের ম্যানেজারের বর্তমানে প্রধান দ্বায়িত্ব হচ্ছে যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং প্রত্যেক কর্মী ন্যুনতম ঝুকি দেখলেই সাথে সাথেই রিপোর্ট করার নিয়ম তৈরি হয়েছে।
যে কোন কোম্পানিতে এরকম অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠা বিষাক্ত অভ্যাস অবশ্যই দুর কর যায়। তবে এটা শুধুমাত্র নির্বাহী আদেশে পরিবর্তন হবে না বরং পকৃত দুর্যোগ/দুর্ঘটণা থেকে কিম্বা এক ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতির আবহ (ক্রাইসিস পারসেপ্সন) তৈরী করে মুল অভ্যাস (keystone habit) তৈরির মাধ্যমে এটা পরিবর্তন করা যায়।
এর পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব কিভাবে কোন কোম্পানি ক্রেতার অভ্যাস পুর্বেই ধারনা করে এবং সেটাকে তাদের পণ্য বিক্রি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৮