অভ্যাসের শক্তি (power of habit), রচনা: চার্লস দুহিগ (Charles Duhigg): (Part One-Chapter Two: The Craving Brain)
মস্তিষ্কের ক্ষুধাঃ কিভাবে নতুন অভ্যাস তৈরী করা যায়?
এই অধ্যায়ের মুল বিষয় হলো কিভাবে নতুন অভ্যাস তৈরি করা যায়। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে কিভাবে অভ্যাস কাজ করে। এক কথায় বললে অভ্যাস হচ্ছে ইঙ্গিত-কাজ-পুরস্কার
( Cue-Routine-Reward) এই তিনের সমন্বয়ে একটি চক্র। মস্তিষ্ক যখন ইংগিত পায়, সে তখন একটা কাজ সম্পন্ন করে যেটা তাকে একটা আকাংখিত পুরষ্কার দেয়।
১৯০০ শতকের প্রথম দিকে আমেরিকায় একজন বিজ্ঞাপন বানানোর জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন তার নাম ক্লাউড সি. হপকিন্স (Claude C. Hopkins), তিনি বিভিন্ন দ্রব্যের বিজ্ঞাপন বানিয়ে প্রচুর সুনাম এবং টাকা উপার্জন করেছিলেন। সেই সময় হপকিন্স এর এক বন্ধু তাকে এসে তার নতুন আবিষ্কৃত পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন বানানোর অনুরোধ করেন। সেই সময় আমেরিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয়েছে, মানুষ অধিক চিনিযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার বাড়িয়ে দিয়েছে এবং জাতিগত ভাবে দাতের স্বাস্থের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বেশ কিছু টুথপেস্ট এবং টুথ পাউডার বাজারে ছিল, তাদের প্রচুর বিজ্ঞাপন এবং বাসায় যেয়ে যেয়ে বিক্রির প্রচেষ্টা ছিল কিন্ত বিক্রির অবস্থা ছিল খুব খারাপ। কারন মানুষ আদৌ দাতই মাজত না। সুতরাং হপকিন্স একটু চিন্তা করে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কিন্তু বন্ধুটি ছিল নাছোড়বান্দা, তিনি বার বার অনুরোধ করতেই থাকেন, নিজের উদ্ভাবিত দ্রব্যের ব্যাপারে উনার আস্থা ছিল অনেক বেশী। অবশেষে হপকিন্স সাহেব ছয় মাসের পেপসোডেন্ট এর রেভিনিউ এর বিনিময়ে এটা নিয়ে কাজ করতে রাজী হন। আর এটা ছিল উনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। পাচ বছরের মাথায় পেপসোডেন্ট পৃথিবীর সবচে বেশী পরিচিত দ্রব্যের অবস্থান দখল করে। হপকিন্স দাত মাজার বিষয়টি আমেরিকানদের প্রতিদিনের অভ্যসে পরিণত করেন। তিনি পুরো জাতির মধ্যে একটি নতুন অভ্যাস তৈরী হয়।
হপকিন্স বিভিন্ন বিজ্ঞাপন তৈরীর জন্য অভ্যাস চক্রকে কাজে লাগিয়েছেন সফল ভাবে। তিনি একটি সাধারন ইংগিত খুজে বের করতেন। পেপসোডেন্ট এর বিজ্ঞাপনের জন্য তিনি ডেন্টাল এর পাঠ্য বই পড়া শুরু করেন। তিনি জানতে পারলেন দাতের উপর মিউসিনের প্লাক জমা হয়, যেটাকে তিনি ফ্লিম বলে অভিহিত করেন। তিনি এই ফ্লিম কে ইংগিত (Cue) হিসাবে ব্যবহার করে উনার বিজ্ঞাপন ডিজাইন করলেন, কাজ (routine) হলো দাত মাজা আর পুরস্কার (reward) হলো সুন্দর দাত বা হাসি। বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হলো এবং তারপর শুধুই সাফল্যের গল্প। মজার ব্যাপার হলো দাতের এই ফ্লিম দূর করতে পেপসোডেন্টের কোন ভুমিকা ছিলনা। একটা আপেল খেলে কিম্বা খালি হাতে দাত কচলালেও এই ফ্লিম দূর হয়ে যেত।
আরেকটি কেস স্টাডি দেয়া হয়েছে এই অধ্যায়ে, প্রোক্টর এন্ড গ্যাম্বল এর ফেব্রিজ এর। এটি একটি স্প্রে এট যেকোন জায়গায় স্প্রে করলে সেই জায়গায় যদি কোন অন্য বাজে দুর্গন্ধ থাকে (যেমন ধুমপানের গন্ধ কিম্বা পোষা প্রাণীর গায়ের গন্ধ ইত্যাদি) তাহলে সেটি দূর হয়। এই দ্রব্যটি বাজারজাত করতে কোম্পানীকে অনেক বেগ পেতে হয়। এই দ্রব্যটি প্রায় ব্যর্থ হয়ে পরিত্যাক্ত হবার সিদ্ধান্ত হতেও গেছিল। এ অবস্থা থেকে মার্কেটিং টিম শেষ বারের মত চেষ্টা করতে সুযোগ চান, নামকরা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পিইএইচডি ছাত্রকে গবেষণার সাথে যুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত তারা একটি ইংগিত (CUE) খুজে বের করেন যেটি দিয়ে ফিব্রিজ ব্যবহার করে একটি পুরস্কার ডিজাইন করেন। একটি সফল অভ্যাস চক্র তেরী করেন যা দ্রব্যটির বিলিওন ডলারের ব্যবসা নিশ্চত করে। তবে ইংগিত আর পুরস্কারে মৌলিক কাঠামোতে (প্রাথমিক চিন্তার তুলনায়) ব্যপক পরিবর্তন আনতে হয়, দ্রব্যটির কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়।
এবার আমরা জানব অভ্যাস কিভাবে তৈরী হয় এই বিষয়ে কেম্ব্রিজ বশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসাইন্স এর অধ্যাপক উলফ্রাম শুলজ (Wolfram Schultz) এর গবেষনার কথা। বিজ্ঞানীরা আগেই জানতেন অভ্যাস চক্রের কথা। ইঙ্গিত-কাজ-পুরস্কার এর সমন্বয়ে সাধারনত অভ্যাস চক্র তৈরী হয় কিন্তু কেন একটি অভ্যাস আরেকটির চেয়ে বেশী শক্তিশালী হয় সেই বিষয়টি আমরা জানতে পারি এই গবেষনা থেকে। তিনি একটি পরীক্ষা করেন যেখানে জুলিও নামের একটি বানরের মাথায় ইলেক্ট্রোড লাগিয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্রম (neuronal activities) পরীক্ষা করেন। একটি অন্ধকার ঘরে বানরটিকে রেখে একটি কম্পিউটার মনিটর চালু করা করা হয়, যেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি ছবি আসে। বানরটির কাজ হলো যখন ছবি আসে তখন যদি সে একটি লিভারে চাপ দেয় তাহলে একটি নল দিয়ে স্ট্রবেরী জুস আসে যেটা সে খেতে পারে। খুব দ্রুতই জুলিও এতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং কম্পিউটার মনিটরে ছবি আসার অপেক্ষায় থাকে। যখনি ছবি আসে সে লিভার চেপে জুস খায়। মি. শুলজ বানরের মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করে একটি নির্দিষট নিয়ম (pattern) দেখতে পান। শুরু থেকে মস্তিষ্কের কার্যক্রমের সংকেত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলেও যখন বানরটি জুস খেতে পায় তখন এই সংকেত অনেক গুণে বৃদ্ধি পায়, এটা তার পুরস্কারের আনন্দ বলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌছান। এই পরীক্ষাটি বার বার করার পর তিনি এই মস্তিষ্কের সংকেতের নিয়মে একটি আকর্ষণীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। অভ্যাস দৃঢ় হবার সাথে সাথে পুরস্কার পাবার যে সংকেতটি এগিয়ে আসে। অর্থাৎ প্রথম দিকে জুস খাবার সময় মস্তিষ্কের যে সংকেতের যে সর্বোচ্চ অবস্থা ছিল, পরবর্তীতে দেখা গেল কম্পিউটার মনিটরে ছবি দেখার সাথে সাথেই মস্তিষ্কে সংকেতের সেই সর্বোচ্চ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ জুস খাবার আগেই মস্তিষ্কে জুস খাবার আনন্দ হচ্ছে। এটাকে তিনি আখ্যা দেন মস্তিষ্কের ক্ষুধা (Craving of brain) বলে। এই পর্যায়ে মাঝে মাঝে জুসের পরিবর্তে পানি বা পানসে জুস দিয়ে দেখেন। তিনি দেখতে পান যে এই আনন্দ আগেই পেয়ে যাবার পর যদি লিভার চেপে সে জুস না পায় তথা পানি কিম্বা পানসে জুস পায় তখন সে রাগান্বিত হয়ে যায়। অন্য গবেষনাগারেও এ ধরনের পরীক্ষা করে একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়। যেখানে বেশ কিছু বানর নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা করা হয় এবং মাঝ পথে দরজা খুলে দেয়া হয়। যেখানে বানররা চাইলে রুমের বাইরে যেয়ে অন্যদের সাথে খেলতে পারে এবং বাইরে রাখা খাবার খেতে পারে। দেখা যায় যে সমস্ত বানরের দৃঢ় অভ্যাস হয় (অর্থাত মস্তিষ্ক আসল খাবার পাবার আগেই যখন আনন্দ পায়) তারা রুমের দরজা খুলে দিলেও বাইরে না যেয়ে চেয়ারে বসে কম্পিউটারের ছবির অপেক্ষায় থাকে। আর কিছু বানর যাদের মস্তিষ্কের ক্ষুধা তৈরী হয়নি তারা দরজা খুলে দিলেই বাইরে চলে যায় এবং পরীক্ষা রুমে ফিরে আসেনা।
এই পরীক্ষার ফলাফল থেকেই বিজ্ঞানীরা ব্যাখা করেন কেন অভ্যাস এত শক্তিশালী হয়ে থাকে, তা হলো কাজটি করে যে পুরস্কার পাবার কথা মস্তিষ্ক আগে থেকেই সেই আনন্দ অনুভব করে অর্থাৎ ঐ আনন্দের জন্য কাজের আগেই মস্তষ্কে ক্ষুধা তৈরি হয় এবং সে কাজটা করবার জন্য ব্যগ্র থাকে। তবে এই অভ্যাস একদিনেই তৈরী হয়না, ধীরে ধীরে একজন মানুষের অজান্তেই এটা তৈরী হয়। একজন ধুমপায়ী যখন সিগারেটের প্যাকেট দেখে তার মস্তিষ্ক নিকোটিনের জন্য ক্ষুধা অনুভব করতে থাকে এবং ওই সময় সিগারেট না খেতে পারলে হতাশ এবং বঞ্চিত বোধ করে, সে সিগারেট খেয়ে মস্তিষ্কের ক্ষুধা নিবারন করে।
পেপসোডেন্ট সফল হবার পর এটার কারন নিয়েও গবেষণা হয়। পেপসোডেন্ট ঐ সময় সাইট্রিক এসিড, মিন্ট ওয়েল এবং আরো কিছু কেমিক্যাল ব্যাবহার করে যা অন্য টুথপেস্টে ছিলনা। এই টুথপেস্ট মুখে এক ভিন্ন ধরনের স্বাদ তৈরি করে, দাত মাজবার পর একধরনের ঠান্ডা আর সাময়িক অবশকারী সংবেদনশীলতা তৈরী হতো ( cool & tingling sensation)। জরীপে দেখা যায় মানুষ দাত মাজতে ভুলে গেলে এই স্বাদ আর অনুভুতিটার অভাব অনুভব করত। যেটাকে পরবর্তীতে মি শুলজের তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে ব্যাখা দেয়া হয়। আসলে মানুষের মস্তিষ্কে এই অনুভুতির জন্য ক্ষুধা তৈরি হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে দাত না মাজলে মস্তিষ্কে বঞ্চনার অনুভুতি হতো। যেটা পেপসোডেন্ট ব্যাবহারকে একটি শক্তিশালী অভ্যাসে পরিনত করে। মি হপকিন্স আসলে সুন্দর দাত বা হাসি বিক্রি করেন নি (তিনি কিন্তু তাই ভেবেছিলেন), মুলত তিনি বিক্রি করেছিলেন “ঠান্ডা আর সাময়িক অবশকারী সংবেদনশীলতা (cool & tingling sensation)” অনুভুতি যেটা মস্তিষ্কের ক্ষুধা তৈরী করতে পেরেছিল।
একই রকমভাবে ফিব্রিজের সফলতার ব্যাখা দাড় করিয়েছেন গবেষকরা। ফিব্রিজ মার্কেটিং টিম প্রথমে চেষ্টা করেছিল এটাকে গন্ধ দূর করার স্প্রে হিসাবে যেটা আসলে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে গবেষকরা গৃহিণিদের বাড়ি পরিস্কার করার ভিডিও দেখেন। তারা দেখেন অনেকেই রুম গোছানোর কাজ শেষ করার পর একটা হাসি দেয় কিম্বা আরামদায়ক একটা অনুভুতির বহিপ্রকাশ ঘটান। গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন মহিলাদের ঘর গুছানোর শেষে যে আনন্দ তারা পাচ্ছেন সেটাকেই অভ্যাস চক্রের পুরস্কার হিসাবে ডিজাইন করবেন। উনারা ফিব্রিজের মধ্যে হালকা সুগন্ধ মিশিয়ে দেন, বিজ্ঞাপন ডিজাইন করেন যেন গৃহিনীরা ঘর গুছানো শেষ করে ফিব্রিজ স্প্রে করে দেন যেন এটা তাদের আনন্দের অনুভুতিকে বাড়িয়ে দেয়। পরের গল্প সফলতার।
অভ্যাস তৈরি করার জন্য একটি ইংগিত, রুটিন আর পুরস্কার চক্র তৈরী করে মস্তিষ্কের ক্ষুধার চাষ করতে হয়। মস্তিষ্কের ক্ষুধা চাষ করতে সফল হলে একটি শক্ত অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব। এভাবে আপনি চাইলে নিজের জন্য নতুন অভ্যাস তৈরী করতে পারেন। সকালে দৌড়াতে চান? একটি সাধারন ইংগিত (cue) প্রস্তত করুন, যেমন বিছানার পাশে দৌড়বার জুতা রাখুন, দৌড়ানোর পর নিজকে একটি মুল্যবান উপহার দিন (যেমন এক গ্লাস টাটকা ফলের রস)। মস্তিষ্কে সেটার আকাঙ্ক্ষা / ক্ষুধা তৈরী করুন, স্বাভাবিক সময়ে এই পুরস্কারটা নিয়ে ভাবুন, মস্তিষ্কের ক্ষুধা তৈরী হতে দিন। দেখবেন ভালো একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে যাবে।
এর পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব কিভাবে একটা অভ্যাস বদলানো যায়।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:০৫