জীবন যে রকমঃ আয়েশা ফয়েজ
তিনি একটি বই লিখেছেন কাজেই তার সবচে বড় পরিচয় তিনি একজন লেখিকা। তবে আর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি হুমায়ন আহমেদ এর মা। আরী একটি পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধে একজন শহীদের স্ত্রী।
বইটি মুলত লেখিকার আত্মজীবনী। নিজের জীবনের বিয়ের ঘটনা থেকে শুরু করেছেন। সময় টা ১৯৪৪। সময়ের সাথে মানুষের চিন্তা, দর্শন আর সমাজ কিভাবে পরিবর্তন হয় সেটা বুঝার জন্য এই বইটি পড়া যেতে পারে। একটা ছোট উদাহরন দেয়া যাক। তখন যৌথ পরিবারে স্বামী স্ত্রী দিনের বেলা কথা বলবে এটা ছিল স্বাভাবিকতা বিরুদ্ধ। স্বামী চাকরি পাবার রেজাল্ট পেয়ে দিনের বেলা স্ত্রীকে জানালেন। লেখিকার বর্ণনায়, ”তখন দিনের বেলা ঘরের ভিতর বউদের সাথে কথা বলা অকল্পনীয় ব্যাপার। সে সেসবের তোয়াক্কা না করে আমাকে খুজে বের করে বলল, ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম মনে আছে? আজ রেজাল্ট হলো, আমি একটা চাকরি পেয়েছি।“ ব্যক্তি জীবনের এরকম বেশ কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণ্না আছে। সন্তান দের জন্ম নিয়ে স্মৃতি চারন করেছেন।
বইটি গত হয়ে যাওয়া সময় কে আমাদের সামনে তুলে ধরে। একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রী, স্বল্প আয়ে কষ্ট করে চলা, বিভিন্ন দুর্গম স্থানে বদলী এবং বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা, বেশ কয়েকজন সন্তান নিয়ে এক মুখরিত পরিবার সব মিলে হয়ত এটি একটি আটপৌরে কাহিনী হতে পারত। কিন্তু বইটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। জীবনের এই সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যে যুদ্ধে তার স্বামীকে পাকিস্তানী মিলিটারীরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কোথাও মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা সহ আশ্রয় পেয়েছে , কেউ আবার নিজের বিপদ এড়াতে বাচ্চা কাচ্চা সহ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। নিজের জীবন বাজী রেখে যুদ্ধের মধ্যেই কিভাবে বিভিন্নজনের (যাদের মাঝে পুলিশ, মিলিটারী এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আছেন) সাথে দেখা করেছেন স্বামীর খোজ পাবার জন্য তার বর্ণ্না দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “কাজলের আব্বাকে মে মাসের পাঁচ তারিখ বিকেল পাঁচটায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। সবাই সেটা জানত, আমাকে সামনাসামনি বলার কারো সাহস হয়নি।“
স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি পিরোজপুর গিয়ে স্বামীর দেহাবশেষ তুলে পোষ্ট মর্টেম করিয়েছেন, শহীদের মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করেছেন এবং স্বাক্ষী প্রমাণ যোগাড় করে স্বামী হত্যার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তার বর্ণ্না পাওয়া যায়। যে মামলা নিয়ে অগ্রগতি হয়নি। এই স্মৃতিটি লিখেছেন লজ্জা নামে শিরোনাম দিয়ে। তার বর্ণ্নায় “অনেক যত্ন করে খুনের কেসটা দাঁড় করানো হয়েছিল। যারা দেখেছে তাদের স্বাক্ষী প্রমাণ। যারা কবর দিয়েছে তাদের সাক্ষী প্রমাণ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সবকিছু। প্রধান আসামী ব্রিগেডিয়ার আতিক রশীদ। সাথে মেজর এজাজ।“
যুদ্ধ পরবর্তী সরকারের কাছে কি ধরনের আচরন পেয়েছেন তার কিছু বর্ণ্না পাওয়া যায়, যা বর্তমান চেতনার বাজারে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন দেশে একজন শহীদের স্ত্রী বাড়ি পাবার একজন একজন মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতে যান। লেখিকার বর্ণ্নায়, “দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা হলো, আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন, বললেন, পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেকদিন সকালে এসে বসে থাকেন?সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব?” পরবর্তীতে অবশ্য কাজলের বাবার এক কালের বিশেষ বন্ধু একজন জয়েন্ট সেক্রেটারীর সাহায্যে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির এলটমেন্ট পেয়েছিলেন। সে বাড়ি থেকেও তাকে সপরিবার বের করে দেয় তখনকার রক্ষীবাহিনী। সকালে তিনি পুলিশের সাহায্য চাইতে যান।
“ভোর হতেই আমি বের হলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। তারা বলল, আমরা গোলামীর পোশাক পরে বসে আছি! রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব?”
আহমদ ছফার প্রচেষ্টায় গণকন্ঠ পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে প্রেক্ষিতে রক্ষীবাহিনী প্রধান উনার সাথে যোগাযোগ করে একটি সমাধান করে দেন। উনার নামে বরাদ্দকৃত দোতলা বাসার নিচ তলা দেন রক্ষীবাহিনির একজন মেজর সুবেদারকে যিনি তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, দোতলায় উনাদের থাকতে দেয়া হয়।
বইটি সুখপাঠ্য। আর ঐতিহাসিক প্রক্ষাপটের কারনে বইটি পড়লে মনে হবে আপনি টাইম ট্রাভেল করে ফিরে গেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময়ে।
বইটির প্রকাশক সময় প্রকাশনি। রকমারী থেকে অন লাইনে কিনতে পারবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৫৯