সে এক বিরাট ইতিহাস। আমার মেয়ে স্কুল শেষে যেখানে থাকে, সেখোনে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মাঝেমধ্যে সে হাড়ি-পাতিল নিয়ে খেলে এবং খাবার বানানোর সময়, সে প্রায়ই লাড্ডু জাতীয় কিছু বানায়। তো সেই লাড্ডু দেখে- তার অতি উৎসাহী এক শিক্ষক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন; রোজ রোজ এসব তুমি কি বানাও?
আমার কন্যা স্মার্টলি জবাব দিল, এর নাম রসগোল্লা।
আর যায় কোথায়? এবার রসগোল্লা কি দেখাও?
আমি পড়লাম মহা ফাঁপড়ে। গতকাল আসল কারিগররে খবর দিলাম। তারপর বানালাম, সাধের রসগোল্লা।
আমি ছিলাম কারিগরের এ্যাসিষ্টেন্ট। এই ফুটফরমাস খাটা আর কি! মিষ্টি বানানো তো আর যা তা কথা নয়। অবশ্য মূল কারিগরকে আমার কন্যা যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
বিচ্ছুগুলো যখন আগ্রহ ভরে মিষ্টিগুলো খাচ্ছিল, তখন মনটা ভরে গেল। কাল ৪ ঘন্টা ধরে আমরা তিনজনে এগুলো বানিয়েছি।
এই সেই শিক্ষক যার প্ররোচণায় রসগোল্লা কি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আজ জুলাইয়ের সাত। আজ যখন মিষ্টিগুলো নিয়ে গেলাম, 'তখন বেশ ভাব নিয়ে বল্লাম, আমাদের দেশে কোন উৎসব হলে আমরা সেখানে মিষ্টি পাঠাই। তাই তোমাদের জন্য বিশেষ মিষ্টি এনেছি।'
কারণ আজ আবার ওদের একটা বিশেষ উৎসব।(বাঙ্গালী তো! একঢিলে দুই পাখি মারলাম আর কি!)
এই উৎসবকে বলে তানাবাতা। তানাবাতা মানে হল, 'সাতের সন্ধ্যা।' সাত তারিখের সন্ধ্যায় কি হয়েছিল, আসুন সেটাই বলি।
আকাশের রাজা তেনতেই এর মেয়ে ওরিহিমে। খুবই লক্ষী। এক্কেবারে আমার মেয়ের মত।
সে খুব সুন্দর কাপড় বুনতে পারে। সেটা আবার রাজা তেইতেনের খুব পছন্দ। সেটা আবার তিনি কথায় কথায় মেয়েকে জানিয়ে দিলেন। মেয়ে শুনে তো খুশীতে একেবারে দিশেহারা। সারাক্ষণ স্বর্গের নদী আমানোর ধারে বসে কেবল কাপড়ই বুনতে লাগলো আর কাপড়ই বুনতে লাগলো। আর কোন দিকে রাজকন্যার মন নেই। এদিকে দিন যায়, বছর আসে---। রাজনকন্যারও বয়স বাড়তে লাগলো। রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। "এত কাজপাগল মেয়েও হয় নাকি! এখনও মেয়েটার মনে কাউকে ধরলো না। বিয়ে দিতে হবে না?"
রাজা চুপি চুপি মেয়ের মন কাড়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি ডেকে পাঠালেন, আকাশের আরেক সাহসী তারা হিকোবোশিকে। তিনি স্বর্গের রাখাল। বাঁশি বাজান সময় পেলেই। তো হিকোবশি রাজার আদেশে নদীর ওপারে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি শুনে এপারে ওরিহিমে পাগল হলেন। দুজন দুজনের সাথে দেখা করলেন। তারপর মন বিনিময় এবং বিয়ে।
আহা! নতুন নতুন বিয়ে, তায় আবার দুজন দুজনের প্রেমে মত্ত। অরিহিমে আর হিকোবশি কাজ ভুললেন। অরিহিমের কাপড় বোনায় কোন মন নেই। তারা স্বর্গের উদ্যানে বাংলা সিনেমার গান গাইতে লাগলেন, "সন্ধ্যার ছায়া নামে, এলামেলো হাওয়া/ভালো লাগে জীবনের এই গান গাওয়া" সন্ধ্যার ছায়া নামে, এলোমেলো হাওয়া
আর রাখালের গরু গিয়ে ঢুকলো স্বর্গের উদ্যানে।
এসব দেখে, স্বর্গে তো ছি ছি পড়ে গেল। শুনে রাজা ক্ষেপে আগুন। রাজা তেনতেই আবার ওদের আলাদা করে দিলেন। দুই প্রেমিক প্রেমিকা পড়ে রইলেন, স্বর্গের নদী আমানোর দুই পারে। রাজার আদেশ অমান্য করে, কেউ কাউকে দেখা দিতে পারলেন না।
অরিহিমে স্বামীর জন্য কেঁদে কেঁদে আকুল। তিনি রাজাকে আর্জি জানালেন, " বাবা আমি একবার শুধু হিকো কে দেখতে চাই।" রাজা তেনতেই রাগী হলেও, মেয়ের দুঃখে কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি বল্লেন, " ঠিক আছে, তুমি তাকে দেখতে পাবে সাত মাসের সাত তারিখ সন্ধ্যায়।"
আজ জুলাইয়ের সাত। সকাল থেকে অরিহিমে ব্যস্ত। তার হাতের সব কাপড় বুনে শেষ করতে হবে। কিন্তু মনটা বেজায় চঞ্চল। কখন সন্ধ্যা হবে আর তিনি প্রিয়তমকে দেখবেন!
সন্ধ্যায় আলোটা যখন ফিকে হয়ে এল, চারিদিকে আলো আঁধারির খেলা, তখন রাজকন্যা ছুটলেন নদীর ধারে। তার প্রিয়তমকে দেখবেন বলে।
দূরে রাজকন্যা ছায়ার মতন কি যেন একটা দেখতে পেলেন, কিন্তু তার হিকো কে দেখতে পারলেন না। কারণ হিকো ছিলেন, নদীর ওপারে। রাজকন্যা পার হবেন কি ভাবে? কারণ নদীতে কোন সেতু ছিলো না।
দুজন দুপারে ভীষন কাঁদতে লাগলেন। তাদের কান্না শুনে এগিয়ে এলো- এক দোয়েল। সে রাজকন্যাকে কথা দিল, সে তার দুটো ডানা মেলে বানিয়ে দেবে নদীর ওপর সেতু।
এই গল্পের শেষ হল, দোয়েলটা রাজকন্যাকে বলেছিল, যদি জুলাইয়ের সাতে বৃষ্টি হয়, তাহলে আমি কিন্তু উড়তে পারবো না। মেলতে পারবো না আমার ডানা দুটো। সে ক্ষেত্রে তোমাদের দুজনকেই অপেক্ষা করতে আগামী বছরের এই দিনের জন্য।
আজ এখানে বৃষ্টি ছিল, তাই এবছর বুঝি আর দুজনের দেখা হল না। কি আর করবেন, বেচারা হিকো অরিহিমের জন্য গাইলেন, নদীর ওপার থেকে----আমার সারাটাদিন
আহারে! ভালোবাসায় কত পরীক্ষা যে দিতে হয়।
আজকাল ছেলেমেয়েরা অবশ্য এই সন্ধ্যায় বিভিন্ন ইচ্ছা রাখে অরিহিমে আর হিকোবশির কাছে।
যেই উইশকে সামনে রেখে এই উৎসব, সেটা হল মেয়েরা উইশ করে যেন তারা ভালো কাপড় বুনতে পারে আর ছেলেরা উইশ করে, যেন তাদের হাতের লেখা ভালো হয়।
[
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১২ দুপুর ১২:১৯