সে রীতিমত একটা দস্যুই বটে! এক মিনিটও চুপ থাকে না। কথা বলে কম, কাজ করে অনেক বেশী। ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত খুব সচল। ছোট্ট মাথাটায় বেজায় সব বুদ্ধি সারাক্ষণ আপডেট হচ্ছে, প্রতিটাই নতুন। ঝাঁ চকচকে। একটার সাথে আগেরটার কোন মিলই নেই।
কাল চেয়ার টেনে উঠে, অনেক উঁচু থেকে ওর মায়ের ফেইস ওয়াশ নামিয়ে; অর্দ্ধেকটা খেল, তারপর অসাধারণ ভঙ্গিতে দু আঙ্গুলে ওটা ঝুলাতে ঝুলাতে এনে আমাকে বল্লো, বাবা খাবে?
ওর মায়ের ধারণা চার বছর বয়স মানে, অনেক বড়। এই বয়সে নাকি মুনিয়া ওর দুবছরের বড় বোনের সাথে অলরেডী শেয়ার করতে শিখে গেছে। টুটলুকে সামলাতে মুনিয়ার চোখে মুখে একটু দুঃখী দুঃখী ভাব চলে এসেছে।
মা'র সব কাজ লন্ডভন্ড করাই টুটলুর সবচাইতে প্রিয় কাজ। ছুটির দিন বাসায় থাকলে--"আমার বাড়িটাকে ঢাকার ব্যস্ত রাজপথ মনে হয়। মা ছেলের চিৎকার হট্টোগোলে বাসায় টেকা দায়!"
আমার সকালের প্রিয় ছুটিঘুম বাদ পড়েছে আজ দীর্ঘকাল হল।
গত পরশুদিন আমি অফিসে ছিলাম, ফিরে এসে মুনিয়ার কাছে যা শুনলাম, "মুনিয়া দুপুরে খেয়ে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে। কাজের মেয়েটা বসার ঘরে টিভি দেখছে। টুটলু মুনিয়ার কাছেই ঘুমুচ্ছিল। একটু পরে হঠাৎ আওয়াজ---'কেউ একজন আমাকে বাঁচাও। কেউ একজন আমাকে বাঁচাও।' কচি গলার চিৎকার। ধড়ফড় করে উঠে গিয়ে মুনিয়া দেখে উঁচু বুকসেল্ফের বিপদ্দজনক গ্লাস ডোরটা ধরে কোন রকমে ঝুলছে আর চেঁচাচ্ছে।
বেচারা মুনিয়া বেশ ভালো একটা চাকুরী ছেড়েছে, শুধু টুটলুকে সময় দেবর জন্য। বেচারা সারাদিন বাসায় থাকে--একঘেঁয়ে বোধ করবে দেখে--বাসায় আকাশ সংস্কৃতিটাকে আর এড়ানো যায়নি।
কাজের মেয়েটাও সারাদিন খেটেখুটে সামান্য বিনোদন বলতে ঐ টিভির সামনেই বসে।
তাই টুটলুর প্রিয় যত না শিশুতোষ কার্টুন তার চেয়ে বেশী প্রিয় বাংলা সিনেমা আর কিছু গাঁজাখুড়ি গল্পের নাটক কিম্বা সিরিয়াল।
একমাত্র বাংলা সিনেমা শুরু হলে টুটলু এক নাগারে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারে।
ওকে বিরত রাখার জন্য , শুধু রুবি নয় মুনিয়াও এখন বাংলা সিনেমা শুরু হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
মুনিয়া মাঝে মাঝে চোখ মোছে, বাচ্চাটা কোথাও খেলতে পারে না। হাঁটার জায়গা নেই পার্ক নেই। মাঠ নেই। খেলার বন্ধুরা নেই।
টুটলু উতপাৎ থেকে বাঁচবার জন্য মুনিয়া কিছুদিন আগে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সাহসের সাথে সম্পন্ন করে টুটলুকে একটা স্কুলে দিয়েছে।
আমাদের অকুতোভয় টুটলু তার বাংলা সিনেমার যাবতীয় মারপিট তার আর অশ্লীল বাক্যবাণ বন্ধুদের উপহার দেয় আর বাড়ি এসে তার কৃতিত্ব আমার কাছে খোঁজে। মার কাছে যেতে সাহস পায় না।
চার বছরের বাচ্চা। তেমন ছোট তো নয়। বড়ই হয়ে গেছে। পড়াশোনার বেশ চাপ। "পড়লেই না শেখা যাবে। গাড়িঘোড়া চড়া যাবে।"
আমার ধারণা অশিক্ষিত বাঙ্গালীদের জন্য অথবা অশিক্ষিত ইন্ডিয়ার জন্য এই প্রবাদ বৃটিশরা রেখে গেছে।"
আজকাল মানুষ হবার জন্য পড়ালেখা নয়, অনেক বই মুখস্ত করে আর ইংরেজী বলে আমার দেশের সুবিধা প্রাপ্ত সব ছেলেমেয়েরাই গাড়িতে চড়বে---- শিশুদের সেই স্বপ্ন দেখাতো মানা নেই।
আমিও তো আমার সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, তাই আমিই বা এসবের বিরদ্ধে আর কতটুকুই যেতে পারি। আমি শুধু গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
বাচ্চাটাকে স্কুলে ভর্তি করার সময় বলেছিলাম, "দেখুন আমার বাচ্চাটা বাসায় একা একা থাকে। এই বয়সের বাচ্চারা আসলে বাচ্চার সাথে মিশলেই ওদের বেড়ে ওঠাটা স্বাভাবিক হবে। তাই স্কুলে ওকে চাপ দেবেন না। আমরা চেষ্টা করবো, ওকে প্রতিদিনের পড়াগুলো পড়িয়ে দিতে। আর স্কুলে ও নিজে থেকে যা করবে-তাতেই আমাদের চলবে।আমি কোন কম্পিটিশন চাই না"
স্কুলের প্রধান শিক্ষক খুব অপমানিত বোধ করলেন. তিনি অগ্নিবর্ষন করে বল্লেন-- আপনাদের খেয়াল খুশি মত তো আর আমি আমার স্কুল চালাতে পারি না। আপনাদের পছন্দ না হলে বাচ্চা নিয়ে যান। আপনার বাচ্চার মত একটা বাচ্চা আমার স্কুলে না থাকলে আমার স্কুলের কিছুই আসে যায় না।
স্কুলে যাবার পর থেকে টুটলু টা ঠিক মত খায়না। দুষ্টুমি আরও বেড়েছে। ওর এত্তটুকুন চোখেমুখে কেমন একটা সতর্ক ভাব চলে এসেছে। কথাবার্তায় শিশুসুলভ সারল্যের চেয়ে ক্লান্তিটা অনেক বেশী।
মুনিয়া রোজ স্কুল থেকে ডাক পায়। অজস্র কমপ্লেইন আসে টুটলুর বিরুদ্ধে। কখনও শিক্ষক, কখনও গার্জেন। কেউ ছাড় দেয় না। চার বছরের বাচ্চার আবার ছাড় কিসের?!
মুনিয়া আজকাল ধৈর্য রাখতে পারেনা। টুটলু প্রায় মার খায় মা'র হাতে।
ওর একমাত্র জায়গা আমি। আমার কাছে এসে একটু আশ্রয় খোঁজে।
মুনিয়া আরও অধৈর্য হয়। সারাক্ষণ চেঁচায়, তোমার আহলাদ পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আমার আরও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমার খুব কষ্ট হয় টুটলুটার জন্য। ওর প্রিয় খেলা বন্দুক নিয়ে। মুনিয়া এবার ওর জন্ম দিনে বড় পার্টি দিয়ে ছিল। উপহার হিসেবে ছেলেটা আমার পেয়েছে ১৩ টা খেলনা বন্দুক, ১০ টা গাড়ি। দু বক্স আইসক্রীম আর চার সেট ড্রেস।
আমি দুটো শিশুতোষ কিছু বই কিনে নিজের ছেলের হাতে দিয়েছি, চুপি চুপি। আমার উপহারটা ওর এসব উপহারের মধ্যে বড্ড বেমানান ছিল।
আজকাল টুটলু উপহার পেলে বিষ্মিত হয় না। এক সন্তান বলে, সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শিশু বলে সবই ওর অনেক আছে।
ওকে বলেছিলাম, "বাবা কি হতে চাও বড় হলে? আমার টুটলু স্মার্টলি জবাব দিল-বাবা আমি পুলিশ হতে চাই।" আমি হাসতে হাসতে বল্লাম, কেন বাবা পুলিশ হতে চাও?
সে বল্লো, পুলিশরা যে দুষ্টু লোককে পানিশমেন্ট দেয়। আমি বলি, বাবা তোমার সাথে কে দুষ্টুমি করেছে?
সে তার লিষ্টে নিজের মা সহ, স্কুলের রাগী মিস,পাত্ত না দেয়া বন্ধবী, টিজ করা ছেলে বন্ধু এবং বন্ধুর মা সহ অনেককেই রেখেছে।
আমি মনে মনে শংকিত হই।
টুটলু জেনে গেছে বন্দুকের একটা শক্তি আছে। ও এম্নিতেই কাউকেই ভয় পায় না। আর হাতে বন্দুক থাকলে তো কোন কথাই নেই। হোক না সে যত খেলনা।
আজ শনিবার। এই ভর সন্ধ্যায় ইলেক্ট্রসিটি নেই। গরমে দম বন্ধ হবার জোগাড়। বাসার সামনে ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গা আছে। কিন্তু সেখানেও ইট বালি সিমেন্ট রাখা হয়েছে। ক'দিন বাদে ওখানেও বোধকরি অট্টালিকা তৈরী হবে।
একটু বাতাসের লোভে টুটলুকে নিয়ে নীচে নামি। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, হটাৎ টুটলু ভয়ে চীৎকার করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমি অবাক হয়ে দেখি, আমার অসম্ভব সাহসী ছেলেটা জোনাকি দেখে ভয় পেয়েছে। ওর এই ক্ষুদ্র জীবনে এটাই প্রথম জোনাকি দর্শন।
আমি ওকে নিবিড় করে বুকের মধ্যে নিয়ে হেঁটে বেড়াই। ঢাকা শহরের এ পাড়ায় গ্রীষ্মের এই সন্ধ্যায় হঠাৎ দু তিনটে জোনাকিকে কেমন পথ হারা মনে হয়।
তবুও ওর রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটির কথা মনে পড়ে যায়--"ও জোনাকি কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ।"
শুধু আমার টুটলুর মত নরম সবুজ আলোয় ভরা জোনাক হৃদয়ের শিশুরা এ শহরে ডানা মেলতে পারেনা। ওদের ছোট্ট বুকে ভর করে আছে কিসের যেন অসুখ।
ওদের সবুজ ডানায় ভর করে আছে লোডশেডিং এর মত অকালে শৈশব হারানোর অন্ধকার।
(আচ্ছা জোনাকি বানান কি হবে? ছোটবেলায় আমরা শিখেছি, জ্বোনাকি। কিন্তু আধুনিক বাংলা বানান রীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। জ্বোনাকি কি জোনাকি হয়েছে? বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পেলাম না।)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:১৯