আমার ছানাটা দিন দিন যত বড় হচ্ছে, আমার মধ্যে দেখি মায়া জাতীয় গরল পদার্থটা ততই বাড়ছে। প্রথম যখন হল, অপারেশন টেবিলে কোন এক নার্স আমাকে দেখালেন, 'এই দেখুন আপনার কি ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে," আমি অর্ধচেতন চোখ মেলে দেখলাম- মোমের মত অদ্ভূত এক দেব শিশু। আমি তো অবাক, এটা আমার বেবী,এত সুন্দর- ধ্যাত তাই হয় নাকি? নার্স নিশ্চই আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখেছিলেন, নইলে বলবেন কেন, কি খুশী হননি?
যতই খুশী হইনা কেন? প্রথম কয়েক দিন তো ওকে আমি আমার কাছে রাখিনি। আরে এত ছোট একটা বাচ্চা আমি রাখবো কি করে? আর আমার সাইজ তখন মাশাল্লাহ ছোটখাটো একটা হাতির মত।আর এখন? ওকে ছাড়া আমি ঘুমাতেই পারি না।মোদ্দা কথা আমার পুরো জগৎ টাই এখন ছানাময় হয়ে গেছে।
মা হিসেবে আমি অবশ্য আমি কখনই ততটা ভালো নই। তার নানান রকম সাক্ষ্য প্রমাণ ওর জন্মের পর থেকে দিয়ে যাচ্ছি, তবুও মেয়েটা কেন যে আমার ন্যাওটা বুঝতে পারি না।
আমি যে ভালো মা নই, তার একটা ঘটনা বলি, ওর তখন মাস ছয়েক হবে বা তারও কম।একদিন রাতে ওকে দুহাতে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলছি. কারণ ও তখনও দাঁড়াতে শেখেনি। হঠাৎ এক বিশাল সাইজের তেলাপোকা কোত্থেকে উড়ে এসে আমার মুখের উপর পড়লো। আর আমিও আত্মরক্ষার জন্য আমার দুই হাত ব্যবহার করলাম। ব্যাস দেখি
আমার ছানা সরাসরি মেঝেতে। দুম করে শব্দ পেলাম শুধু। (পৃথিবীর সব মায়েরাই বাচ্চার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারেন অথচ আমি কিনা তেলাপোকার ভয়ে----------) যাই হোক মেয়ে তিনগুন বেশী নিরাপদ তার বাবার কাছে। কোন বাবা যে এতটা করতে পারেন, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। মেয়েটা ক'দিন আগেও চাঁদ মামাকে বলতো, চাবান্না, চানাচুর কে তাতালুম। সেই মেয়েটা আমার চোখের সামনে বলা নেই কওয়া নেই অনেক বড় হয়ে গেল। এখন তার কল্পনা গুলোর সাথে, প্রশ্নের সাথে পেরে উঠি না। এই বলে মেঘ খেতে কেমন লাগে- ঐ বলে, আল্লাহ কেন সারাদিন জেগে থেকে সব দেখে- সাপ কেন কামড়ায়- ভূত কেন দুষ্টু হয়, ভালো
ভূত রা দেখতে কেমন হয়? সমস্যা আরও আছে, মেয়েটা হয়েছে খুবই নরম এক্কেবারে মাখনের মত। কোন দাবি দাওয়া নেই, খেলনা নিয়ে জেদ করেনা। কেউ চাইলেই নিজের খেলনা দিয়ে দেয়।খেলনা পিস্তল দেখলে ভয়াবহ ভয় পায়। ওর বয়স যখন আড়াই। তখন বেবী'জ ডে আউট ছবিটা
দেখে কেঁদে বুক ভাসালো, কেন বেবীটা ওর আম্মুকে খুঁজে পাচ্ছেনা।
শখ করে নাম রেখেছি রাজ রাজেশ্বরী---- যে কোন একদিন আমার ছানাটা রাজ হাঁসের মত গ্রীবা উঁচিয়ে চলবে। আপাততঃ তার কোন লক্ষণ ই নেই। আস্ত একটা ভীতুর ডিম। সেদিন ঘুম থেকে উঠে শোবার ঘর ছেড়েছি মাত্র হঠাৎ শুনি বেড়াল ডাকছে আমার পেছনে, আমি তো চমকে উঠে যেইনা ঘুরে তাকিয়েছি, অম্নি দেখি আমার মেয়েও চমকে উঠেছে। চুপি চুপি আমার পেছনে উঠে এসেছে মিহি গলায় মিউ মিউ করতে করতে। এত ভয় পেলে চলে নাকি? বেড়াল ছানা সাজতে ওর জুড়ি নেই। নিজেও সব আল্লাদ প্রকাশ করবে মিহি গলায় মিউ মিউ করে, আর আমাকেও মা বেড়াল বানিয়ে ছেড়েছে। ওর অভিমান হলে যখন কোন কিছুতে কাজ হয় না, তখন মিউ মিউ করে দুহাত বাড়িয়ে দিলেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এটা ওর নিজের আবিস্কার। এ খেলায় আমার কোন কৃতিত্ব নেই।
ইদানীং স্কুলের বাচ্চাদের হাতে বেশ মার খায়। কিছু কিছু বিচ্ছু আছে, চান্স
পেলেই ছোটখাটো মার দেয়, আর আমার মেয়ে নাকি শুধু বলে, ইয়ামেতে ইয়ামেতে (থামো, আমাকে মেরো না টাইপের।) এটা ওর বাবা দেখেছে। ওর বাবা ক'দিন খুব ট্রেনিং দিল- কেউ তোমাকে মারলে, তুমি পাল্টা মার দেবে। মেয়ে শুধু বাবা কে বলে, বাবা কাউকে মারা তো দামে (খারাপ) কেন তমোদাচিদের (বন্ধুদের) মারবো। আমিও মেয়ের সাথে সহমত।
সেদিন মেয়েকে নিয়ে তার বাবা স্কুলে গেছে, একটা বাচ্চা ওর সামনেই আমার বাচ্চাটাকে মেরেছে। এবার মেয়ের বাবা ঐ ভিলেন বাচ্চাটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে স্কুলের এক কোনায় গিয়ে জোরে কান মলে দিয়ে, চুপ করে চলে এসেছে। শুনে আমি তো ভয়ে অস্থির। কেউ দেখে ফেল্লে কি কেলেংকারীই না হত।
আমি আবার খুব বাস্তববাদী। মেয়ের বয়স পাঁচ হল আর ক'দিন পর তো আমাকে পুছবেই না। মেয়ের এই একটা বিষয়ে মেয়ের বাবাও আমার সাথে এক মত। তাই মায়া টায়ার বেশী ধার ধারি না, কিন্তু বিচ্ছু টা যখন নরম কোমল হাত বাড়িয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে, আমাকে ছাড়তেই চায় না তখন মনে হয়------ ওকে ছাড়া আমার একটা মুহূর্ত
চলবে কি করে?
পুরোনো একটা লেখা। আবার রিপোষ্ট করলাম। লেখা টা মুছে ফেলেছিলাম। ব্লগার ছন্ন তার প্রিয় লেখার ভান্ডার থেকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে বলেছিল, পারলে লেখাটা আবার দিও। আর ব্লগার তাজীন লেখাটা পড়ে বলেছিল, লেখা টা কখনই মুছবেন না। তাই নতুন বছরে একটা পুরোনো কে ফিরিয়ে আনলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৫:২২