somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মকথন ৯ঃ নিজেরে খুঁজি

২৯ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডাক্তার হিসাবে কত রোগীর আত্মীয়স্বজনকে ৭২ ঘন্টার কথা বলেছেন, আজ নিজের ছেলের বেলায় বুঝতে পারছেন ৭২ ঘন্টা কত, কত দীর্ঘসময়।অপারেশন শেষে বিদ্যুতের মাকে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসলেন, মুখোমুখি চেয়ারে দু’জন, কোন কথা নেই কারো মুখে।নিজেই নীরবতা ভাঙ্গেন ডাক্তারঃ
-চা খাবে?
-হ্যা, খাওয়া যায়।
দু’কাপ চার অর্ডার দেওয়া হলো।
ওর এতবড় একটা দুর্যোগের দিনে কিছু একটা সান্ত্বনার কথা বলা প্রয়োজন, ডাক্তার সেটা বুঝতে পারছেন, কিন্তু বলতে পারছেননা। নিজের এই স্বভাবটা আজো বদলাতে পারলেননা। স্ত্রী হিসাবে ওর এই স্বভাবটা খালাম্মা বেশ জানেন।তাই দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে সাময়িক সেঁতু বন্ধন রচনাকারী অসুস্থ বিদ্যুতকে টেনে আনলেন কথায়ঃ
- পোস্ট অপারেটিভ থেকে বিদ্যুতকে বেডে কখন দেবে?
- আশা করছি বিকেল নাগাদ।
- এতক্ষণ তো এখানে বসে থেকে লাভ নেই, বাসা থেকে ঘুরে আসি, বন্যা আর ওর খালা কি করছে কে জানে?
- চল, আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।
- ঠিক আছে, আমাকে নামিয়ে দিয়ে তুমি বাসায় চলে যেও – কাল রাত থেকে তোমার উপর দিয়ে যে ধকল গেল।
- আর তোমার?
- আমি তো মা, আর তাছাড়া, না থাক ওসব কথা, তোমাকে আমি আজ কোন কটু কথা বলবনা।
- কেন?
- কাল সারারাত ধরে আমি বুঝতে পেরেছি, বিদ্যুৎ আমার কাছে কতটুকু। তুমি কখনো ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাওনি, সে জন্য আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
- ও, বলে ডাক্তার ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
ছেলেটা চা নিয়ে এলে কথা থেমে যায়। চা শেষ করে দু’জন ওঠে পড়ে।
পাশাপাশি দু’জন বহুদিন পর একসাথে হাঁটলেন, গাড়ির সামনের দরজাটা ডাক্তার খুলে ধরলেন, স্বামীর পাশে বসে বহুকাল পর ঢাকা শহরের রাস্তায় ছুটে চললেন-এমনি করে পাশাপাশি বসে ছুটে চলারই কথা ছিল।কিন্তু একটা ঝড়ে একদিন সব তছনচ হয়ে গেল।নিজেকে খালাম্মা মনে মনে তিরস্কার করলেন-ছেলে মৃত্যু শয্যায় আর আমি নিজের দুঃখী অতীত নিয়ে ভাবছি।মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়লে কী পুরনো স্মৃতিরা বেশী করে ফিরে আসে? হয়তো – নানা ভাবনারা এসে জড়ো হয় খালাম্মার মনে। পাশে বসা মানুষটাকে আড়চোখে দেখেন, মুখে কোন ভাবান্তর নেই, নিবিষ্ট মনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। হঠাত করেই মাঝবয়সী ডাক্তারের মুখটা বদলে গেল, তরুণ ভারী চশমা পড়া সেদিনের সুদর্শন ডাক্তারের মুখটা ভেসে ওঠল। কিন্তু সেটা বেশী সময় স্থায়ী হলোনা। ডাক্তারের ঠোট দু’টো নড়ে ওঠে তরুণ মুখটা হারিয়ে গেলঃ
-পেট্রোল পাম্পে থামতে হবে, তেল নিতে হবে।
খালাম্মা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেন।
নিউমার্কেটের কাছে একটা পাম্প থেকে তেল নিয়ে আবার কলাবাগানের দিকে যাত্রা। কলোনীর গেট দিয়ে গাড়িটা প্রবেশ করছে, খালাম্মা ডানদিকে তাকিয়ে দেখেন চৌধুরী ভাই দোকানে বসে আছেন রাস্তার দিকে মুখ করে, তার সামনে উনার ওপরের তলার হাবিব দাঁড়িয়ে আছে, হাবিবের মুখটা দেখতে পাচ্ছেননা, কিন্তু বুঝতে পারছেন ডানহাতে সিগারেটটা মুখের কাছে নিয়ে আয়েশ করে টানছে।গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে মাঠের দিকে নেমে গেল-পার্ক করে দু’জন গাড়ি থেকে নামলেন, সোজা বাসার দিকে হাঁটা দিলেন।খালাম্মা দোকানের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছেন, দু’জোড়া কৌতুহলী চোখ তাদের দু’জনকে অনুসরণ করছে।
যে কোন ধরণের সংবাদ চৌধুরী ভাইয়ের দোকানে পাওয়া যায়, সিগারেট-পান খেতে খেতে সেগুলো আলোচিত হয়।ব্যাপারটা উনি পছন্দ করেননা, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, বিভিন্ন রকম মুখরোচক গল্পের জন্য অনেকেই চৌধুরী ভাইকে খুব পছন্দ করেন, তাদের পদচারণায় সকাল থেকে গভীর রাত অবধি দোকানটা সরগরম থাকে।

গেটের সামনে মুরুব্বীদের ছোট্ট একটা জটলা দেখে খালাম্মার খেয়াল হয় আজ রবিবার, অফিস বন্ধ, সকাল সকাল খবরের কাগজ হাতে আড্ডা চলছে।আড্ডায় রতনের বাবাকে দেখতে পেলেন, ডাক্তারের পাশে হাঁটতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কাছাকাছি আসতে রতনের বাবাই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেনঃ
- আপা, বিদ্যুৎ কেমন আছে?
উনি অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে কে খবর দিল?
-কোন চৌধুরী ভাই, আপনি যখন গতকাল রাতে হন্তদন্ত হয়ে বেবীট্যাক্সি নিয়ে যান, তখন চৌধুরী ভাই ব্যাপারটা খেয়াল করে, পরে হাবিবকে জানায়।হাবিব আপনার বাসায় খোঁজ নিয়ে ঘটনাটা জানতে পারে।ওই সবাইকে জানায়।
সিগারেট খাওয়া এবং দোকানে আড্ডা দেওয়া, দু’টোই খালাম্মা খুব অপছন্দ করেন। সেই জন্য হাবিব ছেলেটাকেও উনি অপছন্দ করতেন।আজ উনার বিপদের দিনে ছেলেটার এগিয়ে আসাটা উনাকে অবাক করে দিল-মানুষ চেনা বড়ই কঠিন।
-কালরাতে অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়ছিল;
পাশে দাঁড়ানো ডাক্তারকে ইংগিত করে যোগ করলেনঃ
-শেষে ওর বাবাই ওর অপারেশন করে ইন্টারনাল ব্লিডিং বন্ধ করে। তবে ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা।
সবাই সমবেদনা জানাল।
অলিভের বাবার কথাটা সবার পছন্দ হলো। উনি মসজিদের ইমাম সাহেবকে আসরের সময় বিদ্যুতের জন্য দোওয়া করার কথা বললেন।
খালাম্মা অনেকদিন হলো কলোনীতে আছেন।তবে কারো সাথে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি।আজ তার প্রতিবেশীরা তার বিপদের দিনে যেভাবে এগিয়ে আসলেন, তাতে তার অন্তর কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল।
-আপনাদের দু’জনকেই খুব ক্লান্ত লাগছে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন; বলে রতনের বাবা সংগীদের নিয়ে মাঠের দিকে হাঁটা দিলেন; খালাম্মাও মৃদু হেসে ডাক্তারকে নিয়ে বাসার দিকে চললেন।
সিড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় ওঠার পর দরজায় কড়া নাড়ার আগেই দরজাটা খুলে গেল, বন্যা আর ওর খালা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে-মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘বিদ্যুৎ কেমন আছে?’
নিজেকে শক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন খালাম্মা। নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
-তোমাকে হঠাত ডেকে পাঠানোর জন্য দুঃখিত,
তারপর একটু থেমে যোগ করলেনঃ
-বিদ্যুৎ ভাল আছে।

সকালের নাস্তাটা বিদ্যুতের মার পিড়াপিড়িতে বাসাতেই সারতে হলো ডাক্তারকে।সেই সাথে এককাপ গরম চা খেয়ে শরীরটা বেশ চাঙ্গা বোধ করলেন, সোফায় গাটা একটু এলিয়ে দিলেন, একটু তন্দ্রা মত এসেছে, মাথার চুলগুলোকে কে যেন বিলি কেঁটে দিচ্ছে, আরামে চোখ দু’টো বুঁজে আসছে, ছোট্ট ছোট্ট কোমল দু’টো হাতে মেয়ের এই আদর বাবার ভালই লাগে, নিঃশব্দ এই ভালবাসার জন্যই কি ডাক্তারের ছুটে আসা?
এরপর মেয়ের চুপিচুপি কন্ঠের প্রশ্নঃ
-বাবা, সত্যি কোরে বলো ভাইয়া কেমন আছে?
ক্লাস সেভেন পড়ুয়া মেয়ে এমন কায়দা করে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, ডাক্তার বেকায়দায় পড়ে যায়। একটু ভেবে বলেঃ
-আগের চে অনেক ভাল, তবে আগামী তিনটা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ড্রইং রুমের দরজার মাকে দেখে বন্যা চুপ করে যায়। উনি ডাক্তারকে বললেনঃ
- বাসায় যাবে না? ওরা তোমার জন্য নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।
ডাক্তার মনে মনে বললেনঃ
-তুমি যাদের জন্য চিন্তা করছো, তারা কি তোমার কথা ভাবে?
মুখে বললেনঃ
-এই তো ওঠছি।

জানলার পাশে দাঁড়িয়ে খালাম্মা ডাক্তারের গাড়িটাকে নিউমার্কেটের দিকে যেতে দেখলেন। কিন্তু উনি জানলেননা গাড়িটা বাসার দিকে না গিয়ে অন্যত্র যাত্রা করেছে।
গাড়িটা মেডিকেলের ভিতরে পার্ক করে চিন্তিত মনে ডাক্তার হাঁটতে হাঁটতে পোস্ট অপারেটিভ রুমে এসে হাজির হয়। ডিউটিরত নার্সটা উনাকে দেখে এগিয়ে আসে, উনি বিদ্যুতের ফাইলটা দেখতে চান।কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে ফাইলটা ফেরত দিয়ে ছেলের বেডের দিকে এগিয়ে যান – মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ান।কোথাও কোন শব্দ নেই, বিদ্যুতের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে, ডাক্তারের মনটা কেঁদে ওঠে। কিন্তু শত দুঃখ-কষ্টেও উনার চোখ দিয়ে কান্না ঝরেনা, মনটা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যায়।তবে আজ তার ব্যতিক্রম হলো,ডাক্তারে চশমাটা ঝাপসা হয়ে এলো-ছোট্ট বিদ্যুতের দুষ্টিমিভরা মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন।

ঢাকা
২৮ মে ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৪০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা নিয়োগ কারা দেয় ?

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির পর আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা ডক্টর ইউনুসকে দেশের ক্ষমতা গ্রহন করার আহবান সেই শহীদ মিনার থেকেই জানিয়েছিল। ডক্টর ইউনুস প্রথমে অরাজি হলেও পরে ছাত্রদের হাজারো অনুরোধের মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমুখী একটি চাওয়া

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২০


মানুষের মুখে হাসি ফুটুক,
আঁধার মুছে আলোর ছোঁয়া,
ক্লান্তিহীন পথ চলুক,
নতুন স্বপ্ন আনবে জোড়া।

দিনবদলের শপথ নিয়ে,
কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করে যাই,
নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে
একটি স্রোতে মিলিয়ে যাই।

সবার তরে সমান বিচার,
ধনীর দুঃখীর,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলার একমাত্র অভিশপ্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ

লিখেছেন জ্যাকেল , ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫০

২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব জনাব সিরাজ উদ দৌলা ব্রিটিশদের কাছ হেরে যান কেবলমাত্র মীরজাফর, জগৎশেট, রাজভল্লভ, ঘষেটিদের কারণে। বাংলার ইতিহাসে এই দিনটি একটি অভিশপ্ত দিন। এর পর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের গ্রামের বিয়ের বর দেখা

লিখেছেন প্রামানিক, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওবায়েদুল কাদের কি মির্জা ফখরুলের বাসায় আছেন?

লিখেছেন রাজীব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

"পালাবো না, পালিয়ে কোথায় যাবো? দরকার হলে মির্জা ফখরুলের বাসায় আশ্রয় নেবো। কি ফখরুল সাহেব, আশ্রয় দেবেন না?" ওবায়েদুল কাদের একটি জনসভায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। ৫ই আগষ্টের পরে উনি মির্জা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×