আমাদের এক বন্ধুর স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে সে একদিন কবিতার দোকানদার হবে ।
২
আমাজাদের দোকানে কেবল অন্ধকার ঢুকতে শুরু করেছে তখন । পশ্চিমের আকাশ তার তাবৎ সৃষ্টিশীলতা নিয়ে ঝুলে পড়েছে আবিরের ক্যানভাসে ! আমাদের দাঁত কেলানো হাসি আর অকালপক্ব আড্ডাটা জমবে জমবে করছে এমন সময় তুহিন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমাদের চাপাচাপিতে জায়গা দখল নেয়! ওর ঘামের বিন্দু নুইয়ে পরে নিঃশ্বাসের দ্রুততায় । এক গ্যালন চা ঝিমিয়ে পড়া পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দিয়েই ও বলে, তাহের একটা কবিতার দোকান দিয়েছে ! আমাদের গল্প খাওয়া সন্ধ্যাটা হঠাৎ থমকে যায় । একটা পিচ্ছিল গরম ছলকে ওঠে হাতের ডগায় । তাহলে শেষপর্যন্ত তাহের সত্যিই একটা কবিতার দোকান দিলো । অথচ ও যখন প্রথম কবিতার দোকানের কথা বলেছিল আমরা তখন বুঝিইনি । তারপর যখন বুঝেছিলাম তখন কিলবিলিয়ে হেসেছিলাম সবকটা দাঁতের ফাঁকে ! আহা তখন আমাদের কি বিচিত্র জীবনই না ছিল ! ইচ্ছে করলেই নিজেকে ঘুড়ী ঘোষণা করে তারা ধরতে যেতাম । কোনও কোনও দিন বারান্দার রেলিং পাহারা দিতাম খাতা কলম হাতে ! সারাটা দিন ঘুম লেপটে থাকতো আমাদের চোখজুড়ে , আর সন্ধ্যা হলেই আমাদের স্বপ্ন সন্ত্রাস চলতো আমাদের বাগরম্বরে, বহুদিন আগে উপহার পাওয়া ডাইরির হলুদ পাতায় । মাত্র চারজন থাকতাম আমরা তারচেয়েও মাত্র একটা রুমে, ইমন আমি তুহিন আর তাহের, চার আমড়া কাঠের সেনাপতি । যে রুমে পথ ভোলা রোদ হঠাৎ কোনোদিন দিন ঢুকে পড়লে আমাদের মনে হতো কেউ বুঝি কোহিনূর এনে লুকিয়ে রেখেছে জানালার কার্নিশে ! তারপরেও আমাদের রাজ্যের একটা নাম ছিলো । শ্যাওলামহল ! এই উদ্বাস্তুর শহরে পরজীবী কয়েকজন তাদের ঘুন খাওয়া রাজ্যের আর কি নামইবা দিতে পারতো । সস্তায় পাওয়া একটা গিটার আর আমাদের কোনোমতে পরিস্কার চাদর নিয়ে তুহিনের চৌকি ছিল রংমহল । তুহিনের গানের গলা বড় চমৎকার ছিল । ইমন ছিল মার্ক্সবাদী, একদিন গ্রামে ফিরে যেয়ে ওদের গ্রামের সব জমির আইল ভেঙ্গে দিবে এই নিয়েই বেঁচে ছিল পুরোটা জাগরণ কাল । আমি দেখতাম আমার দুইহাত ভর্তি টাকার আর পকেটভর্তি মেয়েদের শরীরের গন্ধ । আর তাহের, চল্লিশ ওয়াটের হলদেটে ঝাড়বাতির শেষ দিনগুলোর নিচে, বলেছিল, একটা কবিতার দোকান দিবে সে । কি দমফাটানো হাসিই না আমরা হেসেছিলাম । কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই পেরেছে । ইমনটা কবেই মরে গেলো বিপ্লব ডায়রির পাতায় বন্দি রেখে । তুহিন ৯ টা - ৫ টা জীবনের বিভীষিকায় হারিয়ে ফেলেছে গিটারের তার । আমি কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে খুঁজছি লটারির টিকেট, আমার পকেটে শুধুই পোকামাকড়ের চিৎকার । তাহেরের জন্য আমাদের মন কেমন করে ! একদিন জল নালা হিসেব নিকেশ পেরিয়ে যাই ওর কবিতার দোকানে । কি আশ্চর্য দোকান । নাম রেখেছে, রুপালি কবিতা স্টোর । দোকানের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সুতা , সুতাতে রুপালি কাগজে ঝুলে আছে একেকটা কবিতা । যেনও বদ্ধ ঘরে জোছনার এসে আটকে পড়েছে কবিতা হয়ে । আমরা এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত হেঁটে যাই । হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাই কোনও কবিতার সামনে, খোলসের ভিতর থেকে মুক্তো দানার মতো উঁকি দেয় কিছু শব্দের জোড়াতালি,
এই অর্থহীন রোদ জল গল্পের শহরে
মাসের শেষে কুড়িয়ে পাওয়া মৃত প্রজাপতির ভিড়ে
রোদ চশমা জেগে আছে পথের পাহারায়
শূন্যতা নাড়ছে কড়া ভুলের ইশারায়
ঝাপসা আয়নায় কার চেহেরা কিসের গরমিল
না জেনেই উড়াল দিবে পোষা গাঙচিল
তাই সুখের গন্ধ খুজি
কাঁচের দরজায় রোজই
আর বেঁচে থাকা যেনও প্রতিস্রুতি নামের ফাকি।
তাহেরের দিকে তাকাই, বলি কত দাম রে এই কবিতাটার ? ও হেসে বলে, ৩০ টাকা একদাম! আমি কবিতা কিনিনা আরও সামনে এগুতে থাকি । যেনও বিশাল এক অনিকেত প্রান্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে আর আমি এক পক্ষঘাতগ্রস্তকাল হেঁটে যাচ্ছি কবিতাপথে!
৩
তাহেরের দোকান থেকে ফিরলাম এক রাশ বিষণ্ণতা নিয়ে । আমরা যারা হাতের মুঠোয় লাট্টু ঘুরিয়ে ভাবি এটাই পৃথিবী, তাদের মিথ্যে গর্ব নিয়ে বুকের গোপন গহীনে প্রবল বেদনাবোধ থাকে । তারা জানে তারা কোনওদিন এক বর্ষাকাল কাটাতে পারবে না কোনও ব্যাঙের ছাতায় তবুও বৃষ্টিতে ভেজার গল্পর অপেক্ষা করে বিপুল ব্যাথায় । মাঝে মাঝে যখন সে ব্যাথা প্রবল হয় তখন তারা ঘোরগ্রস্ত হয় , মৃত্যুর মতো নিশ্চিত আকংখায় ডুবে যায় সব মুখোশ ভাবনা । এরই মাঝে আরেকদিন তুহিন খবর আনলো, তাহেরের দোকানটা কি একটা পুরস্কার পেয়ে গেছে । কেমন যেনও বুকের ভিতরে চির চির করে উঠলো । সব ব্যর্থরাই কি এমন চিনচিনে শোকে তাকিয়ে থাকে নিজের নির্মম স্বপ্নগুলোর দিকে? আমরা আবার গেলাম রুপালি কবিতা স্টোরে । আরেকবার চিনচিনে শোক আভিভুত করলো আমাদের । তাহেরের দোকানভর্তি মানুষজন । তাহেরের আমাদের দিকে তাকাবার সময় নেই । সে একটার পর একটা কবিতা ঝুলিয়ে দিচ্ছে রুপালি জোছনার গায়ে, মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে । আবার ঝুলাচ্ছে আবার কাড়াকাড়ি পরে যাচ্ছে । কেউ দাঁড়িয়ে আছে শুধু তাকে দেখবে বলবে । আর শরতের ঝিলের মতো আনাবিল মেয়েরা তার পাশে । তাহেরের বুক পকেটে নিশ্চয়ই তাদের গন্ধ । ওর আমাদের দিকে আহঙ্কারের হাসি আমাদের অন্তর্গত নাবোধক তীব্র আকারে ছড়িয়ে দেয় শরীরজুড়ে । আমি আর তুহিন পেছন ফিরে আসি । যেনও কতকালের না পাওয়া আমাদের অস্তিত্বজুড়ে । হঠাৎ করে বহু পেছনের পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে কঙ্কালময় অতীত । সেই যে কবে একটা একটা কালজয়ী গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজও খুঁজে পাইনি কোনও রঙ্গিন কলম । সেই মেয়েটা কথা দিয়েছিলো, যেখানে শেষ রাতে চাঁদ নেমে যায় আকাশের তলায় ততদুর পাড়ি দিলে সে ফিরে আসবে আবার । কিংবা আমরা যে চার জন একদিন ভেবেছিলাম একদিন আমাদের নামেও আসবে বিখ্যাত হবার আমন্ত্রন, হয়তো ভুল ঠিকানায় তবুও আসবে তো । আজ তাহেরের হাসি আমাদের সব অসমাপ্ত গল্পের পাতা ছিঁড়ে দেয় । আমি আর তুহিন আবার আমাজাদের দোকানে বসি । আমাদের মধ্যে জেগে উঠছে সহস্র বছর পুরানো শয়তানবোধ । তীব্র জিঘাংসায় তছনছ হবে অহংকার!
৪
গোমড়ামুখো রাত পেরিয়ে যাচ্ছে তার যৌবন কাল । অন্ধকার আরেকটু ছায়া সরিয়ে নিচ্ছে আলোর দিক থেকে । বহুদূরে কি ডাকছে ঝিঁঝিঁপোকা ?? কিংবা রাত জাগা পাখি?? এই শহরে খুব সম্ভব কোনও রাত জাগা পাখি ডাকে না । এখানে পাখিরাও হয়তো ক্লান্ত হয় স্বার্থপরতার ডানা ঝাপটানোতে । ভালই হয়েছে । কেউ দেখবে না আমাদের, আমি আর তুহিন । আমরা দুইজন যেনও বিম্বিসার আশকের ধুসর জগত থেকে উঠে আসা প্রাচিন অভিশাপ । নাকে বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ । আমার ভিতরটা কুয়াশার মতো আবছা হয়ে যায় । আমি দেখি আগুন জ্বলে উঠেছে । খুব সূক্ষ্ম কিন্তু সাপের মতো নিখুঁত হিসেবে ছুটছে রুপালি কবিতা ষ্টোরের দিকে । আমরা খুব ভীরুতায় জোরে জোরে হাঁটতে থাকি । পিছনে লালচে হয়ে উঠছে রুপালি স্টোর। সহস্র বছরের পুরানো প্রতিহিংসা গিলে খাচ্ছে কুসুম কমল জোছনা । বোবা পৃথিবীর বুকে আরেকটি পাপের দাগ একে আমরা গলে যাচ্ছি যেখানে এমনকি চাঁদও আমাদের সাথে আসতে পারে না । আমি শেষবারের মতো পিছনে তাকালাম ।
৫
আমারা তখনও জানিনা আমাদের বন্ধু সে রাতে ঘুমিয়েছিলো তার কবিতার দোকানে !
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:২৫