somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্প্রচার আইনে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার অর্থ গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করা

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের দেশে গণমাধ্যম কতটুকু গণ-মানুষের আর তা কতটুকু স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু সম্প্রতি প্রস্তাবিত সম্প্রচার আইন-২০১১ এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বস্তুত, এই আইন জারী হলে দেশের সরকারী-বেসরকারী সকল সম্প্রচার মাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের কুক্ষিগত হবে। যদিও বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগের ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ১৯তম দফায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, “সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতান ও তথ্য-প্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে।" কিন্তু তারা যে গণমাধ্যমকে স্বাধীন করতে কতটা সচেতন (!) তা গত পৌনে তিন বছরে বিভিন্ন প্রিন্ট/ইলেক্ট্রনিক/অনলাইন মাধ্যম, এমন কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধের মাধ্যমে আমাদের বেশ ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের দেশে মূলধারা বলে যা পরিচিত, সেই মূলধারায় এমন কোনো জাতীয় বা স্থানীয় দৈনিক নেই, এমন কোনো টিভি চ্যানেলও নেই, যার সাথে সরকারের, কিংবা ব্যবসায়ের কিংবা আমলাতন্ত্রের কিংবা সেনাবাহিনীর কিংবা ধর্মীয় অন্ধত্ববাদীদের কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কিংবা বৈশ্বিক ক্ষমতাশক্তির, তথা আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের, তথা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার কোনো স্বার্থের বন্ধন নেই। টিভি চ্যানেলগুলো অথবা পত্রিকাগুলো ব্যবসায়ীদের নয়তো সরকারের চামচাদের। স্থানীয় পত্রিকাগুলো বাদ দিলে জাতীয় দৈনিক এবং টিভি চ্যানেলগুলো বড় বড় সব কর্পোরেটদের। পত্রিকার কাজ তাই হয় ক্ষমতায় থাকা সরকারের কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধীদের কিংবা বড় বড় সব ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করে যাওয়া। মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপন যে পত্রিকার ২ পাতা জুড়ে থাকে, সেই পত্রিকার পক্ষে কোনোভাবেই ঐ মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশের প্রায় সব মিডিয়াই চলে অগণতান্ত্রিকভাবে। সম্পাদক থেকে শুরু করে ক্রমে ক্রমে স্তরে স্তরে আছে কর্তৃত্বের চাবি। এখানে একজন সংবাদকর্মী স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার সুযোগ নেই। ‘উপরের’ লোকজনেরা তাদের বিকাশ রুদ্ধ করতে চায়, চায় যেন তার থেকে বড় হয়ে উঠতে না পারে। এজন্যই পত্রিকায় অগণিত সংবাদকর্মী কাজ করলেও মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মতামতই সেখানে প্রাধান্য পায়। তাই কোনোভাবেই সেই মিডিয়াটি পারে না অনেক অনেক সংবাদকর্মীর মিলিত চিন্তায়, মিলিত ভাবনায়, মিলিত শ্রমে ঋদ্ধ হতে।
ঢাউস ঢাউস সব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের প্রায় সমস্ত প্রধান মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি হবার কারণে ঐ সব বেনিয়াদের স্বার্থ দেখাটাই মিডিয়ার কাজ হয়ে দাঁড়ায়। মুখে দেশের কথা, মানুষের কথা, বদলে যাওয়া-বদলে দেওয়ার নাম করে আসলে ব্যবসায়ীদের, শুধুই বড়লোকদের স্বার্থ দেখা তাদের কথা বলা, তাদের জন্য পরামর্শ দেয়া মিডিয়ার কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যই, পত্রিকা যখন প্রথম পাতা সাজায় সেই পাতায় খালেদা-হাসিনা-ইউনুস-আবেদ-নায়িকা-গায়িকা ছাড়া সমাজের বেশিরভাগ মানুষের সমস্যাগুলো আলোচিত হয়না বললেই চলে। যখন পত্রিকা বিদেশনীতির বিষয়ে মতামত ছাপে তখন চিন্তা করে কোনটুকু বড়লোকদের স্বার্থ। দেশের জাতীয় সম্পদ বিকিয়ে দেবার পক্ষে মতামত ছাপে, জায়েজ করে তাকে, রক্ষা করে কর্পোরেশনের স্বার্থ।

তা স্বত্ত্বেও, সরকারী দলের পক্ষে নয়, এমন বেসরকারী মিডিয়াগুলো যখন সরকারী অপকর্মের হালখাতা মানুষের সামনে অবমুক্ত করে, তখন তা ক্ষমতাসীনদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনই আসে ঐ মিডিয়ার উপর সম্প্রচার বন্ধের খড়গ। এই কালচার (!) এই রাষ্ট্রে নতুন কিছু নয়, জন্মের সূচনা লগ্ন থেকেই মিডিয়াকে কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট ছিল প্রতিটা সরকার।
বাংলাদেশ সরকার প্রণীত বিভিন্ন প্রকাশনা ও সম্প্রচার বিষয়ক নীতিমালাগুলোতে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি প্রণীত সম্প্রচার নীতিমালায় এর প্রতিফলনই দেখা গেছে। এই রাষ্ট্রের বহুবার ‘ধর্ষিত’ সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বস্তুত এই রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের কোন অস্তিত্ব নাই, মত প্রকাশ তো অনেক দূরের কথা।

খসড়া সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে:
১. কোনো টেলিভিশন চ্যানেল বা সম্প্রচার মাধ্যম সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচার চালাতে পারবে না।
২. বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায় এমন কোনো টক শো প্রচার করা যাবে না।
৩. জাতীয় আদর্শ বা জাতীয় নেতাদের সমালোচনা করা যাবে না।
৪. কোনো অনুষ্ঠানে জাতির জনকের সমালোচনা করা যাবে না।
৫. কোনো অনুষ্ঠানে কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করা যাবে না।
৬. জাতীয় আদর্শ ও লক্ষ্যের সমালোচনা করা যাবে না।
৭. সামরিক বা সরকারী কোনো তথ্য ফাস করা যাবে না।
৮. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, এমন কোনো তথ্য প্রচার করা যাবে না।
৯. বন্ধুপ্রতিম কোনো রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে না।
১০. নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান বা ইত্যাদি বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করা যাবে না।
১১. চুমুর দৃশ্য প্রচার করা যাবে না।
১২. বিদ্রোহ বা প্রতিবাদের কোনো খবর বা অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না।
১৩. অপরাধীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না।
১৪. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, সরকারী প্রেস নোটস, বিজ্ঞপ্তি এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করতে বেসরকারী সম্প্রচার মাধ্যমগুলো বাধ্য থাকবে।
সেই সাথে এই আইন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারও ক্ষুন্ন করেছে। নতুন খসড়া সম্প্রচার আইন অনুসারে,
“হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কোন প্রচারণামূলক অনুষ্টান (ক্রিসমাস,বৌদ্ধ পূর্ণিমা,পূজা ইত্যাদি নিয়ে অনুষ্টান) প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।”

এই ধারাগুলোকে আসলে পৃথক করে খণ্ডানোর প্রয়োজন পড়ে না, প্রতিটা ধারা শতভাগ অগণতান্ত্রিক, শতভাগ অমানবিক। তবুও পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই--
১. কোনো টেলিভিশন চ্যানেল বা সম্প্রচার মাধ্যমের একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে, সেক্ষেত্রে তার তথ্য প্রকাশের মধ্যেই সে মতাদর্শের প্রতিফলন চলে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
২. টক শো'তে কথা বললেই তো এখন আদালত অবমাননা করা হয়, আর তা ক্ষমতাসীনদের নির্দেশেই করা হয় আর এই কথাগুলো তো সরকারের জন্য বিভ্রান্তিমূলকই বটে।
৩. এই রাষ্ট্রে জাতীয় আদর্শ কোনটি, তা কী কোন দলের আদর্শ? আর রাষ্ট্র নির্দেশিত জাতীয় নেতাদের নেতা হিসেবে আমরা যারা মনে করি না, তাদের ক্ষেত্রেও কী এটি প্রযোজ্য? আর এটি কী কোন নির্দিষ্ট দলের দ্বারা নির্দেশিত?
৪. ‘জাতির জনক’ কনসেপ্টটাই হলো ব্যক্তিপূজা। কোন উন্নত বুদ্ধিদ্বীপ্ত জাতিতে ‘জাতির জনক’ ধরণের কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ভারতবর্ষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবার পরে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় অংশেই ‘জাতির পিতা’ হিসেবে যথাক্রমে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'কে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এখানের যেই চিন্তাধারা সেই অনুযায়ী কোন কীর্তিমান ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তাকে ‘ঈশ্বর’ (!!!) বলে গণ্য করাটা প্রায় সমার্থক। আমরা যদি জার্মানি, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে ভারতবর্ষের তুলনা করি তাহলে দেখব যে, কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের কারণে চিন্তা-ভাবনায় বিস্তর ফারাক। জার্মানি, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশগুলোতে যথার্থভাবেই তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে প্রগতিশীল বুর্জোয়া বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। যে কারণে সেইসব দেশসমূহে দার্শনিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা স্বাভাবিকভাবেই ছিল প্রগতিশীল। অন্যদিকে, সেই সময়ে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ পশ্চাৎপদ হলেও বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে নেতৃত্বাধীন দলগুলোর আদর্শ তাদের সচেতন করে রেখেছিল বিধায় সেসব দেশেও ‘জাতির পিতা’ নামক হাস্যকর কোন ধারণা সেখানে গড়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকার সময় ভারত উপমহাদেশের যেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তার চরিত্র ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর থেকে আলাদা ছিল। সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল এই জায়গাতে যে, সেই শ্রেণীটির নিজস্ব রাজনৈতিক কোন ক্ষমতা ছিলনা, যা ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির ছিল। যেই দেশীয় পুঁজি সেই সময়ে গঠিত হয়েছিল তার সিংহভাগই বিনিয়োগ করা হত ভূসম্পত্তি ও জমিদারী স্বত্ব কেনার জন্যে। তাই ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর মত এই বাঙ্গালী মধ্যশ্রেণী কোন শিল্প প্রক্রিয়ার থেকে উদ্ভব হয়নি, তেমনি তার কোন স্বাধীন অস্তিত্বও ছিলনা।
একদিকে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ বলে আখ্যায়িত করে, অন্যদিকে তাকেই আবার বলে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ (!!!!) তাকে বাঙ্গালী জাতির জনক হিসাবে বললে অবশ্যই ১৯৭১ সালের পূর্বের যেই বাঙ্গালী জাতি তার থেকে বিচ্ছিন্ন করেই বলতে হবে; কারণ তাতে বাঙ্গালী জাতির যেই ইতিহাস সামনে এসে যায়, সেটা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মেরও আগের!!!! সেই সময়ে আরো অনেক অনেক কীর্তিমান ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল এবং বাঙ্গালী জাতিও অন্যান্য জাতি সমূহের মতই ক্রমাগত পরিবর্তিত এবং পুনর্গঠিত হচ্ছিল এমন এক ধারাবাহিকতায় যা বাঙ্গালী জাতির অতীত এবং বর্তমান উভয়কেই একই সূত্রে সম্পর্কিতভাবে বেঁধে রাখে। অর্থাৎ যেই ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে সেই ‘জাতির জনক’ তাকেই আবার বলা হচ্ছে সেই জাতির ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কীর্তিমান ব্যক্তি’!!!!!! এরুপ ভন্ডামি যে কেবল আওয়ামী লীগই করে থাকে তা কিন্তু নয়। তার ধারাবাহিকতায় বিএনপিও জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক নামে আখ্যায়িত করে!!! এরুপ ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ উপাধির উদাহরণ আজ বাংলাদেশে সর্বত্র দেখা যায়। সুদখোর মহাজন ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসকে বলা হয় 'গরীবের একমাত্র প্রকৃত বন্ধু'!!! এইরুপ যত ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ উপাধি দিয়ে জনগণের মনে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়, তার মধ্যে কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি মার্কা পার্থক্য নেই, বরং রয়েছে মিল। তাহলো জনগণকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, তাদের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করা যে সংগঠিতভাবে কোন প্রকার ইতিবাচক পরিবর্তন বাংলাদেশে করা সম্ভব নয়। সর্বত্রই এই ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া যে দেশের, রাষ্ট্রের মুক্তি আনবার জন্যে সম্মিলিত কোন প্রতিরোধের প্রয়োজন নেই, বরং সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত একজন অবতার এসে এই রাষ্ট্রকে মুক্ত করে দিতে সক্ষম!!!
৫. কোনো অনুষ্ঠানে কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করা যাবে না কেন? সমালোচনা করার মাধ্যমেই সেই ব্যক্তির ভুল-ত্রুটি পরিমার্জন করা সম্ভব; আর যদি তিনি মনে করেন কথাগুলোতে উনাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে, সেক্ষেত্রে উনি ব্যক্তিগতভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। যখন সংসদে অশ্লীল ভাষায় ‘সাংসদ’ নামক প্রাণীরা কথা বলেন, গালাগালি করেন, মহিলা সাংসদদের শরীর নিয়ে কথা বলেন, তখন তো সবাই অভিশংসন পেয়ে যান। টক শো'তে কথা বললেই তাদের গা-জ্বলুনি শুরু হয়!
৬. জাতীয় আদর্শ ও লক্ষ্য আমার কাছে সাধারণের প্রকৃত মুক্তি অর্জন করা; সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র নির্দেশিত আদর্শ ও লক্ষ্য কোনটি হবে? এমতাবস্থায় সমালোচনা অবশ্যম্ভাবি।
৭. সামরিক বা সরকারী সকল তথ্য জানার অধিকার রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের আছে, আর তা ফাঁস করা যাবে না কেন? তথ্য সংরক্ষণ আইন কোন কাজের?
৮. মিডিয়াতেই যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা না জানা যায়, তাহলে এমন পঙ্গু মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
৯. কোন রাষ্ট্র আওয়ামী লীগ বা বিএনপি'কে ক্ষমতায় যেতে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে সুপারিশ করলে সে রাষ্ট্র ওই দলের বন্ধুপ্রতিম হতে পারে কিন্তু যখন সে তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্রটি আমাদের দেশে অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালাবে, সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারবে, নদীতে বাঁধ দিয়ে ফসলী জমি মরূভূমি বানাবে, আবার করিডোর নিয়ে এই দেশকে ঔপনিবেশিক রাজ্য বানাতে চায়; সেই রাষ্ট্র আমার বন্ধুপ্রতীম তো হতে পারে না, তবে সেই রাষ্ট্রের নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষেরা আমার পরম বন্ধু। সেই রাষ্ট্রের সমালোচনা তো আমি প্রতি মূহুর্তেই করব, আর তা করাটাই স্বাভাবিক নয় কী?
১০. নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান বা ইত্যাদি বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করা যাবে না কেন? মিডিয়ার কাজ কী শুধু নাচ-গান আর বিজ্ঞাপণে ভরপুর থাকাটাই?
১১. চুমুর দৃশ্য প্রচার করা যাবে না; এখানে চুমু কে, কাকে, কি অবস্থায়, কোথায়, কিভাবে দিচ্ছে এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
১২. বিদ্রোহ বা প্রতিবাদের কোনো খবর বা অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না, খুবই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ জাগছে প্রতিনিয়ত। আর যে সাম্রাজ্যবাদের পা চাটে ক্ষমতাধারীরা, সেই সিআইএ'র তালিকায় এই অঞ্চলে এখনো এক নম্বর কাজ হলো মাওবাদ দমন, যদিও এই রাষ্ট্রে মাওবাদীরা এখনো সংগঠিত কোন শক্তি নয়।
১৩. অপরাধীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না কেন? অপরাধীদের অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য জানতে পারলেই তো সাধারণ মানুষেরা এথেকে সাবধান হতে পারবে। নাকি এই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টরা অনেকাংশে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের ক্যাডাররা বলেই এই ধারা?
১৪. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, সরকারী প্রেস নোটস, বিজ্ঞপ্তি এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করতে বেসরকারী সম্প্রচার মাধ্যমগুলো বাধ্য থাকবে। বাধ্য তো থাকতেই হবে, সামন্ততন্ত্র শেষ হয়ে গেলেও এর ভগ্নাংশ যে এখনো বিদ্যমান!
সেই সাথে নতুন খসড়া সম্প্রচার আইন অনুসারে, “হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কোন প্রচারণামূলক অনুষ্টান (ক্রিসমাস,বৌদ্ধ পূর্ণিমা,পূজা ইত্যাদি নিয়ে অনুষ্টান) প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।” এটি রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের পরিচায়ক, আর এই পয়েন্টে বিএনপি এবং জামায়াতও সহমত পোষণ করবে প্রশ্নাতীতভাবে। কারণ, এই রাষ্ট্র বাঙ্গালী মুসলমানের সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র।

ব্রিটিশ শাসনামলে আইন করে যুক্তরাজ্যের রাজা, রাজকর্মচারী এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের ব্যঙ্গ উপস্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। পত্রিকায় কিংবা নাটকে রাজন্যবর্গের এমন উপস্থাপন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো সে সময়। বর্তমান জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায়ও একটি বিধানে বলা হয়েছে, “জাতীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতি অবমাননাসূচক মন্তব্য কিংবা ব্যঙ্গাত্মক বিকৃত উপস্থাপনা এ বিধানের বলে নিষিদ্ধ বিবেচিত হবে।”
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই অঞ্চল থেকে পলায়নের পর বর্তমান বাংলাদেশ ভুখন্ডটি কার্যত পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। তখন ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে শাসকশ্রেণীর মূলমন্ত্র হয়ে উঠে ইসলামী মূল্যবোধ, জাতীয় সংহতি, সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা এবং সামাজিক মূল্যবোধ। সাধারণ মানুষের শালীনতা বোধ এবং মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অশোভন-অশালীন বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণীত হয়। ব্রিটিশ আমলেও এমনি আইন জারী ছিল। যা রিমিক্স হয়ে বর্তমান সম্প্রচার আইনে বলা হচ্ছে “চুমুর দৃশ্য প্রচার করা যাবে না।” কিন্তু বলা হয়নি কাকে, কোথায়, কিভাবে চুমু দিলে তা প্রকাশ করা যাবে না।
১৯৭৩ সালে প্রিন্টিং প্রেসেস এন্ড পাবলিকেশন এক্ট জারী করে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা এবং দলীয় কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ সরকার বিরুদ্ধ সমালোচনা এবং রাষ্ট্রের সংহতি এবং স্থিতিশীলতাবিনাশী সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে সরকার মুখপত্র, স্পোকসম্যান, লালপত্র, হক কথা, চরমপত্র, দেশ বাংলা , স্বাধীকার, স্বাধীনতা এবং নবযুগ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়, তাদের প্রেস তালাবন্ধ করে সরকার স্বীয় ব্যর্থতায় গণবিক্ষোভ এড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলো, অন্তত সচেতন ছাত্ররা যে সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়ায় সরকারী দলকে সমর্থন দিতে অনীহ সেটা প্রকট হয়ে যায় ১৯৭৩-৭৪ সালে শিক্ষাঙ্গনগুলোর ছাত্র পরিষদ নির্বাচনে, ছাত্রলীগ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পরে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ব্যলট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচন বানচাল করে দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ দেশে বাকশাল কায়েম করে দেশের মিডিয়াগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন (শুধু সরকারী ৪টি মিডিয়া ছাড়া)। পরবর্তীতে, এই গণমাধ্যম আর কখনোই গণ-মানুষের হয়ে উঠেনি, তা জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা, নিজামীর গৃহবন্দি; অথবা কর্পোরেট, বিদেশী কোম্পানি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আনুকূল্যে লালিত। আর সেই তথাকথিত গণমাধ্যমকেই নিজের পোষা ময়না পাখি বানাতে মরিয়া রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা। বর্তমানে আমাদের সামনে রাষ্ট্রের যে ফ্যাসিবাদী সর্বভুক চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তা একদিনে হয়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রাপ্ত এই দালাল সুবিধাভোগী চরিত্র, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে গত ৪০ বছরের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র আজ স্বমহিমায় (!) উদ্ভাসিত।

সম্প্রচার নীতিমালা মূলত এমন কিছু মৌলিক নীতি, বিধি, নিয়মাবলীর সমষ্টি, যার মাধ্যমে সে অঞ্চলের সম্প্রচার বিষয়ক বিষয়াদি পরিচালিত হয়ে থাকে। অতীতে কয়েকবার সম্প্রচার নীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হলেও তা চূড়ান্ত করা হয়নি কখনোই। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ তারিখে ওই সময়কার মন্ত্রী পরিষদ সচিব মুজিবুল হকের নেতৃত্বে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশন ৩০ সেপ্টম্বর ১৯৯১ সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া স্বত্তেও ক্ষমতায় থাকা বিএনপি'র প্রথম সরকারের পুরো মেয়াদকালেই এই প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
১৯৯৬ সালে বেতার-টিভি'র স্বায়ত্ব শাসন কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের প্রতিবেদনে বেতার-টিভি'র স্বায়ত্ব শাসন নিশ্চিত করতে বলা হয় সরকারকে। তাতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, “সরকার কর্তৃক সংসদে জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠনের বিল আনতে হবে, জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন ও তার কার্যপরিধি নির্ধারণ করতে হবে এবং জাতীয় সম্প্রচার কমিশন কর্তৃক সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।”
১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারী বেতার-টিভি'র জন্য “বেসরকারী মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালনা নীতি” এবং “বেসরকারী মালিকানায় বেতার কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা নীতি” নামে দু'টি পৃথক খসড় নীতিমালা তৈরি করে। এদু'টি খসড়া নীতির আলোকে এখনো বেসরকারী টিভি ও রেডিও'র সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালে প্রথম বেসরকারী চ্যানেল হিসেবে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)'র যাত্রা শুরু হয়।

সম্প্রচার শুরুর পর থেকেই বিটিভি'র টেরিস্ট্রিয়াল সুবিধা ও মান সম্পন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বেশ সাড়া ফেলে ইটিভি। কিন্তু শোষণের পালা বদলে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় বিএনপি'র নেতৃত্বে চার দলীয় জোট। আর তাই একুশে টেলিভিশনের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি খুঁজে পায় আদালত। সেই ত্রুটির অজুহাতে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট আদালতের রায় ঘোষণার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়েছিল জোট সরকার। তারপর টেন্ডার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে মন্ত্রী, সাংসদদের নামে দেওয়া হলো একের পর এক লাইসেন্স।
২০০৩ সালে মালয়েশিয়া ভিত্তিক এশিয়া প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট অব ব্রডকাস্টিং ডেভেলপমেন্ট একটি খসড়া নীতিমালার তৈরী করে সরকারকে দেয়, যার নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্রডকাস্টিং অ্যাক্ট। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে ১৯৯৮ সালের দু'টি খসড়া নীতির ভিত্তিতেই ৮টি টেলিভিশন চ্যানেল ও ৪টি এফএম রেডিও স্থাপনের অনুমতি দেয়।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরতে জলপাই রঙের বাহিনী এই অঞ্চলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাত্র আন্দোলনের সময়ে আর্মি-পুলিশের বর্বরতা প্রকাশের জন্য তৎকালীন বাংলাদেশের একমাত্র নিউজ চ্যানেল সিএসবি নিউজ'কে বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে সকল সম্প্রচার মাধ্যমে অঘোষিত সেন্সর জারি করে। সেই ধারা অব্যহত রাখে পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। চার দলীয় জোট সরকারের পথ অনুসরণ করে মহাজোট সরকারও যোগ্য ও পেশাদার বিনিয়োগকারীর বদলে দলীয় অনুসারীদের নামে দিল ১২টি বেসরকারী চ্যানেলের লাইসেন্স। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন সেমিনার, গোল টেবিলে সরকারের নীতি নির্ধারকেরা বলে আসছে মিডিয়াকে কুক্ষিগত করার জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথা।
তার কিছুদিন পরই পুনঃঅনাপত্তিপত্র আবেদনের অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হলো ‘যমুনা টিভি’র পরীক্ষামূলক সম্প্রচার। মালিকানা একজনের, যন্ত্রপাতি আরেকজনের, এই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হলো ‘চ্যানেল ওয়ান’। চাকরী হারায় দু'টি চ্যানেলের প্রায় এক হাজার কর্মী। প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত বিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে টেলিভিশনের মালিকের সঙ্গে। কিন্তু সংবাদকর্মীরা কোন অপরাধে অপরাধী, তারা তো সবাই নিবেদিতপ্রাণ, পেশাদার। অনিয়ম হয়ে থাকলে সম্প্রচার বন্ধ না করেও আর্থিক শাস্তির মাধ্যমে তার প্রতিকার করা সম্ভব। কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বা মোবাইল কোম্পানি তো অবৈধ ব্যবসা করলেও তা বন্ধ করার সাহস পায় না কোন সরকার। তাহলে টিভি চ্যানেল বন্ধ করতে হবে কেন? এর মূল কারণ প্রতিহিংসা, সমালোচনা সহ্য না করার মানসিকতা এবং নিজের অপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে পৌছাতে না দেওয়া, তথা শোষণের মোহ।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে তথ্য মন্ত্রণালয় হতে এক চিঠির মাধ্যমে ‘বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালনা নীতি-১৯৯৮’এর ৪(৪) ধারা অনুযায়ী, বর্তমানে সম্প্রচারে থাকা দেশের ১৩টি বেসরকারী টিভি চ্যানেলকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত দুপুর দুইটা ও রাত আটটার সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, চিঠিতে স্বাক্ষর ছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব তন্দ্রা শিকদার'এর। বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিরোধিতার মুখে ২২ সেপ্টেম্বর বেসরকারী চ্যানেল মালিকদের সাথে এক বৈঠকে তথ্য মন্ত্রী আপাতত শুধুমাত্র দুপুর দুইটার সংবাদ সরাসরি প্রচারের জন্য অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে, ২৬ সেপ্টেম্বর সব বেসরকারী টিভি চ্যানেলের মালিকেরা বিটিভির দুপুর দুইটার সংবাদ রেকর্ড করে দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে যেকোনো সময়ে সম্প্রচারের জন্য সম্মতি জানিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক চিঠি পাঠায়।

প্রিন্ট মিডিয়াও সরকারী প্রশাসন ও সরকার দলীয় লোকদের হস্তক্ষেপ থেকে আলাদা ছিল না, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং জাতীয় প্রেসেক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ সহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সাংবাদিক। এখানে উল্লেখ্য যে, জনাব মাহমুদুর রহমানও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নন, বরং তিনি ফুলবাড়ী'র শহীদদের হত্যার পরিকল্পনাকারী, সাম্রাজ্যবাদী দালালদের অন্যতম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদের দালাল উভয় জোটই মুখে কুলুপ এঁটে রাখে, কারণ তাদের মাঝে মৌলিক কোন পার্থক্য লক্ষণীয় নয়। তারা বরং আদালত অবমাননা নামক একটি অমানবিক পন্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের নির্যাতনের পক্ষপাতী। তবে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধের প্রকৃত কারণ মূলত দুইটি রিপোর্ট “তৌফিক এলাহী ও জয়ের বিরুদ্ধে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেয়ার অভিযোগ : শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিতে উৎকোচ গ্রহণের বিষয় তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়” এবং “বিডিআর বিদ্রোহ : সরকারী তদন্ত কমিটির রিপোর্ট”। এই রিপোর্টগুলোয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়'এর বেশ কিছু অপকর্ম সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে, আর তা সহ্য করা মহাক্ষমতাধরদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

অনলাইনও ক্রমেই আওয়ামী লীগের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এদিকে তাদের শ্যেণ দৃষ্টি রেখে আসছে। মূলত নির্বাচনে তরুণদের একটা বিশাল অংশের সমর্থন আদায়ে আওয়ামী লীগ ফেসবুক ও ব্লগ সাইটগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা চালায়, আর তা করতে গিয়ে তারা কুমিরের বাচ্চার মতো তরুণদের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মূলা ঝুলিয়ে রাখে। সেই মূলাতে এখন পঁচন ধরায় অনেকেরই মোহ ভঙ্গ হয়েছে আর তাই ভিন্নমত ধারণ করা শতাধিক ওয়েবসাইট ব্যান করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে বাম মতাদর্শ ধারণ করে। এর মাঝে আমাদের স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যম মঙ্গলধ্বনি (http://www.mongoldhoni.com) ব্যান করা হয়েছিল ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বিনা নোটিশে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিআইএ ও সরকারের সাইবার এক্সপার্টদের নির্দেশে এই সাইটগুলো বন্ধ করা হয় বিটিআরসি কর্তৃক (যদিও জামাতী ও পর্ন সাইটগুলো ঠিকই অনলাইনে আছে, এমন কিছু পর্ন সাইটের মালিক আবার আওয়ামী লীগেরই কেউ কেউ)।
৩১শে জুলাই ২০১১ অনলাইন ভিত্তিক নিউজ এজেন্সী শীর্ষ নিউজ ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ'এর সম্পাদক একরামুল হক'কে গ্রেপ্তার করে মুক্তিপণ হিসেবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করা হয়েছে শীর্ষ নিউজ ডট কম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, “গত জুন মাসে শীর্ষ নিউজ ডট কমের ভ্রাতৃপ্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের কথিত দূর্ণীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে চিঠি দিয়ে দু'টি প্রতিষ্ঠানেরই সব সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বা সরকারের দেয়া পরিচয়পত্র বাতিল করা হয়। বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে এবং এ নিয়ে নানা পর্যায়ে আন্দোলন সংগ্রামও শুরু হয়, যা অব্যাহত ছিলো পত্রিকা দু'টির সম্পাদক গ্রেপ্তার হবার পরও।”

আরো মজার বিষয় হলো, যে পাকিস্তানের বিরোধীতা করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ধ্বজাধারীরা, সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই তারা সম্ভবত আইডল মনে করে, আর এজন্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তারা গড়ে তুলতে চাইছে বাঙ্গালী মুসলমানের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানকে অনুসরণ করে ২৯ মে ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ করে দেয়। আর এর কারণও ভিন্ন মতের প্রকাশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যেকোন প্রকারে দূরে রাখা। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল সাইবার বিশেষজ্ঞদের ভাড়া করেছে সাইবার জগতে নজর রাখার জন্য। আর তাদের একটি চোখ এখন সর্বদা এদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের দিকে নিবদ্ধ। সেই সাথে মোবাইল-ল্যান্ড ফোনে শব্দ ফিল্টার করে সেই ব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করে ফলো করা তো আছেই। মোট কথা, আমরা যেন নজর বন্দি হয়েই আছি সর্বত্র। এখানে মানবাধিকার কমিশন থাকলেও ‘মানবাধিকার’ যেন বিরল প্রজাতির কোন বস্তু!
সম্প্রতি, আদালতকে সরকার পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। বেশ কিছু টক শো বন্ধ করেও হচ্ছিল না, শেষে আদালতকে দিয়ে বলানো হলো টক শো'তে মত প্রকাশ করলেও আদালত অবমাননা হয়, এমন কী ফেসবুক স্ট্যাটাসও আদালত অবমাননা! জানামতে আর কোন দেশে 'আদালত অবমাননা'র মতো ভুয়া কোন ব্যাপার দেখা যায়নি, মানবাধিকার তো সুদূর পরাহত। সর্বক্ষেত্রে ১৪৪ধারা জারী, মুখেও, হাতেও; দয়া পরবশত তারা আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকারটুকু এখনো কেড়ে নেয়নি। অবশ্য যমদূত রূপী কালো র‍্যাব হয়ত হুকুমের অপেক্ষাতেই আছে, তবু লিখছি; মৃত্যু ভয় আছে, তবু লিখছি।

পরিশেষে বলতে চাই, এমন অনেক অনেক অনেক মিডিয়া দরকার, যে মিডিয়া যাবতীয় রকমের ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে অবস্থান করবে। আমরা এমন অনেক মিডিয়া চাই যেখানে সমস্ত সংবাদকর্মীর মতামতের সমান গুরুত্ব থাকবে এবং সব সংবাদকর্মীর মিলিত চিন্তায় একটি চমৎকার মিডিয়া হয়ে উঠবে। আমরা এমন একটা মিডিয়া চাই যেখানে পাঠক আর লেখকের আলাদা কোনো সত্তা থাকবে না। পাঠকও হবে একজন সক্রিয় লেখক। বড়লোকদের স্বার্থে নয়, সমাজের সমস্ত শ্রেণী-পেশা-বর্ণ-জাতি-ধর্মের মানুষের এবং অপরাপর প্রাণের এবং প্রকৃতির স্বার্থে কাজ করবে এমন মিডিয়া দরকার।

সবাই মিলে কথা হলে, তর্ক হলে, বাহাস হলে, দ্বন্দ্বের বিকাশ হলে তবেই সত্যিকারের গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করে। সংসদীয় গণতন্ত্র নামের ৫ বছরের জন্য নির্ধারিত স্বৈরতন্ত্র নয়, এটা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, সত্যিকারের নয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন।।

লিখেছেন: শাহেরীন আরাফাত
(আন্তরিক কৃতজ্ঞতা কমরেড মনজুরুল হক'এর প্রতি)
(ফটো ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত)

মূল লেখা
তথ্যসুত্র:
১. Click This Link
২. http://unmochon.net/node/896
৩. Click This Link
৪. Click This Link
৫. Click This Link
৬. Click This Link
৭. Click This Link
৮. Click This Link
৯. Click This Link
১০. Click This Link
১১. Click This Link
১২. http://amarblog.com/raselpervez/posts/136791
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×