স্পিনোজার জীবন ও তাঁর সমসাময়িক জগৎ
এএম হারুন অর রশিদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য দা কস্টার ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ১৬৪০ (অথবা ১৬৪৭) সালে সিনাগগ দা কস্টার সঙ্গে এক সমঝোতায় উপনীত হলেন এই শর্তে যে, তিনি তাঁর ধর্মবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করে ক্ষমা ভিক্ষা করবেন।
এই ক্ষমা প্রার্থনার অনুষ্ঠানে দা কস্টাকে একটি রজ্জু দিয়ে দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা হয়েছিল এবং তাঁর অনাবৃত পৃষ্ঠে ৩৯ বার বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। দা কস্টা লিখেছেন, ঠিক ওই ৩৯ সংখ্যাতেই বেত্রাঘাত করা হয়েছিল_ আইন অনুসারে!
শুধু তা-ই নয়, সবশেষে দা কস্টাকে প্রধান দরজার সামনে শয়ন করতে বলা হলো এবং তাঁর ওপর দিয়ে সবাইকে হেঁটে যেতে বলা হলো। দা কস্টা লিখেছেন, কেউ অবশ্য তাঁকে মাড়িয়ে যাননি, শুধু সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গিয়েছেন।
এই ঘটনা দা কস্টা তাঁর আত্মজীবনীতে বিস্তৃতভাবে দিয়েছেন এবং এ বইটির পা-ুলিপি শেষ করে দা কস্টা নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
স্পিনোজা তাঁর কোন রচনা বা গ্রন্থে ইউরিয়েল দা কস্টার এই আত্মাহুতির ঘটনা উল্লেখ করেননি। কিন্তু এক সময় সুসংগঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে ইউরিয়েল দা কস্টার অবস্থান আর বেন্টো বারুচ্ স্পিনোজার অবস্থান একই হয়ে দাঁড়ায়। দা কস্টা স্পিনোজার মতো গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন না, বরং তিনি ধর্মীয় ভ-ামির বিরুদ্ধে তাঁর অনুভূতি আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। দা কস্টার মৌলিকত্ব ছিল এই যে, তিনি তাঁর বিশ্বাসের জন্য আত্মাহুতি দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। স্পিনোজার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিবরণী_ চেরেম_ সেই মঞ্চটি থেকেই পাঠ করা হয়েছিল যেখান থেকে দা কষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিরা নির্যাতনে অভ্যস্ত এবং তারা হল্যান্ডে বাস করতেন এক অলিখিত ভদ্রলোকের চুক্তির অধীনে। এই চুক্তি অনুসারে ইহুদিরা তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করতে পারতেন, কিন্তু ইহুদি ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন না, কাউকে ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারতেন না এবং স্থানীয় কোন নারীকে বিয়ে করতেও পারতেন না। ইহুদিরা ছিলেন সমাজের এক উপকারী অতিথি জনগোষ্ঠী, কিন্তু তারা সমাধিকারভোগী নাগরিক ছিলেন না। স্পিনোজার সমসাময়িক ইহুদিরা নিজেদের ডাচ্ বলেই মনে করতেন, কিন্তু তাদের এ নাগরিকত্ব খুব দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না বলেই মনে হয়। স্পিনোজা এ ইতিহাস ভালোভাবেই জানতেন এবং এসম্বন্ধে তিনি তাঁর 'ট্র্যাকটেটাস' গ্রন্থেও আলোচনা করেছেন। স্পিনোজার দর্শনে ইহুদি জাতির ওপর এই ঐতিহাসিক চাপ বা ভার বাদ দেয়া যায় না; কেননা এটা মার্রানো ইতিহাসেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাররানো ঐতিহ্য ছিল এটাই, যেসব ইহুদি খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে বা হতে বাধ্য হয়েছে অতিগোপনে তাদের ইহুদি ধর্মের নিয়ম-কানুন মেনে চলতেই হবে। ইহুদিরা একপর্যায়ে হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিস্টায়োস- নোভোস বা নব্য খ্রিস্টান। অবশ্য সেফারডীয় সম্প্রদায়ের এক অংশ মার্রানোই থেকে গিয়েছিলেন, যারা প্রকাশ্যে খ্রিস্টান হিসেবেই আচরণ করতেন, কিন্তু দরজা বন্ধ করে ইহুদি রীতিনীতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন।
এই মার্রানোরা মাঝে মধ্যেই নিরাপত্তার জন্য নাম বদলাতেন, যেমন গ্যাব্রিয়েল নিজেকে ইউরিয়েল করেছিলেন। কিন্তু শুধু নামই নয়, তাদের চিন্তা-চেতনাও লুকিয়ে রাখতে হতো। মার্রানো জীবনে তাই একটা 'সুখেষু বিগতস্পৃহ, দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা' স্টোইক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল তাদের এক উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য হিসেবেই। সেফারডীয় ইহুদিদের সাম্প্রতিক ইতিহাস স্পিনোজাকে বাধ্য করেছিল ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে, যার ফলেই স্পিনোজার মনে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চাশার এক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়, যা শুধু ইহুদি জাতির সমসাময়িক সমস্যার ঊধর্ে্ব উঠতে সাহায্য করতে পারে তা-ই নয়, তা গোটা মানুষ জাতিকেও পরিত্রাণের পথ দেখাতে পারে।
স্পিনোজার চিন্তামানসের এই বিশাল উত্তরণ সম্ভব হতো না, যদি তিনি পর্তুগাল ত্যাগ করে হল্যান্ডে না আসতেন। ডাচ্ স্বর্ণযুগের অনন্যসাধারণ সহিষ্ণুতার পরিবেশের প্রয়োজন ছিল এক হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অবরুদ্ধ ভাবাবেশকে অবারিত করে এক আদর্শবাদী বিরল প্রতিভার সৃষ্টিশীল রচনার মধ্য দিয়ে মানুষের সর্বোত্তম পরিচয়কে প্রকাশ করার চেষ্টার।
৫. স্পিনেজার জাতিচ্যুতি
স্পিনোজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক দেশত্যাগী সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে এবং ২৫ বছর বয়সে তিনি নিজেই এ সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গেলেন তাঁর ধর্মীয় মত প্রকাশের জন্যে। স্পিনোজার সঙ্গে তাঁর সিনাগগের সংঘর্ষের শেষ অধ্যায়টি এ নাটকীয়তারই প্রতিচ্ছবি, যা ইউরিয়েল দা কস্টার জীবনেও ঘটেছিল। ইহুদি রেবাইরা জানতেন যে স্পিনোজার চিন্তা-চেতনার এক বিশেষ বৈপ্লবিক চরিত্র রয়েছে, কেননা তিনি ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্বন্ধে এমন সব যুক্তির অবতারণা করছেন যা প্রচলিত আইনের সরাসরি পরিপন্থী; কিন্তু যুক্তির মাধ্যমে তা খ-ন করাও অসম্ভব। তাঁর পিতা জীবিত থাকাকালে স্পিনোজা তাঁর এসব ধারণা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতেন না, লিখতেনও না; কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তিনি প্রকাশ্যে কথা বলা শুরু করেন এবং তাঁর ধ্যান-ধারণা অন্যকে কতখানি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলছে তা নিয়ে চিন্তাও করতেন না, বোধহয় ভয়ও পেতেন না।
স্পিনোজার সিনাগগের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরা সবরকম চেষ্টা করলেন স্পিনাজাকে এই বিপদসংকুল পথে না হাঁটতে দিতে এবং তাঁর আচরণ শোধরাতে। তারা তাঁকে বার্ষিক ১ হাজার ফ্লোরিন অনুদান দেয়ার প্রস্তাব দিলেন; কিন্তু স্পিনোজা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। সুতরাং সমাজপতিরা বাধ্য হয়ে একটা 'নমনীয়' সমাজচ্যুতির আদেশ জারি করলেন, যার ফলে স্পিনাজাকে ইহুদি সমাজ থেকে তিরিশ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এ সময় স্পিনোজার জীবনের ওপর একটা আক্রমণ করার চেষ্টাও করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁর বড়-সড় আলখাল্লা-পোষাকটির জন্য যা তিনি এরপর সঙ্গেই রাখতেন সব সময়।
১৬৫৬ সালের ২৭ জুলাই ইহুদি সিনাগগ স্পিনোজার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আদেশ বা চেরেম জারি করল_ যার বলে তাঁকে ইহুদি সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো। এ আদেশের বলে ইহুদি জাতির কারও সঙ্গে ভৌত এবং সামাজিক সম্পর্ক রাখা থেকে স্পিনোজাকে কঠোরভাবে পৃথক করে দেয়া হলো। এটা ঠিক, ক্যাথলিকদের ইনকুইজিশনের মতো এত নিষ্ঠুর হয়তো এটা ছিল না, কিন্তু অ্যামস্টারডামের ইহুদি সম্প্রদায় এ শাস্তিদানকে লজ্জাজনক বলেই মনে করেছিল। স্পিনোজার জীবনী লেখক কোলরাস এই চেরেমের একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন যেখানে বলা হয়েছিল, '... কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলবে না, মৌখিক বা লিখিত কোনভাবেই নয়; তাকে কোন দয়া-অনুকম্পাও দেখাবে না, তাঁর সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাসও করবে না, তাঁর চার হাতের কাছেও আসবে না, তাঁর রচিত অথবা লিখিত কোন গ্রন্থ- প্রবন্ধও পড়বে না।' (এফ পল্লোক, 'স্পিনোজা')। এভাবেই স্পিনোজাকে ইহুদি সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকেও তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতে আদেশ দেয়া হয়।
স্পিনোজা এখন আকাশের বিহঙ্গের মতো মুক্ত। এভাবেই তিনি হয়ে গেলেন বাস্তবিকই বেনেডিক্টাস বা 'ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট'।
স্পিনোজা চেরেমের এ সংবাদ শুনে বলেছিলেন, এটা আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করে না, যা আমি অন্যভাবে করতাম না।
আত্মসম্মানের সঙ্গে_ একটা সহজ ও স্পষ্ট কথা।
৬. স্পিনোজার উত্তরাধিকার
স্পিনোজার উত্তরাধিকার এক বিষাদময় ইতিহাস এবং বলা যায় যে, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তাঁর আপসহীন অবস্থানের জন্য তাঁর অসাধারণ সব রচনার ওপর আক্রমণের তীব্রতাও যে অসাধারণ হবে তা হয়তো তাঁর বুঝতে পারা উচিত ছিল। তিনি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেভাবে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বন্ধু এবং প্রকাশক রিউভেটসের কাছে তাঁর পা-ুলিপিগুলো সম্বন্ধে তিনি বিস্তৃত নির্দেশ না রেখে গিয়েছিলেন। এই বন্ধু শুধু যে বিশ্বাসী ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন সাহসী এবং বুদ্ধিমান। তিনি কর্তৃপক্ষকে বলতেন, মূল পা-ুলিপি সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না এবং এর মুদ্রণের দায়িত্বেও তিনি নেই। (চলবে)
[লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন