বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তখন আমরা টুক-টাক কাজ করি। খ্যাপ মারা টাইপ কাজ। বিনিময়ে যা পাই তা দিয়ে দু-একদিন ফুটানি করি। চানখাঁর পুলে 'নীরব হোটেল' এ ভর্তা আর কালাভুনা কিংবা নীলক্ষেতের দোতালার 'মামা হোটেল'র গরুর মাংস সেই ফুটানির অন্যতম অনুষঙ্গ।
এমনই কিছু টাকা হাতে এসেছে। অতঃপর আমাদের বাঁই উঠলো কালাভুনা খাবার। আমি আর সে। (সংগত কারণেই বন্ধুর নাম বলছিনা)
নীরবে ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ দশা। গ্রামের বিয়ে বাড়ির মত আমরা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছি। চেয়ারে উপবিষ্ট ব্যক্তি আর তার সঙ্গীনি আসন ছাড়লেই তার দখল নিশ্চিত করার জন্য।
রীতিমত বিব্রতকর পরিস্থিতি। আমরা বিব্রত হইনা, চেয়ারের বর্তমান দখলদারেরাও না। তারা খাবারের নামে রোমান্সে ব্যস্ত। নারী সঙ্গী লোকমা তুলে দিচ্ছে পুরুষ সঙ্গীর মুখে।
মেজাজ খিঁচড়ে গেলেও অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। সবুরে কালাভুনা পাওয়া এবং খাওয়া যাবে বলে মনকে যথাসম্ভব শান্ত করে দাঁড়িয়ে আছি।
কপোত-কপোতীর দানাগ্রহণ শেষ হতেই আমরা হামলে পড়ে চেয়ারে দখল নিলাম। বসতে না বসতেই খাবারও এসে গেল। ভাত মাখতে মাখতে খেয়ালই ছিলনা আমাদের সামনের চেয়ার দুটিও ফাঁকা হয়ে গেছে। আর সেখানে এসেছে নতুন জোড়া।
বলা নেই কওয়া নেই শুকনো মৌসুমে হঠাৎ বন্ধুর কাশি শুরু হলো। কাশির দমকে তার দম বন্ধ হবার দশা। সামনে তাকিয়ে দেখি বন্ধুর থেকে ঠিক ‘চুম্বন দূরত্বে’ বসে আছে তার সাবেক প্রেয়সী। সাবেকের বর্তমানজন হাত ধুতে গেছে আর সে বজ্রাহত হয়ে বসে আছে।
বন্ধুর বিষম খাবার চমকে আমি রীতিমত দ্বিধায়। বন্ধুর কাশি থামাব না কালাভুনার স্বাদ নেব?
গুরুজনেরা বলেন, খেতে বসে বেশি ভাবতে নেই। অতএব, আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে খাবার সাবাড়েই মনোনিবেশ করলাম।
বন্ধুর কাশি থেমেছে। কিন্তু মনের ঝড়ে বোধহয় সে কাবু। ওপাশেও একই দশা। দুই সাবেক শুধুই ভাত নাড়ছে। বন্ধুর সামনের বাটির কালাভুনা যেন আমায় ডাকছে। আর সে এখনও বেগুন ভর্তার অর্ধাংশ দিয়েই ভাতের কিয়দংশ মেখেই চলেছে।
- মাংস খাবিনা?
- ভালো লাগছেনা।
- আমি নিয়ে নিলাম।
বন্ধুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই পুরো বাটি উপুড় করে আমার থালায়...
আমার হাপুস খাওয়া দেখে অপর পাশের পুরুষ সঙ্গীটি বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো, ঝাল বেশি হলেও কালাভুনাটা আজ কিন্তু বেশি মজা হয়েছে। তাই না ভাই?
মুখে খাবার তাই কোনমতে মাথা নাড়িয়ে সমর্থন জানালাম।
- অ্যাই, তুমি খাচ্ছোনা কেন? খেয়ে ফেল। দারুণ হয়েছে দারুণ।
বন্ধুর সাবেক প্রেমিকাও ঠিক তার মত করেই উত্তর দিল, ভালো লাগছেনা।
খাবার নষ্ট হতে দেখলে আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তাই বলেই ফেললাম, খেয়ে ফেলুন ভাই। মাংসের এমন ফাইন সালুন নষ্ট করাও পাপ।
উনি পারলে এঁটো হাতেই আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বসেন। আকর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন।
বাকি দু’জনের অগ্নিদৃষ্টি আমার দিকে। কালাভুনার প্রচণ্ড ঝাল আর দুর্দান্ত স্বাদের বাইরে আমার যে কোন দিকে তাকানোর সময়ই নেই।
নীরবের গমগমে আসরে তখন ঝরছে দুজনের নীরব অশ্রু...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৬ দুপুর ২:৫৭