আরজ আলী মাতুব্বর একজন দার্শনিক। আমার কাছে তাঁর সবচেয়ে যে বড় পরিচয় তা ঠিক দার্শনিক হিসেবে নয়; আমি তাঁকে মনে করি একজন পরিপূর্ণ বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ। একইসাথে দর্শন এবং বিজ্ঞানমনষ্কতার সংযোগ হয়তো অনেকের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু মৃদু-ভাষনে তাঁর যে প্রশ্নের মায়াজাল তা তাঁকে নিয়ে গিয়েছে এক অন্যরকম উচ্চতায় যেখানে বাংলাদেশের অন্য সাহিত্যিকদের তুলনা মেলা ভার। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল মাতুব্বরের গ্রামটি দেখতে যাব। কেবল শুনেই এসেছি তাঁর গ্রাম 'লামচরি'র গল্প, সেই অজপাড়া-গাঁটি কার না দেখতে ইচ্ছে করে যে গ্রাম জন্ম দিয়েছিল আরজ আলী মাতুব্বরের মত একজন বিজ্ঞানমনস্ক দার্শনিকের।
গত ২১-০১-২০১২ তারিখ বিকেলে আমি, আমার ছেলে নির্ঝর, কবি ও ব্লগার মাহমুদ মিটুল, মিটুলের সাথে ছিল যুগল (এই পোস্টের সকল ফটোর প্রশংসা তার) এবং প্রণব কুমার (একজন কলেজ শিক্ষক) মিলে মোট ৫ জন একটি আলফা (মাহিন্দ্র ৩ হুইলার) ভাড়া করে মাতুব্বরের গ্রাম লামচরির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বরিশাল থেকে দূরত্ব ১৩.৫ কি.মি। রাস্তা প্রায় পুরোটাই ভাঙা-চুরা এক কথায় যাকে বলে আবুল (এক্স যোগাযোগমন্ত্রী) টাইপ। সুন্দর বিকেলটার আরো সুন্দর একটি ছবি তুলেছেন যুগল। বিকেলটার ছবিটা না দিলেই নয়।
মাতুব্বরের গ্রামের পথের আরেকটি ছবি। পা দিয়ে ধান নাড়ছেন এক গ্রাম্য মহিলা।
মাতুব্বরের বাড়ির দরজায়। ভিতরে 'আরজ মঞ্জিল' লাইব্রেরী দেখা যাচ্ছে।
আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে নির্ঝর ও যুগল।
মরণোত্তর দেহদান করলেও তাঁর পরিবার পরিজন তার নখ, চুল ও একটি দাঁত এনে এখানে প্রতীকি কবর দেন যাতে শুধুই 'আরজ' লেখা।
আরজ আলী মাতুব্বরের মায়ের কবর; মৃত মায়ের ছবি তুলতে গিয়েই তার জ্ঞানানুসন্ধানের শুরু। যদিও আমি মনে করি তিনি তাঁর পূর্বেই বিজ্ঞানে অবিচল ছিলেন বলেই মোল্লাদের উপেক্ষা করে মৃত মাকে স্মৃতিময় রাখতে তখনকার বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার (বরিশাল তথা তাঁর গ্রামে) ক্যামেরার দারস্থ হয়েছিলেন। অথবা ক্যামেরাটাকে তিনি একটি উপলক্ষ হিসেবে দেখিয়েছেন তার মনের অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আশায়।
আরজ আলী মাতুব্বর যে ঘরে বাস করতেন। ঘরের সামনে কবি ও ব্লগার মাহমুদ মিটুল।
বাংলা একাডেমী থেকে আরজ আলী মাতুব্বরকে দেয়া 'ফেলো কার্ড' ও 'সংবধর্না পত্র'।
বাংলাদেশ লেখক শিবির থেকে 'হুমায়ুন কবির স্মৃতি পূরস্কার ১৩৮৫' প্রদান করা হয় তাঁকে। বরিশাল সাহিত্য পরিষদের সনদপত্রও রয়েছে।
আরজ আলী মাতুব্বরের ছেলে মালেক মাতুব্বরের সাথে। এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর বরিশাল অশ্বিনীকুমার টাউন হলে অনুষ্ঠিত 'আরজ আলী সংসদ' আয়োজিত জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মালেক মাতুব্বরকে দেখে হতাশ হয়েছিলাম এবং সে সম্পর্কে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। কিন্তু এবারে অনেকক্ষণ আলাপচারিতায় দেখলাম কিছুটা হলেও মাতুব্বরের দর্শন ধারণ করেন মালেক মাতুব্বর। লামচরি বাজারে চা-সিংগারা খাচ্ছিলাম। একটু আগে যখন মাতুব্বরের লাইব্রেরীর সামনে বসে কথা বলছিলাম তখন এক মাহফিল ঘোষণাকারী ও প্রচারক আমাদের হাতে কয়েকটি মাহফিলের প্রচারপত্র দিয়ে গিয়েছিল। মালেক মাতুব্বর একটি প্রচারপত্র আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'এই যে দেখেন, এগুলো কী? এতো কেবলই ব্যবসা।' বলেই বেশ অবজ্ঞার সাথে প্রচারপত্রটি দিয়ে হাতে লেগে থাকা সিঙ্গারার তেল মুছলেন।
আরজ আলী মাতুব্বর যে কতখানি অজপাড়া-গাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার নিদর্শন হিসেবে দুটো ছবি দিচ্ছি। এই ২০১২ সালেও তাঁর গ্রামে যাওয়ার ভাল রাস্তা নেই। পথে দুটো ব্রিজ আছে যার একটির একপাশের রেলিং নেই। আরেকটির কোনপাশেরটিরই নেই। ছবিতে দেখে কতটা বুঝতে পারবেন জানি না। তবে এই ব্রিজের উপর দিয়ে যানবাহনে চড়ে যেতে গেলে বুক ধড়ফড় করে উঠবেই। এই বুঝি পড়ে গেলাম!
একপাশের রেলিং ভাঙা ব্রিজ।
এ ব্রিজটির দুপাশেই রেলিং নেই। এই সেই বাহন যা নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম।
আমরা যে রাস্তায় গিয়েছি মাতুব্বর অবশ্য সে রাস্তায় বরিশাল আসতেন না। নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে সাড়ে আট কি.মি পার হয়ে রোদ-বন্যা-ঝড়-জল পেরিয়ে তিনি বরিশালে আসতে জ্ঞান চর্চার জন্য। বরিশাল বি.এম কলেজ লাইব্রেরী, পাবলিক লাইব্রেরী থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরীতেও তিনি বই পড়তেন। যুগে যুগে এমন মানুষের জন্ম হয় না; কয়েক যুগ পর হয়তো দু'একজনার দেখা মেলে।
আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়িতে সময়টা বেশ সুন্দর কেটেছে। এমন দার্শনিকের বাড়িতে গেলে নিজের ভেতরেই এক দার্শনিক মন চাঙা দিয়ে উঠতে চায়। এক অদ্ভুত ভাল লাগায় ছেয়ে যায় মন।
*আপলোডের সুবিধার্থে ছবিগুলোর প্রোপার্টিজ কয়েশভাগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।