ঈদের দিন। আমি আমার এক বন্ধুর সাথে রিকশায় যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। রাস্তাঘাট ফাঁকা হলেও আমাদের রিকশা যাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। ঈদের দিন রিকশা ছুটে যাবে তুখোড় গতিতে, সুন্দর বাতাস লাগবে শরীরে এমনটা আশা ছিল। আমরা বেশ বিরক্ত, আশেপাশের সব রিকশা আমাদের চেয়ে আগে চলে যাচ্ছে। আমি বেশ মেজাজ খারাপ করে রিকশা চালকের দিকে তাকালাম। আগে খেয়াল করা হয়নি, আমাদের রিকশাচালক বেশ বৃদ্ধ। আমি হতাশ হলাম, এমন বৃদ্ধ রিকশা চালকের রিকশায় আমি সাধারণত উঠি না।
কিন্তু এত বয়সের মানুষটা রিকশা চালাচ্ছে কেন, তাও আবার ঈদের দিনে। উনার কী ছেলেমেয়ে কেউ নেই? আমি বেশ কৌতূহল বোধ করলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, “চাচা এই বয়সে রিকশা চালান কেন? ছেলেমেয়ে কেউ নেই?”
চাচা পিছনে ফিরলেন। ফিরেই আবার সামনে তাকিয়ে রিকশা চালানো শুরু করলেন। বুঝলাম এই প্রশ্নের উত্তর উনাকে প্রায়ই দিতে হয়।
একটু পর বেশ শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বললেন, “বাবা, আমার দুইটা ছেলে আছিল। দুইটাই এখন অনেক বড়লোক, ঢাকা শহরে বাড়ি আছে, দামী গাড়ি চালায়। তয় আমারে আর ওদের মায়েরে দেখে না। বিয়া কইরা বউ নিয়া আলাদা হইয়া গেছে।”
আমি আর আমার বন্ধু চুপ করে গেলাম। মুহূর্তেই পরিবেশটা কেমন গুমোট হয়ে গেল।
চাচা বলতে থাকলেন, “এখন আমার বউকে নিয়া একটা বস্তিতে থাকি। আমার বউয়ের অসুখ, কাজ করতে পারে না। আমি রিকশা চালাইয়া যা পাই তাই দিয়া কোনমতে চলি। রিকশা টানতে না পারলে ভিক্ষা শুরু করতে হইব।”
চাচাকে কে,এফ,সি এর সামনে থামতে বললাম। আমরা সব ফ্রেন্ডরা মিলে এখানে আড্ডা দেয়ার কথা।
আমি চাচাকে বললাম, “আসেন চাচা একসাথে এখানে কিছু খাই।”
আমি ভেবেছিলাম চাচা অনেক খুশি হবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে চাচা বললেন, “না বাবা, আমি একা খাব না, আমার বউ বাসায় শুয়ে আছে। ওরে রাইখা আমি খাই কেমনে?”
আমি বললাম, “ঠিক আছে আপনি আমাদের সাথে খান, আর আপনার স্ত্রীর খাবার প্যাকেটে করে নিয়ে যান।”
চাচা বললেন, “আমি এক বেলা এত দামী খাবার দিয়া কী করব? এর চেয়ে এখন রিকশা টানলে তিন বেলা পেট ভইরা খাইতে পারতাম।”
আমি বললাম, “চাচা কিছু মনে না করলে আমরা কয়েকজন আপনাকে কিছু টাকা দেই?”
চাচা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর কিছু না বলে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে চলে যেতে থাকলেন।
একটু দূর যাওয়ার পর চাচা একটা গাড়ির সাথে রিকশা লাগিয়ে দিলেন। রিকশার চাকা লেগে গাড়ির রঙ একটুখানি উঠে গেছে।
বুঝতে পারলাম চাচার অবস্থা খারাপ আছে। সাথে সাথেই গাড়ি থেকে একটা ছেলে নামলো। বেশ অবাক হলাম, কারণ ছেলেটা আমাদেরই বন্ধু আশিক। আশিকের পাশ থেকে ওর বান্ধবী শ্রেয়াও নামলো।
আশিক গাড়ি থেকে নেমেই বেশ চিৎকার করে চাচাকে গালাগালি করতে থাকল। পাশে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া মিটিমিটি হাসছে। একটু পর আমাদের বেশ অবাক করে দিয়ে আশিক চাচার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল।
চড় বসিয়ে আশিক চলে আসছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে বলে উঠল, “দেখ তো হারামজাদাটা কী করল। ব্র্যান্ড নিউ গাড়িটা একদম নষ্টই করে দিল।”
আমি হতবাক হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এত মুরুব্বি একজন মানুষকে আমারই বন্ধু চড় দিল!
আমি চাচার দিকে তাকালাম। চাচা আমার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, একদম কাছে এসে বলল, “বাবা আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিলে না? আমাকে না দিয়ে টাকাটা তোমার বন্ধুকে দিয়ে দিও।” বলেই রিকশা টেনে চলে গেলেন।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই চলে যাওয়া দেখলাম।