এ জার্নি বাই ট্রেন!! ছোট বেলার পড়াশুনার একটি বিশেষ রচনার নাম! তা সেই রচনার নাম এই ভ্রমণ গ্রুপে এলো কিভাবে? কারণ, কয়েকদিন আগে এই তেতুলিয়া ভ্রমণের উপরে “ওয়ান ডিশ পার্টি!” লেখা পড়ে একজন মন্তব্য করেছিলেন রচনার মত লেগেছে তার!
তাই তার মন্তব্যের সম্মান রক্ষার্থে আসলেই একটা ভ্রমণ রচনা লেখার খায়েস জেগেছে! কি আর করার, লেখার নেশা কমাতে কখন যে কি খায়েস জাগে বলা বা বোঝা মুশকিল! যাইহোক, ফালতু কথা বাদ দিয়ে এবার একটা রচনা রিডিং পড়ি! অবশ্যই যাদের ইচ্ছে হবে। অনেক দিনের পুরনো অভ্যাসের একটু চর্চা করি?
অরণ্যরা ছয় বন্ধু যাবে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া। দেখবে সমতলের চা বাগান, বাংলার শেষ সীমানা আর আজকাল নাকি ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়! দেখবে সেটাও। আর যাবে ট্রেনে। সেটাও অনেক চেষ্টা ও তর্কবিতর্কের পরে ঠিক হল।
ট্রেন ছাড়বে সকাল ৮ টায়। ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশন থেকে। সবাই যথারীতি ৭:৩০ এর মধ্যে হাজির। ৮ টা পেরিয়া যাবার পরেও ট্রেনের খবর নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ট্রেন এখনো এসে পৌঁছায়নি! ব্যাস শুরু হল এই নিয়ে কথা শোনানো। দেখ বাসে গেলে ঠিক সময়ে অন্তত ছাড়তো। এভাবে স্টেশনে দাড়িয়ে থাকতে হতোনা রোদের ভিতরে। এমন আরও কত কথা।
এবার অরণ্য সরব হল। আরে ধুর কি বলিস এটা, ট্রেন আসেনি তো কি হল, এখানে তো অন্তত বাস স্ট্যান্ডের মত ঘিঞ্জি নয়। বিড়ি-সিগারেটের গা ঘিনঘিনে ব্যাপার-স্যাপার নেই, নেই উৎকট গন্ধের কারণে নাক বন্ধ করে রাখার যন্ত্রণা। হাজার-হাজার বাস ট্র্যাকের প্যা-পু নেই, নেই ধুলো আর বালুর সাগর! চল ওই সামনের কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় গিয়ে বসি। পাশের দোকান থেকে লাল চা আনিয়ে ঝিরঝিরে বাতাসে বসে উপভোগ করি। পাশের পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়া চৌচির মাটির ওপরে বসে ছবি তুলি? দ্যাখ কত সুন্দর ফাঁকা রেললাইন, চল ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে গল্প করি। পাশের লাইনের ট্রেনের যাওয়া-আসা দেখি।
যাবার তো তেমন কোন তারা নেই, তাহলে এতো এতো টেনশন আর অতৃপ্তি কিসের? তারচেয়ে এই নির্জন আর পরিচ্ছন্ন রেল স্টেশনটাকে উপভোগ করি। শেষমেশ তাই হল, পাশের লাইনে এসে দাড়িয়ে থাকা ট্রেনের ইঞ্জিনে, পিছনের বগির উপরে উঠে লাফ-ঝাপ, এঁকেবেঁকে ছবি তোলা, কিশোর বয়সের অপূর্ণতাকে ৩০ পেরিয়ে পূর্ণতা দেয়া!
পাশের দোকানে বসে কলা-রুটি আর চা উপভোগ করা। প্লাট ফরমের উপরে দাড়িয়ে থাকা বট গাছের ছায়ার বসে, সামনের কৃষ্ণচূড়ার ছবি তোলা, এমন আরও কত কি?
ট্রেন এলো পুরো একঘণ্টা পরে। ছাড়লো আরও আধা ঘণ্টা পরে! তার মানে এখানেই দেড় ঘণ্টা লেট! পৌঁছাবে কখন তবে? ট্রেনগুলো এমনিতেই লেট করে আর এখানে তো ছাড়তেই দেড় ঘণ্টা লেট, আজ নিশ্চিত মধ্য রাতে পৌঁছাবে সেই সৈয়দপুরে!
আরে তাতে কি? ট্রেন জার্নির মত এতো আরামের জার্নি আর হয় নাকি?
কিভাবে ট্রেন জার্নি এতো এতো আরামের হল?
আগে ট্রেন ঠিকঠাক মত চলা তো শুরু করুক, তারপর না হয় দেখিস, কিভাবে ট্রেন জার্নিকে উপভোগ করতে হয়, ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
এভাবে বিভিন্ন তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ট্রেন জয়দেবপুর অতিক্রম করলো। এবার তবে ট্রেন জার্নির মজাটা শুরু হোক?
বিরাগের বাথরুম লেগেছে!
তো ঠিক আছে চলে যাও টয়লেটে!
পানি আছে কি?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, এই ট্রেন আর লোকাল ট্রেন তো আর এক নারে, গিয়েই দ্যাখনা আগে!
ফিরে এলো ফ্রেস হয়ে!
কিরে দেখলি তো ট্রেন জার্নির একটা মজা বা আরামের ব্যাপার!
আরে ধুর না হলেও চলতো!
আচ্ছা তাই না, তবে তো আর কিছু বলার নেই! তুই তো বিরোধী দলের মত কথা বলিস দেখছি!
কি রকম?
এই যে এতো ভালো ভাবে ফ্রেস হয়ে এলি আর আরাম করছিস, যেটা বাসে পেতিসনা, সেই কৃতজ্ঞতাটুকুও দেখালিনা! তোরা পারিসও!
চল তবে এবার অন্য কিছু দেখি, ট্রেন জার্নির মোহময়তা একটু উপভোগ করি?
নীল সাগর টাঙ্গাইল ছাড়লো। ছুটছে তার অন্য রকম গতিবেগে। কেউ কেউ তাসের আড্ডায় মজেছে, কেউ ফেসবুকে আর কেউ ফোনে প্রিতমার সাথে, কেউ আবার কখন খাবারের বাটি খোলা হবে সেই প্রতীক্ষায় জিভের জলে ঠোঁট ভিজিয়ে ফেলছে অনবরত! দুই এক ফোটা লোভী লালা হয়তো জামা-কাপড়েও পড়েছে, অতি সংগোপনে! কে জানে? কেউ ট্রেনের ডান পাশের বড় কাছের জানালায় দৃষ্টি দিল।
বাইরে চকচকে রোদ। এসির বাইরে বের হলেই সেটা বোধ হচ্ছে শরীরে, মুহূর্তেই ঘেমে গিয়ে! ফিরে এসে আবার এসির বিলাস বহুল কামরায়। ট্রেন লাইনের এঁকেবারে গা ঘেঁসে ধানের ক্ষেত, ট্রেনের ছুটে যাওয়া বাতাসের দোলায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে সবুজ গাছের মাথায় থোকা থোকা সোনালি ধান। যেন সবুজের মাঝে অবিরত সোনালি ঢেউ! পাশের বড় গাছ গুলোতে উদ্দাম নাচ। হঠাৎ ট্রেনের গতি কমে গিয়ে প্রায় থেমে যাওয়া।
ট্রেন এবার যমুনা নদী পার হবে। ধীরে ধীরে এবং ধীরতম লয়ে। কারণ ট্রেনের লাইন এমন ভাবে করা হয়েছে, যে একটু এদিক ওদিক হলেই, সলীল সমাধি! তাই চূড়ান্ত সাবধানতার সাথে চলেছে। সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। যমুনা নদীটাকে উপভোগ করা গেছে প্রান ভরে। ওর চর, বাতাসের বালু ঝড়, কৃষকের চাষাবাদ (প্রায় শুকিয়ে যাওয়া যমুনার বুকে!) মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল গাছ আকৃতির সবুজ ঘাস! পশু-পাখির অবাধ বিচরণ আর দূরে সবুজের হাতছানি।
সিরাজগঞ্জের যমুনা তীরের নান্দনিক বাঁধানো ঘাট দেখে সবাই উচ্ছ্বসিত! সেই সাথে দেখে রেল লাইন সংলগ্ন ইকো পার্কের নান্দনিকতা, মিহি পিচ ঢালা পথ। যেটা দেখে ওখানে একটা ভ্রমণের তৃষ্ণায় তৃষিত হয়ে উঠলো সবাই!
নীল সাগর এবার উত্তর বঙ্গের আসল লাইনে তার পথ চলা শুরু করলো। মাঝে মাঝে নীরব-নির্মল লাল-সবুজে ছাওয়া আর নিরীহ মানুষদের মুখচ্ছবি সম্বলিত স্টেশনে থামা। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা কচি ডাবের নোনতা পানির শীতল পরশ, গাছ পাকা কলার আসল মিষ্টি স্বাদ আর আলু ভাঁজার পুরনো অভ্যাসে মজে গিয়ে আবেগের টানা পড়েনের পার্বতীপুর স্টেশনে গিয়ে গোধূলি নামালো!
সেখানে কিছু উচ্ছ্বাস, কিছু সৃতি চারণা, কিছু প্রিয় আর পুরনো মুখের সন্ধান, কিছু ব্যাথা আর নতুন কিছু সৃতি ও অনুভূতি নিয়ে আবারো ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ তুলে ছুটে চলা।
২০ মিনিট পরেই হুট করে গন্তব্যে! এবং সঠিক সময়ের মধ্যেই! কি অদ্ভুত, দেড় ঘণ্টা পরে যে ট্রেন ছাড়ে, সেই ট্রেন কিভাবে সঠিক সময়ই পৌঁছে যায়, এই বাংলাদেশে?
হ্যাঁ সেটাই হয়েছিল, এবং ভ্রমণ সদস্যর প্রত্যেকেই এমন একটা আরামদায়ক ও নান্দনিক এবং অবশ্যই অনেক অনেক মজার ট্রেন ভ্রমণ করে পূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছিল!
তবে ভ্রমনে কিছু বিষাদ থাকবেনা, সে কি করে হয়? বিষাদও ছিল এর পরে!
যেটা শোনাবো আগামী গল্পে!