আতিক সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন। তিনি কমপক্ষে সাতবার বিনুকে ডেকেছেন।
বৃদ্ধ বয়সে এই এক সমস্যা। কেউ কথার দাম দিতে চায় না। যেন এক পরগাছা, উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন কোথা থেকে। রেগে গিয়েও লাভ নেই, এরা রাগকেও পাত্তা দেবে না। যেন রাগটা তাঁর ব্যাধি, খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। এতে মাথা ঘামানোর কিচ্ছু নেই।
একটি বিড়াল তাঁর পাশে মিউ মিউ করছে। আতিক সাহেব বড় বড় চোখে চশমার উপর দিয়ে বিড়ালটির দিকে তাকালেন- যেন কিছু একটা বলতে চাইছে আতিক সাহেবকে।
আতিক সাহেব চমকে উঠলেন!
‘আতিক সাহেব! আপনার সময় শেষ। আপনি এখন বিড়াল প্রজাতির কাতারে। দ্যাখেন না- আমার কথাকেও কেউ দাম দেয় না। সারাদিন ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে যখন কাকুতি-মিনতি করে বলি- দয়া করে একটু খেতে দিন জনাব। তখন আপনারা কী করেন? হাতের কাছে যা পান তাই ছুড়ে মারেন এই নিরীহ প্রজাতির দিকে। আপনাদের একটু দয়া হয় না। এখন বুঝেন।’
আতিক সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘যা-যা, দূর হ।’
বিড়ালটি একই অবস্থায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন কোন পরোয়া নেই। যেন একটি বিড়াল আরেকটিকে হুঙ্কার দিচ্ছে এমন। একটু অবজ্ঞার হাসিও লেগে আছে বিড়ালটির চোখে-মুখে। মুখে ভেংচি কাটছে।
বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন আতিক সাহেব। ঘটনা কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? তিনি এখন মিউ মিউ জীবন কাটাবেন?
আতিক সাহেবের মনে পড়লো তাঁর বাবার কথা। তার বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘মা-বাবার জন্য যতটুকু তোমরা করবে, তার পুরো প্রতিদান তোমাদের সন্তানদের কাছ থেকে হিসেব মতো পাবে।’
কই আতিক সাহেব তো তাঁর বাবাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। এমনকি তাঁর বাবা যখন হাঁটতে-চলতে অক্ষম হয়ে গেলেন তখন আতিক সাহেব তাঁর পিছুপিছু ছায়ার মতো থেকেছিলেন। দিন-রাত বাবার পাশে বসে থাকতেন- কখন কি দরকার হয়ে পড়ে। তাঁর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে গোসল এমনকি বাবার মলমূত্রও পরিষ্কার করতে সামান্য দ্বিধাবোধ করতেন না বাবার প্রতি তাঁর অপার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার টানে। তারপর বাবা যেদিন তাঁকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেলেন সেদিন যেন বুকের মধ্যখানে কোথাও একটি বায়ুশূন্য চিপসে যাওয়া বেলুনের মতো ফাঁকা কিছু একটা টের পেলেন। এরপর রাতদিন যেন ব্যথা-বেদনার পিড়াপিড়ি।
‘বাবা বলো কেন ডেকেছো ।’ বিনু এসে আতিক সাহেবের পাশে দাঁড়ালো।
‘কী করছিলি এতক্ষণ?’ কর্কশ গলায় বললেন আতিক সাহেব।
- ‘দু’দিন পরই তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি। এখনো বাবা-মায়ের প্রতি টান আসলো না?’
- ‘বাবা রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি ব্যস্ত ছিলাম। রেজা ফোন করেছিলো।’
- ‘রেজা ফোন করলেই কথা বলতে হবে? সারাদিন কী এতো কথা বলিস ওর সাথে?’
আতিক সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আবার ফোন বেজে উঠলো। বিনু একদৌড়ে চলে গেলো ফোন রিসিভ করতে।
আতিক সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ‘দেখো, জেনারেশনের অবস্থা । যেনো আজ পারলে আজই চলে যায় এই ছেলের হাত ধরে ।’
আতিক সাহেব ভেবে পান না দিনরাত এতো কী কথা বলে এরা! যতক্ষণ বিনু বাসায় থাকে ফোনটা ওর কানের সাথে লেগেই থাকে।
বিয়ের আগে তিনি তাঁর স্ত্রী রেহানাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো এতো সহজ ছিলো না। যা ঐ চিঠিপত্র পর্যন্তই!
দুই-তিন রাত জেগেও চিঠিতে রঙ-রসের কিছু লিখতে পারলেন না। চিঠি অবশ্য তিনি পাঠিয়েছিলেন এবং তাতে লেখা ছিলো ক’টি কথা-
রেহানা কেমন আছ? তোমাদের বাসার পাশে কদমগাছটিতে এতো ফুল ফুটেছে! ঘ্রাণ পাও না? কদম ফুল আমার খুব পছন্দ।
আর কোনো লেখা তাঁর কলম দিয়ে বের হলো না।
রেহানা তাঁদের বাসর রাত্রিতে আতিক সাহেবকে কঠিন গলায় বললেন, ‘কেমন চিঠি পাঠালে তুমি? আমি লজ্জায় মরে যাই। কাউকে মুখ দেখাতে পারি না।’
আতিক সাহেব অপরাধীর স্বরে বললেন, ‘কি করবো? লজ্জায় লিখতে পারি নি কিছু। চিঠি লিখতে বসলেই সব তালগোল পাঁকিয়ে ফেলি। তখন কেবল তোমাদের বাসার পাশে কদমগাছের কথা মাথায় চলে আসে। এমনকি কদমফুলের ঘ্রাণও পেয়েছি আমি।’
- ‘তোমাকে চিঠি লিখতেই কে বললো?’
- ‘লিখতে ইচ্ছে করছিলো যে খুব!’
সেদিন রেহানা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন আতিক সাহেবের কথা শুনে। এই লোক নিয়ে সংসার করতে হবে? কোন ভুল করলাম না তো!
রেহানা কোন ভুল করেনি। বাকি জীবনে রেহানার বারবার মনে হয়েছিলো কথাটি। লোকটি একটু সরল প্রকৃতির -এই যা।
এই ছিলো আতিক সাহেবদের প্রজন্ম।
আর এখনকার প্রজন্ম! আতিক সাহেব ভাবতেই পারেন না, ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে। তার এক শিক্ষক কোনো কিছুতে তার মতের বাইরে দেখলেই বলতেন- ‘গো-টু-ডগ’। আতিক সাহেবের মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ সেই ‘গো-টু-ডগের’ দিকেই যাচ্ছে।
বিনুর বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হলো। বিয়ে ঠিকঠাক। হঠাৎ বিনু বেঁকে বসলো। ঘটনা কী? জানা গেলো কোন ছেলের সাথে নাকি ওর সাত বছরের ভাব-ভালোবাসা।
কথাটি শুনে আতিক সাহেবের আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। তার মানে পিচ্চি কাল থেকে এই ছেলের সাথে ওর ভালোবাসাবাসি?
ছেলে ভালো। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার- ভালো সেলারির চাকরি করে। অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। শুধু ওর নামটা একটু কেমন যেন– রেজা চাকলাদার।
শেষ পর্যন্ত ওর সাথেই বিনুর বিয়ে ঠিক হলো। কাল ওদের বিয়ে।
বল্টুটা একাই সব সামলাচ্ছে। এতোদিনে বল্টু প্রমাণ করলো ও চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। শুধু এই ইচ্ছেটা ওর নেই। বল্টুর দুইদিনের কর্মকাণ্ডে ছেলের প্রতি আতিক সাহেবের ধারণা পাল্টে গেলো।
তাহলে কি বল্টু এতোদিন বোকার অভিনয় করে থাকতো! আতিক সাহেব মনে মনে স্থির করলেন, ‘না, এখন থেকে ওকে ওর আসল নামেই ডাকতে হবে।’
বল্টুর ভালো নাম আব্দুল্লাহ আল আলীম চৌধুরী। আব্দুল্লাহ ছিলেন নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(সঃ)-এর বাবা। আলীম নামের অর্থ জ্ঞানী ব্যক্তি। আরবি শব্দ। বল্টুর জন্মের দু’দিন পর জৈনপুর থেকে একজন পীরসাহেব তাঁদের পাড়ায় ধর্ম প্রচারণায় এসেছিলেন। আতিক সাহেব বল্টুকে নিয়ে গিয়েছিলেন পীরসাহেবের কাছে ফুঁ দিয়ে আনার জন্য। তিনি নাম রেখে দিলেন আব্দুল্লাহ আল আলীম। চৌধুরী তাঁদের বংশের টাইটেল।
জ্ঞানী শব্দের ওয়েট যতটুকু, বল্টু ঠিক তার ইনভার্স। তাই আতিক সাহেব ওকে বল্টু নমেই ডাকেন। আজ হঠাৎ আতিক সাহেবের মনে হলো বল্টুর আলীম নামটিই ঠিক ছিলো। অবশ্য বল্টু নামের মধ্যে যে পরিমাণ মমতা ও ভালোবাসা আছে আলীম নামের মধ্যে তাঁর ঘাটতি অনেক।
বিনু ওর বল্টু ভাইয়াকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। বল্টুর নামে কোন দুর্নাম বিনু সহ্য করতে পারে না। মাঝে মাঝে আতিক সাহেব বিনুকে দু’একবার ক্ষেপিয়ে তোলেন। ভাইয়ের প্রতি বোনের এতো ভালোবাসা দেখে আতিক সাহেবের চোখে পানি এসে যায়। গর্বে বুক ফুলে ওঠে। তখন তাঁর এই ছোট্ট সংসারটিকে স্বর্গ মনে হয়।
বিনুর বান্ধবী তিথি। ওরা সমবয়সী। সেই ছোটোবেলা থেকে ওরা পাশাপাশি এ বাড়ি দুটি মাতিয়ে রেখেছে সারাক্ষণ। কি অদ্ভুত মিল ওদের- একই দিনে দুজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে! তিথিদের বাড়িতেও বিয়ের ধুমধাম চলছে।
ওদের দুজনের কি দুর্ভাগ্য কেউ কারো বিয়েতে থাকতে পারবে না। সেদিন আতিক সাহেব তিথির বাবাকে গিয়ে বললেন, ‘আমিনুল ভাই, তিথির বিয়েটা দু’একদিন পিছিয়ে দেন না। ওরা এতো ভালো বন্ধু অথচ কেউ কারো বিয়েতে থাকতে পারবে না ব্যাপারটা মানা যায় না।’
আমিনুল হক ভ্রু-কুঁচকে কপালে বিরক্তির রেখা এনে বললেন, ‘আপনি পিছিয়ে দেন না একদিন! আজাইরা প্যাঁচাল পাড়তে আসেন।’
আমিনুল হকের কথা শুনে কিছু শক্ত কথা আতিক সাহেবের মুখে এসে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে এলেন। মনে মনে বললেন, ‘শালা বদ! দুই নম্বর! সারাটা জীবন অন্যকে নকল করে গেলি।’ আতিক সাহেবের মনে পড়তে লাগলো বদ আমিনুলের কাণ্ডকারখানা।
বিনুর ছোটোবেলায় ওকে একটি নতুন জামা কিনে দিলে দু’দিন পর দেখা যেতো একই জামা তিথির গায়ে। আমিনুল পুরো শহর ঘুরে একই দোকান বের করে মেয়ের জন্য একই জামা কিনে নিয়ে আসতেন। বিনুকে যে স্কুলে ভর্তি করানো হলো- দু’দিন পর একই স্কুলে তিথি। আতিক সাহেবের বাড়ির ডিজাইন কপি করে বাড়ি বানালেন আমিনুল হক। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বিয়ের দিনটাকেও কপি করলো এই বদ! ভাগ্য ভালো জামাইটা কপি করা গেলো না।
বল্টু এসে আতিক সাহেবের পেছনে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বল্টুকে দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোকে কে ডাকলো? বিনুটা কই? সেই কখন থেকে বসে আছি। আমাকে বসিয়ে রেখে ফোনে কথা বলছে। একটু দেখে আয় তো বল্টু কী করছে এতোক্ষণ! জোরে একটা চর বসাবি গালে। পারবি তো?’
বল্টু নরম গলায় বললো, ‘বাবা ফোনে আমি কথা বলছিলাম।’
- ‘বিনু কই?’
- ‘বিনু কই তা তুমি ভালো করেই জানো। ও গত সাত বছর আগে টাইফয়েডে মারা গিয়েছিলো।’
আতিক সাহেব এবার অসহায় দৃষ্টিতে বল্টুর দিকে তাকিয়ে অনিশ্চয়তার ভঙ্গিতে থেমে থেমে বললেন,- ‘তাহলে আজ যে বিনুর বিয়ে!’
- ‘কোথায় তুমি বিয়ে দেখলে?’
- ‘বিয়ে না হলে বাড়িতে এতো হইচই কিসের?’
- ‘হইচই আমাদের বাড়িতে হচ্ছে না। আজ তিথির বিয়ে। ওদের বাড়িতে লোকজনের চেচামেচির শব্দ পাচ্ছ তুমি।’
আতিক সাহেবের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তিনি বললেন- ‘বল্টু আমাকে ধরে একটু খাটের কাছে নিয়ে চলতো।’
বল্টু আর কোন কথা বললো না। আতিক সাহেবকে ধরে নিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দিলো।
- ‘তুই কার সাথে কথা বলছিলি?’
- ‘রেজার সাথে।’
- ‘কোন রেজা?’
- ‘বাবা তুমি ক’জন রেজাকে চেনো? আমার বন্ধু রেজা। রেজা চাকলাদার।’
আতিক সাহেবের চোখে ঘুম চলে এলো। তিনি চোখ দুটো বন্ধ করলেন। বিড়ালটি আবার মিউ মিউ করে ডাকছে। আতিক সাহেব বিড়ালের ডাক শুনতে শুনতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৮