আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন ছিল না কোনদিনই, বাতাসে ভাসার অলীক কল্পনাও না। অগ্যতা জীবিকার তাগিদে বিদেশ বিভূয়ে পাড়ি জমাতে নিয়মিতই বাতাসে ভাসতে হচ্ছে।ছোটবেলায় উড়োজাহাজের শব্দকে নাকি ভীষন ভয় পেতাম আর তাই আমি উঠোনে থাকলে আর উড়োজাহাজে শব্দ ভেসে আসলে মা চাচিরা ছুটত উড়োজাহাজের ছোবল থেকে আমাকে বাচাতে।এখন প্লেনে চড়লে প্রায়শই এটা মনে পরে। প্লেনের বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরব।
১
প্রথমবার ভ্রমন করি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এ, স্বভাবতই অনেক কিছুই খেলে যাচ্ছিল ভেতরে। একই কোম্পানির ৩০ জন, অধিকাংশই নব্যযাত্রী। লাউন্সে পাশে বসা আমার মতই নব্য যাত্রীকে পুরুনো একজন ভিতরে কি হবে তা বলে দিচ্ছিল। যা হোক ৩ সিট পাশাপাশি, মাঝখানের বসা যাত্রী জানালার পাশে বসা যাত্রীকে সিট বদলাতে অনুরোধের ঢেকি গেলাতে পারলনা। একটু পর বিমানবালা নিয়ে আসল সাদা রোল। আশে পাশে তাকাচ্ছিলাম বুঝতে আসলে জিনিসটা কি। কিছু বুঝে উঠার আগেই জানালার পাশের যাত্রী মুখে দিয়ে কামর দিতেই কেউ যেন হেসে দিল। ততক্ষনে বুঝতে বাকি রইলনা এটা তোয়ালে।
২
প্লেনে্র টয়লেটে ঢুকার পরও উপরে ভেকেণ্ট লেখাটা জ্বলজ্বল করতেছিল। বুঝতেই পারছিলাম ছিটকিনি আটকায় নি। হঠাত এক আপু আমাকে টপকিয়ে চলে গেলেও (হয়ত ভাবেন নি আমিও ত্যাগের মহিমায় উজ্বল হতেই স্বগর্বে দাঁড়িয়ে)। বিপত্তি তখনি, আপু দরজা ধাক্কা দিয়েই চোখ ছানাবড়, লজ্জার হাসি ঢেকে গেল দু হাতের আড়েলে। আমি তখনও লাইনে দাঁড়ানো (হাসি চাপানোর বৃথা চেষ্টারত), ভাবতেছিলাম ভেতরে থাকা লোকটার কথা, সে আসলে কোন অবস্থায় ছিল।
৩
আমাদের বাংলাদেশ বিমানে চড়ার সৌভাগ্য হয়েছে একবার। সিট নিয়ে রিতিমত ঝগড়া, একজন আরেক জনের সিটে বসছে। বিমান বালাদের অসহায় আত্নসমর্পনের মতই অবস্থা। বিমান চড়তে শুরু করার পর বুঝতে পারতেছিলাম না ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ যাচ্ছি নাকি প্লেনেই আছি। মালপত্রে বোঝাই, এক এক জনের দু’তিনটা বাক্সপোটরা। যাত্রী সেবার মান এতটাই বিশ্বমানের (!) ছিল যে উল্লেখ না করাই ভাল। পাশে বসা যাত্রী বলতে শুরু করল, “এটা বাংলাদেশ রেলওয়ের ফ্লাইং ভার্শন, ঠিক মত স্টেশন পৌছতে পারলেই বাচি”
৪
একবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে খাবার অর্ডার নিতে আসা বিমানবালা বিপত্তিতে পরেছিল। দু’টো মেন্যু থেকে একটা পছন্দ করতে হবে কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই বলতেছিলাম আমি দু’টোই নেব। মহিলা কয়েকবার বুঝাতে চেষ্টা করল আমাকে বুঝাতে যে একটার জন্য অর্ডার করা যাবে।যতবারই বুঝাচ্ছে একবারও মুখে বিরক্তির রেশ পর্যন্তও পরিলক্ষিত হল না। শেষে বলে ফেল্লামই যে মজা করছিলাম। মজার ভেতর একটা জিনিস ঠিকই উপলব্ধি করলাম, আর তা হল – সম্মান ধরে রাখা সহজ সাধ্য নয় (বাংলায় যা হল – নাম ফোটে যার, ***_ ফাটে তার)। সিঙ্গাপুরে এয়ারলাইন্স এজন্যই হয়তো বিশ্বসেরা।
৫
প্লেনের টয়লেটের ফ্লাশ এ চাপ দিলে এতো শব্দ হবে তা ভাবতে পারি নি, এ নিয়ে একদিন কথা উঠতেই এক ভাই বল্ল উনি নাকি রিতিমত ভয়েই অস্থির যে ভুল কিছু করে বসল নাকি।
৬
আর একবার একযাত্রী পেলাম যে সকল নিয়ম মেনে চলে। ইলেন্ট্রনিক্স ডিভাইস বন্ধ করার ঘোষনার পরোও একজন যখন ফোনে ভিডিও করা চালিয়ে যাচ্ছিল, ওই যাত্রীতো রীতিমত তার উপর চড়াও হতে উদ্দত হল। বাংলাদেশী যাত্রীদের অনেককেই দেখা যায় সিট বেল্ট বাধতে চান না, ইলেন্ট্রনিক্স ডিভাইস বন্ধ করতে চান না। প্লেন মাটিতে নামতে না নামতেই বের হতে দৌড়ঝাপ, যেন হরতালে পুলিশের ধাওয়া খাওয়ার মত।
৭
থাই এয়ার এ দেশে ফিরছিলাম। নাটকপাড়ার কিছু সেলেব্রিটি পেয়েছিলাম একই ফ্লাইটে, হয়তো শুটিং শেষে ব্যাংকক থেকে ঢাকার পথে। বন্ধুসম একজন বলল একটু মজা করে আসি। ফিরে এসে হতাশ হয়ে বলল, “মজা করার কোন উপায় নাই, আশে পাশে যাত্রীদের কাছথেকে পরিচালকের মত উপদেশ ও পরামর্শে সেলেব্রিটিদের কাছে প্লেন যেন ছিপি আটকানো পাইপলাইন। ছিপির মুখ (প্লেনের দরজা) না খোলা না পর্যন্ত এ থেকে নিস্তার নাই”। দিন বদলেছে এখন ছিপি আটকানো পাইপলাইনে অনেক অভিনয় শিল্পিই দেখা যায়, কিন্তু মানুষের আগ্রহ্য কম। শিল্পি বেশি বলে, নাকি অভিনয়ের মান নিম্নমুখী বলে অথবা সবাই নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবে সেজন্য তা ভাবনারই বিষয়।
৮
বাজেট এয়ারলাইন্সে খাবার খেতে টাকা গুনতে হয়েছে বলে (কোম্পানি শুধু টিকেট কিনেছে) পরের বার অন্য এক এয়ারলাইন্সে চড়ার সময় এক অধস্থন বিমান বালার খাবারের অনুরোধ পায়ে ঠেলে দেয় (যদি অর্ডার নেবার পর টাকা চায়)। অন্য আরেক সহকর্মী এ কথা অফিসে বলার পর হাসির রোল।
৯
বিজনেস আর ইকোনোমি ক্লাসের বাইরেও যে আরও একটা ক্লাস আছে তা উপলব্ধি করি দেশীয়ও এবং প্রতিবেশি এয়ারগুলোতে। ইকোনোমির ভেতরে যাত্রীদের পোষাকপরিচ্ছেদ বৈমানিকও তাদের সাঙ্গপাংগদের ব্যবহারের পার্থক্য চোখে পরে। যেমনটি পরে একই ক্লাসের যাত্রী হয়েও জাতিভেদের কারনে।
১০
প্লেনে বিমর্ষ মুখদেখলেই নানা প্রশ্ন দোল খেয়ে যায়। প্রবাসের পথে পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় হয়তো পরিজন ছেড়ে দূর দেশের পথে তাই বিমর্ষ। কিন্তু দেশের পথে বিমর্ষ বদন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্নীয়বিয়োগের শেষ দেখার জন্য, অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গে হয়তো লাশ বহন করছে। আবার অনেক সময় দালালের প্রতারনার শিকার, কিছু বুঝার আগেই ফিরতি ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে দিয়েছে অনিশ্চয়তা ও ঋনের বোঝা। চারিপাশের বাড়িফেরার যাত্রীদের হাস্যোজ্জল আলোজ্বলমলে মুখগুলো বিমর্ষ বদনে আকাশ পাড়ির বেদনাগ্রস্ত মুখগুলোর বিষাদতা বাড়িয়ে দেয় তার খোজ অবশ্য কেউ রাখে না।
বিমানভ্রমনে কারোও প্রেম হয়েছে বা তার সুত্রপাত হয়েছে কিনা জানি না তবে ঝগড়া হতে দেখেছি। বাস্তবের আর গল্পের ভ্রমন অনেকক্ষেত্রেই অমিল।
স্কুলে পড়া জার্নি বাই প্লেন আর বাস্তবের পাইপলাইনের প্লেন জার্নির মাঝে তফাৎ অনেক। সবচেয়ে বড় তফাৎ হল সেই জার্নির প্লেন কখনোই দুর্ঘটনায় পতিত হয়নি, উধাও ও হয়ে যায়নি। সে জার্নিতে নাই পরিবার পরিজনদের উদিগ্নতার লেশমাত্র। সবার বিমানভ্রমন হোক স্কুলের জার্নি বাই প্লেনের মত সুখময়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:২২