কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিতে বিএনপির অস্বীকার
আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। আমি কওমি মাদ্রাসায় পড়ি। বেশি কিছু বুঝতামনা। কিন্তু যে পড়াশুনা করছি তার যে কোন স্বীকৃতি নেই বা এই পড়াশুনার সার্টিফিকেট দিয়ে কোন চাকরি হবেনা তা বিলক্ষণ বুঝতাম। তাই হুজুররা যখন বললেন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করতে হবে, আমরা তালেবুল এলেমরা সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্র পল্টন, জিরো-পয়েন্টের দিকে অবস্থান নিই ব্যস্ত রাস্তা বন্ধ করে। জিহাদি জোশের সাথে পুলিশের সাথে মারামারি করি। সারা রাত সেখানে রাস্তায় কাটাই! আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমার বয়স তখন মোটে ১২ বছর! আমাকে বড়রা কিকরে সেখানে নিয়ে গেল এখন ভাবতেই অবাক লাগে। যাই হোক, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, স্বীকৃতি দিয়ে দিবে সরকার। কারন আমরা তো সরকার পক্ষেরই লোক। ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ‘চারদলীয় ঐক্যজোট’-এর একটা। কিন্তু নাহ্ স্বীকৃতি মেলেনাই। কিছু বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা-বিবৃতিতেই সরকার ভয় পেয়ে যায়। স্বীকৃতি দিলে যদি সরকার জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক এই ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়! কিছুদিনের মধ্যে বিএনপি সরকার বিদায় নেয়।
স্বীকৃতি দিতে আওয়ামী লীগের জোর তৎপরতা
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ কল্পনাও করতে পারেননাই, এই সরকার তাদের স্বীকৃতি দিবে। কারন কওমি মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র-শিক্ষকের বদ্ধমূল বিশ্বাস: আওয়ামি লীগ ইসলাম-বিরোধী। কওমি মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে একজন সবজান্তা ক্লাসমেট বলেছিল, আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় আসলে সব কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করে দিবে! কিন্তু বাস্তবে কি ঘটলো? বেফাক (কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাবোর্ডগুলোর মধ্যে সবচে শক্তিশালী বোর্ড এটা; মোট বোর্ড আছে ১১ টা) যখন ভয়ে ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে স্বীকৃতির জন্য দাবি জানালো, দেখা গেল সরকার খুব গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে বিষয়টা। ২০১২ সালের এপ্রিলে গঠিত হয়- ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ যার কাজ হবে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয় এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়ন করা। দেখা গেল, সরকার আগ বাড়িয়ে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী; কিন্তু আলেমদের একটা অংশের বিরোধীতার কারনে স্বীকৃতির কার্যক্রম থমকে দাঁড়ায়। কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামাদের মধ্যে অনেক দল-উপদল থাকলেও দুইটি গ্রুপ বেশ শক্তিশালী। একটা গ্রুপ হলো বেফাক যেটা বাংলাদেশের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রন করে; হেফাজতকে বেফাকের সিস্টার অগানাইজেশন বলা যায়। আহমদ শফী বেফাকেরও চেয়ারম্যান। অন্য গ্রুপে আছেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ যাকে আওয়ামিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওনার সাথে আছেন আরেকটা আঞ্চলিক বোর্ডের প্রধান মাওলানা রুহুল আমীন যিনি কওমি অঙ্গনে সমাদৃত, এখন মরহুম, একজন বড় আলেম শামসুল হক ফরিদপুরীর ছেলে। সরকার যেই কমিশন গঠন করে তার চেয়ারম্যান ছিলেন মাওলানা শফী, কো-চেয়ারম্যান ছিলেন ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা রুহুল আমিন। যেহেতু আহমদ শফী এখন বয়োবৃদ্ধ, তাই এ কমিশনের নিয়ন্ত্রন ফরীদ উদ্দিন মাসউদ-রুহুল আমীন এই গ্রুপের কাছে চলে যায় যা মানতে বেফাক একদম নারাজ। তাই বেফাক চাচ্ছিল, সরকার এই স্বীকৃতি কমিশনের অধীনে না দিয়ে বেফাকের অধীনে দিক। কিন্তু সেটা আবার বেফাক বাদে আরো ১১ টা শিক্ষাবোর্ড কোনক্রমেই মেনে নিবেনা। অন্যদিকে বেফাকের ভেতরেও দুইটা গ্রুপ। একদল স্বীকৃতি চাইরেও অন্যটির মতে স্বীকৃতির কোন প্রয়োজনই নাই; তাদের আশঙ্কা, স্বীকৃতি দিয়ে সরকার মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করবে যা কিনা কওমি মাদ্রাসার মৌলিক নীতির পরিপন্থি। এইজন্য পুরো প্রক্রিয়াটা ঝুলে যায়। কিন্তু পোড়খাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার যখন স্বীকৃতি দিতে চায় কে তা ঠেকাতে পারে? সর্বশেষ গত এপ্রিল ১১, ২০১৭ তে গণভবনে ৩৫০ জন আলেম-ওলামার উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার দাওরা হাদীসকে ইসলামিক স্টাডিজ এবং অ্যারাবিকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১১ টা বোর্ডের মধ্যে ৬ টা বোর্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বোর্ডগুলা তাদের অধীনের মাদ্রাসাগুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রন করবে। বাকি মাদ্রাসাগুলো আশা করা হচ্ছে, এই ৬ টা বোর্ডের অন্তভূক্ত হয়ে যাবে।
কিছু চ্যালেঞ্জ
এই স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে সরকারের কি রাজনীতি কাজ করেছে তা বিশেষজ্ঞরা ভালো বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ হেফাজত এবং কওমি মাদ্রাসাকে সন্তুষ্ট রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যাতে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে সরকারের যে একটা ইমেজ আছে যেটা দূর হয়। গত নির্বাচনটা সুষ্ঠু না হওয়ায় আওয়ামী লীগ যে বেশ চাপে আছে তাও বোঝা যায়। আমি বরঞ্চ এই স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে চ্যালেঞ্জগুরৈা সামনে আসবে তা তুলে ধরি।
ক. প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় মাস্টার্স করতে ১৮ বছর লাগে। (প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করলে। প্লে, নার্সারি ওগুলা বাদে) কিন্তু দাওরায়ে হাদীস ১২ বছরেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
খ. কওমি মাদ্রাসায় কেউ চাইলে সহজেই ৩-৪ ক্লাস লাফ দিয়ে উপরের ক্লাসে ভর্তি হতে পারে। (আমার পরিচিত একজন ৬ টা ক্লাস লাফ দিয়ে মাওলানা মুফতি হয়ে এখন এক মাদ্রাসার ভাইস-প্রিন্সিপাল!) ফলে ১২ বছরের জায়গায় সময়টা আরো কমিয়ে আনা সম্ভব। আমি কওমি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছি ৮-৯ বছর। ওখানে কন্টিনিউ করলে ১৭ বছর বয়সেই আমার দাওরা এবং সেই সূত্রে মাস্টার্স সম্প্ন হয়ে যেতো!
গ. এসএসসি, এইচএসসি, আন্ডারগ্রাজুয়েট ইত্যাদির সমমানের কোন বিষয়ে পাস না করে সরাসরি মাস্টার্স পাস! কেউ যদি দাওরার শেষ বছর পড়াশুনা করতে না পারে কোন কারনে, তাহলে সে কোন ডিগ্রিই পাবেনা। আর এক বছর পড়তে পারলেই একদম মাস্টার্স!!
ঘ. বর্তমানে আমি মাস্টার্স করছি দেশের প্রথম সারির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই জানি মাস্টার্সের পড়াশুনা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। এই পর্যায়ের পড়াশুনা গবেষণাধর্মী। ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান অর্জনের চেয়ে existing জ্ঞানের ভাণ্ডারে কতটুকু যোগ করতে পারল সেটার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তাদের নিদেনপক্ষে একটা থিসিস করতে হয়। Epistemology এবং Ontology নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু দাওরা হাদীসের পড়াশুনা স্কুল লেভেলের পড়াশুনার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কোন থিসিস করতে হয়না। ৪-৫ টা হাদীসের বই অর্থসহ পড়তে পারলেই হলো।
ভালো দিক
ভালো দিক হচ্ছে, এখন কওমি মাদ্রাসার অনেক ছাত্র দেশের বাইরে পড়াশুনা করতে যেতে পারবে। এই ছেলেগুলা দেশে ফিরে আসলে কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস আপডেট করতে একটা internal pressure তৈরি হবে। দেশে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা এক লাফে কয়েকগুন বেড়ে যাবে; বিশ্ব-র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অকস্মাৎ বিশাল পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে বড়ো দিক হচ্ছে, মাদ্রাসার পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীরা মেইনস্ট্রীমের সাথে মেলামেশার দারুন সুযোগ তৈরি হবে; ফলে দেশ ও সমাজের জন্য কল্যানকর কিছু করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। গোঁড়ামি, সঙ্কীর্ণতা এবং অবিশ্বাস দূর হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:৪৩