আপডেট: ০১
* দুর্গাপূজা ও দশমী, ২০১৩ – বাংলাদেশ।
* পুরনো কিছু দুর্গাপূজার আলোকচিত্র।
হিন্দু শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা নিম্নোক্তরূপে প্রদত্ত হয়েছে :
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা” – অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।
দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথায় দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে।
সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও পরিবারে অবশ্য পনেরো দিনে দুর্গোৎসব পালনের প্রথা আছে। এক্ষেত্রে উৎসব মহালয়ার পূর্বপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষের নবম দিন অর্থাৎ কৃষ্ণানবমীতে শুরু হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবাড়িতে আজও এই প্রথা বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় মহাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী অবধি জাতীয় ছুটি ঘোষিত থাকে; এই ছুটি বাংলাদেশে কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিনই পাওয়া যায়।
বর্তমানকালে দুর্গাপূজা দুইভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে – ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে পাড়া স্তরে। ব্যক্তিগত পূজাগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়; এগুলির আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলিতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।
দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা। দেবী পুরাণে কুমারী পূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত ১ বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে। বয়স ভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। এদিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক এবং পায়ে আলতা। ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক মুখরিত হয় শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশী প্রকাশ। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূত-পবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন। প্রত্যেকে শ্রদ্ধাশীল হবে নারী জাতির প্রতি।
১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ জন কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। তখন থেকে প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণ সাধনই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। জগতের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অশুভের ভেদাভেদ ভুলে মায়ের কৃপা তুষ্টি লাভই মানব জীবনের মোক্ষ উদ্দেশ্য।
দূর্গাপূজার আরো একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধিপূজা । দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিন হয় এই বিশেষ পূজা , এই পূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালিন পূজা। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এইসময় দেবী দূর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়, হয় পশুবলি সেই বলিকৃত পশুর স্মাংস-রুধি (মাংস ও রক্ত) এবং কারণ (মদ) প্রদান করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে।
দুর্গাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত নানা আচার-উপাচার ও ভক্তিশ্রদ্ধায় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেবীদুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব। যা বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী বিজয়া দশমীর এই দিনে মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে যাবেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গাকে বেদনাবিধূর বিদায়লগ্নে তেল, সিঁদুর ও পান দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। এরপর শোভাযাত্রা। সর্বশেষ প্রতিমা বিসর্জন।
দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান ব্যাপক। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অবদান এ পূজাকে সার্বজনীন করে তুলেছে। দুর্গা পূজাতেই আমরা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে যাই সবাই। সবার প্রাণের উৎসবে পরিণত হয় দুর্গাপূজা।
আজকের এই শুভ ক্ষণে, ঘরে-বাইরে, দেশে-বিদেশে অবস্থানরত প্রত্যেককে জানাই ‘শুভ বিজয়ার’ শুভেচ্ছা! দেখা হবে আগামীতে! সকলেই ভালো থাকবেন এবং সকলের মঙ্গল হোক।
* দুর্গাপূজা ও দশমী, ২০১৩ – বাংলাদেশ।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, এবার দেবী এসেছেন দোলায় (পালকি) চড়ে, যাবেন গজে (হাতি) চেপে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দোলায় চড়ে দেবির আগমণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বার্তা দেয়। তবে তিনি হাতিতে চড়ে বিদায় নেয়ায় পৃথিবী হয়ে উঠবে সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা।
এ বছর সারাদেশে ২৯ হাজারের বেশি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছে। আলোকসজ্জা আর নানা কারুকার্যে সজ্জিত হয়ে ওঠে প্রতিটি মণ্ডপ। ঢাকা মহানগরে এ বছর পূজা মন্ডপের সংখ্যা ২১২টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিলো ২০২টি। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রামকৃষ্ণ আশ্রম, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, ধানমন্ডি সর্বজনীন পূজা কমিটি, গুলশান বনানী সর্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদ, কলাবাগান সর্বজনীন পূজা উত্সব, রমনা কালীমন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ও ব্যক্তিগতভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে উত্সবমুখর পরিবেশে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেছেন। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করেন।
রাজধানীর অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হয় সদরঘাটের ওয়াইজঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে। প্রতিমা বিসর্জনের পালা শুরু হয় বিকাল থেকেই। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে কেন্দ্রীয় বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয় বেলা আড়াইটার দিকে। এর আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিমা জড়ো করা হতে থাকে পলাশী মোড়ে।
শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনি বাদ্যের সঙ্গে আধুনিক উচ্চস্বরের সাউন্ড সিস্টেমে দেবী বন্দনার গানের মধ্য দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দিয়ে কয়েক হাজার মানুষের এ শোভাযাত্রার সময় বিভিন্ন সড়কে সৃষ্টি হয় যানজটের।
বিকাল ৩টা ৫০ এ বীণাস্মৃতি স্নানঘাটে বিসর্জন দেয়া হয় রথখোলা রোডের আদি মরণচাঁদ মণ্ডপের প্রতিমা। এরপর জলে ভাসানো হয় পাতলা খান লেনের সবুজ স্বপন সংঘ মণ্ডপের প্রতিমা।
ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বসুদেব ধর জানান, রাজধানীর ২১৪টি মণ্ডপের দেবী প্রতিমা বীণাস্মৃতি স্নানঘাট, তুরাগ নদীর বিআইডব্লিউটিএ ঘাট ও পোস্তগোলায় বিসর্জন দেয়া হবে।
প্রতিমা ঘাটে নিয়ে আসার পর শেষবারের মতো ধুপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন ভক্তকূল। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্যদিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেয়া হয়।
বিসর্জনের এ পর্ব অবশ্য রাত পর্যন্ত চলবে।
চট্টগ্রামে পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন।
* পুরনো কিছু দুর্গাপূজার আলোকচিত্র।
উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতায় দুর্গাপূজার আলোকচিত্র।
১৮৫৯ সালে কলকাতার দুর্গাপূজা। এঁকেছিলেন অ্যালেক্সিস সোলটিকফ।
পাটনা রীতিতে আঁকা ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজা।
ইউরোপীয়দের সম্মানার্থে কলকাতায় দুর্গাপূজায় নাচ ও গানের আয়োজন করা হত। ১৮৩০-১৮৪০ সালের মধ্যে উইলিয়াম প্রিন্সের আঁকা।
উনিশশতকের দুর্গাপূজা লিথোগ্রাফ।
আলোকচিত্র: bdnews24.com সৌজন্যে।
কিছু কথা: পোষ্টটি স্টিকি করার জন্য মডারেটর, নির্বাচক এবং ব্লগ কতৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আসলে পূজো এবং ঈদকে সামনে রেখে সামুতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ বেশকিছু পোস্ট এসেছে। সুন্দর সুন্দর পোস্টের ভিড়ে, দু’একটা অসুন্দর পোস্টও চোখে পড়েছে। যা কিছুটা বিব্রতকর ও হতাশাজনক। কিন্তু কোন পোস্টেই আমি পূজোর পুরনো এবং পৌরাণিক ইতিহাস পেলাম না। এটা বড়ই কষ্টের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন দুর্গাপূজা এবং দশমী সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে তাই, আমি এই পোস্টটি দিয়েছি। সবাইকে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫৪