ভারত ছিল প্রথম বড় রাজ্য যা পাশ্চাত্যের হাতে পড়েছিল। এটা সেনাবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে বিজয় কিংবা প্রযুক্তিগত প্রাধান্যের কারণে রাতারাতি ঘটে নি।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝখানের পাশ্চাত্য ধারাভাষ্যকারেরা (মার্কস সহ) এটা ভেবে ভুল করেছিলেন যে ভারত একটি প্রাচীন স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরেও ‘বণিক, ব্যাংকার এবং মজুরিচাষীদের’ কল্যাণে ভারতজুড়ে অর্থনীতির বেশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল। কিন্তু তারা সর্বদা ছয়টি প্রতিযোগী রাজ্যের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। এই রাজ্যগুলো তাদের সম্পত্তির কোনোপ্রকার নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ ছিল। এটা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তাদের সৈন্য এবং অস্ত্র সহযোগে ভারতে নাক গলানোর পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। অনেক ব্যবসায়ী দেখতে পারছিলেন ব্রিটিশরা তাদের অধিকারগুলো এমনভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে যা করতে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী সমর্থ নয়।
অষ্টাদশ শতকের শুরুতেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে একটা প্রান্তিক দল বৈ আর কিছু ছিল না। উপকূলে বাণিজ্য করার জন্য তাদের ভারতীয় শাসকদের অনুমতি লাগত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা ভারতীয় বণিকদের মধ্যে যারা টেক্সটাইল এবং ভিতর থেকে অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করত তাদের সাথে তীব্র মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারপর ১৭৫০ সালে কোম্পানির এক কর্মকর্তা রবার্ট ক্লাইভ বাংলার একচ্ছত্র অধিপতিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। ফরাসি সৈন্যদলের একটা অংশকে পরাজিত করেন এবং প্রদেশের শাসনভার কোম্পানির দখলে নিয়ে নেন। বাংলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী অংশ। কোম্পানি তখন খাজনা আদায় এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করাও শুরু করে দেয়।
অতি অল্প পরিশ্রমেই ব্রিটেন উত্তর আমেরিকায় পুরাতন সাম্রাজ্য হারানোর পরপরই ভারতে নতুন সাম্রাজ্য লাভ করে। আর এর শুরুটা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের মধ্য দিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সমস্ত ব্যয়ভার ভারতীয় মানুষের খাজনা থেকে চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারতীয় ‘সিপাহী’ নির্ভর এক সেনাবাহিনী তৈরি করে।
বাংলায় সাফল্য অর্জনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য অন্য রাজ্যগুলোতেও সফলতার দ্বার খুলে গিয়েছিল। অন্যান্য ভারতীয় শাসকেরা কোম্পানিকে একটি অতি প্রয়োজনীয় মিত্র হিসেবে গণ্য করতে থাকে এবং তাদের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও প্রশাসন চালানোর জন্য তাদের ব্যবহার করতে থাকে। ভারতের বণিকেরা তাদের স্বাগত জানায়। কারণ কোম্পানি তাদের কাছ থেকে প্রচুর টেক্সটাইল পণ্য কিনত এবং স্থানীয় শাসকদের আক্রমণ থেকে কোম্পানি তাদের সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা দিত।
তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমিদারদের একেবারে বিলুপ্ত করে দেয় নি। তারা পুরাতন জমিদারদের আদলে একদল নতুন জমিদার শ্রেণি গঠন করে। যারা তাদের কথা মতোই সব কাজ করতো।
১৮৫০ সালের মধ্যে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতাধীনে চলে আসে। মারাঠারা বিজিত হয় ১৮১৮ সালে, সিন্ধরা ১৮৪৩ সালে, শিখেরা ১৮৪৮ সালে এবং উদেরা ১৮৫৬ সালে এভাবে তারা একে একে বড় বড় রাজ শক্তিগুলোকে পরাস্ত করে। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা গর্ব করে বলতো, তাদের কোম্পানির কার্যক্রম রোমানদের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত- ভাগ করো এবং শাসন করো।
কিছু জায়গায় ঘুষ প্রদান করে, কিছু জায়গায় নাশকতা চালিয়ে তারা শাসকের বিরুদ্ধে শাসককে, রাজ্যের বিরুদ্ধে রাজ্যকে, সুবিধাবাদী শ্রেণির বিরুদ্ধে সুবিধাবাদী শ্রেণিকে, জাতের বিরুদ্ধে জাতকে, ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মকে লেলিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য সবখানেই তারা তারা স্থানীয় কিছু মিত্রের সহায়তা পেয়েছিলো। যার ফলে তারা সহজেই করেছিল ২০ কোটি মানুষের একটি দেশকে জয় করে নেয়। যে সেনাবাহিনী নিয়ে তারা পুরো কাজটি করেছিলো সেখানে সৈন্যসংখ্যা ছিলো ২ লক্ষের মত। অবাক করার বিষয় হলো, এই পুরো বাহিনীতে ইংরেজদের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০০০।
ধীরে ধীরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হতে থাকে। লুটেরা ক্লাইভ তৎকালীন ২,৩৪,০০০ পাউন্ড নিয়ে ভারত ছেড়েছিলেন যার বর্তমানে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের সমান। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসও তখন নানা উপায়ে প্রচুর ঘুষ নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন।
অথচ এই সম্পদের পুরোটাই তৈরি হয়েছিলো চাষীর খাজনা দিয়ে। তখন বাংলা এবং বিহারের চাষীরা খাজনা হিসেবে প্রতি বছর ২০ লক্ষ টাকা পরিশোধ করতে হতো। কোম্পানি তাদের খাজনা আদায়ের কর্মকর্তাদের ‘জমাদার’ নামে অভিহিত করত এবং মুঘলদের মতোই একই পদ্ধতিতে জুলুম অব্যাহত রাখে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরঞ্চ আরও কার্যকরভাবে এবং ধ্বংসাত্মক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তারা খাজনা আদায় করতে থাকে।
এসব জনগণের দারিদ্র্যতা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, তা মুঘলদের সময়কালকেও হার মানিয়েছিল। সঠিক সময়ে ফসল না ওঠায় ১৭৬৯ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেয়। যা প্রায় এক কোটি লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এভাবে এক শতাব্দী আগেও যার জৌলুস ইউরোপবাসীদের অভিভূত করেছিলো, অর্ধ শতাব্দী পরই তা পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়ে যায়।
কোম্পানির কার্যক্রমকে যেসব জমিদার, নবাব, মহাজন এবং ব্যবসায়ীরা পছন্দ করত তাদের এসবের কোনো কিছুই স্পর্শ করত না। কোম্পানির ফুলেফেঁপে ওঠার সাথে সাথে তারাও ফুলেফেঁপে উঠছিল। কিন্তু অচিরেই তারা আবিষ্কার করল ব্রিটিশদের সাথে তাদের ভাগাভাগি আর সমান নেই। কোম্পানি যে স্থানীয় শাসকদের উত্থান ঘটিয়েছিল দ্বিতীয় কোনো চিন্তা ছাড়াই তাদেরকে চাইলে কোম্পানি এক মুহূর্তে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে।
উনিশ শতকের প্রথম দশকে ভারতীয় বণিকরা এটা প্রকাশ্যে দেখতে পায়। ব্রিটেনের বাজারে ভারতীয় পণ্যের আধিপত্যের পরিবর্তে, ব্রিটেনের পণ্য ভারতের বাজার দখল করে নিয়েছিল। ভারতের সকল বস্ত্র কারখানা ধ্বংস হয়ে যায়, লক্ষাধিক বস্ত্র শ্রমিকেরা জীবনজীবিকা ধ্বংস হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ভারতীয় বণিকদের মুনাফা। বণিকরা তখন অনুধাবন করা শুরু করলো, নিজেদের সরকার ব্যবস্থা ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের এই বি-শিল্পায়ন রোখার আর কোনো পথ নেই।
১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার আচরণে আরো পরিবর্তন নিয়ে আসে। যখন কোম্পানি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবজ্ঞা করে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো কার্তুজ ব্যবহার করতে বলেছিল তখন এই সৈন্যরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। কোম্পানির এই আচরণ পুরো ভারতজুড়ে তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বিদ্রোহীরা উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা তখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের দ্বেষ ভুলে এক হয়ে যায়।
তবে কোম্পানি এই উত্থানকে যথাসময়ে শান্ত করতে পেরেছিল। সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের উপমহাদেশে পাঠিয়েছিল এবং তারা মাদ্রাজ ও মুম্বাইতে ভারতীয় সৈন্যদের বুঝিয়ে উত্তরের বিদ্রোহীদের দমন করেছিল। বিদ্রোহ দমন করার জন্য তারপর থেকে যেকোনো ধরনের বর্বরতামূলক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা হতো।
তবে কোম্পানি এটাও বুঝতে পারছিল যে শুধুমাত্র দমন-পীড়নের মাধ্যমে ভারতবাসীদের শান্ত করা যাবে না। ব্রিটিশদের ব্যবসায়ের অর্থলিপ্সার উপর তাদেরও কিছু অধিকার দিতে হবে নতুবা সোনার ডিম পাড়া হাসটি অচিরেই মারা যেতে পারে। তারা তখন ভাগ করো এবং শাসন করো নীতির উপর আরও অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে। সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দিতে থাকে।
ধীরে ধীরে ভারতের সরাসরি শাসনবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে চলে গেল ব্রিটেনের সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে। স্থানীয় সকল শাসক এবং জমিদাররাও তখন এই নতুন শাসন মানতে বাধ্য ছিলেন।
এই শাসন নিয়মিত চলতে থাকায় জনগণের দারিদ্র্যতা বাড়তে থাকে। কৃষির উপর তখনও ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ মানুষ নির্ভরশীল ছিল। যেখানে রাজস্বের ২৫ শতাংশ চলে যায় সেনাবাহিনীতে (ভারতীয়দের দমন করে রাখার জন্য!)। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও কৃষিতে এক শতাংশেরও কম বরাদ্দ রাখা হতো। ফলে ভারতবর্ষ অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক দফায় দুর্ভিক্ষের স্বীকার হয়। ১৮৬০ সালে ১০ লক্ষ, ১৮৭০ সালে ৩৫ লক্ষ এবং ১৮৯০ সালে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ কেবল দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
এই চাষীদের করের টাকায় ব্রিটিশ উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের সুনিশ্চিত ভবিষ্যত নির্মিত হতে লাগল। অন্যদিকে এই ভারত তখন বিট্রিশদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তুতে পরিণত হয়।
তবে কিছু এদেশীয় লোকের উপর তারা তখনও নির্ভরশীল ছিল। এটি মূলত ছিল এই বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে। পুরাতন রাজন কিংবা মহাজনরা তখনো তাদের প্রাসাদেই বসবাস করতেন। এমনকি অসংখ্য স্ত্রী, চাকরবাকর, ঘোড়া, হাতি এবং শিকারী কুকুর সহযোগে তাদের জীবনযাত্রা আরও আরামদায়ক এবং লোভনীয় হয়ে উঠেছিল। কখনও কখনও তারা নামেমাত্র শাসকও ছিল (বিশেষত হায়দারাবাদে)। যদিও তারা ব্রিটিশ উপদেষ্টাদের ‘আদেশ’ পালন করতেই অভ্যস্ত ছিল।
ভারতে তখন ব্রাহ্মণ এবং গ্রাম প্রধান নামে আরো দুটি শ্রেণী ছিলো। তারা মূলত কর আদায় করতে জমিদারদের সহায়তা করে ব্রিটিশদের মদত করত। এদের কারণেই মূলত উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শুরুর চেয়ে জাতিভেদ প্রথা মোটামুটি একটা কাঠামোবদ্ধ পর্যায়ে আসে। একই সময়ে ভারতে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটতে থাকে যার সদস্যরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আইনজীবী, কেরাণী কিংবা বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে অগ্রগতি সাধনের আশা করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের জাতিগত বিদ্বেষের কারণে তাদের এই আশা বারবার হোঁচট খাচ্ছিলো।
অনুবাদক: প্রবাল রায় প্রান্ত
অনুবাদ সম্পাদনা: সৌরভ দাস
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৫৬