উনিশশো সাল নাগাদ পুঁজির প্রভা ছড়িয়ে যায় বিশ্বের সর্বত্র। এন্টার্কটিকা, আমাজনের গভীরতম জঙ্গল, নিউগিনির পার্বত্য উপত্যকা এরকম জায়গার কিছু জনগোষ্ঠী ছাড়া সবাইই এই পুঁজিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তখন।
তবে পুঁজির প্রভাবটা সব জায়গায় এক রকম ছিল না। পৃথিবীর বহু অংশে এখনো পুঁজিবাদ বলতে সেই শ্রম আর ঘামের চর্চাই বোঝায় যা দিয়ে মূলত মালিকরা লাভবান হয়। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় এই পুঁজিবাদের ফলে কারখানা, পরিবহন, এমনকি কৃষিক্ষেত্রেও ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ ঘটে।
একশ বছর আগের শিল্পবিপ্লব মূলত সীমাবদ্ধ ছিল বস্ত্র উৎপাদনের একটা বিশেষ শাখায়- তুলো থেকে সুতো তৈরিতে। কিন্তু উনিশ শতক থেকে সবকিছুতেই ঘটতে থাকে আরো নতুন নতুন সব পরিবর্তন। এ যেন নতুন আরেক শিল্প বিপ্লব! উৎপাদনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সাবান উৎপাদন থেকে শুরু করে ছাপশিল্প, রঞ্জনশিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, বুট-জুতো কিংবা কাগজ উৎপাদনে আসে পুনঃ পুনঃ বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার আর ফিলামেন্ট বাল্বের উন্নয়ন সাধনের ফলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করে বাড়ানো হয় শ্রমিকের কর্মঘন্টা (বোম্বের প্রথম টেক্সটাইল ধর্মঘট ছিল তারই প্রতিক্রিয়া)। ধীরে ধীরে আবিষ্কার হলো বৈদ্যুতিক মোটর, টাইপ রাইটার। এই দুটো আবিষ্কার যথাক্রমে যোগাযোগ এবং ব্যাবসায়িক চিঠিপত্র আদান-প্রদানে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
টেলিগ্রাফ এবং ১৮৮০ এর দশকের শেষ দিকে টেলিফোন আবিষ্কারের ফলে দূর থেকেও উৎপাদন কার্য এবং যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনা করা সহজ হয়ে যায়। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগও আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় (১৮৯৫ সালে, এঙ্গেলস এর মৃত্যুর আগে, তার লন্ডনের বাড়িতে টেলিফোন সংযোগ নেওয়া হয়েছিল) ।
রেললাইনের বিস্তারের সাথে তাল রেখে বাড়তে লাগল কারখানার সংখ্যা। সেই সাথে দূরতম অঞ্চলগুলোর সাথে শহরের যোগাযোগে এলো ব্যাপক পরিবর্তন। রেলগাড়ি, কারখানা আর বাষ্প জাহাজের জ্বালানি চাহিদা যোগান দিতে কয়লাখনির সংখ্যাও বাড়তে লাগল দ্রুত গতিতে। লোহা আর স্টীলের বদৌলতে ছোট শহরগুলো ঊর্ধ্বগামী হতে লাগল আর শ্রমিকদের জন্য শহরের পাশেই স্থাপিত হলো শহরতলী। এভাবে একেকটি শিল্পের বিকাশ অন্য শিল্পের বিকাশের পথ সুগম করে দেয়।
শহরের মানুষ, খনি শ্রমিক আর স্টিল কারখানার শ্রমিকদের খাদ্য ও কাপড়ের যোগান দেওয়াও প্রয়োজন ছিল তখন। ফলে আমেরিকার মধ্যাঞ্চলে অতীতে চাষ না করা তৃণভূমি থেকে শস্য, আর্জেন্টিনার প্যাম্পাস অঞ্চলের গরুর মাংস আর অস্ট্রেলিয়ার উল তখন এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে হাজার মাইল দূরে পাঠানো সম্ভব হলো। তখন থেকেই শিল্প পর্যায়ে কৃষি খামারের বিকাশ শুরু হলো। এ থেকে উৎসাহিত হলো খাদ্য সংরক্ষণ ও গুদামজাত করার নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা।
বর্ধনশীল শহরে লোকজনের বাসস্থান থেকে কাজের জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা করাটাও ধীরে ধীরে দরকারি হয়ে পড়ল। পুঁজিবাদীরা দেখলো মানুষের এই যাতায়াত ব্যবস্থাকে উন্নত করলে তাদের পুঁজি আরো দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকবে। তারা তখন বাস, ট্রাম লাইন এরকম নিত্যনতুন যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে লাগলো।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নোংরা অস্বাস্থ্যকর বস্তিগুলোতে গরীব মানুষের গাদাগাদি করে থাকা আর ক্ষুধা এবং রোগে ভুগে মারা যাওয়া নিয়ে মধ্যবিত্তদের তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকে তারা বুঝতে পারল রোগজীবাণু কি করে গরিব এলাকা থেকে ধনী এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ উপলব্ধি থেকে তারা শহরময় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ, মূল শহরে জনসংখ্যা কমানো, পরিষ্কার পানি সরবরাহকরণ এবং রাস্তাঘাট আলোকিত করা ও ঘরকে উত্তপ্ত রাখতে গ্যাস সরবরাহ করা প্রভৃতি বিষয়ে নানাবিদ উদ্যোগ নিতে থাকে।
একদল পুঁজিপতি উক্ত সেবাগুলো প্রদান করে লাভবান হলো আর নতুন শ্রমিক নিয়োগ করল সরবরাহ চালু রাখার জন্য। সর্বোপরি এর মধ্য দিয়ে নগরায়ন প্রক্রিয়াটি ব্যাপক হারে ত্বরান্বিত হয়। ১৮৮০ সালে যেখানে লন্ডনের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ ছিল শহরে বসবাস করতো সেখানে ১৯০০ সাল নাগাদ ব্রিটেনের জনসংখ্যার চারভাগের তিনভাগই শহরে বসবাস করতে শুরু করে। অর্থাৎ গ্রামে কাজ করে এই সংখ্যাটা ছিল প্রতি দশজনে একজন। অর্থাৎ ব্রিটেনে নগরায়ণ প্রক্রিয়াটি অনেক দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়েছিলো। অন্যান্য দেশগুলোতে অবশ্য এ দ্রুত হয় নি। জার্মানিতে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তখনো মাঠে কাজ করত, আর কারখানার শ্রমিকদের অনেকেই বড়ো শহরের পরিবর্তে ছোট শহর কিংবা গ্রামে বাস করত। ১৯৫০ সালের হিসেব মতে ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার শতকরা ত্রিশ ভাগ মাঠে কাজ করত। ১৯৫০সালে জাপানে এ সংখ্যাটা ছিল প্রায় আটত্রিশ শতাংশ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও মোট জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল (যদিও, যান্ত্রিকীকরণের ফলে তৃণভূমিগুলো পাল্টাতে শুরু করেছিল) এবং উনিশশো চল্লিশের দশক পর্যন্ত বড় শহরের তুলনায় ছোট শহরে বসবাসকারীদের সংখ্যা বেশি ছিল। তা স্বত্ত্বেও, সবগুলো দেশই তখন ব্রিটিশদের অনুসরণ করা শুরু করে। গ্রামগুলো ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিল অতীতের স্মারক।
মানুষের জীবনযাপনের পুরো পদ্ধতিই তখন সম্মুখীন হচ্ছিলো পরিবর্তনের। আর এই পরিবর্তন পুঁজির জন্য সুযোগ এবং সমস্যা- দুইই হাজির করল। বস্তুগত চাহিদার বাইরেও মানুষের নানাবিধ চাহিদা আছে। আরাম আয়েশ করা, সামাজিকভাবে মেলামেশা করা এবং শারীরিক ক্লান্তি এবং একঘেয়ে কাজের বিরক্ত কাটিয়ে ওঠা মানুষের একান্ত প্রয়োজন। কারখানাভিত্তিক উৎপাদন এবং শহুরে জীবন এধরনের প্রয়োজন মেটানোর পুরোনো প্রায় সবগুলো পদ্ধতিকেই বাতিল করে দিয়েছিল।
এজন্য পুঁজিবাদ সামাজিকীকরণের নতুন পন্থা উদ্ভাবন করলো। শুরু হলো “বিনোদন ব্যাবসা”। বিনোদনমূলক এবং সুড়সুড়ি নির্ভর খবরের বিপুলসংখ্যক পাঠক পেয়ে যায় “ব্যারন” (প্রথম সংবাদপত্র)। তবে বিনোদন ব্যবসার প্রথম পদক্ষেপ ছিল মিউজিক হল আর দ্বিতীয়টি ছিল ১৮৯০ সালে ফোনোগ্রাফের আবিষ্কার (রেকর্ড প্লেয়ারের পূর্বসূরী)।
এরপর খেলাধুলাও পুঁজিবাদের অন্তর্ভুক্ত হলো। বল নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে খেলার চল হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু খেলার দলগুলো নিয়ে সংগঠনের উৎপত্তি এবং বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে খেলার সূচনা (যা আসলে পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিযোগী মনোভাবেরই প্রতিফলন) ছিল উনিশ শতকের ব্রিটেনের অন্যতম নতুন বৈশিষ্ট্য এবং এ বৈশিষ্ট্য শীঘ্রই ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। তখন ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো টিমের জন্ম হয়েছিল (যেমন 'আর্সেনাল' কিংবা 'মস্কো ডায়নামো' )। আঞ্চলিক পর্যায়ে সকল শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় হবার জন্যই এই টিমগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
এভাবে মানুষের শোবার বিছানা থেকে থাকার ঘর, তাদের খাবার জন্য খাদ্য, তাদের কাজের জায়গায় পৌঁছানোর জন্য পরিবহন কিংবা কর্ম শ্রান্তি ভুলতে যে বিনোদন, সবই পুঁজিবাদের লাভের খাতে পরিণত হয়ে যায়। পুঁজিবাদ হয়ে উঠে একটি পরিপূর্ণ সিস্টেম।
এর থেকে একটি সমস্যাও উদ্ভুত হলো। শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে ব্রিটেনের পুঁজিপতিদের এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে দেখা গেলেও অন্যান্য দেশের শিল্প পুঁজিপতিরা ছিল উদাসীন। সুতো কারখানার জন্য নারী ও শিশুদের শ্রম ছিল সবচেয়ে সস্তা এবং উপযোগী। আর তাই তাদের স্বাস্থ্য কিংবা শৈশব সম্পর্কে কোনো রকম বিবেচনা না করেই তাদের ঢোকানো হতো কারখানায়। কিন্তু এতে শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে একেবারে ধ্বংস হতে হয়। ১৮৫০ সাল নাগাদ, তুলনামূলক দূরদর্শিতা সম্পন্ন পুঁজিবাদীরা তাদের ভবিষ্যতের সঞ্চিত শ্রমশক্তির ক্ষয় আন্দাজ করে শঙ্কিত হলো। ১৮৭১ সালে ব্রিটেনের 'দরিদ্র আইন' বিষয়ক এক পরিদর্শকের রিপোর্টও ছিল আশঙ্খাজনক- ‘একথা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, শহরের দরিদ্র শ্রেণির বালকেরা, বিশেষত যারা লন্ডনে লালিত হয়েছে, পনেরো বছর বয়সে উচ্চতার দিক দিয়ে চার ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি এবং বুকের ছাতির মাপ ঊনত্রিশ ইঞ্চি ছাড়াতে পারেনি, জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যা খর্বাকায় বলে বিবেচিত।’
‘শ্রমিক শ্রেণির শারীরিক সক্ষমতা ও নৈতিক শক্তিবৃদ্ধিই হলো এ পরিস্থিতির সুস্পষ্ট প্রতিকার।’-- ১৮৯৩ সালে এই বলে সমাপ্তি টেনেছিল ম্যানসন হাউজ কমিশন। তখন ধারাবাহিকভাবে কিছু আইনের মাধ্যমে শিশুদের সর্বোচ্চ শ্রমঘন্টা নির্দিষ্ট করা হলো এবং সফল গর্ভধারণকে ঝুঁকির মুখে ফেলে এমন সব কাজে নারীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হলো। সাবান উৎপাদনকারী লিভার'স পোর্ট সানলাইট এবং বার্মিংহামের নিকটবর্তী চকলেট প্রস্তুতকারী ক্যাডবেরী'স বোর্নভিলের মতো কিছু পুঁজিপতিরা আদর্শ গ্রামের পত্তন ঘটায় যেখানে যথাযথ পরিবেশে শ্রমিকদের বসবাস সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনক্ষমতা বজায় থাকবে (মদ্যপানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপনসহ)। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে সরকারি প্রচেষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত।
১৮৯৯-১৯০২ সময়কালে চলা বোয়ার যুদ্ধের জন্য সংগৃহিত সৈন্যদের নিয়ে শারীরিক শক্তি নিয়ে অনুসন্ধান চালায় 'শারীরিক ক্ষয় বিষয়ক' এক কমিটি এবং ভবিষ্যত যুদ্ধ পরিচালনায় ব্রিটেনের সক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন উদারনৈতিক সরকার স্কুলে স্কুলে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ চালু করে।
পাশাপাশি জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, গির্জা এবং পার্লামেন্টের সদস্যরা “মধ্যবিত্ত শ্রেণি”র ধারণা অর্থাৎ 'উপার্জনে সক্ষম স্বামী, কর্তব্যপরায়ণা গৃহবধূ এবং বিনয়ী ছেলেমেয়ে সমৃদ্ধ ধাতস্থ, একগামী, একক পরিবার ‘- কে জনগণের জন্য আদর্শ বলে প্রচার করতে থাকে। দাবী করা হয়, শুধুমাত্র এইরকম আদর্শ পরিবারই শিশুদের দায়িত্বশীল এবং অনুগত হয়ে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে পারে। আর মানবপ্রকৃতি অনুসারে মহিলাদের অবস্থান হয় বাড়িতে। অতীতে বহুবিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও আদর্শ পরিবার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন সকল ধরনের চর্চা অনৈতিক কিংবা অস্বাভাবিক বলে প্রচারিত হলো। বিবাহ পূর্ব কিংবা বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার, গর্ভনিরোধণ এবং যৌনস্বাস্থ্য কিংবা যৌন সম্ভোগ সম্পর্কিত সকল আলোচনা সরকারি শুদ্ধতাবাদের বাতাবরণে মুখোমুখি হলো শাস্তি এবং সমালোচনার। তখন ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো পুং সমকামিতাকেও অপরাধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
আদর্শ পরিবারের এমন ধারণার সাথেই উৎপত্তি হলো পারিবারিক মজুরি ধারণার। যেখানে পুরুষের উপার্জন পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট হবে এবং নারীরা বাড়িতে থেকে বাচ্চা লালন পালন করবে। যদিও অতি অল্প সংখ্যক শ্রমিক ছাড়া আর কারো জন্যই তা বাস্তব হয়নি কখনো। চাকুরিদাতারা কাটতি বেশি হলে অথবা ধর্মঘট কিংবা শ্রমিক ঘাটতির ভয়ে যদিও বা পুরুষদের বর্ধিত মজুরি দিত, ব্যাবসায় মন্দা নামলেই আবার আগের অবস্থায় চলে যেত। ফলে এক শ্রমিকের পক্ষে পুরো একটা পরিবার চালানো তখন সম্ভব ছিল না। ফলে নারী সদস্যদেরও নানা রকম কাজে যেতে হয়।
বিয়ের পর বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দেওয়া, চাকরি ছেড়ে গৃহিণী হওয়া এসবের পরেও নারীদের অনেকেই নানাভাবে উপার্জনের সাথে জড়িত ছিল (গৃহকর্মী কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে)। কিন্তু নারীদের কাজকে পুরুষের উপার্জনের তুলনায় ছোট করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করায় নারীদের কম মজুরি দেওয়া তাদের চাকরিদাতাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে পুঁজিবাদীদের লাভের উপায় ছিল শ্রমিকদের প্রতিদিন যত বেশি পারা যায় খাটানো। যাকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন 'পরম উদ্বৃত্ত মূল্য'। দুই তিন শিফট কাজ করানোর মাধ্যমে যখন কার্যকর ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা গেল তখন থেকেই শ্রমকে তীব্রতর করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হলো যাতে করে উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো ছেদ না পড়ে। ফ্রেডরিক টেলর নামে জনৈক আমেরিকান ‘বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা' হাজির করেন। অর্থাৎ স্টপওয়াচ হাতে পরিদর্শকেরা পরিমাপ করবে একজন শ্রমিকের পক্ষে সারাদিনে সর্বোচ্চ কতটা কাজ করা সম্ভব এবং পরবর্তীতে এই সর্বোচ্চ কাজের ওপর ভিত্তি করে তার মজুরি দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে যন্ত্র শ্রমিকের বর্ধিত অংশ নয় বরং শ্রমিকই যন্ত্রের অধস্তন হলো।
উৎপাদন বৃদ্ধির চিন্তা থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। সামন্ত যুগে কৃষক এবং খেতমজুরদের জন্য লিখতে পড়তে ও গুণতে পারাটা ছিল ঐচ্ছিক। আর তাই সামন্ত যুগের সাহিত্যে শুধু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতই চোখে পড়ে। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার জটিল মিথস্ক্রিয় প্রক্রিয়ার প্রয়োজনেই শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে। যাতে শ্রমিকরা যন্ত্রের গায়ে লেখা নির্দেশ, মোড়কের গায়ের লেবেল পড়তে পারে, সেই সাথে প্রাথমিক স্তরের গণনাও বুঝতে ক্ষমতা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যামে তাদের অনুগত করানোটাও একটা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তখন।
যেসব অঞ্চলে পুঁজিবাদ তুলনামূলক দেরীতে এসেছিল সেখানে এমন শ্রমিক শ্রেণির দরকার ছিল যারা ব্রিটেনের দখল করা বাজার নিয়ে পাল্লা দিতে সক্ষম। আর তাই সেসব অঞ্চলে পুঁজিবাদের শুরু থেকেই গণশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি জোর দেওয়া হয়। যার লক্ষ্য শুধু ভবিষ্যত শ্রমিকদেরই দক্ষ করে তোলা নয় বরং মধ্যবিত্তদের কিছু অংশকেও গ্রাস করে নেওয়া।
বিশ শতকের শুরুতেই পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় পুঁজিবাদ পরিণত হতে শুরু করে। আজকের সমাজের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য তখন পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছিল। তার অন্যতম ফলাফল ছিল লোকেরা পরিবর্তিত সে বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই মেনে নিচ্ছিলো। শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে গ্রাম্য জীবন থেকে শিল্প কারখানায় শ্রমিক জীবনে প্রবেশ করে মানুষ হতচকিত হয়েছিল। সে জীবনের অসঙ্গতি দূর করতে তারা অনেক সময় অতীত থেকেও প্রতিকার খুঁজত।
কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকে মানুষ আর হতচকিত হতো না। নতুন নতুন আবিষ্কার যেমন মোটর গাড়ি কিংবা বিদ্যুৎ বাতির আবিষ্কার মানুষকে বিষ্মিত করত বটে কিন্তু প্রতিযোগিতা আর সময়ের সাথে দৌঁড়ানো আপাদমস্তক লোভের ওপর নির্মিত সমাজ তাদের আর হতচকিত করত না। পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য তখন মানুষেরই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপ নিতে থাকে।
অনুবাদক: সৌরভ দাস
ইউনিভার্সিটি অব কাসেল
জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:২০