রং রহস্য! রহস্যের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত! সৌন্দর্যের ধারণা প্রকাশের সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো রং। অনুভূতি, অবস্থান এবং পরিস্থিতির নির্দেশক হিসেবেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের মনোজগতে এর স্থান খুবই গভীর এবং ব্যাপক। ফলে, চোখ বন্ধ করলেই আমরা দেখতে পাই আমাদের চারপাশে বিচিত্র এক রঙের দুনিয়া। যার প্রত্যেকটা পরতে পরতে রঙের ছোঁয়ায় রঙ্গিন হয়ে আছে। কিন্তু আমরা কি আসলেই জানি, কেন এই পৃথিবীতে এত রঙের খেলা? কিংবা কেন এই পৃথিবীতে আমরা এত রঙের ছড়াছড়ি দেখতে পাই? যেদিকে দু'চোখ যায়, সেদিকেই কেন শুধু রং আর রং? তাছাড়া আমাদের মনের উপরেও যে রঙের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, এবং আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যেও যে রঙের গুরুত্ব অপরিসীম; সেটা কি আদৌও আমরা জানি? কিংবা কখনো কি নিবিষ্ট মনে সেটা ভেবে দেখেছি?
হয়তো হ্যাঁ অথবা না! তবে আপনার উত্তর যাই হোক না কেন, আপনি জানেন অথবা নাইবা জানেন; আজ কিন্তু জানবো! একদম বিস্তারিত ভাবে, এই রং সম্পর্কে! বলতে পারেন এই কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা স্ব-শরীরে নেমে পড়বো রঙের পোস্টমর্টেম করতে! তো পাঠক চলুন, অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভূমিকা শেষ করে এবার মূল লেখার মধ্যে প্রবেশ করি.........!!
রং কিঃ- নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, লাল ফুল, হলুদ দালান- এভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, আসলে আমরা একটা রঙের পৃথিবীতে বাস করছি। আমাদের চার পাশের প্রকৃতিটা বিভিন্ন রঙে রঙে সুশভিত হয়ে আছে। রং কাহাকে বলে (?) কিংবা রং কি (?) এটা সম্পর্কে বোধ হয় আমার বিজ্ঞ পাঠককে আর নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া লাগবে না। কারণ ছোট থেকে বড়, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ রং চেনেনা, এমন কথা বললে মানুষ অবশ্যই হাসবে। কিন্তু তার পরেও রং সম্পর্কিত বিষয়ে খুবই অল্প কথায় বলতে গেলে-
"কোন উৎস হতে নিক্ষিপ্ত আলো যখন বস্তুর উপর পতিত হয়; তখন এর কিছু অংশ বস্তু কর্তৃক শোষিত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ প্রতিফলিত হয়। আর এই প্রতিফলিত আলোই আমাদের চোখে বিভিন্ন রঙের অনুভুতির সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে একেক বস্তুকে আমরা একেক রঙে দেখতে পাই।"
এছাড়াও বাতাসে বাস করে তার অস্তিত্ব যেমন অনুভব করা যায় না, ঠিক তেমনি ভাবে রং-কেও অনুধাবন করতে হলে আমাদেরকে আলোর সাহায্য নিতে হয়। সব থেকে মজার বিষয় হলো, আমাদের চারপাশের বিভিন্ন জিনিসের রং সম্পর্কে খুব কম মানুষ সচেতনভাবে চিন্তা করে থাকে। অথচ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কোনোভাবে না কোনোভাবে রঙের গুরুত্ব রয়েছে। রংহীন পৃথিবীর কল্পনা যেমন করা যায় না, সেভাবে বর্ণহীন চিত্র-ভাবা যায় কি? মূলত বর্ণ বা রং থেকে একটি চিত্রের যাত্রা শুরু। আমরা জানি যে, দর্শকের চোখে শিল্পকলার অন্য উপাদানগুলোর চাইতে রঙের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক। কিন্তু রঙের সৌন্দর্য সম্পর্কে আসলে আমরা কতজনই বা জানি?
রং-কে এক সময় মনে করা হতো বস্তুকে চিহ্নিত করবার উপকরণ। কেননা বস্তুই একটি দৃশ্যমান উপাদান, যার সাহায্যে আমরা রং-কে নির্ণয় করে থাকি। চিত্রকর্মে বহুদিন পর্যন্ত রঙের স্বতন্ত্র সত্তা অপরিহার্য্য হিসাবেই বিদ্যমান ছিলো। রং যে নিজস্ব আভায় একটি অস্তিত্ব বা সুনিশ্চয়তা, সে সম্পর্কে এখনও সকলের ধারণা সু-পরিস্ফুটিত নয়। তাছাড়া চিত্রকর্মের ইতিহাসে দীর্ঘকাল পর্যন্ত রং-কে অলঙ্ককরণের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাঁর ক্রিটিক অব জাজমেন্ট গ্রুপে রং সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসের কথাই বলা হয়েছে ঠিক এভাবে, চিত্রকর্মে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে এবং উদ্যান-সজ্জায়; প্রত্যেকটা গঠন-কৌশল এবং আকৃতিতে রঙের গুরুত্ব অপরিসীম। রঙের সাহায্যে একটা বস্তু ঔজ্জ্বল্য পায় কিন্তু মজার বিষয় হলো রং আকৃতির সৌন্দর্যময়তার একটি অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আধুনিককালের চিত্রকর্মে রংকেই আকৃতির মূলধার বলা হচ্ছে; অর্থাৎ রং অলঙ্করণ নয়, বরং রং-কেই অস্বিত্বের মূল হিসাবে ধরা হচ্ছে।
আমাদের চোখ দিয়ে কিভাবে আমরা রং দেখিঃ- যদি লাল গোলাপ হঠাৎ করে কালো হয়ে যায়? যদি গাছের সবুজ পাতা হয়ে যায় সাদা? শুভ্রতার প্রতীক সাদা রং যদি হয়ে যায় লাল? তাহলে কেমন লাগবে একটু ভাবুন তো? কি হবে ভালোবাসার গোলাপের (?) আর কি-ই বা হবে শুভ্রতার? কি (?) মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তাই না? আসলে পৃথিবীতে যদি এমন কিছু হয় তাহলে সেদিন আসলেই লন্ড-ভন্ড হয়ে যাবে সব কিছু। নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য! লাল গোলাপ হারাবে তার সকল আবেদন, গাছের পাতার বিমুগ্ধতা খুঁজতে গিয়ে বিফল হবে মানুষ! ভাবতেই অবাক লাগে যে, একটু বর্ণ বা রঙের পরিবর্তনের জন্য হয়ে যেতে পারে অনেক কিছু, ঘটে যেতে পারে অনেক ভয়াবহ কিছু। আর সেজন্য সঠিক বস্তুর সঠিক রং হওয়াটা তাই বাঞ্চনীয়। আর সব থেকে আশ্চার্যজনক ব্যাপার হলো, এই রং দেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে- আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্ক।
"আমাদের চোখের যে রেটিনা আছে, সেটা মিলিয়ন মিলিয়ন আলোক সংবেদী কোষ দ্বারা আবৃত। এর কিছু কোষ হচ্ছে রড কোষ, আবার কিছু কোষ হচ্ছে 'কোণ কোষ'। এই আলোক সংবেদী স্নায়ুমুখগুলো আমাদের মস্তিস্কে স্নায়ু উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং অপটিক নার্ভের (দর্শন স্নায়ু) মাধ্যমে মস্তিষ্কের কর্টেক্সে পাঠায়। এভাবেই আসলে আমাদের মাঝে রঙের অনুভূতি সৃষ্টি হয়।"
এই সংক্রান্ত বিষয়ে আরো বিশদ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, রঙ পর্যবেক্ষণের কাজটা মানুষের চোখ এবং মস্তিষ্ক অনেকটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে করে থাকে। আমাদের চোখ এবং মস্তিস্ক একজোট হয়ে আলো-কে ট্রান্সলেট করে রঙে পরিণত করে। চোখের ভেতরে থাকা আলোক সংবেদী কোষ স্নায়ুর মাধ্যমে আমাদের মস্তিস্কে বার্তা প্রেরণ করে থাকে। অর্থাৎ এই আলোক সংবেদী কোষগুলো ডাকঘর এবং স্নায়ুগুলো ডাকপিয়নের মত কাজ করে। ডাকপিয়ন যেমন আমাদের কাছে চিঠি নিয়ে আসলে চিঠি পাবার পর আমাদের যেরকম আবেগের বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি (হাসি বা কান্না ইত্যাদি) সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি ভাবে আলোক সংবেদী স্নায়ু মস্তিস্কে বার্তা প্রেরণ করলে, আমাদের মস্তিস্ক তখন আমাদের মাঝে রঙের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
রঙের বিভাগ বৈচিত্র্য সীমাহীন। কত প্রকার সম্ভাব্য সংমিশ্রণ এবং দীপ্তিগত প্রকাশ যে এর আছে, তা সংক্ষিপ্ত গণনায় নির্ণয় করা যায় না। সুতরাং একজন শিল্পীর রং ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ থাকে এবং চিত্তের সকল প্রকার ইঙ্গিত ও আশ্বাসকে রং-এর সাহায্যে তিনি প্রকাশ করতে পারেন। রং একটি অসাধারণ প্রকাশক্ষম শিল্প উপাদান, যার প্রকাশ-ক্ষমতার প্রাচুর্যের কারণেই এর প্রয়োগবিধি জটিল এবং অনবরত পরিবর্তনশীল। এছাড়া একজন শিল্পী তার কোন দৃষ্টিতে যে রং-কে দেখেন, এবং অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে নিজের আয়ত্তে আনেন, তা নির্ণয় করা আসলেই খুব কঠিন। শিল্পী- সত্তার উপলব্ধির একান্ত নির্জনতায় সত্যকে যেভাবে আবিস্কার করেন, তারই দৃশ্যগত রূপান্তর ঘটে চিত্রকর্মে অা-কুন্ঠ বর্ণবিভার সাহায্যে। রং-এর অপব্যয়ে নয়, বরং এর নিগুঢ়তম পরীক্ষায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যঞ্জনতার একটি যথার্থ প্রয়োগবিধি অনেকে আবিস্কার করবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বিধি প্রকারণের মধ্যে তাকে কখনও আবদ্ধ রাখা সম্ভবপর হয়নি। প্রতিবারই নতুন আবিস্কারের মধ্যেই রঙের নতুন নতুন নির্মাল্য ঘটেছে।
রঙের আবিষ্কার এবং এর প্রকারভেদঃ- রঙের প্রকারভেদ কিংবা এর সরুপ উন্মোচন করতে গেলে সর্বপ্রথমে আমাদের মনে বেশ কিছু প্রশ্নের উঁকি দেয়! যেমন, খুশির দিনগুলোকে আমাদের কাছে কেন এত রঙিন বলে মনে হয়? কিংবা নৈরাশ্যের রং কেন ধূসর হয় অথবা বেদনার রংকে নীল বলে ডাকা হয় কেন? এমন হাজারও প্রশ্ন অহরহ আমাদের মনের কোণে উঁকি-ঝুঁকি দিতে থাকে। তবে এসব প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর রয়েছে মানুষের সংবেদনশীলতা এবং মনোবিকাশ প্রকাশ ক্ষমতার ইতিহাসের মধ্যেই। যারা সেদিকে যেতে রাজি হন না, তারা হয়তো এর দ্বায়ভারটা সম্পর্ণ মানুষের অনুভূতির উপরেই চাপিয়ে দেবেন। তবে সত্যি বলতে এ এমন জিনিস, যা আসলেই পরখ করে দেখা যায় না। আর সেই না দেখার এই শূন্যতাটাই আমরা পূরণ করে থাকি মূলত রঙ দিয়ে। তবে স্পষ্ট করে রঙের ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, প্রকৃত রঙ থাকে প্রকৃতিতে; আর কৃত্রিমগুলো থাকে মূলত পেইন্টের কৌটায়।
আবিষ্কারকঃ- পৃথিবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হলো 'স্যার আইজ্যাক নিউটন'। যাকে আমরা মূলত মহাকর্ষের সূত্র আবিষ্কারক হিসাবেই সব থেকে বেশি চিনি। যিনি তার ব্যক্তি জীবনে বহু ধরনের আবিষ্কার সহ গবেষণা করে বিভিন্ন জিনিসের অদ্ভুদ সব সমাধান বের করেছেন। আমি নিউটনের জীবনী সংক্রান্ত একটা বইয়ে এক সময় পড়েছিলাম, নিউটনকে ছোট বেলা তার ধাত্রীমাতা মৃত ভেবে ভুল করেছিলেন; অথচ পরবর্তিতে তার মা বুঝতে পারেন যে তার সদ্য জন্মানো শিশুটি এখনো জীবিত আছেন। আর নিউটনের এই শৈশবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিখ্যাত মণিষী তার সম্পর্কে ধারনা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন-
"সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় তার সৃষ্টির মঙ্গলার্থেই নিউটনকে শেষ পর্যন্ত জীবনে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন! তা না হলে আমরা আজকের এই আধুনিক রুপী সুন্দর পৃথিবীকে কখনোই দেখতে পেতাম না!"
মজার বিষয় হলো ১৬৬৬ সালে এই আত্মভোলা বিজ্ঞানীই সর্বপ্রথম রং সৃষ্টির তত্ত্ব আবিষ্কার করেন! তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন যে, রং একটা বস্তুর নির্দিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্য নয়। তবে এটা আলাদা কোনো বস্তুও নয়। অনেকের মনে হয়তো এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এটা কি করে সম্ভব? তাহলে আমরা যে আপেলের গায়ের রং লাল দেখি, আসলেই কি তার রং লাল নয়? মানুষের মনের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দেওয়া এই প্রশ্নেরও খুব সুন্দর সমাধান বলে দিয়েছেন যুগের শ্রেষ্ট এই বিজ্ঞানী। তিনি বলেন-
'মূলত বস্তুর পৃষ্ঠ বা তলের উপরে কোন আলো পতিত হলে যদি বস্তুটি সেই আলোর সবটুকু শোষণ করতে সক্ষম হয় অথচ কোন একটা নির্দিষ্ট রং-কে শোষণ করতে না পেরে বরং সেই রংটিকে বাইরে প্রতিফলিত করে দেয়, তাহলে আমরা তখন সেই বস্তুটিকে ঠিক নির্দিষ্ট সেই রঙেই দেখে থাকি।' (উরে কঠিন, এই জিনিসটা বুঝতে গিয়ে আমার নিজেরই প্রায় তিন গ্লাস পানি পান করতে হইছিল, আর সময় লেগেছিল প্রায় আধাঘন্টা)
এখন নিউটন সাহেবের এই থিওরি অনুযায়ী বলা যায় যে, আলোর মধ্যেই আসলে যত রঙের খেলা। তাই আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রঙেরও পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া কোন একটি বস্তুকে যদি একদিক থেকে আর একদিক নাড়ানো হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে রং-ও নড়াচড়া করে। আর এভাবেই রঙের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া আরো ভাল ভাবে বুঝাতে গেলে বলতে হয়, আলোক রশ্মি প্রতিবিম্বিত হলেই মূলত বস্তুতে রং পরিস্ফুটিত হয়। আর আমরা রং তখনই দেখি, যখন বস্তুতে এক বা একাধিক আলোক রশ্মি প্রতিবিম্বিত হয় এবং অবশিষ্ট রশ্মিগুলো শোষিত হয়। যে রশ্মিগুলো শোষিত হয় সেগুলো সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় এবং আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কিন্তু যে আলোক রশ্মি গুলো বস্তুতে আপতিত হয়ে শোষিত হচ্ছে না, অথবা বস্তুর মধ্যদিয়ে বেরিয়ে যেতে পারছে না; তখন সেই আলোক রশ্মিটি তার প্রতিক্ষেপ ঘটাবে অর্থাৎ বস্তু সে রশ্মিকে বিক্ষিপ্ত করবে। এছাড়াও যে কৌণিকরূপে রশ্মি বস্তুর উপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, বস্তুও ঠিক একই কৌণিক পরিমাপে তাকে নিক্ষেপ করবে। অপরদিকে কোনো বস্তুর বহির্দেশ যদি অসমতল থাকে, তবে তা নিস্তেজ বা অনুজ্জ্বল দেখাবে। তার কারণ আপতিত আলো তীক্ষ্ণভাবে প্রতিবিম্বিত না হয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে অর্থাৎ তা বহুকৌণিকতায় বিভক্ত হয়ে তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলে।
এখন হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আমরা একটা আপেলকে যে লাল রঙে দেখি; তাহলে সেই লালটা কি আসলে লাল রং নয়? একদম ঠিক তাই! আসলে আমরা আপেলকে যে লাল রঙে দেখি, কিন্তু সত্যিটা হলো তার মাঝে কোন লাল রং নেই। বরং আপেলের পৃষ্ঠে বা তলে যখন আলো আপতিত হয়, তখন আপেলের পৃষ্ঠটি লাল ব্যতীত অন্যান্য সকল রঙ শোষণ করে নেয়। এবং লাল রঙকে প্রতিফলিত করে দেয়, আর সেজন্যই আমরা আপেলকে মূলত লাল রঙের দেখি। তাছাড়া আমরা এই প্রতিফলিত আলো দেখে ভাবি যে, আপেলটি লাল রঙের। কিন্তু সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, এর মাধ্যমে আমরা আসলে প্রতিনিয়ত খুব বড়সড় রকমের একটা ধোঁকা খাচ্ছি। কেননা আপেল তো লাল রঙের নয়, বরং আপেল শুধুমাত্র লাল রঙকে শোষণ করতে পারছেনা বলেই তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। আর সেজন্যই আমরা আপেলকে আমাদের চোখের সামনে ধরলে লাল রঙের দেখি। (কি (?) মাথার উপ্রে দিয়া গেল, না নিচ দিয়া গেল বুঝতাছেন না তাইতো? তাহলে আসুন আর একটু সহজ ভাবে চিন্তা করে দেখি, নিউটন সাহেব আসলে কি বলতে চেয়েছেন!)
এছাড়াও তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে একদম হাতে কলমে দেখিয়ে দেন, যখন পরিপূর্ণ সাদা আলো একটি স্বচ্ছ প্রিজমের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এর ভেতরে থাকা প্রতিটি রং-কে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যায়। তাছাড়া প্রতিটি রং একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যর (মধ্যবর্তী ব্যবধান) হয়ে থাকে, যাকে এর চেয়ে বেশি ভাগ করা যায় না। অবশ্য এরপরের গবেষণা থেকে জানা যায়, একাধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যর আলো মিশিয়ে কোনো নির্দিষ্ট একটি রং তৈরি করা যায়। যেমন, 'লালের সঙ্গে হলুদ মেশালে পাওয়া যায় কমলা রঙ; নীলের সাথে হলুদ মেশালে হয় সবুজ; আবার কালোর সাথে লাল মেশালে হয় খয়েরি।' এ তো গেল তত্ত্ব কথা! তবে আসলেই, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে রং অবিচ্ছেদ্য হিসাবে ছিল প্রায় সব সময়ই। উহাদরণ টানতে গেলে বলতে হয়, প্রকৃতি যেখানে; কোনো না কোনো রং সেখানে থাকবেই।
এমনকি প্রাচীনকালে চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও ব্যবহৃত হতো রং। বিশেষ করে মিসর ও চীনে। সেখানকার চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন, রং স্নায়ু ও শরীরকে উদ্দীপ্ত করে এবং রক্তসঞ্চালন বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। তবে এ কাজে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন লাল রং-কে। আর ব্যাথা কমাতে এবং অসুস্থতার উপশমে ব্যবহৃত হতো নীল রং। হলুদ তাদের কাছে ছিল স্নায়ু উত্তেজক এবং শরীর শুদ্ধিকারক। বলবর্ধক এবং ফুসফুসের আরোগ্যের জন্য ব্যবহৃত হতো কমলা রং। মজার বিষয় হলো, লাল রঙের প্রভাব যেখানে অনেকটাই শারীরিক; সেখানে নীল রঙের প্রভাব মানসিক। তাছাড়া লালচে আভাযুক্ত রঙগুলোকে বলা হয় উষ্ণ রং। যেমন- কমলা, হলুদ, খয়েরি ও লাল। আবার নীল আভাযুক্ত রঙগুলোকে বলা হয় শীতল রং। যেমন- বেগুনি, সবুজ ও আকাশি ইত্যাদি।
প্রকারভেদঃ- রঙের প্রকারভেদ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করার আগে আমি আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। ঘাবড়াবেন না, খুবই সহজ প্রশ্ন! আচ্ছা আপনাকে যদি বলা হয় যে, বলেন তো এই পৃথিবীতে আপনি সর্বমোট কতপ্রকারের রং দেখেছেন? তাহলে আপনি কি উত্তর দেবেন? কিংবা আপনি কি আসলেই জানেন, পৃথিবীতে রং মোট কয়টি?
আপনার রঙের পেন্সিল বক্স খুলে দেখলে হয়তো সেখানে ০৬টি, ১২টি অথবা সর্বোচ্চ ২৪টি নানা রকমের রং দেখতে পাবেন। কিন্তু আসলেই এই পৃথিবীতে মোট কয়টি রং আছে, সেটা কি আপনি জানেন? বলছি! তবে তারও আগে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে নিই! কোন বাচ্চাকে এই রঙের প্রকারভেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো সে- লাল, নীল, কমলা, হলুদ ইত্যাদি আরও কয়েকটি রঙের নাম বলতে পারবে। আবার ঠিক একই প্রশ্নটা যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে হয়তো উপরোল্লেখিত রং ছাড়াও বাড়তি হিসাবে বেগুণী, ফিরোজা, বাদামী, খয়েরি এই ধরণের আরও কয়েকটা রঙের নাম আপনি বলতে পারবেন।
কিন্তু খুবই মজার এবং অত্যন্ত আশ্চার্যজনক বিষয় হলো, আমাদের এই চোখই প্রায় ১০ মিলিয়ন রঙকে খুবই সাবলিল ভঙ্গীমায় পৃথক পৃথকভাবে সনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও শুনলে আরো আশ্চার্য হবেন যে, এদিক থেকে সব থেকে বেশি এগিয়ে আছে মেয়েরা। কি (?) মেয়েদের কথা শুনে খুব হিংসা হচ্ছে তাই তো? তবে আপনি হিংসা করনে আর যাই করেন, ঘটনা কিন্তু সত্যি! একটা মেয়ের সামনে, তাই সেই মেয়েটা যে বয়সেরই হোক না কেন (আবার প্রতিবন্ধী কাওরে ধরে কইয়েন না), কোন অপরিচিত রঙের একটা জিনিস যেটা সে এর আগে কখনো দেখেনি; ধরে পরীক্ষামূলক ভাবে জিজ্ঞাসা করেন যে ওটা কি রং? দেখবেন সে অবলিলাক্রমে সেই রংটার নাম বলে দিতে পারবে! এটা সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে মেয়েদের জন্য একটা অতিরিক্ত পাওনাও বলতে পারেন, যেটা সে জন্মগত ভাবেই পেয়ে থাকে! (হাউ চুইট)
তবে রঙের এই বহুল প্রকারভেদ থাকলেও আমরা কেবল অল্প কিছু রঙেরই মূলত নামকরণ করতে পেরেছি। কেননা পৃথিবীতে এত এত প্রকারের রং আছে যে, সেগুলোর নাম দেওয়া বিজ্ঞানীদের পক্ষে আদৌও সম্ভব নয়। আর তাই বিজ্ঞানীরা প্রত্যেক রঙকে পৃথক করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন সংখ্যা এবং কোডের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া রঙের আরও ভেরিয়েশনের জন্য তারা কয়েকটি কালার মডেল প্রবর্তন করেছেন। কেননা, শুধুমাত্র লাল, সবুজ, নীল রং (RGB Color) দিয়ে একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জের বা সীমার রঙ তৈরি করা সম্ভব। এছাড়াও আমরা বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি (কম্পিউটার, টেলিভিশন, প্রিন্টার ইত্যাদি) ব্যবহার করি, তার জন্য আরও অনেক বেশি রঙের ভেরিয়েশনের প্রয়োজন হয়।
তাই, CMY (Cyan, Magneta, Yellow) কালার মডেলের রঙগুলোকে বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে আরও প্রচুর রঙ তৈরি করতে পারি। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলে বলতে হয়, আধুনিক যুগের অন্যতম আবিষ্কার প্রিন্টার; এই কালার মডেল ব্যবহার করেই মূলত ছবি প্রিন্ট করে।
"এবার ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে! আধুনিক বিজ্ঞানীরা রং-কে মূলত দুইভাগে ভাগ করেছেন। যার মধ্যে একটি হলো মৌলিক রং এবং অপরটি হলো যৌগিক রং।"
মৌলিক রঙঃ- মৌলিক রং বলতে আমরা সবাই বুঝি- 'লাল, সবুজ এবং নীল (RGB)' রং-কে। পৃথিবীর আর যাবতীয় লক্ষ লক্ষ প্রকারের রঙের সবই এই তিন রং হতে তৈরি হয় বা করা সম্ভব। সেই প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত দর্শনযোগ্য সব ( টিভি, ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, এল.সি.ডি স্ক্রিন, এল.ই.ডি টিভি) মাধ্যমই তার রং দেখানোর ক্ষেত্রে এই RGB সম্পর্কিত তত্ত্বটি অনুসরণ করে যাচ্ছে এবং যাবে। তবে ব্যতিক্রম শুধু ছাপাখানার বর্ণীয় ফর্মূলা ( যেখানে ছাপাখানার মূল রং হলো- CMYK)। এছাড়াও সহজ পদ্ধতীতে উচ্চারণ বা মনে রাখার ক্ষেত্রে কেউ কেউ এই মৌলিক রঙগুলোকে সংক্ষেপে 'আসল' অর্থাৎ- আসমানী (নীল), সবুজ এবং লাল বলে সম্বোধন করে থাকেন।
তবে আপনি যদি চিত্রশিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তখন মৌলিক রং হিসেবে 'লাল, হলুদ এবং নীল'কেই কেবল পাবেন। সেক্ষেত্রে সবুজ একটি যৌগিক রঙ। তবে সাধারণত আমরা যে স্ট্যান্ডার্ডে রঙের বিচার করি, তাতে লাল, নীল এবং সবুজকেই মৌলিক রং হিসেবে বলতে পারি। এই অবমিশ্রিত তিনটি রং-কে আবার প্রাথমিক রং-ও বলা হয়। কেননা আগেই বলেছি, পৃথিবীর আর সব রং মূলত এই তিনটি রঙের বিভিন্ন সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়।
যৌগিক রঙঃ- আবার এই মৌলিক রং তিনটির যে কোনো দু'টির সংমিশ্রণেই সেকেন্ডারি রঙের সৃষ্টি হয়। সেকেন্ডারি বা দ্বৈত পর্যায়ের রং হচ্ছে- 'কমলা=(হলুদ+লাল), বেগুনী=(লাল+নীল), সবুজ=(নীল+হলুদ)' ইত্যাদি। তাছাড়া মিশ্রণ ঘটিত ঘনত্বের তারতম্যে এবং দু’টি রঙের পারস্পরিক অনুপাতের তারতম্যের কারণে সেকেন্ডারি রঙেরও আবার বিভিন্ন বিচিত্র বিভাজন ঘটানো যায়। যেমন- সবুজ রংটি নীলের কাছাকাছি হতে পারে, আবার হয়তো হলুদের কাছাকাছিও আসতে পারে। তবে খাঁটি সবুজ বলতে মূলত নীল-হলুদের মাঝামাঝি রংকেই বুঝায়। এছাড়াও এই লাল, নীল এবং সবুজ রং-কে সমান অনুপাতে মিশিয়ে আমরা শুভ্র বা সাদা রং পেতে পারি। কেননা কোন বস্তুতে যখন সবকটি রঙের প্রতিক্ষেপ ঘটে, তখনই কেবল তা সাদা দেখায়। অপরপক্ষে কোন বস্তু যখন সবকটি রংকে একসঙ্গে শোষণ করে নেয়, তখন তা কালো দেখায়। কারণ শোষণের ফলে আলোর অভাব ঘটে, তাই কালো হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্ধকার। আর এই তিনটি মৌলিক রঙের সংমিশ্রনে অন্যান্য বর্ণালী যে সমস্থ রঙের উৎপত্তি হয়, সেগুলোকেই বলা হয় যৌগিক রং।
এছাড়াও যৌগিক রঙয়ের আরো বহু প্রকারের কার্য কারণ আছে। উদাহরণ সরুপ বলা যায়- রং নিজে কথা বলতে পারে না, তবে মানুষের গোপন অনুভূতিকে কিন্তু সে সহজেই নাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন- উষ্ণতা বা শীতলতা, গতির সঞ্চার বা স্থবিরতা, আনন্দ বা বিষাদ, অবাক বা বীভৎসতা, পৌরুষ্য বা নারীত্ব এরকম অনেক কিছুই শুধু রঙের মাধ্যমেই প্রকাশ করা যায়। আসুন এই বিষয়টি আমরা আরও কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে দেখিঃ-
(ক) সাধারণভাবে হলুদকে একটি উষ্ণ রং বলা হয়। শিল্পে হলুদ রং রৌদ্রলোক, উজ্জ্বলতা, আলো এবং আনন্দের প্রকাশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(খ) সবুজ অন্যান্য রঙের তুলনায় অনেক বেশী স্থিরতা এবং প্রশান্তির ভাব প্রকাশ করে। এর রং প্রকৃতির সাথে সরাসরি জড়িত।
(গ) উত্তেজনাকর অনুভূতির প্রায় সবকিছু্ই লাল রঙে পাওয়া যায়। লাল রং প্রাণ-প্রাচুর্য আর আগুনের উষ্ণতায় পরিপূর্ণ। এই রংটাকেই মূলত পৌরষ্য এবং নারীত্বের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়।
(ঘ) কমলা রঙে, হলুদ রঙের আনন্দ আর লাল রঙের উষ্ণতার সংমিশ্রণ ঘটেছে।
(ঙ) বেগুনী রঙে, সাথে একটা বেশ গম্ভীর এবং মর্যাদাব্যঞ্জক ভাব আছে। তবে অপরদিকে চিত্রকলায় সাদা, কালো এবং ধূসর বর্ণকে রং হিসেবে উল্লেখ করা হয় না।
রঙের বৈশিষ্টঃ- আধুনিক কালে চিত্রকর্মে রংকেই আকৃতির মূলধারা বলা হয়। অর্থাৎ রং অলঙ্করণ নয়, বরং রং-ই অস্তিত্বের মূল। রং সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক কুপকা বলেন, 'আমরা যখন রুটির কথা বলি, তখন সাদা অথবা কালো রংটি চোখের সামনে ভাসে। মদের রং এবং তেলের রং-ও সাদা। হলুদ হচ্ছে লেবুর রং, এবং দেহপসারিণীদের দোকানঘরের চিহ্ণও ছিল এই রং। আবার হলুদ, এককালে রোমক সম্রাটদের প্রিয় রং ছিল, তেমনি ছিল চীন সম্রাটদেরও। এছাড়া মিসরে হলুদ ছিল দুঃখ প্রকাশের রং। বেগুনী ছিল আবেগ এবং বিনয় মর্যাদার রং। তাই বিশপদের গাত্রাবরণ বেগুনী। আর সবুজ হচ্ছে উচ্ছল প্রান্তরের রং, অর্থাৎ সজীবতা এবং ফলবানতার রং হলো সবুজ।'
আমাদের বিভিন্ন অনুভূতিকে আমরা যেমন কবিতায় উপমা বা রূপকের সাহায্যে প্রকাশ করে থাকি, ঠিক তেমনিভাবে চিত্রকর্মে প্রকাশ করে থাকি রঙের সাহায্যে। লোকেরা হয়তো স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রথার কারণে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন রঙের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, এশিয়ার কিছু লোকের কাছে লাল রং সৌভাগ্য ও আনন্দোৎসবের প্রতীক, কিন্তু আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে লাল রং হচ্ছে শোকের চিহ্ন। তবে মানুষ যে-পরিবেশেই বড় হোক না কেন, নির্দিষ্ট কিছু রং সব মানুষের আবেগকে একইভাবে নাড়া দিয়ে থাকে। এখন আপনি বুঝতে পারেন বা না-ই পারেন, কিংবা মানেন অথবা নাইবা মানেন, বিজ্ঞাপনদাতারা সতর্কতার সঙ্গে এমন সব রং আর রঙের সমাহার বাছাই করে থাকে; যাতে সেটা আপনার সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী- লিঙ্গভেদে এবং আপনার বয়সি লোকেদের কাছে আকর্ষণীয় হয়। যেমন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার (যে-ব্যক্তি ঘরের ভিতরের সাজসজ্জার কাজ করে থাকেন), পোশাকের ডিজাইনার এবং চিত্রশিল্পীরাও জানে যে, রং আবেগকে নাড়া দিতে পারে।
গ্রাফিক্স ডিজাইনে রঙের ব্যবহার এবং এর সাইক্লোজিক্যাল ফ্যাক্টঃ- সহজাত ভাবেই আমাদের মন রঙের প্রতি সংবেদনশীল। নন-ভার্বাল কমিউনিকেশনেও রং আমাদের চিন্তা ও আবেগকে খুব সহজে নাড়া দিতে পারে। তাই কোনো ডিজাইনের ক্ষেত্রে যে গোপন অর্থ বহন করে, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে নিতে রং আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, রং একটি পাওয়ারফুল কমিউনিকেশন টুল। শুধুমাত্র কালার ইফেক্টের ব্যবহার মানুষের মাঝে কেনাকাটার মত অভ্যাসেও বিস্তর পরিবর্তন আনতে পারে। শুনলে হয়ত অবাক হবেন, কিছু রং মানুষের ব্লাডপ্রেসার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি অনলাইন শপিং, এডভার্টাইজিং, মার্কেটিং এবং ক্যাম্পেইন সহ প্রায় ৮০ভাগ ক্ষেত্রে, ক্রেতার আকর্ষণ বাড়াতে রঙের ব্যবহারকে বেশ উল্লেখযোগ্য হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। তাই নন-ভার্বাল কমিউনিকেশনে যে পার্টগুলো গ্রাফিক ডিজাইনাররা ব্যবহার করে থাকেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হলো কালার বা রং। এ জন্যেই সঠিকভাবে জেনে রঙের ব্যবহার করা ফটোগ্রাফার, গ্রাফিক্স ও ওয়েব ডিজাইনারদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
মানুষের প্রিয় রং সেটিই, যা তাকে সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত এবং উদ্দীপ্ত করে তোলে। প্রায়শই পোশাকে, অফিসে, বাড়ির সাজে ইত্যাদী যে কোন কাজে সেই প্রিয় রঙের প্রভাবই সব থেকে বেশি নজরে আসে। তবে এটি মানসিক অবস্থার ওপরও নির্ভরশীল। একেক মানসিক অবস্থায় একেক রঙ আমাদের আকর্ষণ করতে পারে। প্রিয় রং তাই পাল্টাতে পারে যেকোনো সময়ই। উদাহরণ সরুপ বলা যায়, আজ লাল ভালো লাগছে বলে কিছুদিন পর যে সবুজ ভালো লাগবে না, এমন কিন্তু নয়।
এছাড়াও ইন্টেরিয়র ডিজাইনে কালার সাইকোলজি সব থেকে বেশি কাজ করে। মানুষ কখনোই কালো রঙে তার বাড়ি সাজায় না। বরং তার বিপরিত সাদা রঙে চোখ একধরনের আরাম পায় বলেই বেশির ভাগ বাড়ির ভেতরের দেয়ালের রং হয় এটাই। তবে সেক্ষেত্রেও এই ব্যাপার কিছুটা ব্যক্তির রুচি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং ভৌগোলিক পরিবেশের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। বাড়ির ভেতরের রঙ, আসবাব কিংবা দেয়ালের পর্দা- সবই এগুলোকে ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়। আবার বলা হয় কোনো রঙ সম্পর্কে যদি কারও খুব বিতৃষ্ণা থাকে, তাহলে এটি তার অতীতের অপছন্দনীয় কোনো অভিজ্ঞতা ও দুর্বল মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। সে কারণেই সে রঙ তাকে স্বস্তি দেয় না, বরং মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে।
গ্রাফিক্স ডিজাইনের ক্ষেত্রে রং-কে ঠিক এভাবেই ভাগ করা হয়ঃ-
(১) First Order Colors, (২) Second Order Colors, এবং (৩) Third-Order Colors!
☞ First Order Colors- এই রঙ গুলি হলো Red, Yellow, blue (লাল, হলুদ এবং নীল)। এবং এই রং গুলি অন্য কোন রং-এর সংমিশ্রনে তৈরী করা যায় না।
☞ Second Order Colors- লাল, হলুদ এবং নীল এই তিন রঙের সংমিশ্রনে যে রং তৈরী করা হয় তাকে Second Order Colors বলা হয়। যেমন-কমলা, সবুজ, বেগুনী।
☞ Third-Order Colors- যা First Order Colors এবং Second Order Colors এর সংমিশ্রনে তৈরী করা হয়।
তবে গ্রাফিক্স ডিজাইনে রং নিয়ে খেলা করতে চাইলে আরও কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া লাগবে। সেগুলো হচ্ছে-
(১) Complementary Colors, (২) Simultaneous Contrast, (৩) Complementary Ratios, এবং (৪) Harmonizing Colors.
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বিবেচনায় পছন্দের রং পরিবর্তনঃ- ছেলেবেলা প্রায় প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট পছন্দের রং থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তনও ঘটে। এটি ওই সময়ে তার চাহিদার ওপর নির্ভর করে। বলা হয় কিছুদিনের জন্য অন্য রং আকর্ষণ করলেও, সেই নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণ হবার পর আবার আগের সেই আসল প্রিয় রঙে ফিরে আসে সবাই। তবে এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, কোনো জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার সূত্রেই মূলত এমনটা ঘটতে পারে। যেমন আমাদের আশে-আশেই এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের কাছে কিছু বিশেষ জায়গার প্রতি বেশ বিরক্তি কাজ করে। তাছাড়া আবার কিছু জায়গায় বেশ ভাল প্রশান্তি পাওয়া যায় এবং মনের জোরও বাড়ে। আর এর পেছনেও কিন্তু রয়েছে সেখানকার রং-এর প্রভাব।
শিল্পী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, আর্ট থেরাপিস্ট সহ এই জাতীয় ব্যক্তিরা এই বিষয়গুলোকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। তবে মজার বিষয় হলো, রঙের এই প্রভাব নিয়ন্ত্রণও কিন্তু নিজের হাতেই থাকে। অবচেতনে বিভিন্ন রঙে নিজের আবেগ-অনুভূতিকে রাঙালেও, রং-মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী, দৈনন্দিন জীবনে সচেতনভাবে রঙের প্রভাব চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন দেয়ালে রঙ করার সময়, পেইন্টিং চেঞ্জের সময় বা নতুন করে ঘর সাজানোর সময় একটু ভেবে নিলেই হয়; কোন রঙগুলো এনার্জি দেয়, কোন রঙ মেজাজ নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে এবং মনে প্রশান্তির সৃষ্টি করে। আগেই বলা হয়েছে, বিপণন ও বিজ্ঞাপন সংস্থা বিভিন্ন উপায়ে রঙমনস্তত্ত্ব ব্যবহার করে। কিছু কোম্পানি এ নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণাও করে এবং সে অনুযায়ী তাদের প্রডাক্টেও তদ্রুত রং ব্যবহার করে থাকে। যেমন, চিপসের প্যাকেট বেশির ভাগ লাল রঙের হয়, আর মেয়েদের প্রডাক্টে গোলাপি রঙের আধিক্য থাকে। কেননা রঙিন প্যাকেটগুলোই ক্রেতাদের ওই পণ্য ক্রয়ে সব থেকে বেশি উৎসাহ জোগায় এবং অনেকটা চুম্বকের মতো টানে। তবে বয়স, লিঙ্গ, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি অনুযায়ী রঙের ব্যাখ্যা, বৈচিত্র্য, অর্থ, উপলব্ধি ও প্রভাব হয় বিচিত্র। আর এই কারণেই উৎসবের পোশাক, শোকের প্রতীক, দেয়ালের রং এর সবই এক এক দেশে এক এক রকমের হয়ে থকে। যেমন, লাল রঙের কথাই না হয় ধরা যাক!
আমাদের দেশে বিয়েতে লাল রং পরা হয়। কারণ, আমাদের দেশে এটিকে রোম্যান্টিক রং হিসেবে ধরে নেয়া হয়। পাশাপাশি এ রং অন্যকে আকর্ষিত ও উত্তেজিত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু প্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশে লাল মানেই বিপজ্জনক। যেকোনো ভয়ংকর অর্থ বোঝাতে বা কোনো কিছুর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য তারা এই রং ব্যবহার করে থাকে। বরং তাদের কাছে পবিত্রতা, ভালোবাসা এবং সরলতার রং হলো সাদা। সাদা দিয়ে তারা ভার্জিনিটিও প্রকাশ করে। তাই তাদের বিয়ের পোশাক হয় সাদা।
আবার আমাদের এখানে শোক প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে সাদা। তাই বিধবারা এ রঙের পোশাক পরে। তবে সাদাকে আমাদের এখানেও শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এটি এমন একটি রং, যেখানে সব রঙের সংমিশ্রণ থাকে। এছাড়াও এটিকে আভিজাত্য প্রকাশের একটা উপায় হিসেবেও দেখা হয়। সে কারণে সেলিব্রিটিদের বেশির ভাগ পোশাকের রঙই হয় সাদা। তবে বাইরে শোক প্রকাশের রং হচ্ছে কালো। এ রঙটিকে তারা একটা রঙহীন রং বলে থাকে। অর্থাৎ কালো মানে হচ্ছে যেটিতে কোনো রঙের উপস্থিতি নেই। তাই কেউ মারা গেলে সেখানে কালো রঙের পোশাক পরা হয়। যার মানে হচ্ছে, মৃত্যুতে সবকিছু বিবর্ণ হয়ে গেছে।
মজার ব্যাপার হলো, কালো কিন্তু গর্জাসও। যেকোনো জমকালো পোশাক হিসেবে কালো পরা হয়, বিশেষ করে রাতে। তবে অপরপক্ষে হলুদ হচ্ছে এনার্জেটিক রং। এটাকে আবার কম্যুনিকেটিভ রং-ও বলা হয়। আমাদের হলুদ পোশাক পরার একটা অর্থ হচ্ছে, নতুন আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে। বলা হয় বিজনেস পারসনরা এটি পরলে, অন্যের সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজ হয়। হলুদের মাধ্যমে এনথুজিয়াজমও বোঝানো হয়। অরেঞ্জ বা কমলা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের রঙ। উৎফুল্ল ও আত্মবিশ্বাসীরা এ রঙ পরতে ভালোবাসেন। আবার নীলকে ভালোবাসার রঙ বলা হলেও এটি কিন্তু বেদনা প্রকাশের অর্থেও বোঝানো হয়ে থাকে। ব্লু মানে রোম্যান্টিকও। নীল আলোর সংমিশ্রণে সেখানে রোম্যান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তবে কর্তৃত্ব এবং আভিজাত্য প্রকাশে সাহায্য করে রয়েল ব্লু। এছাড়াও প্রতিটি কোম্পানিই রঙের সঙ্গে মানুষের অনুভূতির সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চায়। যেমন, গ্রামীণফোন মানেই হলো নীল রং আর বাংলালিংক হলো কমলা। দুটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও এর উপস্থিতি রয়েছে। একটি শান্তি আর সৌহার্দ্যের কথা শোনায়, আর অন্যটি উষ্ণতার সন্ধান দেয়। আসলে রঙের অর্থ যা-ই হোক, এটি যে আমাদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মনের উপরে রঙের প্রভাবঃ- রঙের ব্যবহার যেহেতু মানুষের মনের উপরেও প্রভাব বিস্তার করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে, তাই কালার ইফেক্টের কিছু সর্বজনীন অর্থও রয়েছে। মানুষের মানসিকতায়, জীবন-যাপনে, আধ্যাত্মিক কর্মে সহ প্রায় সব জায়গাতেই রঙের প্রভাব বিস্তর। একেকটি রঙ একেকভাবে প্রভাবিত করে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনকে। বিভিন্ন রং আমাদের মনে বিভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। তাই রং এবং এর ব্যবহারে হতে হয় সতর্ক।
রং নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন আর্টিস্টরা। যেমন পাবলো পিকাসোর ছবিতে রং হয়ে উঠেছে সময়ের নির্দেশক। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত পিকাসো যে মনোক্রোম বা একরঙা ছবিটি এঁকেছিলেন নীল রঙকে প্রাধান্য দিয়ে, সেটিকে বলা হয় 'ব্লু পিরিয়ড'। আর এই ছবিগুলো হলো বিষন্নতা জ্ঞাপক শুধুমাত্র এই নীল রঙের বারলেই। তবে ১৯০৪ থেকে ১৯০৬ সাল- এই সময়ের ছবিগুলো কিন্তু ঠিক তার উল্টো। এবং এটি 'রোজ পিরিয়ড' নামে খ্যাত। আর এখানেও গোলাপি রঙের আধিক্যের কারণেই। তবে এ পিরিয়ডের ছবিগুলো প্রাণবন্ত বা বিষন্নতার আভাস থাকলেও তা প্রাধান্য পায়নি কোথাও। বরং গোলাপি রঙ ঢেকে দিয়েছে পুরো বিষন্নতাকে।
কালার সাইকোলজি বা রং-মনোবিজ্ঞান নামে একটি বিষয় আছে। যা কোন রং আমাদের আবেগ, অনুভূতি ও আচরণে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা ব্যাখ্যা করে। এই শাস্ত্রের মূলকথা, রঙের মাঝে জীবনের সব ক'টি দিকই দেখতে পায় মানুষ। আর মাত্র দু'টি স্তর নিয়েই এটি কাজ করে। প্রথম স্তরে সাধারণত ১১টি মৌলিক রঙ থাকে, যেগুলো মানসিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। এছাড়াও এর প্রতিটিতে সম্ভাব্য ইতিবাচক বা নেতিবাচক মানসিক প্রভাবও বিদ্যমান। তবে গভীরভাবে রঙের সমন্বয় বা সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে রং-মনোবিজ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর। আর তাদের ধারনা, কোনো রঙেরই ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব নির্দিষ্ট নয়। যেমন. মরু অঞ্চলের মানুষ খুব কালারফুল পোশাক পছন্দ করে। কারণ, তারা উষ্ণ এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু গ্রামের দিকে, যেখানে প্রকৃতি সব সময়ই নানা রঙে রঞ্জিত হয়ে আছে, সেখানে মানুষের পছন্দ অপেক্ষাকৃত ধূসর রঙ। আর এর কারণ হিসাবে বলা হয়, আশপাশে এত রঙ বলেই হয়তো তারা পোশাকে এই রঙের প্রয়োজনকে অনুভব করে না। তো পাঠক, আসুন আর দেরি না করে আমরা এবার মানুষের মনে কোন রং কেমন প্রভাব সৃষ্টি করে সেটা জেনে নিইঃ-
=> সাদাঃ- শুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে সাদা রঙের ব্যবহার বিশ্বজনীন। এছাড়াও সাদা রংকে প্রায়ই আলো, নিরাপত্তা ও শুচিতার প্রতীক বলে মনে করা হয়। এই রং সততা, নির্দোষ অবস্থা ও পবিত্রতার মতো গুণের সঙ্গেও জড়িত। বাইবেলে অনেক বার সাদা রঙের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দর্শনে, মানুষ এবং স্বর্গদূতদের শুক্ল বর্ণ বা সাদা রঙের বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। আর এটা ধার্মিকতা ও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে শুচি থাকার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। সাদা রঙের ঘোড়ার ওপর শ্বেত বা সাদা ও শুচি মসিনা বস্ত্র পরিহিত আরোহী, ধার্মিকতার পক্ষে যুদ্ধকে চিত্রিত করে। এছাড়াও বাইবেলে উল্লেখ আছে, "তোমাদের পাপ সকল সিন্দূরবর্ণ হইলেও হিমের ন্যায় শুক্লবর্ণ হইবে; লাক্ষার ন্যায় রাঙ্গা হইলেও মেষলোমের ন্যায় হইবে।" —যিশাইয় ১:১৮।
ডিজাইনে এই রংটি সাধারণত রিভার্সড টেক্সট কিংবা নেগেটিভ স্পেসিং-এও বেশী ব্যবহৃত হয়। মানুষের মনে সাদা রং সাধারণত যে ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- পরিচ্ছন্নতা, সত্যনিষ্ঠ, শান্তি, শুদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সরলতা নির্দোষিতা এবং পবিত্রতা।
☞ নেতিবাচকঃ- শূন্যতা এবং উদাসীনতা।
=> কালোঃ- সাদার পরই যে রঙের কথা আসে সেটা হলো কালো। কালো সাধারণ কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী একটি রং হিসাবে বিবেচিত। সম্পদশালী এবং সুরুচিপূর্ণতাকে যেমন তুলে ধরে তেমনি অশুভ, ভয় এবং বিষন্ন ভাবের প্রতিকৃতি মনে জাগিয়ে তোলে। আবার এর শৈল্পিক ব্যবহার মনে এমন একটি প্রতিরক্ষামূলক বাধা সৃষ্টি করে, যেন মনে হবে আপনার দিকে আসা সকল অপশক্তিকে শুষে নিচ্ছে। সাধারণত কালো রং মানুষের মনে যে ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- বোল্ডনেস, কর্তৃত্ব, বিশুদ্ধতা, নিয়মানুগত্য এবং রহস্য।
☞ নেতিবাচকঃ- ভয়, নিপীড়ন এবং উদাসীনতা।
=> সবুজঃ- নতুন জীবন এবং নতুনের মত করা বোঝাতে সবুজ রঙের ব্যবহার উল্লেখ করার মত। সবুজ রং মনে যেমন প্রশান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য জাগিয়ে তোলে, তেমনি অপরিপক্বতাকেও তুলে ধরে। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানির লোগোতে এই রঙের ব্যবহার চোখে পড়ে, বিশেষত যারা নিজেদের ইকো-ফ্রেন্ডলি হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। এনিমেল প্ল্যানেটচ্যানেলের লোগোটি এর বড় উদাহরণ। সাধারণত সবুজ রঙ মানুষের মনে যে ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- টাটকা, প্রাকৃতিক, ছন্দ, সুস্বাস্থ্য, নিরাময় এবং সজিবতা।
☞ নেতিবাচকঃ- কোমলত্ব এবং একঘেয়েমী।
=> লালঃ- সবচেয়ে লম্বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের হওয়ায় লাল বেশ শক্তিশালী একটি রং। তাই খুব দূর থেকেও এটি বেশ ভাল রকম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। লাল রঙের এই ধর্মের কারণেই ট্রাফিক লাইটে এর ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। লাল এমন একটি গাঢ় রং, যা মানুষের মনে ভালবাসার মত তীব্র আবেগ জাগানো থেকে শুরু করে; ব্লাডপ্রেসার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও লোগো ডিজাইনে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে লাল রং বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও মূল ভাষার বাইবেলে 'লাল' হিসাবে অনুবাদিত ইব্রীয় শব্দটা, এমন একটা শব্দ থেকে এসেছে, যেটার অর্থ হচ্ছে 'রক্ত'। বাইবেলে বেগুনিয়া ও সিন্দূর বর্ণ বস্ত্র পরিহিতা এক নিষ্ঠুর বেশ্যার লক্ষণীয় চিত্র বর্ণনা করার জন্য টকটকে লাল রং বা সিন্দূর বর্ণ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে,সেই বেশ্যা "সিন্দূরবর্ণ পশুর উপরে বসিয়া আছে; সেই পশু ধর্ম্মনিন্দার নামে পরিপূর্ণ" —প্রকাশিত বাক্য ১৭:১-৬। সাধারণত লাল রং মানুষের মনে যে ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- সাহসিকতা, প্রবলতা, উষ্ণতা, শক্তি, ফাইট অর ফ্লাইট, উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা।
☞ নেতিবাচকঃ- আক্রমণাত্মকতা, আগ্রাসন, মানসিক চাপ সৃষ্টি।
=> নীলঃ- নীলের সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট লালের ঠিক উল্টো। কারণ লাল রং কাজ করে ফিজিক্যালি, আর নীল রং কাজ করে মেন্টালি। নীল রং খুব সহজেই মনের মাঝে শান্ত করার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। বেশীর ভাগ মানুষেই একটা ব্যাপারে একমত যে, ডিজাইনে অন্তত একটা নীল শেড থাকলেও সেটা তাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। বেশীর ভাগ মানুষের প্রিয় রং নীল, তাই নীল রংকে বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রিয় রং বলা হয়। এমনকি রিসার্চেও এটা প্রমাণিত হয়েছে। নীল রং মানুষের মনে যে ধরনের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- বুদ্ধিদীপ্ততা, যোগাযোগ দক্ষতা, প্রশান্ত ভাব, আস্থা, প্রত্যয়, নির্মলতা এবং বিশ্বাস।
☞ নেতিবাচকঃ- নির্লিপ্ততা এবং আবেগশূন্যতা।
=> হলুদঃ- অত্যন্ত দৃষ্টিগোচর একটি রং এবং দেখার জন্য সব থেকে সহজতম রং হলো হলুদ। তাই এই রং খুব সহজেই মানুষের মাঝে উদ্দীপনা জাগাতে পারে। হলুদ রঙের সঠিক ব্যবহার আমাদের মনে যেমন প্রফুল্লতা এবং আত্মসম্মানবোধকে জাগিয়ে তোলে, ঠিক তেমনি ভাবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার ভয় এবং উদ্বিগ্নতাকেও জাগিয়ে তুলতে পারে। মানুষের মনে হলুদ রং যে ধরনের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- আত্মমর্যাদা, বুদ্ধিদীপ্ততা, আগ্রহ, আনন্দ, ইতিবাচকতা এবং সূর্যোদয়।
☞ নেতিবাচকঃ- নির্লিপ্ততা এবং আবেগশূন্যতা।
=> বাদামীঃ- লাল, হলুদ এবং কালোর সমন্বয়ে গঠিত হয় বাদামী রং। এর ফলে বাদামী রং মস্তিষ্কে কালো রঙের মতই প্রভাব ফেলে। কিন্তু এটি তুলনামূলকভাবে উষ্ণ এবং কোমলতার অনুভূতি জাগায়। বাদামী রংকে বলা হয় প্রকৃতির রং। এই রং-টি প্রাকৃতিক বা অর্গানিক বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়াও পৃথিবীর বিখ্যাত বেশীর ভাগ ডিজাইনারই পিওর ব্ল্যাক ব্যবহার করার চেয়ে বাদামী রং ব্যবহার করতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বলে জানা যায়। এবং তারা আধুনিক ডিজাইনের ক্ষেত্রে এই রং ব্যবহার করার জন্যই সব থেকে বেশি পরামর্শ প্রদান করেছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। মানুষের মনে বাদামী রং যে ধরনের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরূপঃ-
☞ ইতিবাচকঃ- গুরুত্ব, আন্তরিকতা, প্রাকৃতিক, নির্ভরযোগ্যতা এবং সাপোর্ট।
☞ নেতিবাচকঃ- রসবোধের অভাব এবং রাশভারি।
কোন রং মানুষের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে সেটা অনেকখানি নির্ভর করে কীভাবে এবং কোথায় রং-টি ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর। আর তাই গ্রাফিক্স ডিজাইনের জন্য রঙের ব্যবহার এবং এর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট সম্পর্কিত বিষয়টি একজন ডিজাইনারে জ্ঞাত থাকাটা সব থেকে বেশি জরুরি।
হিন্দু ধর্মে রঙের ব্যবহারঃ- স্বাস্থ্যও মনের ওপর রঙের প্রভাব প্রচণ্ড। আকর্ষনীয় রঙ্গিন পরিবেশে মনও থাকে আনন্দে পরিপূর্ণ। এছাড়াও একঘেয়ে ভাব কেটে যায় এবং নিরাশা দূর হয়ে যায়। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মে সিঁদুরের লাল, হলুদের পীত, পাতার সবুজ, আটার সাদা রং ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। এগুলো সবই স্বাস্থ্য, স্ফূর্তি ও কল্যাণের জন্য। তাছাড়া সূর্যের রশ্মিতে সকল রঙের সংমিশ্রণ থাকে। এমন কি সূর্যের রশ্মি থেকে রংধনুর সাতটি রং, আমাদের পরিবেশ ও মনকে প্রভাবিত করে। সূর্যের ছত্রছায়ায় নানা বনস্পতি এবং জীব যে রকমভাবে লালিত হয়, সেই রকমভাবে সবুজ, লাল ও নীল রং মানুষকে সুস্থ, সবল, তেজস্বী ও গৌরবান্বিত করে। তাছাড়া লাল রং সৌভাগ্যের চিহ্ণ হিসাবে পরিচিত এবং সবুজ রং ব্যক্ত করে শুভেচ্ছা।
☆☆ লাল রংঃ- হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রং হল লাল। কেননা এই ধর্মে লাল রংকেই সব থেকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজে লাল রঙের ব্যবহার হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রায় সকল দেবদেবীর মূর্তিতে লাল সিঁদুরের তিলক পরানো হয়। লাল তিলক শৌর্য এবং বিজয়ের প্রতীক। লাল তিলক লাগালে ব্যক্তির মধ্যে তেজস্বিতা, পরাক্রম, গৌরব ও যশের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। গৌরবের রং হল লাল। এমনকি সুস্বাস্থ্য এবং শক্তি মানুষের শরীরের গোলাপী আভা থেকেই প্রকাশিত হয়। তাছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই লাল রঙের বিশিষ্ট স্থান রয়েছে ভারতীয় নারীর জীবন ও শৃঙ্গারে। সধবা-মহিলারা মাথায় সিঁদুর বা লাল টিপ পরেন। এবং একজন হিন্দু নারীর গৌরব, সম্মান, সৌভাগ্য এবং স্নেহ এই লাল রং থেকেই বিকশিত হয়।
লাল রং শক্তি, উৎসাহ, স্ফূর্তি ও পরাক্রমেরও প্রতীক। আনন্দ প্রকাশের রং-ও লাল। বিবাহ, জন্ম ও উৎসবে আনন্দের মনোভাব ব্যক্ত করা হয় এই লাল রং দিয়েই। ধন-দাত্রী দেবী লক্ষ্মীও পরেন লাল বস্ত্র। লাল রং ধনসম্পদ, বিপুল সম্পত্তি সমৃদ্ধির শুভ প্রকাশ করে। এছাড়াও দেবী লক্ষ্মীকে লাল পদ্মফুলের উপর বসানো হয়। আর এই লাল পদ্ম হলো সমৃদ্ধির প্রতীক।
☆☆ গেরুয়া রংঃ- গেরুয়া হলো আধ্যাত্মিকতা প্রকাশের রং। এটি জ্ঞান, ত্যাগ, তপস্যা ও বৈরাগ্যের প্রতীকও বটে। হিন্দু যোগী, তপস্বী, সাধু, বৈরাগী সকলেই গেরুয়া বস্ত্র পরেন। মনে হয় তাঁরাও যেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে এবং অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছেন। যেমন- অগ্নি থেকে জ্যোতির প্রকাশ, ঠিক তেমনই গেরুয়াবস্ত্রধারী যোগীও আধ্যাত্মিক জ্যোতির মাধ্যমে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেন। গেরুয়া বস্ত্রধারী সাধু দেবতাদের গুণাবলীকে নিজের মধ্যে বিকশিত করতে চান। তাছাড়া এই রং শুভ-সংকল্প সূচক।
☆☆ সবুজ রংঃ- সবুজ রং সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে ব্যাপ্ত রয়েছে। আমাদের জীবনে এই সবুজ রং অধ্যাত্ম প্রেরণাদায়ী পরিবেশের প্রতীক। এটি গাছপালা, শস্য সুশোভিত ক্ষেত, কেয়ারি, পার্বত্যাঞ্চল ইত্যাদী আচ্ছানকারী মধুর রং। সবুজ মনকে শান্তি দেয় এবং হৃদয়কে করে শীতল। মানুষকে সুখ, শান্তি, স্ফূর্তি দেয় এই প্রিয় সবুজ রং। মুণি-ঋষিরা নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উঁচু সবুজ পর্বত শীর্ষে, লম্বা গাছের সবুজ মাঠের মধ্যে শান্ত, সুখী পরিবেশকে আপন করে নিয়েছিলেন।
☆☆ হলুদ রংঃ- জ্ঞান, বিদ্যা ও বিবেকের প্রতীক হল হলুদ রং। এই রং সুখ, শান্তি, অধ্যয়ন, জ্ঞান, যোগ্যতা, একাগ্রতা এবং মানসিক বৌদ্ধিক উন্নতিরও প্রতীক। হলুদ বা বাসন্তী রং মস্তিষ্ককে প্রফুল্ল ও উত্তেজিত করে। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আনে। মানুষের মধ্যে নতুন নতুন সুস্থ চিন্তা দ্বারা তৈরী করে এই বাসন্তী রং। বসন্ত ঋতু মনের আনন্দদানকারী জ্ঞানবর্ধক ঋতু। হিন্দু দেবতা শ্রী বিষ্ণুর পোশাকের রং-ও হলুদ। আর তাঁর পীতবস্ত্র অসীম জ্ঞানের দ্যোতক। তাছাড়া হিন্দু অন্য আর এক দেবতা শ্রী গণেশের ধুতিও হলুদ রঙের। আর একারণে সকল মঙ্গল কার্যে হলুদ ধুতি পরা গণেশ, বিঘ্ননাশকারী বলে গণ্য হন।
☆☆ নীল রংঃ- মনোবিজ্ঞান অনুসারে নীল রং শক্তি, পৌরুষ ও বীরত্ব মনোভাবের প্রতীক। পুরুষোত্তম দেবতা শ্রী রামচন্দ্র এবং লীলা-পুরুষোত্তম দেবতা শ্রী কৃষ্ণ উভয়ের জীবনই মানবতার রক্ষা এবং দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই কেটে গেছে। এদের উভয়েরই শরীরের বর্ণ ছিল নীল। যে রকম নীল রং আকাশ এবং পৃথিবীতে সর্বব্যাপ্ত, ঠিক তেমনই নীল বর্ণের বীর শ্রী রাম এবং মহাযোদ্ধা শ্রী কৃষ্ণও সর্বব্যাপক ও শক্তিমান। নীল রং ক্ষত্রিয় স্বভাব প্রকট করে। এছাড়াও উদ্যোগী পুরুষের রং নীল। এই রঙের পোশাকধারী ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়। এবং নীল রংকে সমুদ্র গভীর বলে মনে করা হয়।
☆☆ সাদা রংঃ- শ্বেত রঙের সৃষ্টি, সাতটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে। সূর্যের সাদা রশ্মিকে ভেঙে দিলেই কেবল তা থেকে সকল রকমের রং বেরিয়ে আসে। আর এতে সকল রকমের রঙের কিছুটা ছায়া থাকে। শ্বেত রং পবিত্রতা, শুদ্ধতা, বিদ্যা ও শান্তির প্রতীক। এর দ্বারা মানসিক, বৌদ্ধিক ও নৈতিক স্বচ্ছতা বিকাশিত হয়। জ্ঞান এবং বিদ্যার রং-ও সাদা। এবং বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর কাছে সাদা রং সব থেকে প্রিয়।
রংধনুর সাতটি রং কে-কিসের অর্থ বহন করে তার বর্ননাঃ-
☞ আসমানীঃ- পরিপূর্ণতার জন্য সংগ্রামী মনোভাবের পরিচায়ক।
☞ সবুজঃ- প্রভাব বিস্তারকারী হওয়ার প্রবণতা এবং অন্যদের সুপরিচিত হওয়ার গভীর ইচ্ছা।
☞ হলুদঃ- অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। প্রতিযোগিতায় অন্যদের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের ইচ্ছা।
☞ বেগুনীঃ- সর্বদা হাসি-খুশি থাকার মনোভাব। সামাজিক হওয়ার প্রবণতা।
☞ নীলঃ- মাঝারি-কঠোর পরিশ্রমী, নিজের কাজে বেশি উদ্যোগী।
☞ কমলাঃ- সামাজিক সকলকে নিয়ে চলার প্রচেষ্টা। ত্যাগের প্রতীক, জ্ঞানপিপাসু এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ চালচলন।
☞ লালঃ- স্বভাবগতভাবেই সাহসী, জীবন উপভোগ করার অনুভূতি এবং স্পষ্টবাদী।
রংধনুর এই সাতটি রঙের বাইরে আরও বেশ কিছু রং আছে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে এই সাতটি রঙের-ই সমাহার। সেই রংগুলোর কয়েকটি সম্পর্কে নিচে বলা হলোঃ-
☞ কালোঃ- বে-আইনী কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। কখনও কখনও পরিণতির কথা না ভেবেই ওই সব কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া।
☞ চকোলেটঃ- বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা, সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং অন্য স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে যৌনাকাঙ্ক্ষা তীব্র।
বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন রকম। তবে রঙের ব্যবহারের উপরও তার অনেকটাই সম্পর্ক রয়েছে। আর এই সম্পর্কের কারণে মানুষের গুণাগুণের তারতম্য কীভাবে ঘটে, সেটা নিচে আলোচনা করা হলোঃ-
❏ লাল রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- তেজস্বী, অন্যক্ষেত্রে উৎসাহী, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি এবং সাহসী।
লাল রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- আগ্রাসী, আবেগপ্রবণ, অধৈর্য, অল্পেই রেগে যাওয়া।
❏ কমলা রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- সামাজিক সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে, সকলকে আপন করে নেওয়ার ইচ্ছা। অন্যেরা পছন্দ করে। ভাবাবেগ তো আছেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশী অন্যের সঙ্গলাভ।
কমলা রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- আনুগত্যের অভাব, আলস্য।
❏ হলুদ রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, আধুনিক ও চ্যালেঞ্জ জাতীয় জিনিসের প্রতি ভালবাসা, যুক্তিবাদী, সহজেই শিখে নেওয়ার ক্ষমতা এবং অভিনব বস্তুর প্রতি ভালবাসা।
হলুদ রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- নার্ভাস, জেদ, সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ, নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রতি অতিরিক্ত গর্ববোধ এবং দুর্বল ইচ্ছাশক্তি।
❏ সবুজ রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- সহানুভূতি সম্পন্ন, অমায়িক উদ্ভাবন শক্তিসম্পন্ন, আরোগ্যকর, সামাজিক এবং প্রকৃতির প্রতি প্রেম।
সবুজ রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- পান-ভোজন রসিক এবং বাচাল, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যস্ততা।
❏ নীল রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- আরও ভাল কিছুর আশায় থাকা, ভাল কিছু খোঁজ করা। আধ্যাত্মিক অন্বেষণকারী। সহিষ্ণু, সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ও রসিক।
নীল রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- আত্ম-গর্বিত, ব্যঙ্গবিদ্রূপকারী, দাম্ভিক, জমকালো, মেধা গ্রহণকারী।
❏ সাদা রঙের অনুকূল সম্পর্কঃ- দয়াময়, ভদ্র, উদার, উপকারী, অধ্যাত্ম উপলব্ধিকারী।
সাদা রঙের প্রতিকূল সম্পর্কঃ- জীবনে উন্নতির অভাব, কঠোর ইচ্ছাশক্তির মানুষ সহজেই এ সব লোকের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করে নেয়।
রং ও রাশিচক্রঃ- মানুষের জীবনে বিভিন্ন রঙের একটা গুরুত্ব আছে। রাশিচক্র হিসেবে রং ব্যবহার ও তার প্রভাবে মানুষের জীবন সৌভাগ্যময় এবং আনন্দদায়ক হতে পারে। রাশিচক্রের সামঞ্জস্য রেখে কার কী রং দরকার তার একটি তালিকা নিচে উপস্থাপন করা হলোঃ-
❏ মেষ- প্রবাল লাল; ❏ বৃষ- দুধের মতো সাদা; ❏ মিথুন- সবুজ; ❏ কর্কট- গোলাপী/মুক্তোর সতো সাদা; ❏ সিংহ- হাল্কা সাদা/চুনি লাল; ❏ কন্যা- বিবিধ রকমের হাল্কা রং বা বিভিন্ন রকমের সবুজ; ❏ তুলা- দুধ সাদা; ❏ বৃশ্চিক- প্রবাল লাল; ❏ মকর- হাল্কা লাল; ❏ ধনু- সুবর্ণ হলুদ; ❏ কুম্ভ- নীল ও গোলাপী এবং ❏ মীন- হলুদ ও ধবধবে সাদা।
দিক বিবেচনায় রঙের ব্যবহারঃ- বিভিন্ন দিকের কথা বিবেচনা করে বাড়িঘরের রং কেমন হবে, সে সম্পর্কে পণ্ডিত ব্যক্তিরা নানা ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন দিকের গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের কথা ভেবেই মূলত এই রং ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। তাহলে আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক দিক বিবেচনায় কোন রং কেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটাঃ-
❍ পূর্ব(সূর্য)- উজ্জ্বল অথবা ভোরের সূর্যোদয়ের মতো লাল; ❍ পশ্চিম(শনি)- হাল্কা নীল; ❍ দক্ষিণ(মঙ্গল)- প্রবাল লাল অথবা গোলাপী; ❍ উত্তর-পূর্ব (বৃহস্পতি)- সুবর্ণ হলুদ; ❍ দক্ষিণ-পশ্চিম(রাহু ও কেতু)- গাঢ় সবুজ অথবা ধূসর; ❍ দক্ষিণ-পূর্ব (শুক্র)- শঙ্খের মতো সাদা এবং ❍ উত্তর-পশ্চিম(চন্দ্র)- গৌরবর্ণ সাদা।
মোট কথা প্রতিটি রং-ই মানুষের মনে ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় দেখা গেছে. প্রতিটি রং মানুষের মনে কীভাবে প্রভাব ফেলে সেটার অনেকখানি মানুষের ব্যক্তিত্ব, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার উপরও নির্ভর করে। তাই রং কীভাবে মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে সেটা নিয়ে এখনও বিস্তর গবেষণা চলছে।
কোন রঙের গোলাপ কিসের প্রতীক বহন করেঃ- এবার একটু সম্পূর্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করবো। যদিও এই বিষয়টা পোস্ট সংশ্লিষ্ট হবে কিনা জানি না, তবে যেহেতু সেটাও রং সম্পর্কিত বিষয়; তাই আলোচনা করলে বোধ হয় খুব একটা খারাপ হবে না। ছোট থেকে বড়, গোলাপ ফুল চেনে না এমন মানুষ বোধ হয় এই পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে আধুনিক যুগে, গোলাপ ছাড়া তো প্রেমকে এক প্রকার অসম্ভবই বলা চলে। তবে শুধু প্রেমের ক্ষেত্রে বা ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেই যে গোলাপ ব্যবহার করা হয়, এমন কিন্তু নয়? বরং এই গোলাপের আরো বহুবিধ ব্যবহার এই পৃথিবীতে বিদ্যমান।
তাছাড়া গোলাপের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রকারভেদ। যেমন কোনটা লাল, কোনটা হলদে, আবার কোনটা সাদা। আর এই প্রতিটি রঙের গোলাপ প্রত্যেকটাই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক বহন করে? যা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। আর তাই আসুন, আজ আমরা এই বিভিন্ন রঙের গোলাপ আসলে ঠিক কিসের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয় সেটা জেনে নেবোঃ-
☆☆☆ লাল গোলাপঃ- প্রেমের কবিতা আর গল্পে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে রক্ত গোলাপের কথা। সৌন্দর্য, ভালোবাসার প্রতীক হলো লাল গোলাপ। কেননা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের ধরন বদলে গেলেও, প্রেম নিবেদনের ভাষা হিসেবে লাল গোলাপের আবেদন এখনও চিরন্তন।
☆☆☆ গোলাপি গোলাপঃ- শুধু লাল গোলাপ নয়, মনের ভাষা বুঝতে পারে গোলাপি গোলাপও। ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকৃতির প্রতীক হলো গোলাপি গোলাপ। এছাড়া প্রিয় বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য সঙ্গীকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে পারেন এই গোলাপি গোলাপ দিয়ে।
☆☆☆ সাদা গোলাপঃ- আমরা সাধারণত শোক জ্ঞাপনে সাদা ফুল ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সাদা গোলাপের গুরুত্ব অনেক গভীর। বিয়ের সময় কনের হাতে দেওয়া হয় একগুচ্ছ সাদা গোলাপ। কেন জানেন? কারণ এই ফুল নতুন জীবন শুরুর প্রতীক। এছাড়া আধ্যাত্মিকতারও প্রতীক সাদা গোলাপ। মৃতহেদ কিংবা সমাধির উপর সাদা গোলাপ রাখার অর্থ হলো তাকে মিস করা। তবে শুধু মৃত ব্যক্তিকে নয়, বরং কাউকে মিস করলে আপনি তাকেও সাদা গোলাপ পাঠিয়ে জানাতে পারেন আপনার মনের ভাষা।
☆☆☆ কমলা গোলাপঃ- এই রঙের গোলাপ মূলত আবেগ, উৎসাহ এবং উদ্দীপনার প্রতীক। এছাড়াও সহযোদ্ধাকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয় কমলা গোলাপ। কোন সহযোদ্ধাকে কমলা গোলাপ উপহার দিয়ে বোঝাতে পারেন, আপনি তার পাশে আছেন।
☆☆☆ হলুদ গোলাপঃ- জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কের প্রতীক হলো এই হলুদ গোলাপ। কি বুঝতে পারছেন না তো? ভাবছেন ভালবাসার থেকে আর বড় কি সম্পর্ক থাকতে পারে, তাই তো? একদম না! কারণ ভালবাসার থেকে আরও এমন কিছু বড় সম্পর্ক থাকে যা, সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেটা হলো বন্ধুত্ব! আর হ্যাঁ, এই হলুদ গোলাপ কিন্তু সেই বন্ধুত্বেরই প্রতীক! এছাড়া আনন্দ এবং সুস্বাস্থ্য বোঝাতেও হলুদ গোলাপ ব্যবহার করা হয়। এমন কি আপনার জীবনে আপনার বন্ধুর মূল্য যে কতখানি সেটা বোঝাতে প্রিয়বন্ধুর হাতে তুলে দিতে পারেন একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ।
☆☆☆ রক্তবেগুনী গোলাপঃ- রক্তবেগুনী রং বিশ্বস্ততার প্রতীক। তাই কোন দেশের রানিকে সম্মান জানাতে দেওয়া হয় রক্তবেগুনী গোলাপ।
☆☆☆ পিচ গোলাপঃ- এই রঙের গোলাপ আরোগ্যের প্রতীক। সততা, আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা বোঝাতেও দেওয়া হয় গুচ্ছ পিচ গোলাপ।
পুনশ্চঃ- আমি পোস্টে রং সম্পর্কিত বিষয়ে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মকে নিয়ে আলোচনা করেছি এই কারণে, কেননা হিন্দু ধর্মে রং ব্যবহারের যেমন অত্যাধিক বাহুল্যতা দেখা যায়; ইসলাম সহ অন্যান্য ধর্মে ঠিক ততটা দেখা যায় না। আর এ কারণেই পোস্টে মূলত রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেই এখানে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া আদৌতে কুসংস্কার কিংবা ঐধরনের কোন কিছুকে প্রশ্রয় দেওয়াটা এই পোস্টের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং পোস্ট সংশ্লিষ্টতা থাকার দরুন কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যা এই ফিচারটা লিখতে গিয়েই সর্ব প্রথম আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল এবং পরবর্তিতে সেটা পোস্টে উল্লেখ করে দিয়েছি।
তথ্যসূত্রঃ- ছবি সহ প্রত্যেকটা তথ্যই অনলাইন ভিত্তিক বাংলা এবং ইংরেজি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা। যার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকটা লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ-
☞ রং- উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া।
☞ কেন, রং নিয়ে বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলিদেরকে চিন্তা ভাবনা করা উচিত?- পড়ুন বিস্তারিত।
☞ রঙের তালিকা- উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া।
☞ রঙের সাইক্লোজিক্যাল ফ্যাক্ট- উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া।
☞ ছবি সূত্র- পোস্টে উল্লেখিত সবগুলো ছবিই এখান থেকে সংগ্রহ করা।
☞ রঙের অন্তর্জগৎ- মহিউদ্দীন মোহাম্মদ।
রং সম্পর্কিত বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের লিংক গুলোতে ক্লিক করুনঃ-
☞ সাধারন মৌলিক রঙের থেকে তৈরি আরো অন্যান্য রঙের তালিকা।
☞ রং সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত টিউটরিয়াল (CSS)- বাংলা ওয়েবসাইট।
☞ রং সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত টিউটরিয়াল (CSS)- ইংরেজি ওয়েবসাইট।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো! তাছাড়া এতক্ষণ যাবত সাথে থেকে এবং কষ্ট করে এতবড় একটা পোস্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন! হ্যাপি ব্লগিং....!!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৩৬