পৃথিবীর ভয়াবহতম প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম যে নামটি চলে আসে সেটি হলো "ভূমিকম্প"। ভুমিকম্প সম্পর্কে জানেনা এমন মানুষ সম্ভাবত এই পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোট থেকে বড়, আমরা সবাই বয়সে কম বেশি এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছি। তাছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যানে আমরা এই ভুমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কেও অনেক কিছুই জানি।
"ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নাম, যে কিনা এক মূহুর্ত্বের মধ্যে সব কিছুকে লন্ড-ভন্ড করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এর আঘাতে সামান্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি গ্রাম, একটি শহর, এমনকি মুহুর্ত্বের মধ্যে একটি দেশের চিত্রও পাল্টে যেতে পারে।"
বর্তমান পৃথিবীতে দূর্যোগ প্রবণ দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। প্রতিদিন কোন না কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আমাদের এই সুন্দর দেশটাতে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ গুলো আমাদের এই ছোট্ট দেশটির মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রত্যহ সকালে ভয় ভয় চোখে ঘুম ভাঙে, 'কি জানি হুট করে কখন প্রকৃতির তান্ডব শুরু হয়ে যায়?' আবার ভয় ভয় চোখে রাত্রে ঘুমাতে যেতে হয়, 'কি জানি সকালের সুন্দর সূর্যটা আমি দেখতে পারবো কিনা?' তাছাড়া আমাদের এই দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। এক কথায় যাদের 'নুণ আনতে পান্তা ফুরোয়' অবস্থা। সুতরাং এই দারিদ্রতার মধ্যেও যদি প্রকৃতি আমাদের কে নিয়ে নির্মম ঢ়ূড় আচরণ করে তাহলে সেই সময়কার অবস্থাটা আর বর্ননা করার অপেক্ষা রাখে না। আর সেজন্যই আমাদের সব থেকে বেশি দরকার নিজেদেরকে সব অবস্থাতেই সচেতন রাখা। কারণ কোন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের তেমন কোন উন্নত প্রযু্ক্তি নেই। নেই কোন ভাল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতী। শুধুমাত্র সামাজিক সচেতনতাই আমাদের একমাত্র সম্বল। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আমার আজকের এই পোস্টটি তৈরি করা। যাহাতে ভূমিকম্পের মত এমন ভয়বহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও আমরা নিজেরা সচেতন থাকতে পারি, এবং আমাদের আশে পাশের মানুষ গুলোকেও সচেতন রাখতে পারি। তাহলে আসুন আর দেরি না করে, আমরা ভূমিকম্প সম্পর্কিত বিষয়ের মূল আলোচনায় ফিরে যাই........
ভূমিকম্প কি এবং ভূমিকম্প কেন হয়ঃ- ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে ভূপৃষ্ঠের নিচে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় রয়েছে কঠিন ভূত্বক। ভূত্বকের নিচে প্রায় ১০০ কি. মি. পুরু একটি শীতল কঠিন পদার্থের স্তর রয়েছে। একে লিথোস্ফেয়ার বা কঠিন শিলাত্বক নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কঠিন শিলাত্বক (লিথোস্ফেয়ার) সহ এর ভূ-পৃষ্ঠ বেশ কিছুসংখ্যক শক্ত শিলাত্বকের প্লেট এর মধ্যে অবস্থান করছে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে এই প্লেটের বিচ্যুতি বা নড়া-চড়ার দরুন ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
আরও একটু ভাল ভাবে বললে বলতে হয়, বৃত্তাকার পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আপনার পায়ের তলার সমতল মাটি পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ কি. মি. ব্যাপি বিস্তৃত। এই ৬০০০ কি. মি. পর্যন্ত বিস্তৃত অংশে মাটির মোট চারটি স্তর আছে। যার মধ্যে উপরের ৭৫ কি. মি. পর্যন্ত বিস্তৃত অংশকে আবার 'ক্রাস্ট' বলা হয়। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মতে, এই ক্রাস্টের উপরেই আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটা অবস্থান করছে। এই ক্রাস্টের উপরের অংশটাকে বলা হচ্ছে ‘প্লেট’। কিন্তু পুরো পৃথিবীর উপরের ভাগ বা এই প্লেটটা ডিমের খোসার মত একটা একক বস্তু না। এই প্লেট গুলো ভাঙ্গা। আর ক্রাস্টের নিচের অংশে আছে, ২৮০০ কি. মি. পর্যন্ত বিস্তৃত মেন্টেল। যার নিচের দিকে আছে গলন্ত লাভা। এই লাভা গুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করছে এবং সুযোগ পেলে আগ্নেয়গিরির পথে বের হয়ে আসে। আর সেই আগ্নেয়গিরির প্রভাবে সমস্থ পৃথিবীতে একধরনের কম্পনের সৃষ্টি হয়। যেটাকে আধুনিক বিজ্ঞান ভূমিকম্প নামে অভিহিত করেছে।
ইহাছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের এই গোটা ভূ-পৃষ্ঠই কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। আবার প্রতিটি স্তরই একাধিক সাব প্লেটে বিভক্ত। এসব বিশাল আকারের টেকটোনিক প্লেটগুলো যখন একের অপরে সঙ্গে ধাক্কা খায় তখন কেঁপে ওঠে মাটির নীচের তলদেশ। আর আমরা ভূপৃষ্ঠের ওপর ভূ-কম্পন অনুভুব করি। যেটাকে সাধারণ মানুষ ভূমিকম্প নামে চেনে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলা হয় কোনটাকেঃ- পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সব দিকে ছরিয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারনত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কি. মি. এর মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের কারনঃ- সাধারনত তিনটি প্রধান কারনে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
০১. ভূ-পৃষ্ঠ জনিত কারন,
০২. আগ্নেয়গিরি জনিত কারন এবং
০৩. শিলাচ্যুতি জনিত কারন।
কারণ গুলোর বিস্তারিত বর্ননাঃ- আমাদের ভূ-পৃষ্ঠ অনেক গুলো ছোট/বড় প্লেট এর সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেট গুলো ফল্ট বা ফাটল দ্বারা একটির থেকে আর একটি আলাদা থাকে। এই প্লেট গুলোর নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ। কোন প্রাকৃতিক কারনে এই গলিত পদার্থ গুলির স্থানচ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলিরও কিছুটা স্থানচ্যুতি ঘটে। যার কারনে একটি প্লেট আর একটির মধ্যে ঢুকে যায়, এবং এর ফলে ভূমিতে একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই আমাদের কাছে ভূমিকম্প রুপে আবির্ভূত হয়। ইহা ছাড়াও কখনো কখনো আগ্নেয়গিরির বিস্ফরন এবং গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারনেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে।
বিভিন্ন পৌরাণিক মিথে ভূমিকম্পের কারণঃ- ভূমিকম্প নিয়ে নানা ধরনের লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই আবার এই সব লোক কাহিনী গুলোকে সত্য হিসাবে ধরতেও দ্বিধা করেন না। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সেই সমস্থ মিথের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকটা কাহিনীর বর্ননা নিচে দেওয়া হলোঃ-
=> গ্রিক জাতির ধারণা অনুযায়ী তাবৎ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী ভূমিকম্পের দেবতা পোসাইডন। পোসাইডন যখন খারাপ মেজাজে থাকেন, তখন ভূমিতে ত্রিশূল দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করেন। ফলে ভূমিকম্প হয়। মানুষের পাপকাজে রাগন্বিত হয়েও তিনি এরকম করেন বলে প্রচলিত আছে।
=> পশ্চিম আফ্রিকান সংস্কৃতির কিছু মানুষ মনে করত, জীবন টিকে আছে এক দৈত্যের মাথার মধ্যে। গাছপালা সেই দৈত্যের চুল। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী হচ্ছে পরজীবীর মতো, যারা দৈত্যের ত্বকজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে দৈত্যটি মাথা এদিক-ওদিক ঘোরায়। তখনই ভূমিকম্প হয়।
=> জাপানের লোকজন আবার ভূমিকম্পের সঙ্গে নামাজু নামের মাগুর জাতীয় মাছের সম্পর্ক খুঁজে পায়। তাদের মতে নামাজু কাদার মধ্যে বাস করে। কাশিমা নামের এক দেবতা জাপানকে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করার জন্য স্বর্গীয় শক্তির মাধ্যমে শক্ত পাথর দিয়ে নামাজুকে চেপে ধরে রাখেন। ফলে নামাজু নড়াচড়ার সুযোগ পায় না। যখন কাশিমা তার পাহারা সরিয়ে নেন তখনই নড়ে ওঠে নামাজু। ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
=> ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে চারটি বিশালাকৃতির হাতির ওপর। তারা আবার দাড়িয়ে আছে একটি কচ্ছপের ওপর দাঁড়িয়ে। কচ্ছপটি দাড়িয়ে আছে একটি মহিষের দুই শিংয়ের ওপর। এদের মধ্যে যে কোনো একটি প্রাণীর গা চুলকালে তারা নড়াচড়া করে, ফলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়।
=> নর্স পুরাণে আছে সৌন্দর্যের দেবতা বলডারকে হত্যা করার কারণে দেবতা লকিকে একটি বিষধর সাপ মাথার ওপর দিয়ে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। সেই সাপ তার মাথায় ক্রমাগত বিষ ঢেলে চলেছে। তার স্ত্রী সেজিন তাকে বাচানোর জন্য একটি পাত্রে বিষ ভরে রাখছে। পাত্রটি পুর্ণ হয়ে গেলে সে যখন তা খালি করতে যায় তখন ক্রমাগত পড়তে থাকা বিষ থেকে নিজেকে বাচানোর জন্য লকি নাড়াচাড়া করে ফলে ভূমিকম্প হয়।
আফটার শক কাহাকে বলেঃ- সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, কোন ভূমিকম্প হওয়ার পরে ঠিক তার পর মূহুর্ত্বে উক্ত ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে আবারও একটা ছোট খাটো কম্পন অনুভূত হয়। যেটাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় 'আফটার শক' বলা হয়। আফটার শকটা পূর্বের তীব্র ভূমিকম্পের তুলনায় অনেকটা কম জোরালো হয়। এবং এটা হওয়ার নিদ্রিষ্ট কোন সময় সীমা নেই। তবে যতটা সম্ভব এটি ভূমিকম্পের পরপরই অনুভূত হয়।
ভূমিকম্পের শক্তি বা রিখটার স্কেল কিঃ- বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত আধুনিক সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। এই সিসমোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কারের আগে মানুষ শুধু বলতে পারত ভূমিকম্প হয়ে গেছে। কিন্তু কোন মাত্রায় হলো, তা বলা সম্ভব ছিল না। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিনই ভূপৃষ্ঠের ভেতরে কোথাও না কোথাও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সবগুলো অত জোরালো নয়। ভূমিকম্প মাপা হয় সাধারণত দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচণ্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে জমে থাকা শক্তি প্রচুর পরিমাণে নির্গত হতে থাকে। এই শক্তিকে মাপা হয় রিখটার স্কেলের মাধ্যমে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। ৩ থেকে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প বোঝা গেলেও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না। তবে ৫ কিংবা ৬ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেই সেগুলোকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। রিখটার স্কেলের এক মাত্রা পার্থক্যের অর্থ হচ্ছে আগেরটির চেয়ে পরেরটি ভূত্বকের ভেতর ৩২ গুন বেশি শক্তিশালী। তবে ভূপৃষ্ঠে এই তীব্রতার পরিমাণ হয় ১০গুন বেশি।
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রাঃ-
৫ - ৫.৯৯ মাঝারি,
৬ - ৬.৯৯ তীব্র,
৭ - ৭.৯৯ ভয়াবহ এবং
৮ - এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলাদেশ কতটুকু ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের অন্তর্ভূক্তঃ- প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন চক্রের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে, বাংলাদেশেও তার ব্যতয় হয়না। এদেশের ভিতরে ও পার্শ্ববর্তি এলাকার বিগত প্রায় ২৫০ বছরের ভূমিকম্পের নথিভুক্ত তালিকা পাওয়া যায়। এ তালিকা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ১০০'রও বেশি ভূমিকম্প; তন্মধ্যে ৬৫টিরও বেশি ঘটেছে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিগত ৩০ বছরে (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৪) ভূমিকম্প সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত; আমাদের বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, এবং অপেক্ষা করছে বড় ধরণের নড়াচড়ার, অর্থাৎ বড় ধরণের ভূ-কম্পনের। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছে এই প্লেট দুটো হয়তো নিকট ভবিষ্যতে নড়ে উঠবে, যা বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা: বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা।
টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে আমাদের উত্তর ও পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিক্যাল ভাষায় ‘ভূ-চ্যুতি’ রয়েছে, যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ। এজন্যে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল তথা সিলেট এবং ততসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্প প্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন ঢাকা ও রাজশাহী শহরও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা।
ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জোন সমূহঃ- বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন-এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। যেখানে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলো। নতুন মানচিত্র অনুযায়ী, মাত্রাভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অবস্থান নিম্নরূপঃ
জোন-১: পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ, এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ।
জোন-২: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকা।
জোন-৩: বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং সব দ্বীপ ও চর।
১৮৯৭ সনের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার ‘দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ ভারতবর্ষকে আঘাত হানে যা আজও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর তবে এর প্রভাব বর্তমান বাংলাদেশ সহ বহু দূর পর্যন্ত অনুভূতি হয়েছিল। সে সময়ের ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন মিশনারীদের বিল্ডিং ভেঙে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এছাড়াও ঢাকায় ৪৫০ জনের মত নিহত হবার খবর পাওয়া গিয়েছিল যা সেই সময়ের তুলনায় রীতিমত অনেক বড় সংখ্যা।
এ ভূমিকম্পগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মোটামোটি প্রতি একশ বছর পরপর এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ১৯১৮ সন ছিল সর্বশেষ বড় ভূমিকম্পের বছর। এরপর প্রায় একশ বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু আর কোন বড় ভূমিকম্প আঘাত করেনি বাংলাদেশকে যা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক আবহাওয়াবিদ এটাও মনে করেন যে, ছোটছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। আর যদি সেটা ঘটে, তাহলে সেটার ভয়াবহতা হবে মারাত্মক।
ভূমিকম্প সম্পর্কে ইসলামের বানীঃ- ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কুরআনে সুরায়ে ‘জিলযাল’ নামে একটি সুরা-ই নাজিল করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোন ঘটনা ঘটার পরে মানুষ শুধু উক্ত ঘটনা ঘটার কার্যকারণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞানও এই কার্যকারণ সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে। কিন্তু কুরআনুল কারিম একই সাথে কোনো ঘটনা ঘটার কার্যকারণ বর্ণনার পাশাপাশি, উক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় কি এবং এই ঘটনা থেকে অন্য আরো বড় কোনো ঘটনা ঘটার সংশয়হীনতার প্রতি ইঙ্গিত করে। ভূমিকম্প বিষয়ে কুরআনুল কারিমে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
একটি হলো 'জিলযালাহ', যার অর্থ হলো একটি বস্তুর নড়াচড়ায় অন্য আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। দ্বিতীয় শব্দটি হল ‘দাক্কা’, এর অর্থ হলো প্রচন্ড কোনো শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোনো কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া। পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বকে বিচ্যূতি বা স্থানান্তরের কারণে। কিয়ামতের দিন আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধূলিকণায় পরিণত হবে এবং তা হবে ফেরেশেতা হজরত ইসরাফিল (আ.) এর সিঙ্গায় ফুঁৎকারের কারণে, যাকে বলা হয় ‘দাক্কা’। যা হবে এক প্রচন্ড আওয়াজ।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা. বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ (হারজ অর্থ খুনখারাবি) বৃদ্ধি পাবে। তোমাদের সম্পদ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা উপচে পড়বে। [সহি বুখারি : ৯৭৯]
ইমাম বুখারি তার সহি বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন তোমদের উপর থেকে (আসমান থেকে) নাজিল হলো তখন রাসুল সা. বললেন, আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, অথবা যখন, অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব নাজিল হলো, তখন তিনি বললেন, আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। [সহি বুখারি, ৫/১৯৩]
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়। তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুনাজাত করে। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতো, 'মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।'
ভূমিকম্পের সময় আমাদের করণীয়ঃ- স্বাভাবিক ভাবেই ভূমিকম্পের সময় আমরা দিক বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়ি এবং এদিক সেদিক ছুটা ছুটি করতে থাকি। যা আদৌও ঠিক নয়। কারণ তাহলে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণটা বাড়া ছাড়া কখনোই কম হয় না। সুতরাং ভূমিকম্পের সময় আমাদের উচিত, ঠান্ডা মাথায় ধিরে সুস্থে চিন্তা ভাবনা করে কোন কিছু করা। নিচে ভূমিকম্পের সময় আমাদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ-
১। ভূকম্পন অনুভূত হলে কোন ভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
২। ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে, বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নেওয়া ভাল।
৩। রান্নাঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসুন।
৪। বীম, কলাম ও পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিন।
৫। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।
৬। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দুরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিন।
৭। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন।
৮। ভাঙ্গা দেওয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্ট করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলাবালি শ্বাসনালিতে না ঢুকে।
৯। একবার কম্পন হওয়ার পর আবার ও কম্পন (আফটার শক) হতে পারে, তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন।
১০। উপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন।
১১। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন।
১২। গাড়ীতে থাকলে ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুটি থেকে দূরে গাড়ী থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ীর ভিতরে অবস্থান করুন।
১৩। ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন।
১৪। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মান করুন।
ভূমিকম্পের করণীয় বিষয় সম্পর্কে রাসুলে পাক (সা.) বলেন, যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেভাবে রাসুল সা. সূর্যগ্রহণ দেখলে বলতেন, যদি তুমি এ রকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। [বুখারি ২/৩০; মুসলিম ২/৬২৮]
পৃথিবী বিখ্যাত দশটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের বর্ননাঃ- পৃথিবীতে ভয়াবহতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে সব থেকে উল্লেখ যোগ্য হলো ভূমিকম্প। এর এক একটি আঘাতে মূহুর্ত্বের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হতে পারে। তবে পৃথিবীর মধ্যে ভূমিকম্প প্রবণ দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান দেশ হলো জাপান। জাপানের মানচিত্র দেখলে মনে হয় যেন গোটা দেশটাই একটা বিশাল আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছে। এই কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ভূমিকম্পের অধিকাংশই হয় জাপানে। তবে ইতিহাস কুখ্যাত ভূমিকম্পটি জাপানে না হয়ে আঘাত হেনেছিল চিলিতে। বিজ্ঞানীদের মতে, এক হাজারটি পারমাণবিক বোমা ফাটালে যে ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়, সেই একই পরিমাণ শক্তি নিয়ে ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিল চিলির বুকে। ১৯৬০ সালে চিলিতে এরকম ভয়ংকর ভূমিকম্প আঘাত হানার পর আরও অনেক দেশে কম-বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যা আজ আমার সামহোয়্যার ইন ব্লগ বন্ধুদের কাছে তুলে ধরবো।
০১। ভালদিভিয়া, চিলিঃ- ১৯৬০ সালে চিলির ভালদিভিয়া অঞ্চলে প্রায় '৯ দশমিক ৫' মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হানে। পরবর্তীতে গবেষকরা জানিয়েছিলেন যে, ঐ ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা ছিল প্রায় ১৭৮ গিগাট্রন। ভূমিকম্পটি ভালদিভিয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী হাওয়াই দ্বীপেও আঘাত হেনেছিল। প্রাথমিক ধাক্কাতেই প্রায় ছয় হাজার মানুষ মারা যায় এই ভূমিকম্পে এবং এক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে ভূমিকম্প পরবর্তীতে আঘাতপ্রাপ্ত আরও অনেক মানুষ মারা যায়।
০২। শানসি, চীনঃ- চীনের শানসি প্রদেশের এই ভূমিকম্পটিকে বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ভূমিকম্প। ১৫৫৬ সালের ২৩ শে জানুয়ারি চীনের শানসি প্রদেশকে কেন্দ্র করে এই ভূমিকম্পটি মোট ৯৭টি দেশে একযোগে আঘাত হেনেছিল। বেশ কয়েকটি দেশের সমতল ভূমি প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত ডেবে গিয়েছিল। '৮ দশমিক শূণ্য' মাত্রার এই ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা এক গিগাট্রন হওয়া সত্ত্বেও এতে প্রায় সাড়ে আট লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। ভূমিকম্প পরবর্তি গবেষনায় উঠে আসে, শানসি প্রদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই এই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল।
০৩। সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়াঃ- ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতীয় মহাসাগরে সৃষ্ট '৯ দশমিক ১ থেকে ৯ দশমিক ৩' মাত্রার ভূমিকম্পটি ৩২ গিগাট্রন শক্তি নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় আঘাত হানে। পার্শ্ববর্তী দেশ মালদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডেও এই ভূমিকম্পের ধাক্কা লাগে। এই ঘটনায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রাতারাতি মারা যায় এবং আনুমানিক সাত বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বিশ্লেষকরা জানান যে, ভূমিকম্পটি আট মিনিট থেকে দশ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
০৪। আলেপ্পো, সিরিয়াঃ- সময়টা ১১৩৮ সালের অক্টোবর মাসের ১১ তারিখ। ঐতিহাসিক নগরী সিরিয়ার আলেপ্পোয় তখন মাত্র ভোর হতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই '৮ দশমিক ৫' মাত্রার একটি ভূমিকম্প প্রায় তিন গিগাট্রন শক্তি নিয়ে নাড়িয়ে দেয় আলেপ্পোকে। ভূমিকম্পের ইতিহাসে এই ভূমিকম্পটিকে বলা হয় চতুর্থ ভয়ংকর দুর্যোগ। ওই ভূমিকম্পে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা যায় এবং গোটা একটি শহর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সবচেয়ে প্রাণঘাতী ব্যাপারটি হলো, আলেপ্পোর ওই সকালে একটি গীর্জায় প্রাতঃকালীন প্রার্থনার সময় এক স্থানেই ৬০০ মানুষ মারা যায় ভূমিকম্পে।
০৫। তাংসান, চীনঃ- প্রায় সাত লাখ মানুষ মৃত্যুর জন্য দায়ি এই ভূমিকম্প। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই চীনের তাংসান এবং হেবেই অঞ্চলে '৮ দশমিক ২' মাত্রার এই ভূমিকম্পটি আড়াই গিগাট্রন শক্তিমত্তা নিয়ে আঘাত হানে। মাত্র দশ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে পুরো একটি অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাথমিক হিসেবে বলা হয়েছিল যে, এই ভূমিকম্পে আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চীন সরকার পূর্ণাঙ্গ মৃত্যু তালিকা প্রকাশ করলে বিশাল মৃতের তালিকা দেখা যায়।
০৬। দামহান, ইরানঃ- এশিয়ার দেশ ইরানে হাতে গোনা কয়েকবার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এরমধ্যে ৮৫৬ সালের ২২ শে ডিসেম্বর ইরানের দামহানে (ইরানের তৎকালীন রাজধানী) '৮ দশমিক শূণ্য' মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় এবং গোটা শহরটির পার্শ্ববর্তী স্থানগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। দামহান পার্শ্ববর্তী বিখ্যাত বাস্তাম নগরী পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিলিয়ে যায় এই ভূমিকম্পে।
০৭। থোকো, জাপানঃ- ভূমিকম্পের দেশ জাপানের থোকো অঞ্চলে ২০১১ সালের ১১ মার্চ '৯ দশমিক শূণ্য ৩' মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পে ১৫ হাজার ৮৭৮ জন মানুষ মারা যায়, আহত হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার এবং আরও তিন হাজার মানুষকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। থোকো শহরের প্রায় দেড়লাখ বাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তবে এই ভূমিকম্পের ফলে দেশটির একটি পারমাণবিক স্থাপনা মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ভয়ানক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বায়ুতে ছড়িয়ে যায়। দূরবর্তী কানাডা এবং হাওয়াইয়েও এই ভূমিকম্পের কিছুটা ছোয়া লাগে।
০৮। আসগাবাত, সোভিয়েত ইউনিয়নঃ- তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আসগাবাত অঞ্চলে ১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর '৭ দশমিক ৩' মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ঘটনায় প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায়। আসগাবাত সংলগ্ন বেশ কয়েকটি শহরেও মারাত্মক ক্ষয়্ক্ষতি হয়।
০৯। কাশ্মির, পাকিস্তানঃ- পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির অংশে ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর '৭ দশমিক ৬' মাত্রার এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রাথমিক ধাক্কাতেই ৮৫ হাজার মানুষ নিহত এবং ৬৯ হাজার আহত হয়। পাশাপাশি জম্মুতে এই ভূমিকম্পের কারণে মারা যায় আরও ১৪ হাজার। চীনের একাংশ এবং তাজাকিস্তানেও এই ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার সমপরিমানের ক্ষয়ক্ষতি হয় এতে।
১০। সিসিলি, ইতালিঃ- '৭ দশমিক ৪' মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পটি ১৬৯৩ সালের ১১ জানুয়ারি হঠাৎ করেই আঘাত হানে ইতালির সিসিলিতে। ইতালিসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মোট ৭০টি শহর এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়। ইতালির ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর ভূমিকম্প হিসেবে ঠাই পায়।
এছাড়াও ইতালির ক্যালাব্রিয়া, ইরানের রুদবার, তুরস্কের ইজমিত, জাপানের নানকাইদো এবং আজারবাইযানের শেমাখা অঞ্চলেও প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। প্রত্যেকটি ভূমিকম্পেই বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে এ যাবত যতগুলো দেশেই ভূমিকম্প হয়েছে, সেই দেশগুলোকে ভূমিকম্প পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। মানবিক বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময়ে লেগেছে ঐ সব দেশগুলোর।
তথ্যসূত্রঃ-
০১। Earthquake-Wikipedia, the free encyclopedia
০২। Real Time Seismicity - Latest Earthquakes in the world
০৩। The 10 most powerful recorded earthquakes- World news ...
০৪। Earthquakes: the 10 biggest in history - Australian Geographic
০৫। Earthquake-PDF File
০৬। More Earthquake
আরো বিস্তারিত জানতে হলে নিন্মোক্ত লিংক গুলোতে যেতে পারেনঃ-
Click this Link, Click this Link, Click this Link-PDF, Click this Link-PDF
বিঃ দ্রঃ- পোস্টটা যতটা সম্ভব নির্ভূল করেই প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। তারপরেও অনিশ্চাকৃত ভুলের জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! তাছাড়া টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৪৫