রাত ১১টায় অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন আসলো।
"হ্যালো?" মেয়ে কণ্ঠ।
আমি হ্যালো বলতেই সে জিজ্ঞেস করলো, "কেমন আছেন?" এমনভাবে জিজ্ঞেস করলো যেন সে আমাকে চেনে!
আমিও উত্তরে চেনা মানুষের মতোই বললাম, "ভালো। তুমি কেমন আছো?"
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, "আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি আমাকে চেনেন আমি কে?"
"তুমি আমাকে চেনো?"
"না। আচ্ছা আপনি এখন কী করেন?"
"আমি এখন একটি অপরিচিত নাম্বারে এক মেয়ের সাথে কথা বলছি।"
মেয়েটি হেসে উঠলো। "আপনি অনেক মজার মানুষ তো! জানেন আমার হাইট কতো? পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি!"
আমি বললাম, "তুমি কি এভাবে অপরিচিত নাম্বারে ফোন দিয়ে নিজের হাইট বলে বেড়াও? আশ্চর্য তো! আমার নাম্বার পেলে কোথা থেকে?"
"আমার আপুর ফোনের ডায়াল নাম্বার থেকে পাইছি।" ফিসফিস করে সে বলতে লাগলো, "জানেন আমি কই থেকে কথা বলছি? টেবিলের নীচ থেকে!"
"টেবিলের নীচে তুমি কী করো? আর তোমার আপু কে? কী নাম?"
"আরে, আমার আপুর আজ জন্মদিন! সবাই নিচের তলায় আড্ডা দিচ্ছে। আমি আপুর ফোন থেকে ফোন দিছি। আপুর নাম বলা যাবে না।" ফিসফিস করেই বললো।
"তোমার নাম কী? কী করো?" আমি জানতে চাইলাম।
"আমার নাম সকাল। আমি ক্লাস এইটে পড়ি।"
"ক্লাস এইটে পড়ো? কণ্ঠ শুনে তো মনে হচ্ছে অনার্সে পড়ো!"
"সবাই তাই মনে করে। আমার উচ্চতা একটু বেশি তো!" বলেই সে খিল খিল করে হেসে উঠলো।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ক্লাস এইটের একটা মেয়ে এতো পাকনা! অপরিচিত নাম্বারে ফোন করে নিজের হাইট নিয়ে কথা বলে! ভাবলাম একটু পরখ করি।
"তুমি রবি ঠাকুরের 'ছুটি' গল্প(তখনকার সিলেবাসে ছিলো) পড়ছো?"
"নাহ! ওটা আমাদের সিলেবাসে নাই।"
"নাই মানে? অবশ্যই আছে। তা না হলে তুমি ক্লাস এইটেই পড় না!"
"উহু, আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি তো! সত্যি বলতেছি, ওটা আমাদের নাই।" মেয়েটা বললো। ফিসফিসেই কথা বলে যাচ্ছে।
ইংলিশ মিডিয়াম সম্পর্কে আমার ধারনা নাই। জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার বাসা কই?"
"ঢাকা উত্তরায়। আমি এখন রাখি। কেউ আসতেসে মনে হয়!" তাড়াহুড়া করে বলেই ফোন কেটে দিলো।
আধ ঘন্টা পর আবার ফোন আসলো। তখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এবার টেলিফোন নাম্বার থেকে।
“এই, আছেন?”
আমি বললাম, “না থাকলে ফোন ধরলাম কিভাবে?”
“আপনি এভাবে কথা বলেন কেন? আপুর সাথে যেভাবে কথা বলেন সেভাবে বলেন না প্লিজ!”
“তোমার আপুর সাথে কিভাবে কথা বলি? আর তুমি কিভাবে জানো?”
“সন্ধ্যা আপু ছাদে গিয়ে কথা বলে। আমি অনেকদিন আপনাদের ফোনালাপ শুনেছি। গতরাতেও আপনাদের কথা বলা শুনেছি চুপি চুপি।”
যাক, মেয়েটার নাম জানা গেল তাহলে। সন্ধ্যা। সকাল সন্ধ্যা! বাহ, দারুন মিল তো দুই বোনের নামের মধ্যে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমাদের কথা বলা চুপি চুপি শোনো? তুমি তো ভারী দুষ্টু মেয়ে। তোমার আপুকে সব বলে দিবো।”
মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো। ছেলেমানুষী হাসি।
“হাসছো কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হাসবো না? আপনি আপুকে তো আর বলতে পারবেন না! আপনাদের না কাল ব্রেক আপ হয়ে গেছে! কাল রাতে আপু অনেক কেঁদেছে। আমি ছাদে অনেকক্ষণ ছিলাম টবের আড়ালে।”
“এই মেয়ে! তুমি ব্রেক আপ কী বুঝো?” আমি একটু রেগে গেলাম।
“কেন বুঝবো না? আপনি মানুষটা বহুরূপী। জানেন, আমি আপনাকে দুচক্ষে দেখতে পারি না?” মেয়েটার অভিমানী কন্ঠস্বর।
“তুমি আমাকে দেখেছো? আন্দাজে কথা বলতেছো কেন?”
“আপুর চেহারায় আপনাকে দেখেছি। আপনি জঘণ্য একটা মানুষ! প্রতারক! আচ্ছা, বাবলী কি আমার আপুর থেকে বেশি সুন্দরী? আমার আপুর থেকে বেশি সুইট?”
কথা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতেছিলাম না। এই পর্যায়ে কী বলা যায়? সকাল, তুমি ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছো! তোমার আপুকে আমি ঠকাই নি। আমি তো তোমার আপুকে চিনিই না! সন্ধ্যা নামে কেউ আমার জীবনে আসে নি। আসলেও তাকে আমি কোনদিন ঠকাবো না। সব ছেলের মতো আমি না। কোনো লুকোছাপা আমার মাঝে নেই। খোলা বইয়ের মতো আমার মন। খুব সহজেই পড়ে ফেলা যায়।
আমি ঘটনাটা ভালো করে জানতে অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলাম। “বাবলির কথা তুলতেছো কেন সকাল?”
“কেন তুলবো না, হাহ? সন্ধ্যা আপু কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানেন? আপনাকে না পেলে ও আত্মহত্যা করবে! এখন বলেন, ওর কিছু হলে কে দায়ী হবে?”
আমার বুকটা ধরাস করে উঠলো! একটা মেয়ে একটা ফ্রড ছেলের জন্য আত্মহত্যা করবে? মেয়েজাতি এতো বোকা কেন? আমি এখন কী করে ওকে বুঝাই? আমি কি আমার পরিচয় দিবো? বলবো যে, তুমি সন্ধ্যাকে একটু দাও?
“সন্ধ্যা আত্মহত্যা করবে, তুমি কিভাবে জানলে?” আতংক নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“আপুর আজ বার্থডে। ও ওর সব ফ্রেন্ডকে ডেকেছে। সারাদিন দরজা বন্ধ করে রুমে ছিলো। আপুর রুমে কিচেনের একটা চাকু দেখেছি। সন্দেহজনক মনে করে সন্ধ্যার দিকে ওর রুমে ঢুকেছিলাম। তখন ও রুমে ছিল না। আব্বুর সাথে কেক কিনতে বাইরে গিয়েছিল। ওর টেবিলের উপর আপনার দেয়া ডায়রী আমি চেক করে দেখেছি। আজকের জন্মদিনটাই ওর জীবনের লাস্ট দিন। এভাবে সে ডায়রী লিখেছে।”
“সন্ধ্যা কোথায়? ও কি এখনও নিচে…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ আর একটা মেয়ে কণ্ঠ ভেসে এলো, “এই কে রে সকাল? কার সাথে কথা বলছিস এতো রাতে?”
সম্ভবত ফোনটা কেড়ে নিলো। সকালের অস্পষ্ট কণ্ঠ শুনলাম, “সরি আপু, আবির ভাইয়ার সাথে…”
“এই, তুমি ফোন দিয়েছো কেন আবার?” সম্ভবত সন্ধ্যা নামের মেয়েটার কণ্ঠ।
আমি নিজেকে আবীর হিসেবে কল্পনা করলাম। এই মুহূর্তে আবীরের ছদ্মবেশেই কথা বলতে হবে। সন্ধ্যা নামের মেয়েটি যদি সত্যি সত্যি এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে তো তা ভয়ংকর! আমি নিজেকে সংযত রেখে বললাম, “সন্ধ্যা…আমার কিছু কথা বলার আছে। প্লিজ, আগেই ফোন কেটে দিও না।”
“কী বলবা বলো।” তাড়াহুড়া কণ্ঠস্বর। সম্ভবত আমার কণ্ঠ ধরতে পারে নি। সন্ধ্যাও আমাকে আবীর ভাবছে! টেলিফোনে তো কণ্ঠস্বর চেনার কথা! নাকি আমার পরিচয় দিয়ে বলবো, আমি আবীর না? উহু! আগে শুনি ব্যাপারটা কতটুকু সত্য।
“তুমি কাজটা ঠিক করছো না! নিজেকে এভাবে শেষ করতে পারো না!” আমি অভিমানের সুরে বললাম।
“আমি কেন নিজেকে শেষ করতে যাবো? আশ্চর্য আবীর! কী হইছে তোমার?” সন্ধ্যার অদ্ভুতেড়ে জিজ্ঞাসা।
“সকাল বলতেছিলো, তুমি তোমার আজকের জন্মদিনে সুইসাইড করবা আমার জন্যে?” আমি বললাম।
“তোমার জন্যে? তোমার সাথে কী এমন হয়েছে আমার? কাল তুমিই তো ঝগড়াটা লাগাইছো! এখন রাগ যায় নাই আমার। আর, তুমি কিন্তু রাগটা আরো বাড়াইয়া দিতেছো! আমার জন্মদিন কবে সেটাও ভুলে গেছো? আজ সকালের জন্মদিন ছিলো আবীর!”
আমি পুরাই থ’ হয়ে গেলাম! “কিন্তু, সকাল বলতেছিলো যে আজ তোমার জন্মদিন? আর বাবলির সাথে আমার কী না কী হয়েছে, তাই তোমার সাথে ব্রেক আপ করেছি নাকি?”
“কী আজেবাজে বকতেছো? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? কিসের ব্রেকআপ? সকাল এইসব কই থেকে জানলো?”
“কাল রাতে ছাদে তোমার আমার কথা শুনেছে ও। সারারাত নাকি ছাদে বসে কাঁদছো তুমি?”
“আমি ক্যান কাঁদতে যাবো?দাঁড়াও…কোথাও ভুল হইতেছে! সকালই কাল রাতে ছাদে ছিলো। আম্মু ওরে সকালে ছাদে পেয়েছে। তার মানে…”
“তার মানে কী?” আমি চরমমাত্রায় কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম।
“ওর ডায়রীটাতে যা লিখেছে…একটা ছেলের কথা…বাবলি নামের এক মেয়ের সাথে নতুন করে জড়াইছে…ও লিখেছে, আজকের জন্মদিনটাই ওর শেষদিন! আমি তো ভেবেছি এসব ওর ছেলেমানুষী লেখা!” সন্ধ্যা আতকে উঠলো! “ওর রুমে রান্নাঘরের চাকুটা দেখেছি আমি! হায় আল্লাহ!!”
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, “কোনো সমস্যা…সকালের কিছু হয়েছে?”
“আবীর! সর্বনাশ হতে যাচ্ছে! আমি রাখলাম…আম্মা আ আ আ…” বলে একবার চিতকার শুনলাম সন্ধ্যার।
ভয়ে, আতংকে আমি জড়োসড়ো হয়ে গেলাম! পুরো ব্যাপারটা এখন পরিস্কার! সকালই আসলে একটা কম্পলিকেটেট সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। যে ছেলের সাথে জড়িয়েছে সেই ছেলে আবার বাবলি নামের এক মেয়ের সাথে জড়িয়েছে! সকাল এটা মেনে নিতে পারছে না। তাই গতকাল রাতে ওদের ব্রেক আপ হয়েছে। তাই, সারারাত ছাদেই একাকী কান্নাকাটি করেছে! তারপর আবেগপ্রবণ মন নিজেকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। টিনেজ বয়েসে যা হয় আরর কী! যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে! মেয়েটার কী হবে?
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না।
আবার যদি ফোন আসে। ঐ নাম্বার থেকে। সকালের শেষ খবর কী? কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
কিন্তু ওই রাতের পর আর কখনো ঐ নাম্বার থেকে ফোন আসে নি। আমিও আর অপরিচিত নাম্বারটিতে ফোন দিই নি। উঠতি বয়েসী একটি মেয়ের ইনফ্যাচুয়েশানের জন্য কোনো দুঃসংবাদ যদি শুনতে হয়!
এখনও মাঝে মধ্যে 'সকাল আসে না, আয়না হাসে না' গানটি শুনলে ঐ সকাল নামের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। যার হাইট নাকি পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৮