আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। তার আদর্শের কর্মীর হাতে লড়াইরত অবস্থায় যদি আমি মরে যাই, তবে সেটা আমার জন্য শাহাদাতের সর্বোত্তম মৃত্যু। এটাই আমার ঈমান।
কিন্তু আমি যখন ইতিহাসের মূল্যায়নে বসি তখন ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহন করাও আমার ঈমানী দায়িত্ব। কোন ব্যক্তিসত্তা আমার শত্রু নয়; আদর্শই আমার শত্রু।
ঈসা খাঁ, মুসা খাঁ পরবর্তী বাংলার সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাসে শেখ মুজিব সব'চে উজ্জ্বল নাম। তার হাত ধরে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ভৌগলিক স্বাধীনতা লাভ করে। যে বীজ রূপণ করেছিলেন আমাদের পূর্ববর্তী বীর সেনানীরা, তারই ধারাবাহিক পূর্ণতা আসে শেখ মুজিবের হাত ধরে। যে স্বাধীন বাংলাদেশে আজ আমার বাস, সে ভৌগলিক সীমারেখা তৈরিতে যাদের জীবন অসামান্য ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল; আমার কী উচিত হবে তাদের ব্যাপারে মিথ্যা ধারনা পোষন করা? যে সত্যকে উপলব্দি করতে জানে না, সে সত্যের পথে লড়তেও জানে না।
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সঞ্চিত হয়েছিল নেতৃত্বের বিরল গুণ। এটা সঞ্চারিত হয়েছিল কয়েকশ বছরের দীর্ঘ শোষণ বঞ্ছনার বিরুদ্ধে বাংলার ধারাবাহিক দ্রোহী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ইতিহাস যেখানে এসে বাঁক নেয়, সেখানে যে প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয়; সে উত্তেজিত মাহেন্দ্রক্ষণের নেতৃত্ব যার কপালে জোটে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে হয়ে ওঠে অনন্য উচ্চতার অধিকারী। এটা মহান দার্শনিক ইবনে খালদুনের থিওরি। নদী যেখানে তার বাঁক বদল করে সেখানে পানির উন্মাদ তরঙ্গ তৈরি হয়। অন্যান্য স্থানের চেয়ে সেখানে গভীর খাদ আর ঘুর্ণনের যে বিশেষত্ব আসে ইতিহাস ঠিক এমনই। এজন্য এটা নসিবের সাথেও সম্পৃক্ত। বঙ্গবন্ধুর কপালে এ ঐতিহাসিক ঘুর্ণনে নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ হয়েছিল। প্রমাণ হিসেবে আমি বলতে পারি ৭ই মার্চের সে বিখ্যাত বক্তব্যের কথা। আপনি শেখ মুজিবের জীবনে আরও যে সকল বক্তব্য রয়েছে সেগুলোর সাথে ৭ই মার্চের বক্তব্যকে পাশাপাশি বসিয়ে দেখুন! কেমন আকাশপাতাল পার্থক্য! একই ব্যক্তির হাজারো বক্তব্যের মধ্যে ঐ একটিই কেন অনন্য উচ্চতায় উঠে গেল? একমাত্র কারণ, সমগ্র জাতীয় লক্ষ্য একই ময়দানে সেদিন কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল আর শেখ মুজিব ছিলেন তারই মধ্যবিন্দু। এ বক্তব্য তার মূখ দিয়ে বেরিয়েছে মাত্র, কিন্তু তা রচিত হয়েছে দামাল বাংলার হৈ চৈ এর মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার এ উজ্জীবন একদিনে অথবা এক রাত্রির কোন দৈব স্বপ্নে রচিত হয় নি। এজন্য লড়তে হয়েছে সুদীর্ঘকাল। প্রত্যেক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি নিজেই নিজের চারপাশে একটি শক্ত আবরণ তৈরি করে, যার মাধ্যমে হেফাযত হবে বলে তার স্থির বিশ্বাস জন্মে। বাংলার সাংস্কৃতিক শরীর এ থেকে মুক্ত ছিল না। তিলে তিলে, কালক্রমায় এ দেহ চিত্রবন্দী হওয়ার জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি নেয় একাত্তরে।
এ লড়াই বিশ্বাসের ছিল না; ছিল জ্যাত্যের! এ লড়াই আদর্শের ছিল না; ছিল পরিচয়ের। এজন্য এর ফলাফলও বাংলাকে গঠন করেনি; ভৌগলিক পরিচয় দিয়েছে মাত্র! বাংলায় (উপমহাদেশেও) কোন কালেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমে দাড়িয়ে কোন প্রসাদ নির্মাণ হয়নি। মুসলিম আমলেও না। ব্রিটিশ আমল শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গাই ছিল লক্ষ্য; এমনকি ইসলামী চেতনা ধারনকারী কোন গুষ্টিও না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মাওলানা মওদুদী (র.) এবং মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী (র.)এর জাতীতত্ত্বের দ্বন্ধের মধ্যে। যেখানে এ প্রশ্ন জড়িত ছিল যে আমরা ভারতীয় না মুসলিম?
(বালাকোটের প্রচেষ্টার উদাহরণ অনেকে পেশ করতে পারেন কিন্তু এটা ছিল একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র, যার প্রভাব আর নিদর্শনের কোনই ক্রিয়া নেই উপমহাদেশে)।
বঙ্গবন্ধুর ভুমিকা নিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকা খুবই বাস্তবসম্মত, কিন্তু তাকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক বক্তব্যের ঘোর বিরোধী আমি। এক্ষেত্র রাসুল (স.)-এর বানীই আমাদের পথ বাতলাবে। তিনি বলেছেন, তাদেরকে (মৃতদের) ছেড়ে দাও, তারা তাদের পরিণতির কাছে পৌছে গেছে।" কেন আমি আমার আমলনামায় নোংরা কথাবার্তা দিয়ে ভরে রাখব। মুজিবের পক্ষে অথবা বিপক্ষে লড়াইয়ের জন্য তো আমার পয়দা হয় নি! তিনি তো তার পরিণতি ভোগ করছেন। এটা কেমন তা আল্লাহই ভাল জানেন।
যুদ্ধের ময়দানে লড়াইরত মুসলমানকে সেন্স স্পষ্ট রেখে লড়াই করতে হয়। আলী (রা)'র সেই ঐতিহাসিক ঘঠনাই যার প্রমাণ। যুদ্ধের ময়দানে ধরাশায়ী শত্রু তার তরবারি'র নীচে পড়ে যায়। কোপ দেয়ার মুহূর্তেই কাফির সৈন্য আলী'র মূখে নিক্ষেপ করে মূখভর্তি থুথু। আলী'র তলোয়ার পলকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। তিনি আর কোপ দিয়ে হত্যা করলেন না। কারণ ব্যাখ্যা করে আলী (রা) বললেন, এতক্ষণ তাকে হত্যার জন্য লড়েছি এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ আর রাসুল। এখানে ব্যক্তিগত কোন দ্বন্ধ ছিল না। কিন্তু থুথু নিক্ষেপের পর যদি তারে হত্যা করি তবে সেখানে আল্লাহ ও রাসুলের বিপরীতে ব্যক্তিগত ক্রোধ চলে আসতে পারে বিধায় আমার তলোয়ার উল্টো ফিরে আসলো। এ সমস্ত নজির কী আমাদের চোখে পড়ে না।
কাল আবার ঘনীভূত হচ্ছে;
ইতিহাস আবার নতুন চিত্রাঙ্কনের জন্য তৈরি হচ্ছে। সমস্ত পৃথিবী আবার দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। সত্যমিথ্যার চিরায়ত দ্বন্ধ আবার মূখমুখী। খুবই হুশে হাল বাইতে হবে। নিকটতম সময়ের মধ্যে সর্বব্যাপী যুদ্ধের আওয়াজ বেজে উঠতে পারে। ওধার থেকে আসবে ঘৃণা; এর বিপরীতে ছোড়ে দিতে হবে ফুল। জানি, তবুও হয়তো সংগ্রাম এড়ানো যাবে না কিন্তু নৈতিক এবং আদর্শিক সংগ্রামের পার্থক্যতো তৈরি করা যাবে তো।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৮