মরহুম কবি আফজাল চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি 'এই ঢাকা এই জাহাঙ্গীরনগর'। ইশ্বরচন্দ্র-বঙ্কিমের নখরামির জবাবে কালজয়ী রচনা 'এই ঢাকা এই জাহাঙ্গীরনগর' কবিতাটি। প্রত্যেকের উচিত এ কবিতাটি পড়া এবং এর চেতনা ধারণ করা।
এই ঢাকা এই জাহাঙ্গীরনগর
আফজাল চৌধুরী
'ঢাকাতে দু'চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন-পথের
পথিক হইবে- কাক, কুকুর ও মুসলমান। এই তিনটি সমভাবে কলহপ্রিয়,
অতি দুর্দ্দম, অজেয়। ' বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কটাচক্ষু ইংরেজের দাসস্য দাস, ঠাস গোলাম খাস
বাঁকাচাঁদ চাটুজ্জ্যের এই জঘন্য উক্তি এবং
এত অনৈতিহাসিক বিষাক্ত গালগল্পের রচয়িতা বর্ণবাদী লোকটিকে
সাম্প্রদায়িক সকল রক্তপাত ও হাঙ্গামার জন্য
কালের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত করলাম আমরা
সত্যসন্ধ হিন্দু ও মর্মাহত মুসলিম বাঙালিরা
হিন্দু বাংলাকে মুসলিম বাংলার দুশমনে পরিণত করেছে এই লোক
এবং তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র, বন্ধু ও শিষ্য দীনবন্ধু, হেমচন্দ্র, ডিএল রায়
এবং নবীন সেন গং মিলে
হিংসা ও বিদ্বেষের হলাহল গলগল করে বমন করেছেন তাদের সাহিত্যকর্মে
এমনকি রবীন্দ্রনাথ, যিনি
এই ঘৃণ্য প্রভাববলয় হতে কোনোমতে জীবনের শেষোধ্যায়ে
বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন
তাঁরও গুরু এই বাঁকাচাঁদ চাটুজ্জ্যে রত্নই, এমনি এক কালো হামজাদকে
ওরা পূজা করে ঋষি অভিধায়??
চামার জাতকে ওরা বর্ণভেদপ্রথায় বলে 'ঋষি'
অভিন্ন বানান, অভিন্ন উচ্চারণ, এই ব্রাহ্মণও
শাশ্বত সত্যলোকে তেমনি ঋষি বটে
পুনর্জন্ম নিয়ে হলেন কাক বা কুকুর কি না
কে জানে তা তার বিশ্বাস জন্মান্তরবাদে তো ছিলই
পুনর্জন্ম তার
মুসলিম সন্তানরূপে হয়েছে তো,
আফজাল চৌধুরীরূপে বঙ্কিমচন্দ্রের
পুনর্জন্ম হয়েছে এই দাবি করেন যদি
কে খণ্ডাবে তা।
নিরীহ জীবনানন্দ পাখি কিংবা অন্যকিছু হয়ে
জন্মান্তর চেয়েছিলেন এই বাংলায়
অর্থাৎ জন্মকাণ্ডে হাত নেই চাটুজ্জ্যে, বাড়ুজ্জ্যে, কোনো মুখোজ্জ্যে
ব্রাহ্মণ কিংবা কায়স্থ দাশ বা মহাস্য দাসের
তাই, এই ঝুঁকিপূর্ণ মতবাদ মোতাবেক কি হয়েছে তাঁর পরিণতি খোদাই মালুম।
হে আনন্দমঠের রচয়িতা আসুন, দেখুন
ঘৃণার আগুনে পুড়ে রাঢ় ও বাংলায়
বর্ণবাদী বাঙালিয়ানার কী দুর্দশা এখন
হিন্দি ও দিল্লির লাড্ডু চটকিয়ে কেমন
দাসস্য দাস গোটা পশ্চিমা বাংলাই।
আর সুতানটি, কলকাতা মৌজার আপনার অতিপ্রিয়
জবচার্ণক প্রতিষ্ঠিত শহরটির ঐতিহ্য কী?
কোম্পানির কর্মচারী গভর্নর ড্রেক, শয়তান রবার্ট ক্লাইভ, দুর্বৃত্ত হেস্টিংস
কুচক্রী কর্নওয়ালিসের মতো জঘন্য লুটেরা
ছিলো এই নগরীর শাসক শোষক;
সেতাব রায়, রেজা খাঁ, দেবী সিংহ, কান্তবাবু, রামচাঁদ, নবকৃষ্ণ ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ
নামের মূর্তিমান শয়তানচক্রের যত চোট্টা ও চুতিয়া সঙ্গে ছিলো
নীলচাষ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের হোতা তো এরাই
যাদের নামোচ্চারণে গা শিউরে ওঠে
ঐতিহাসিকদের শরীরের পশম ঝরে পড়ে
নিষ্ঠুর সূর্যাস্ত আইন, অত্যাচারিত নীলচাষী তাঁতিদের আঙুল কর্তন
ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের হোতা তো এরাই
পলাশী প্রহসনের বিশ বছরের মধ্যেই শাসক কোম্পানি
(কী দুর্ভাগ্য! কোম্পানি কিভাবে হয় দেশের শাসক)
কলকাতাকে সাজিয়ে তুললো, এ সময়ে
মুর্শিদাবাদের টাকশাল নিয়ে আসা হলো
আদালতও উঠিয়ে আনা হলো মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায়
পলাশীর অপরাধীরা একে একে মারা পড়লো
মীরজাফর কুষ্ঠরোগে ধুকে ধুকে, মীরন বজ্রাঘাতে
কোটিপতি উমিচাঁদ মরলো নিঃস্ব হয়ে না খেয়ে,
জগৎশেঠ ও স্বরূপচাঁদকে গঙ্গায় চুবিয়ে মারলেন মীরকাশিম
রায়দুর্লভকে জেলখানায় গলে পচে শেষ হতে হল
দুর্লভ রায়, সর্বস্বান্ত ও নাস্তানাবুদ হয়ে মরলো
নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলো হেস্টিংস
ক্লাইভ করলো আত্মহত্যা
মোহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরলো দুর্গন্ধযুক্ত পাতকুয়ায়
এভাবেই মুর্শিদকুলী খাঁর মুর্শিদাবাদ শেষ হলো আর জেগে ওঠলো
জবচার্ণকের কলকাতা
বালিগঞ্জে, টালিগঞ্জে জেঁকে বসলো
জমিদার বেনিয়ান মুৎসুদ্দি ও কালো চামড়ার সুদখোর মহাজন শ্রেণী
লেনে বাইলেনে ইটের ওপরে ইট মাঝে মানুষ কীট কিলবিল করতে লাগলো
আর লুটেরা ইংরেজের রাজত্বের দ্বিতীয় নগরী হলো কলকাতা বন্দর
বর্ণবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিচরণস্থল এই ট্রাম ও টাঙায় চলা উপনিবেশ
এই কলকাতা, উচ্ছিষ্টভোগীদের শহর
শ্বেতাঙ্গ সম্রাজ্যের শক্তিকেন্দ্র
এখানকার 'রায়বাহাদুর' ও সি,আই,ই
'ঋষি' বঙ্কিমচন্দ্র
দুর্গেশনন্দিনী, রাজসিংহ ও আনন্দমঠ নামক হিন্দুত্ববাদী নরকাগ্নির হোতা
দেখুন চাটুজ্জ্যে মশায়
আপনার এই কল্লোলিনী কলকাতা কখনো হবে না
গৌড়, পাণ্ডুয়া, মুর্শিদাবাদ ও জাহাঙ্গীরনগরের মতো সার্বভৌম,
পবিত্র নগরী
গনোরিয়া, সিফিলিস, কুষ্ঠরোগ ও এইডসের এই শহরকে
ফিরিঙ্গির প্রমোদপল্লি বলা যেতে পারে
আর যে ঢাকাকে আপনার চোখে লেগেছে
কাক, কুকুর ও মুসলমান অধ্যুষিত নিকৃষ্ট নগর
তার পটভূমি হলো যুগযুগব্যাপী রাজস্থান
সাভার, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও তারপর জাহাঙ্গীরনগর
সর্বশেষ স্বল্পকালীন বাংলাসাম ও পূর্বপাকিস্তান হয়ে
বাংলাদেশের রাজধানী।
এখানকার লোকেরা মাতৃভাষার জন্যে রক্তপাত করেছে
বাংলাকে বসিয়েছে সমস্ত দুনিয়াব্যাপী
স্বাধীনতা সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছে সার্বভৌমত্ব
কারও দয়ায় তো নয় বরং
বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে
আর হে বাঁকাচাঁদ!
আপনার নগর ছিল প্রথম আযাদী মহাসমরের সময়
ব্রিটিশের দুর্ভেদ্য দুর্গ, বর্ণবাদী দালালদের নিরাপদ স্থল
আপনার গুরি ঈশ্বরগুপ্তের কলম থেকে তখন কী বেরিয়েছিল?
সমস্ত এলিট হিন্দু বাংলা কী জঘন্য কোলেবরেটর তখন
যখন,
ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরের সদরঘাট চত্তরের
গাছে গাছে ঝুলন্ত দেখা গেছে বিপ্লবী যোদ্ধাদের লাশ
এখানে যুদ্ধ হয়েছে মরণপণ, বীর পাতলা খানের নেতৃত্বে
এই প্রতিরোধ সংগ্রাম ছিল অজেয় দুর্দম
যাকে পরে হাতীর পায়ের তলায় পিষে মেরেছে ইংরেজ
এই চত্তরের নাম দিয়েছিল ওরা ভিক্টোরিয়া পার্ক
আমরা বদল করে রেখেছি সম্রাট ও বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা
দ্বিতীয় বাহাদুর শা'র নামে
যুদ্ধ হয়েছে সর্বত্র-মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হতে শুরু হয়ে সমগ্র হিন্দুস্তানে
এবং বাংলায়, বিশেষত চট্টগ্রাম, সিলেট, আসাম, মনিপুর ও বার্মায়
একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতা নগরী
ঈশ্বরগুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্রসহ দালাল তাবৎ বুদ্ধিজীবী এবং
রাজা, মহারাজা, জমিদার, মুৎসুদ্দি শ্রেণীর লোকেরা
এখানে বরকন্দাজ বসিয়ে, চৌকি লাগিয়ে, কুচকাওয়াজে মত্ত হয়ে
হৈ-হল্লা ও নর্তনে কুর্দনে রাত জেগে আর দিনে ঘুমিয়ে
বিপ্লবের বাণীকে বিদ্রূপ করেছে তাই
তৎকালীন কলকাতা ও খলকতা প্রায় অভিন্ন শব্দই।
আর ঢাকা?
রাজা হরিশচন্দ্রের রাজধানী ছিল কোহি ভাওয়াল বা
ভাওয়ালের গড় তথা ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলব্যাপী লাল মৃত্তিকায়
ঢাকার ঠিক এক মঞ্জিল দক্ষিণ দিকে
লক্ষণ সেনের দ্বিতীয় পর্বের রাজ্যকেন্দ্রটি ছিল তো বিক্রমপুরেই
আর সোনারগাঁও, শীতলক্ষ্যার তীরবর্তী সুবর্ণগ্রামে
ঢাকার দশ মাইল পূর্বের মহাজনপদে
আদি মধ্যযুগীয় বিধ্বস্ত নগরীর ধ্বংসাবশেষ
গোয়ালদী, মোগরাপাড়া, মুক্তিসপুর, দমদমা, ভাগলপুর এবং
বিবিধ মৌজায় সমগ্র সোনারগাঁয়ের পানাম-দুলালপুর-ইছাপাড়াসহ
এখনও দ্রষ্টব্য
বায়তুল মোকাররমের পূর্বসংস্করণ সুলতান নুসরত শাহের সেই চতুষ্কোণ মসজিদ
যুগমানব শামসুদ্দীন আবু তাওয়ামাসহ
সার্বভৌম ইলিয়াস শাহ এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযমশাহের
উন্মুক্ত কবরগুলোর কোনো মকবেরা নেই।
কেননা এরা ছিলেন মালিকুশ শার্ক,
ইসলামী দুনিয়ার পূর্ব সীমানার শাসক, খলিফার খেলাফতপ্রাপ্ত নরপতি
দিঘি ও ঘাটলা, সড়ক ও সেতু, টাকশাল
সারি সারি ইমারত ও দুর্গপ্রাকার
স্বাধীন সুলতানি স্বর্ণযুগের কথা বলছে
গৌড়েশ্বর আলাউদ্দিন হোসেনশাহের গৌরবের কৌটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি
মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পৌঁছে যায় ঈসা খাঁ মসনদে আলার স্বাধীনতা রক্ষা
ও সুবেদার ইসলাম খাঁর হাতে তাঁর পুত্র মুসা খাঁর আত্মসমর্পণ
এবং রাজধানী সোনারগাঁর পতনের শেষ অঙ্ক তামাত পৌঁছে যায়।
এই সোনারগাঁ থেকেই বিশ্বপরিব্রাজক ইবনে বতুতা
চতুর্দশ শতকের প্রথম পাদে পৌঁছেছিলেন নৌপথে
উত্তরের সিলেট নগরে
মহাসাধক শাহজালালের দরগায় তিনি
সাদরে গৃহীত হয়েছিলেন,
তাঁকে দুই মঞ্জিল পথ আগে দুইজন দরবেশ স্বাগত জানিয়েছিলেন
আর তাঁর স্বচক্ষে দেখা সুরমার উভয় তীরে সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চল
যেন নীলনদ তীরবর্তী উন্নত সভ্যতার নিদর্শন
আর মানুষগুলো তুর্কিদের মতো তেজস্বী ও সফেদ
তিনি দেখলেন ছিপছিপে একহারা দীপ্তচক্ষু দরবেশকে
যিনি পৌত্তলিক ও মুসলিম উভয় সমাজে
শ্রদ্ধেয় মহান ব্যক্তিত্ব
দক্ষিণ পূর্ব বাংলাসামের আধ্যাত্মিক গুরু
আর ইবনে বতুতা দেখলেন তাঁকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কুতুবরূপে
তাঁর সঙ্গী দরবেশ ও মুবাল্লিগেরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন
মিন্দানাও, মালয় জাতি ও চীনাদের মাঝে, প্রাচ্যজগতের
ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সোনারগাঁর পরেই এই সিলেট শরীফ
বাংলাসামের হৃৎপিণ্ডের মতোই যার অবস্থান
সুলতানুল হিন্দ তাঁকে এখানে পাঠালেন
সুলতানুল বাংলাসামরূপে
তাঁর আত্মিক শক্তির কাছে মাথা নোয়ালো
অত্যাচারী গৌড়গোবিন্দ, কাপালিক ও জাদুবিদ্যাবিদ
কিরাত জাতির এই হিন্দু শাসক
বৌদ্ধদের নিপীড়ক রূপে পাকাপোক্ত হয়ে
মুসলিম নিপীড়নে এগিয়ে আসলো
কেটে ফেললো সাধক বোরহানউদ্দিনের হাত
শিরশ্ছেদ করলো তাঁর নবজাতক শিশুকে
গোহত্যার অভিযোগে ছারখার করলো নবদীক্ষিত মুসলিম পল্লীগুলোকে
অহো কী করুণ ইতিহাস!
সিকান্দর গাজীর নেতৃত্বে সোনারগাঁ থেকে প্রেরিত পর পর দুটি অভিযান সে ঠেকিয়ে
নিজেকে ঘোষণা করলো রাজাধিরাজ
বোরহানউদ্দিন পৌঁছুলেন প্রথম সোনারগাঁয়েই
তারপর সুলতান ফিরোজশাহের গৌড়-দরবারে
সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার মনোনীত হলেন শ্রীহট্টের জেহাদের
সেনানায়ক, সঙ্গে সিকান্দার গাজী, প্রধান উপদেষ্টারূপে
ত্রিবেণিতে অবস্থান করেছিলেন ৩৬০ আউলিয়াসহ কুতুবে জামান
হজরত জালালুদ্দিন তাবরেজি তথা শাহজালাল ইয়েমেনি (রঃ)
সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার এক মহান সাধকপুরুষ
আজমির হতে বাংলাসামের দিকে যাওয়ার
অদৃশ্য অঙ্গুলি নির্দেশ পেয়ে
অপেক্ষমাণ হলেন ত্রিবেণী সংগমে
সুলতানি ফৌজ নিয়ে নাসিরুদ্দিন সেখানে পৌঁছলেন
দীক্ষিত হলেন সকলেই হজরতের হাতে হাত রেখে
মুজাহিদবাহিনী এগিয়ে চললো
লাউড়-গৌড়-ইটা ও তুঙ্গাঞ্চল অভিমুখে
শ্রীহট্ট তথা বাংলাসামের হৃৎপিণ্ড তাক করে
অশ্বারোহী, তিরন্দাজ ও পদাতিক যৌথবাহিনী ছুটলো
যুদ্ধের চেয়ে জাদু চালানোকে বেশি গুরুত্ব দিত গৌড়গোবিন্দ
সিকান্দর গাজী দিতেন যুদ্ধকে
ফলে ইতোপূর্বের দুটি অভিযানই ছিল অসমযুদ্ধ
এইবার হজরতের উপস্থিতি বাহিনীকে করলো অপরাজেয়
জায়নামাজ বিছিয়ে পেরিয়ে গেলেন ওরা সুরমা নদী
অধিকৃত হলো শ্রীহট্ট, হজরত শাহচটের আজান ধ্বনিতে
গৌড়গোবিন্দের দুর্গ চুরমার হয়ে ধ্বসে পড়লো
বাঁকাচাঁদ খচিত পতাকা উড়লো সেখানে
আল্লাহু আকবার আওয়াজ পৌত্তলিকতার বাতাবরণ
ছিন্নভিন্ন করলো আর
এখন ইবনে বতুতা দণ্ডায়মান সেই মুজাহদ দরবেশের সামনে
এখন তাঁর বিদায়ের পালা
একটি চমৎকার ছাগচর্ম-জোব্বা গায়ে পরে মিটিমিটি হাসছেন হজরত
ধীর ও শান্ত কণ্ঠে বললেন তিনি :
আপনি হে মহান পরিব্রাজক, এখান থেকে চাটগাঁ হয়ে
সাগর পাড়ি দিয়ে চীনদেশের ক্যন্টাননগরে পৌঁছবেন অচিরেই
সেখানে আমার বন্ধু আছেন একজন
তাঁর জন্যে হাদিয়াস্বরূপ এই জোব্বাটি আপনাকে আমি পরিয়ে দিলাম
বতুতা জোব্বাটির প্রতি আসক্তির নজর ফেলে ভাবলেন
'জোব্বাটি হাতছাড়া করছি না আমি'
কিন্তু পথিমধ্যে চীনা তস্করের হাতে লুণ্ঠিত হলো সেই জোব্বা
এবং যথারীতি পৌঁছে গেল স্থানীয় রাজার ভাগ্যে
অবশেষে হাদিয়াস্বরূপ সেই উদ্দিষ্ট সাধকের ঠাঁই
ইবনে বতুতা সেখানে পৌঁছে দেখলেন জোব্বাটি দরবেশের গায়ে শোভা পাচ্ছে
ইনি বতুতাকে স্বাগত জানিয়ে মিটিমিটি হাসতেছিলেন
বললেন, 'আমার বন্ধুর হাদিয়া চীনদেশে পৌঁছে গেল আপনার মাধ্যমে,
আপনাকে মোবারকবাদ'
হঠাৎ ছলছল চোখে, গম্ভীর আননে তিনি ব্যথিত কণ্ঠে বললেন,
'আজ চল্লিশ দিন হলো, হজরত শাহজালালের হয়েছে ইন্তেকাল,
ইন্নালিল্লাহি ওয়া অন্না ইলাইহি রাজিউন।'
আর রাজা গণেশের কথাও বলে এক ফাঁকে
সেই খলনায়কের কথা, পুত্র যদুকে জালালুদ্দিন বানিয়ে
ক্ষমতা দখল ও তা রক্ষার বলা যায়
সপ্তদশ শতক শুরু হতেই কামেল দরবেশ শেখ সেলিম চিশতীর পৌত্র
সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়পাত্র আলাউদ্দিন
তারপর ইসলাম খান চিশতী আসলেন
থাকলেন সুবে বাঙালার সুবেদার হয়ে
নদীমাতৃক ঢাকাকে করলেন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর
ভেনিসের মতো এক সুনাব্য নগরী
তিনি রাজমহল বা আকবরনগর হতে নৌপথে ইছামতী ধলেশ্বরী হয়ে
পৌঁছুলেন বুড়িগঙ্গায়
ঢাকাইয়া প্রাকৃত বুলি শুনে পুলক বোধ করলেন খানে খানান
বিদ্রোহের বহ্নিজ্বালাকে বন্ধুত্বের বহ্নিৎসবে পরিণত করার স্থিরসংকল্প
তাঁর প্রশান্ত আননে,
চিশতিয়া তরিকার এই রাজর্ষি পুরুষ
দু'শ বছর আগের শ্রীহট্ট অভিযানের আধ্যাত্মিক ব্লুপ্রিন্ট সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত হয়েই
এখানে খিমা গাড়লেন এসে
সুলতানুল হিন্দ ও সুলতানুল বাংলাসামের উত্তরাধিকারী হয়ে তিনি
রাজকীয় বজরা থেকে নেমে প্রথমে পা রাখলেন
তার নাম হলো ইসলামপুর
পরবর্তীকালে সারি বেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেখানে
বড়ো কাটরা, ছোট কাটরা ও আহসান মঞ্জিল
শ্রীহট্ট-কাছাড়ের খাজা অসমান
সোনারগাঁয়ের মুসা খান
বানিয়াচুঙ্গের আনোয়ার খাঁ
সুতাঙ্গের পহলোয়ান
ফতেহাবাদের মজলিশ কুতুব প্রমুখ বারোভুঁইয়াদের সঙ্গে
লড়াই হয়েছে এবং হয়েছে বন্ধুত্ব স্থাপন
অভিন্ন জাতিসত্তার ডাকে সাড়া দিয়ে উল্লিখিত নায়কগণ
গড়লেন সমৃদ্ধ মুসলিম বাংলার মধ্যযুগীয় রূপ
তাঁর দুর্গ যা ব্রিটিশের হাতে পরিণত হয়েছে
কেন্দ্রীয় কারাগাররূপে, তাঁর ক্যান্টনমেন্ট পিলখানা এখনো
সেনানিবাসরূপেই রয়েছে
মোগলটুলিতে আছে মোঘল এবং মাহুতটুলিতে আছে সেই মাহুতের উত্তরসূরিরা
তাঁর চাঁদের মতো বজরাটি নোঙর করতো চাঁদনিঘাটে
আর বাগ-ই বাদশাহি বা শাহবাগ ছিল তাঁর নিভৃত নিকুঞ্জ, তাঁর ইবাদতগাহ ও
অন্তিম শয্যাস্থল
যেখানে আছেন তিনি শয়ান, আলমে বরজখে
তাঁরই হাতে গড়া এই মহানগরে আসীন হয়েছিলেন
পাঁচজন সম্রাটপুত্র তথা শাহজাদা ও বহু গভর্নর জেনারেল
অপরূপ রূপে সাজালেন এই নগরকে তাঁরা
বড়ো কাটরা, ছোট কাটরা, লালবাগ দুর্গ-এর সাক্ষী এখনো
শাহজাদা খুররম, শাহ সুজা ও শাহজাদা মোহাম্মদ আযম শাহ,
আজিমুশ্বানের ও ফররুখ শিয়ারের স্মৃতিধন্য এই নগরে
এক পর্যায়ে এসেছিলেন দিগবিজয়ী সুবেদার মীরজুমলা তাঁর আসাম অভিযানের
স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ
তোরণটি এখনো তিন নেতার কবরের পাশে দণ্ডায়মান
তিনি আসাম বিজয়ে সক্ষম হয়েছিলেন
বাংলাসামের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়েছিলেন তিনিই, দুশ' বছর পুর্বে
যার আধ্যাত্মিক সংস্থাপনা পত্তন করেছিলেন হজরত শাহজালাল
ভূমিব্যবস্থা সংস্কার করে রাজ্যপাটকে সংহত করেছিলেন
সর্বত্র লঙ্গরখানা খুলে
মোকাবিলা করেছিলেন মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষের
আর সএ অবস্থায় পরবর্তী গরীয়ান শাসক
আমিরুল ওমারা নবাব শায়েস্তা খান, খানে খানান শাসকরূপে আসলেন
যিনি মগ রাজত্ব উৎখাত করে নাফ নদী পর্যন্ত আমাদের সীমানা বাড়িয়েছিলেন
চাটগাঁকে করলেন ইসলামাবাদ, দমন করলেন হার্মাদদের
এই সুবর্ণযুগেই টাকায় আটমন চাউল বিক্রির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সারা দুনিয়ায়
ভিড় করলো পর্তুগিজ, দিনেমার, ফরাসি ও ইংরেজের বাণিজ্যবহর
তারা লুণ্ঠনের হাত গুটিয়ে জালিমের তরবারি ফেলে দিয়ে
মানদণ্ড হাতে তুলে নিল
মুক্ত বাণিজ্যের ফরমান লাভ করলো, ধন্য হলো আর
ইতঃপূর্বে সর্বধর্ম সহাবস্থানের পটভূমি তৈরি হয়েছিল
রেসকোর্সের কালীমন্দির শংকরাচার্যের অনুসারীদের হাতে হয়েছিল গড়া
শিখদের গুরুদ্বার প্রতিষ্ঠা পেল রমনায়, বর্ত্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষস্থলে
তেজগাঁয়ে পর্তুগিজদের চার্চ, ফরাশগঞ্জে ফরাসিদের বসতি,
আর্মানীটোলায় আর্মেনীয়, গ্রিক ও দিনেমারগণ- ইতিউতি
পাটের বাজার ও লবনের বানিজ্যে ওরা যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলো
রোমান ক্যাথলিক, এংলিয়ান ও অর্থোডক্স গির্জাগুলো পত্তন হয়েছিলো
ওয়ারী ও তেজগাঁয়ে গোরস্তান সমেত
শিয়াদের ইমামবাড়া, হোসেনীদালান এবং সুন্নদিদের
অসংখ্য সুরম্য মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের
মিনারে গম্বুজে মকবেরায়
বায়ান্ন বাজার ও তিপ্পান্ন গলির এই মহানগর ; সেই যুগে
চল্লিশ মাইলব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল।
মূলকথা এই,
বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক শশাঙ্কের পতন ও উৎখাতের পর
ছিল শত বছরের অরাজকতা ও মৎস্যন্যায়
জননেতা গোপালের নির্বাচনের মাধ্যমে
মহান বৌদ্ধ পালযুগের পত্তন হয়েছিল তারপর
অষ্টম নবম ও দশক শতক পর্যন্ত ছিল এই গরীয়ান যুগ
তারপর আবার বহিরাগত সেন রাজত্ব ও ব্রাহ্মণ্য দুঃশাসনের পালা
দুশ' বছরের পর বখতিয়ার খিলজীর সতেরো ঘোড়সওয়ার নিয়ে
লক্ষণাবতীতে প্রবেশ ও রাজ লক্ষণ সেনের
খিরকি দুয়ার পথে পলায়ন
তারপর স্বাধীন অর্ধস্বাধীন মুসলিম বাংলার পাঁচশ' বছরের
গৌরবময় বিকাশ ও সমৃদ্ধির যুগ
তাতে 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী' এই প্রবচনের প্রয়োগ হলো এই দেশে
ধেয়ে আসলো মারাঠা শিবসেনারা প্রকাশ্যে নিষ্ঠুর তাণ্ডব চালালো এবং
ফিরিঙ্গি মুলুকের কটাচক্ষু শ্বেতাঙ্গ দানব দলের লোলুপ দৃষ্টিপাত তারপরেই
বাংলা আসাম নামক হরিণীর সুস্বাদু মাংস এরা খুবলে খেতে লাগলো
সিরাজুদ্দৌলা অ মীরকাসিম প্রাণ দিলেন কিন্তু
মোনাফেক মীরজাফর, অধম জগৎশেঠ চক্রের জন্য প্রায় দুশ বছরব্যাপী
বাংলা বিহার ও আসাম হলো ধর্ষিত লুণ্ঠিত ও পরাধীন
গজিয়ে ওঠলো কলকাতা এ সময়ে
বঙ্কিমার গুরু ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় উল্লিখিত হয়েছে
'রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কোলকাতায় আছি'
অর্থাৎ মশা-মাছি ও ঈশ্বরগুপ্তরাই কলকাতায় দৃশ্যমান ছিল সে-সময়ে
ফলে কলকাতায় 'দু'চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের
নয়ন-পথের পথিক হইবে'- মশা, মাছি ও ঈশ্বরগুপ্তের স্বজাতি গয়রহ
এই তিনটি সমভাবে রক্তশোষক, ব্যাধিসঞ্চারক ও জগন্য উৎপাত বিশেষ
এ সময়ে হিন্দু বাংলায় প্রাদুর্ভূত হলেন মহাজন গৌরীসেন
আর মুসলিম বাংলায় হাজি মোহাম্মদ মহসিন
যাঁর ছাত্র-বৃত্তির টাকায় দরিদ্র বঙ্কিমচন্দ্র লেখাপড়া শিখে হলেন
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, লেখক ও সি,আই,ই
অন্ধ 'বন্দে মাতরম' মন্ত্রের ও সহিংস আনন্দমঠের 'ঋষি'
এর আগে কলকলিয়ে উঠেছিলেন কলকাতায়
রামমোহন ও ইশ্বরচন্দ্র নামক দুইজন সংস্কারক হিন্দু হিন্দু বাংলায়
বঙ্কিম এঁদের কষাঘাত করেছেন তাঁর চাবুক সদৃশ কলম দিয়ে
ইতোপূর্বে কায়স্থনন্দন মধুসুদন যাবতীয় স্বজাতীয় পৌত্তলিকতায় পদাঘাত করে
হলেন মাইকেল,সকল আসামীর বিপক্ষে গিয়ে
দ্রাবিড়ের পক্ষ নিয়ে গাঁথলেন 'মেঘনাদবধকাব্য'
রাবণ ও মেঘনাদ হলেন মহানায়ক এবং
রাম-লক্ষণ হলেন প্রতিনায়কে পরিণত হলেন যে কাব্যে
যখন গুরু রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ কুরআনের নির্যাস ও বেদান্তদর্শনের আলোয়
আলোকিত সন্ত হলেন হিন্দু বাংলায়
তারো আগে উত্থিষ্ঠি হয়েছিলেন ফকির মজনু শাহ
ও বিপ্লবী তিতুমীর মুসলিম বাংলায়
হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তৎপুত্র দুদুমিয়া ছিলেন দারুলহক তত্ত্বের পক্ষে
রংপুরে সমাহিত কারামত আলী, জৈনপুরের পীরসাহেব ছিলেন ওই তত্ত্বের বিপক্ষে
বালাকোট রনাঙ্গনের গাজি নিসাপুরীসহ
মুসলিম বাংলার সেই সংস্কারকগণ
পৌত্তলিক সংস্কৃতির দোষণদৃষ্টি থেকে সাফ করে তুললেন মুসলিম বাংলাকে
মুনশি মেহেরউল্লাহ খ্রিস্টান পদরিদের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন আর
ঠেকিয়ে দিলেন তাদের অশুভ প্রক্রিয়া
যখন পাদপ্রদীপের আলোয়
ঝলমল করে ওঠলেন আলীগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও
ফরিদপুরের নওয়াব আব্দুল লতিফ
পাশ্চাত্য রেনেসাঁয় চেতিয়ে তুললেন মধ্য ও উচ্চবিত্ত মুসলিম ভারতকে
আর এই ধারায় যোগ দিলেন জাস্টিস সৈয়দ আমীর আলী
প্রিভিকাউন্সিলের মহান সদস্য হিস্ট্রি অব ইসলাম ও হিস্ট্রি অব সারাসেন
মহাগ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা
মুসলিম বাংলার চিত্ত উন্মোচনকারী
আর ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পর্বতশৃঙ্গের মতো
মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর
তাঁর অবয়ব ও মুখমণ্ডল অবিকল ছিল শহিদ সুলতান টিপুর মতন
অমিত চিত্ত ও বিত্তের অধিকারী নবাব তাঁর সত্তা ও ধনভাণ্ডার
ঢেলে দিলেন বাংলা-আসাম ও হিন্দুস্থানের মুসলিম জাতিসত্তার মুক্তির লক্ষ্যে,
১৯০৫ এর ১৩ অক্টোবর তিনি বাংলা-আসাম প্রদেশ সংগঠনে সক্ষম হলেন
১৯০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় ইসলাম খানের স্মৃতিধন্য শাহবাগের মনোজ্ঞ উদ্যানে
মুসলিম নেতৃবৃন্দের মহাসম্মেলনে
তাঁরই পরিকল্পনা ও মেহমানদারিতে গঠিত হলো
অলইণ্ডিয়া মুসলিমলীগ
তাঁর এই দুই কীর্তি উপমহাদেশের মানচিত্র পাল্টে দিলো
তিরিশোত্তর এক অসাধারণ যুবকের অন্তর্দৃষ্টির পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেন
হেকিম আজমল খান, নওয়াব ভিকারুল মুলক, আল্লামা ইকবাল
ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ
আর এ-অঞ্চলে শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমউদ্দিন
এবং সবশেষে শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান তো তাঁরই অধস্তন মানসসন্তান
হ্যাঁ, মোহাম্মদ মোহসিনের পর মুসলিম বাংলায়
সবচেয়ে বড়ো দাতা পুরুষ এই সলিমুল্লাহ-ই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ কত যে মহৎ কীর্তি তাঁর অবদান
মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে, বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে
ভগ্নপ্রাণে হলো তাঁর জীবনাবসান
তাঁর বাংলা ও আসাম কিছুটা স্বল্পাকারে তবু শেষতক
স্বাধীন সত্তা আর পতাকাসহ আজ দীপ্যমান বটে
আসামের সিলেটাংশ পূর্ববাংলার সাথে মিলে তো হয়েছে এই দেশ
আংশিক বাংলা আর আংশিক আসাম মিলেছে যেহেতু
হতে পারতো এ-রাষ্ট্রের নাম-
'বাংলাসাম' আহা 'বাংলাসাম। '
সিআর দাস ও সুভাষ বোসের অসাম্প্রদায়িক
শেরেবাংলা, সাদুল্লাহ,, বড়দলৈ, শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম
ও মাওলানা ভাষানী
৪৭ এ-ই গড়তে পারতেন সেই 'বাংলাসাম'।
নিখিল বাংলা আর নিখিল আসাম
একযোগে হতে পারতো এশিয়া তথা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এক দেশ
জিন্নাহ ও গান্ধি দুই-ই সম্মতি দিলেন
বাঁধ সাধলেন নেহরু ও প্যাটেল নামের দুই বিবাদী
আশুতোষ মুখার্জিপুত্র আর আনন্দমঠ মন্ত্রে উজ্জীবিত
নেহেরু-প্যাটেলের চেলা হিন্দু বাংলার নেতা শ্যামাপ্রসাদ
সগর্জনে বললেন 'ইফ ইণ্ডিয়া রিমেইন্স ওয়ান
বেঙ্গল মাস্ট বি ডিভাইডেড'
চল্লিশ বছর আগে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে তাঁর পূর্বসূরিরা
সুরেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথেরা কী বলেছিলেন?
হ্যাঁ, আমরা পিণ্ডির জিঞ্জির ছিঁড়েছি দিল্লির জিঞ্জির পরার জন্য নয়
পশ্চিমবাংলা তার সকল স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে এখন
গলার ফাঁসকে ভাবছে মালা, বুট-জুতাকে চকচকে চিবুক মনে করে চুম্বন দিচ্ছে
আচ্ছা! ডক্টর শহীদুল্লাহ ঘোরতর পাকিস্তানবাদী হয়েও
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের উদ্যোক্তা হলেন
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাংলার সেরা কবি হয়েও
হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে গেলেন কেন?
আজগরের মতো পশ্চিমবাংলাকে গ্রাস করছে কোন প্রজাতির সরীসৃপ
আর আহমিয়ারা চিৎকার করছে :
আহম হাহিলে ময় হাহি
অহম কাঁদিলে ময় কাঁদি
ষোড়শ শতক পর্যন্ত বাংলা ও অসমিয়া ছিলো তো এক
অভিন্ন ভাষা, বর্ণমালা এক, ওই ভাষায়
সকল শিশ ধ্বনি অঘোষ হ ধ্বনিতে রূপান্তরিত
যথা-
আজকের হভায় হভাপতি হব হ্রি হিশির হৌমিত্র
ওরা তড়পাচ্ছে, ফারাক্কার বেনোজলে ডুবছে পশ্চিমবাংলা
এই বাংলা হচ্ছে ছারখার
আবার ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে নিতে চায় বিহার, উড়িষ্যা ও কানপুরে তামাত
টিপাইমুখে গড়ছে ফারাক্কা সদৃশ ব্যারেজ ওরা-
মেঘনাকে টুটিচাপার জন্য
গোটা মাগধীমণ্ডলের চেহারাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে চায়
শৌরসেনী মণ্ডলের বর্ণবাদী আর্য শাসকেরা
তাই, আর নয়,
নিখিল বাংলা আর নিখিল আসাম
উত্থিষ্ঠিত হও, ওঠো, ওঠো
জাগ্রত হও ।
স্বচ্ছ পানির তীব্র স্রোতের ওপর ভাসছে তালতমালে ঘেরাও সবুজ গ্রামগুলো
অকাল বানভাসিতে তলিয়েছে এই সঘন বসতির নিম্নাঞ্চল
পানির সরিয়ায় ঢেউ তুলে ব্যস্ত শ্যালো বোটগুলো
মানুষের চেতনায় পারাপার করছে ছলছল গতিবেগ,
লগি-বৈঠার ডিঙি ও কোষাগুলো দারুণ দুলছে
করুণ সামর্থ্য নিয়ে তবু জানান দিচ্ছে এ-তল্লাট
পানির কলকল রবে ভাঙছে পাড়, কান্দি ও উঁচু আইল
গ্রামপতন হচ্ছে, সামাল-সামাল আওয়াজ ওঠছে
প্রাকৃতিক ও মানবিক শোরের ভিতর
দেহাতি মানুষ নিজেদের ডেরাগুলোয় ফিরছে, গুটিগুটি
জারুল ও জারুর শরীর থেকে চেঁচে নিচ্ছে বাকল
ঢোলকলমের কাটি দিয়ে বাঁধছে আঁটি
নারী ও কিশোরীদের কোমল হাত পায়ের ব্যস্ততা বিস্তর
কচ্ছপের পিঠের মতো সদ্য জেগে ওঠা উঠোনগুলোয়
থিকথিক করছে কাদা
নদীস্রোতে ফেলে যাওয়া পলির পলেস্তারায়
নির্বিঘ্ন আছাড় খাচ্ছে দামাল শিশুরা
ঘরদোর মেরামত হচ্ছে বাঁশ কেটে, বেত চিরে
গেরস্ত ও ঘরামির হাতে
রান্না-বান্না চলছে শাক ও শুঁটকির মৌতাতে
নারীদের গতরের গন্ধ মেশানো
ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার মধ্যভূভাগের এই নিম্নাঞ্চলে
শ্রীপুর ও বিক্রমপুরের ইছামতী ও তুরাগের নিম্নাঞ্চলে,
ডেমরা ও ধুলাইখালের ভরাটপূর্ব স্মৃতি নিয়ে
জীবন প্রাগৈতিহাসিকভাবেই এখনে ঘটমান
চাষি, খেতমজুর, জোতদার, বর্গাদারদের
আদি অকৃত্রিম গ্রামগুলো বর্ষাকালীন দ্বীপপুঞ্জ যেন
যেখানে সেপাই, সান্ত্রি, গোলন্দাজ, বরকন্দাজ এবং উজির-নাজির মসনবদার ও
জায়গিরদার শ্রেণীসহ
সুবেদার দিওয়ান, বকশিগণ
উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন যত মোঘল-পাঠান
কেরানি অধ্যুষিত না হয়েও এর নাম কেরানিগঞ্জ বটে
স্বাধীন নবাবের পরিবারকে জিঞ্জির পরিয়ে রাখা হয়েছিল যেখানটায় তার নাম জিঞ্জিরা
নকলনবিশ কারিগরদের আস্তানারূপে এখন যা কুখ্যাত
আর রোহিতপুরের সেরা তাঁতিদের নিবাসভূমি এই গ্রামান্তর
একটি পরগণা
মসলিন-শিল্পীদের উত্তরপুরুষ এরা
আঙুল ও কব্জি কাটা তাঁতিদের পলাতক বংশধরগণ
মোঘলাই ঢাকার এই গহীন বেসিনে এসে আত্মরক্ষাকারী
গেরিলা জনতা যেন; যুগযুগান্তরে
বায়ান্ন হাজার আর তিপ্পান্ন গলির এই শহরকে
ঘিরেই রয়েছে
ওদের চোখের ওপর ওয়াইজঘাটের পর্তুগিজ কুঠি ধসে গিয়েছে
ইসলামপুর উজ্জ্বল করে আসমানে পাখা মেলে রঙিন হয়েছে আহসান মঞ্জিল
আর হালে মতিঝিলের বহুতল হর্মরাজির উত্থান ঘটেছে যখন
ছোটো লাটের বাসভবন হয়েছে হাইকোর্ট
বাংলাসামের সংসদভবন হয়েছে ভার্সিটির কার্জনহল
ইতোপূর্বে দুইটি ঈদের মধ্যবর্তী সময়ে শহরটিকে স্বাধীন হতে দেখেছে
যখন 'জয়বাংলার' জয়ধ্বনির সঙ্গে বিজয়-উল্লাস করছিলো
চাঁদনিঘাট, সোয়ারিঘাট, সদরঘাটের নৌবন্দরগুলোয়
এই ভাটিমুলুকের, সবুজ তল্লাটের পিলপিল জনস্রোত
নিম্নবিত্ত পেশাজীবী
সকাল-সন্ধ্যায় যায়-আসে
রাজধানীর জীবনস্রোতকে জ্যান্ত করে ওরা,
পীর ও পীরজীহুজুর,, হাফেজ্জীহুজুর, মুশরিখোলার, ফরিদপুরির
মুরিদান, এই ধর্মপ্রাণ জনতা
এইসব নদীতীরে পত্তন করেছে এক জিন্দাদিল দারুল ইসলাম
চাকের শাহী মসজিদ থেকে আর
বড়ো কাটরা ও দারুল উলুম লালবাগ মসজিদের সবুজ গম্বুজ ফুঁড়ে
অসংখ্য উঁচুনিচু মিনার হতে ভাসমান সুন্দর আযান
লালবাগ কিল্লার মনোহর নির্মাণে এসে বাড়ি খেয়ে
পাক খেয়ে, বলে দেয় সেই ইতিহাস
যখন মসজিদের শহর এই জাহাঙ্গীরনগর
কেরানীগঞ্জের ভাটি চরাঞ্চল নিয়ে
অনন্তকালের দিকে পাড়ি জমায়; বাহ কী সুন্দর !
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৪২