নীচের ছবি: আখাউড়াতে ফেরী দিয়ে ট্রেইলার পারাপারের জন্য তিতাসনদীর ডাইভারসন সড়ক ভেঙ্গে ইট, পাথর, মাটি উঠিয়ে পানির গভীরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
মনমোহনের সফরে নাকি ট্রানজিট চুক্তি হয় নাই, তাহলে উপরে যে ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে সেইগুলো কিসের ছবি? ট্রানজিটের নামে শত শত টন ওজন বোঝাই ওডিসি (ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো) বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ট্রেইলর, অতিরিক্ত যে ওজনের তোড়ে ট্রানজিটের ভারী মাল পরিবহনের জন্য অনুপযুক্ত বাংলাদেশের দুর্বল সড়ক অবকাঠামো ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। সেই সড়ক অবকাঠামোকে উপযোগী করার জন্য ভারত দিয়েছে আওয়ামী সরকারকে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের আশ্বাস, যে ঋণের টাকা দিয়ে ভারত থেকেই সব মালপত্র কিনে আনতে হবে, ভারত থেকেই ঠিকাদার-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে হবে এবং সেই ঋণের উপর বার্ষিক ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ উচ্চহারে(বিশ্বব্যাঙ্কের সুদের হারের প্রায় দ্বিগুন) সুদ সমেত পুরো ঋণ পরিশোধ করা লাগবে।
ভারতীয় নির্মাণ সামগ্রী, মালপত্র এবং ভারতীয় ঠিকাদার-পরামর্শক নিয়োগ করার মাধ্যমে ঋণের পুরো টাকাটা তো ভারতের পকেটেই আবার ফেরত চলে যাবে। তার উপর উচ্চহারে সুদ সহ এই বিশাল অঙ্কের ঋণের টাকাটা আবার ভারতের কাছেই পাই পাই করে পরিশোধ করতে হবে !!
একেই বলে কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা !!!!
কি চমৎকার, স্বাধীনতার পরপরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা অবাধে লুটপাট এবং '৭২-'৭৪ পর্যন্ত অবাধ সীমান্ত বানিজ্য বা Free Border Trade এর নাম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পাঠানো সকল বিদেশী ত্রান-সাহায্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের মাধ্যমে ভারত যে হাজার হাজার কোটি টাকার লাভ করে শেষে মার্কিনিদের কাছ থেকে বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' উপাধি পাইয়ে দিয়েছিলো তাতেও ভারতের সাধ মিটে নি। বাংলাদেশের সাথে সকল অর্থনৈতিক ও বানিজ্য বৈষম্যের কথা না হয় আপাতত বাদ-ই দিলাম। এবার নতুন কায়দা-কৌশলে আমাদের আবুল-খুকুমণিদের হাত করে 'অবকাঠামো উন্নয়ন' এর ট্যাগ ঝুলিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিশাল একটা লাভজনক বানিজ্য করতে যাচ্ছে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র(!!) ভারত।
মনমোহনের সফরের সময়ে ট্রানজিট তিস্তা-নাটকের জেরে ট্রানজিট চুক্তি বাতিল করেছে বলে প্রচার করে আওয়ামীদের সে কি লোকদেখানো গর্ব আর আত্মতুষ্টি !! কিন্তু গতবছরের ৩০শে নভেম্বরই যে 'আশুগঞ্জ ট্রানজিট চুক্তি' এর নামে ট্রানজিটের প্রথমিক চুক্তিটা হয়ে গেছে সেই কথা কয়জন মনে রেখেছে???
'আশুগঞ্জ ট্রানজিট চুক্তি' অনুসারে আগামী বছর ২০১২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত কোনধরনের ফি ছাড়াই ভারত তার ভারী পণ্যবাহী মালামাল মধ্যরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে নিজেদের ভূ-খন্ডে নিয়ে যাবে, সেই সাথে ইচ্ছে মতো নৌপথ ব্যবহারের অনুমতি তো আছেই।
তথ্যসূত্র: আশুগঞ্জ ট্রানজিট চুক্তি - প্রথম আলো
এদিকে 'অননন্দবাজার' পত্রিকার তথ্যনুসারে মনমোহনের সফরের পরে আমাদের আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট সুবিধা পেতে ১ বছরের মতো সময় লাগতে পারে, আশা করি আগামী বছরের ৩০শে জুনের মধ্যে সেই এক বছরের মেয়াদকাল অবধারিতভাবেই পূর্ণ হয়ে যাবে। তখন 'আশুগঞ্জ ট্রানজিট চুক্তি' এর অনুকরণে নতুন আরেকটা চুক্তি করার জন্য নিশ্চয়ই মনমোহন বা হাসিনা কাউকেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অযথা দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না, হয়ে যাওয়া চুক্তিটার মেয়াদকাল বাড়ালেই ল্যাটা চুকে গেলো, মাঝখান থেকে তিস্তা নিয়েই যতো নাটক মঞ্চস্থ করেই কেবল জনগণের স্ক্রু ঢিলা করার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করা হলো !! তিস্তার ন্যায্য পানির ভাগ দিতে ভারত যেন উন্মুখ হয়ে বসে আছে !!
'৭৪ এর ফারাক্কা প্রকল্পে প্রারম্ভের সময়ে ঠিক একইভাবে একটা ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুমতি চাওয়া হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর কাছে, তিনি সম্মতি দেয়ার পরপরেই আজ ৩৭ বছর যাবত সেই ট্রায়ালটা চালু রয়েছে !!
ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও যে ফারাক্কার মতো অনুরূপ কোন ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি???
তার উপর, প্রাথমিক চুক্তিতে ট্রানজিটের জন্য যখন কোন ফি-ই নির্ধারিত হলো না তখন পরবর্তী চুক্তিতে আমাদের আবুল-খুকুমণিরা কোন উপায়ে এবং কোন মন্ত্রবলে ভারতকে ন্যায্য ফি প্রদানে রাজি করাতে পারবেন??? ট্রানজিটের বিনিময়ে ফি এর নাম করে ভারত যদি নামেমাত্র 'কিছু একটা' বখশিশ দিতে চায় তাতেই আমাদের আবুল-খুকুমণিরা ভারতমাতার গুণগান গাইতে গাইতে রীতিমতো ধন্য হয়ে যাবেন !!!
আসলে আবুল-খুকুমণি-সাহারা-হাসিনা গং রা তো আর ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ বার্ষিক ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে শোধ করবেন না, রাস্তাঘাট ভেঙ্গেচুরে গেলে সেই ক্ষয়ক্ষতিটাও নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে ঠিক করে দিবেন না। ঋণ ও ঋণের উচ্চ সুদ পরিশোধ সহ ট্রানজিটের সকল অর্থনৈতিক ঝড়-ঝাপ্টা এবং দায়-দায়িত্ব যাবে আমাদের জনগণের ঘাড়ের উপর দিয়ে।
বাহ, কি অসাধারণ বন্ধুত্বের নিদর্শন !!!
বন্ধুত্ব হচ্ছে ভারত ও আওয়ামী সরকারের মধ্যে, কিন্তু বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য চড়া মূল্য শোধ করতে হবে দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষদেরকে !!
ধন্য আওয়ামী !! ধন্য বাংলাদেশের জনগণ !!
ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের লাভসমূহ:
১) ট্রানজিটের জন্য সড়ক-রেলপথ-নৌপথ সংস্কারের নামে অবকাঠামো উন্নয়নের ধোঁয়া তুলে যে নির্মাণ-সামগ্রী, মালপত্র এবং ঠিকাদার-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হবে তার সবকিছু ভারত থেকে ক্রয়-নিয়োগের শর্ত বেঁধে দিয়ে ঋণের পুরো টাকাটাই নিরাপদে ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই সাথে এরই মাধ্যমে ভারতের প্রাইভেট সেক্টরের প্রভূত লাভ করা এবং সেখান থেকে কর-ট্যাক্স আদায় করে ভারতের অর্থ-মন্ত্রনালয়ের আরো অনেক অর্থ সমাগম নিশ্চিত করা।
২) বাংলাদেশকে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে সেই ঋণ বার্ষিক ১ দশমিক ৭৫ সুদ হারে পাই পাই করে পুরো ঋণের টাকা সমেত আদায় করে বিশাল আকারের অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন।
৩) ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশকে ন্যায্য ফি, শুল্ক, মাশুল, চার্জ প্রদান না করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সহজে মালামাল পরিবহনের মাধমে পরিবহন ব্যয় অনেক অনেক গুন কমিয়ে আনা।
৪) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহ বা সেভেন-সিস্টার্সে চলমান বিচ্ছন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সহজে ও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অস্ত্র ও সেনাবাহিনী পরিবহন করে সেখানে পৌঁছানোর ক্ষমতা অর্জন করা এবং বিদ্রোহ দমনে অনেকগুলো বাঁধা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। ভারত ট্রানজিটের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের কথা মুখে বললেও সেটার মধ্যে যে প্রতারণা আছে তা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন ট্রানজিটের শর্তের মধ্যে ভারত উল্লেখ করে "সিল-গালা করে দেয়া কোন কন্টেইনার বা কোন কিছু বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ সিল-গালা খুলে চেক করতে পারবে না এবং ভারত চাইলে তার মাল-পত্রের সাথে নিয়াপত্তারক্ষীও প্রেরণ করতে পারবে।"
৫) অরুনাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে বিবাদমান সংঘর্ষের ক্ষেত্রে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারত প্রতিরক্ষা জোরদার করতে সমর্থ হলো এবং বেইজিংকে দিল্লী এই বার্তা পৌঁছে দিলো যে চীনের বিরুদ্ধে সংঘাতে ভারত নিজের জন্য আঞ্চলিক মিত্র(বাংলাদেশ) যোগার করতে সমর্থ হয়েছে।
৬) ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ-চীন সুসম্পর্কে নষ্ট করে ভারত বাংলাদেশের সামরিক নিরাপত্তাকে ধ্বংস করবে এবং দক্ষিন-এশিয়ায় সহজেই আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হবে।
ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষতিসমূহ:
১) ৭ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে চাপিয়ে দেয়া বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় নেয়া।
২) ন্যায্য ও উপযুক্ত ট্রানজিট ফি, শুল্ক, মাশুল, চার্জ আদায় করার ব্যাপারে ভারতকে সম্মত করতে না পেরে 'অবকাঠামো উন্নয়ন' এর নামে নেয়া বিশাল ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য 'খাত সমূহ' কে শুরুতেই নষ্ট করে ফেলা।
৩) বিশাল ঋণের টাকা সুদ সমেত পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত খাত অনুপস্থিত থাকায় ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে দেশীয় অর্থনীতির উপর ভয়াবহ চাপ ও বিপর্যয় ডেকে আনা।
৪) বাংলাদেশের অনুন্নত ও দুর্বল পরিবহন অবকাঠামোর উপর দিয়ে ট্রানজিটের ভারী পরিবহনযানের অবাধ যাতায়তের মাধ্যমে পরিবহন কাঠামোর অপরিসীম ক্ষতি সাধন এবং এইসকল কাঠামোর স্থায়িত্ব অনেক গুনে কমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও বেশী সমস্যাযুক্ত ও বিপদসংকুল করে তোলা।
৫) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী রাজ্যসমূহের নিকট বিদ্রোহ-দমনের প্রশ্নে নিজেকে ভারতের মিত্র বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং এরই সংশ্লিষ্টতায় নিজেকে সেইসকল রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণমূলক হামলা ও আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করানো।
৬) অরুনাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে বিবাদমান সংঘর্ষে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতকে নতুন নতুন সব প্রতিরক্ষাগত মাত্রা উপহার দিয়ে চীনের বিরাগভাজন হওয়া এবং বাংলাদেশ-চীন গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সমূলে বিনষ্ট করা।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যে সামরিক সম্পর্কটি বিদ্যমান আছে তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে থাকে, বিভিন্ন সামরিক প্রকল্পে চীন বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং ২০০২ সালে সাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী যেকোন যুদ্ধকালীন সময়ে চীনই বাংলাদেশের জন্য একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আছে।
বলাই বাহুল্য যে ট্রানজিটের মাধ্যমে বন্ধুত্বের লেবাস ধরা একটি নকল বন্ধু(!!) এর কারণে বাংলাদেশ তার সত্যিকারের প্রকৃত একজন বন্ধুকে হারাবে।