পুরোনো কাঠের আলমারির পাল্লাটা খুলতেই গন্ধটা নাকে ঝাপটা মারলো। ন্যাপথলিনের গন্ধ, সেই আপন পুরোনো গন্ধ!! পাশের ঘর থেকে মা চেঁচিয়ে বললেন “একটাতো নীল রঙের সুতী কোটা শাড়ী থাকার কথা...দেখিস আলমারির সব আবার এলোমেলো করে ফেলিস না যেন!!!” বহ্নি একটা নীল শাড়ী খুজছে। আজ পরে বাইরে যাবে। সুতীর শাড়ী বহ্নির বড্ড প্রিয়। ঢাকায় বেড়াতে এলেই খুঁজে খুঁজে মায়ের সব সুতীর শাড়ীগুলো পরে।
ন্যাপথলিনের গন্ধটা বহ্নিকে হঠাৎই আনমনা করে দিল। মানুষটা সারা শীতকাল একটাই চাদর পড়তো। খয়েরী রঙের, সরু কালো পাড়; সুতো উঠে একটু আঁশটে হয়ে গেছে। যে দিন খুব ঠান্ডা পড়তো সেদিন ফুলহাতা শার্ট আর কালচে মেরুন হাতকাটা সোয়েটারের ওপরে সেই চাদর। হালকা শীত পড়তেই গায়ে চাদর; প্রথম সপ্তাহ খানেক ন্যাপথলিনের গন্ধ। বহ্নির এই গন্ধটা ভালোই লাগতো। আস্তে আস্তে শীত জাঁকিয়ে বসতো আর ন্যাপথলিনের গন্ধটাও উত্তুরে বাতাসে মিলিয়ে যেত।
বেচারার একটাই চাদর। বহ্নির ভীষণ মায়া লাগতো। খুব ঠান্ডার দিনে রিকসায় সেই চাদরে মাথা ঢেকে আসতেন। ঢাকা কলেজের কাছের মেস থেকে বনানী অনেকখানি পথ। আশির দশকের শেষে ঢাকা শহরটা এখনকার মতো যানজটের জালে বন্দী মৎস্যকন্যা ছিলো না। তাও বাস আর রিক্সা মিলিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যেত। স্যার পড়াতে আসতেন সপ্তাহে তিনদিন। বাংলা আর ইংলিশ পড়াতেন। বহ্নিকে সেই ক্লাস ফাইভ থেকে পড়াচ্ছেন; ক্লাস এইট পর্যন্ত সব বিষয় পড়াতেন। নাইনে উঠতেই স্যার বিজ্ঞান আর অঙ্কের জন্য আরেকজন শিক্ষক রাখতে বললেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স করছেন; বাংলা আর ইংলিশ পড়াতেই স্যারের স্বাচ্ছন্দ্য বেশী ছিলো। স্যারই ওনার এক বন্ধুকে ঠিক করে দিলেন যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পদার্থবিজ্ঞানে পড়ছেন।
বহ্নি পড়াশোনায় বেশ ভালো কিন্তু খুব ফাঁকিবাজ। অল্প পড়েই ভালো করতে পারে বলে ছোটবেলা থেকেই সব পড়া পরীক্ষার আগের দিনের জন্য তুলে রাখতো। মা সারাদিন অফিস করে এসে পরীক্ষার আগে যখন দেখতেন কিছুই পড়া হয়নি তখন পিঠে বেশ ভালোই কিল পড়তো। একমাত্র মেয়ে বহ্নি; মা পরে খুব অপরাধবোধে ভুগতেন। শেষে ক্লাস ফাইভে ওঠার পরপরই মার অফিসের এক কলিগ স্যারকে ঠিক করে দিলেন।
প্রথম দিন স্যার এসে ড্রয়িংরুমে বসেছিলেন; বহ্নিরা তখন সেন্ট্রাল রোডে থাকতো। “খুকী তোমার নাম কি?” “কেন? আম্মুতো এক্ষুনি আপনাকে বললো...আমার নাম বহ্নি।“ “এখন থেকে আমি তোমাকে পড়াবো...আর মায়ের কাছে পড়তে হবে না।“ বহ্নি ভীতু চোখে তাকিয়ে বলেছিলো “আপনি কি পড়া না পারলে মারবেন?” স্যার হেসে ফেলেছিলেন; সেই হাসি বহ্নিকে বলে দিয়েছিল মানুষটা খুব ভালো। স্যার আসলেই বহ্নিকে কখনো বেশী বকেনওনি। দুইজন অসমবয়সী মানুষ খুব দ্রুত ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো। বহ্নির প্রচন্ড বই পড়ার নেশা। স্যারও বাংলার ছাত্র, অনেক বই পড়তেন। দুজনে মিলে স্কুলের পড়া বাদেও বাইরের বই নিয়েও অনেক গল্প হতো।
ওরা বনানীতে চলে এলো ক্লাস সিক্সে ওঠার পরে। স্যার ওকে সেই এত্তো দূর থেকে এসে পড়ানোতে সম্মতি দিলেন। যদিও মা বাবা স্যারের আসা যাওয়ার খরচ আর কষ্টের কথা ভেবে বেতন বাড়িয়ে দিলেন কিন্তু বহ্নি জানতো শুধু বন্ধুত্বের জন্যই এই সম্মতি। বহ্নির মতো স্যারও যে বড্ড একা মানুষ ছিলেন। দুজনের পছন্দের মানুষগুলো সব বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে থাকতো; ওরা একসাথে হলেই সেই মানুষগুলো সব জীবন্ত হতে উঠতো। স্যারের সাথে বহ্নির কোন আড়াল ছিলো না; বাবা মা যেমনটা ছিলেন বহ্নির কাছে স্যারও ছিলেন পরিবারের একজন। বয়ঃসন্ধি কালের সমস্ত কৌতুহল, আবিষ্কারের উত্তেজনা আর ভালোলাগা কি সহজেই স্যারকে বলতো ভাবতেই এখন ওর অবাক লাগে। সব নিষিদ্ধ আর অস্বস্তিকর প্রশ্ন কি অবলীলায় না বহ্নি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছে!!
নাইনে ওঠার কিছুদিন পরেই ওদের পাশের ফ্ল্যাটে যে নতুন পরিবার থাকতে এলো তাদের চারটা ছেলে। সেজ ছেলেটা বহ্নির সাথে একই ক্লাসে। বহ্নি পড়াশোনায় ভালো বলে ছেলেটা মাঝে মাঝেই ওর কাছে থেকে নোট আর সাজেশন ধার করে নিতো। ছেলেটাকে ওর ভালো লাগতো; বেশ দেখতে, ধারালো নাক আর চিবুক, উড়ন্ত পাখির ডানার মতো চোখ, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর শ্যামলা ডেভিড। মনে হয় ছেলেটারও বহ্নিকে ভালো লাগতো; বড্ড অস্বস্তি ছিলো যে দুজনের মাঝে। সম্পর্কটা সহজ ছিলো না; নোট দেয়া নেয়ার সময়ে একটু আঙ্গুলের ছোঁয়াতেই চমকে উঠতো দুজনে। অন্য সবকিছুর মতোই ওর এই অন্যরকম ভালোলাগার কথা বহ্নি অন্য কাউকে না বললেও স্যারকে বলেছিল। এই প্রথমবারের মতো স্যার বেশ রেগে গিয়েছিলেন। পড়ায় মন নেই বলে বকেছিলেন; বহ্নি খুব অবাক হয়েছিলো।
স্যার বদলে যাচ্ছিলেন; অল্পতেই খুব রেগে যেতেন; অথচ বহ্নিতো বেশ ভালো রেজাল্ট করছিলো। একদিন বাংলা একটা বাড়ীর কাজ দিয়েছিলেন স্যার; ও করেনি বলে খুব রেগে গেলেন। মাকে নালিশ করলেন যে বহ্নির ইদানীং মোটেও পড়ায় মন নেই। বহ্নি প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলো কারণ স্যার মাকে বলেছিলেন যে ও পাশের বাসার ওই ছেলেকে নিয়েই সারাক্ষণ চিন্তা করে। এটাতো ওদের দুজনের কথা; স্যার কেন মাকে ওর গোপন ভালোলাগার কথা বলে দেবেন!!
বহ্নি স্যারকে ভয় পেতে শুরু করেছিলো। খুব চেষ্টা করতো সব পড়া করে রাখতে; তারপরেও বকা আর বকা। একদিন ও একটা ভাব সম্প্রসারণ করতে ভুলে গিয়েছিলো। স্যার প্রচন্ড রেগে গেলেন। উনি বেশ সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী প্রায় ছয়ফুট লম্বা; ভালোই ফর্সা; শিশুদের মতো চোখ, দীর্ঘ পল্লবে ছায়াময় দয়ালু চোখ দুটো; হালকা লালচে ঠোঁটের ওপরে গোঁফ। ধুতি পাঞ্জাবী পড়িয়ে দিলে স্যার অনায়াসেই রবি ঠাকুরের বা শরৎচন্দ্রের গল্পের নায়ক। বহ্নি অবাক হয়ে দেখলো স্যারের ফর্সা গাল রাগে লাল হয়ে গেছে। আশ্চর্য!!! ও এত্তো রেগে যাবার মতো কি করলো? মাকে ডেকে বললেন যে ওনার পক্ষে আর বহ্নিকে পড়ানো সম্ভব নয় কারণ ও কথা শোনে না। মা যথেষ্টই অনুরোধ করলেন; কিন্তু স্যার সিদ্ধান্তে অটল। বহ্নি ঘটনার আস্মকিকতায় এত চমকে গিয়েছিলো যে বিশ্বাসই করেনি স্যারের কথা। কিন্তু স্যার বললেন যে আর একদিন আসবেন সব পড়া গুছিয়ে দিতে আর বেতন নিতে। সেদিন রাতে মায়ের কাছে বহ্নি অনেকদিন পরে খুব বকা খেলো পড়াশোনা না করার জন্য।
শেষদিন স্যার এলেন দুপুর তিনটার দিকে। মা বাবা অফিস থেকে পাঁচটায় ফেরেন। বহ্নি অনেকবার সরি বলেছিলো; স্যারকে প্রমিজ করেছিলো যে এরপরে থেকে ও ঠিক ঠিক পড়বে। এ দুদিনে বহ্নির ছোট্ট পৃথিবীর অনেকখানিই এলোমেলো হয়ে গেছে। ও বুঝতেই পারছে না স্যার না থাকলে ওর সব কথা ও কাকে বলবে। স্যার পড়া আর সাজেশন গুছিয়ে দেবার পরে হঠাৎই বললেন “বহ্নি...তুমি কি আসলেই বোঝোনি আমি কেন তোমাকে আর পড়াবো না?” পনের ছুঁই ছুঁই বহ্নি আসলেই বোঝেন.। কিন্তু স্যারের গলায় সেই বহ্নি ডাকটা কেমন যেন অন্যরকম ছিলো।
ও অবাক হয়ে তাকাতেই স্যার বললেন “আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি...বোঝোনি?” উনি কেন জানি নিজের ওপরে রেগে গেলেন “যে আমাকে ইউনিভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ে চেয়েছে...সেই আমি কিনা প্রেমে পড়লাম এক অবুঝ কিশোরীর, যে ভালোবাসা বোঝে না...ভালোবাসার সুখ না...ভালোবাসার দুঃখতো নয়ই...” বহ্নি অবাক হয়ে শুনছে “তুমি যে কি সুন্দর করে কথা বলো...ঠিক যেন কলকল ছলছল এক পাহাড়ী ঝরনা...এই কথার জন্যই অসংখ্য ছেলেরা তোমার প্রেমে বারবার পড়বে...তুমি যখন কথা বলো তোমার চোখ কথা বলে...কিন্তু বহ্নি তুমি...তুমি যে বেশীদিন কাউকেই ভালোবাসবে না!!” “আর...আর তোমার ঠোঁট যখন কথা বলার সময় বাঁকে...অসহ্য সুন্দর...যখন তুমি রেগে গিয়ে ছোটলোক বলো...ইচ্ছা করে ঠোঁটে চুমু দেই...তোমাকে একটা চুমু দেই?” স্যার এইসব কি বলছেন, ঠিক যেন নাটকের ডায়ালগ, আশুতোষের প্রেমের গল্পের মতো!! বহ্নির কেন যেন হাসি পেলো; ও হেসে ফেলতেই স্যারের আহত চোখজোড়া দেখে চুপ করে গেলো।
তিন দশক কেটে গেছে। স্যার কি আসলেই জানতেন না যে কিশোরীরা বড় নিষ্ঠুর হয়? সরলতা তো সবসময়ই নিষ্ঠুর!! এই যে ও নীল শাড়ী খুজঁছে যে মানুষটার জন্য তাকেতো ওই ধরা দেয়নি। পেছনে ফিরে তাকালে বহ্নি জানে যে ও আসলেই কাউকে ধরা দিতে চায়নি। কোন না কোন পুরুষহরিণ হৃদয় “পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে চিতার চোখের ভয়- চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে” ওর কাছে যে ধরা দিতে চায়নি তা নয়। কিন্তু পলাতক বহ্নি সারা জীবনে বা্রবার সেই মানুষগুলোকেই ভালোবেসেছে যাদেরকে পাওয়া যাবে না। ভুল করে ভালোবাসেনি, জেনে শুনেই প্রেমে পড়েছে। ও চায়নি ওর ভালোবাসা সংসারের তেলে হলুদে মেখে যাক। স্যার কি বহ্নিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন?
আজ যদি স্যার ওকে চাইতেন বহ্নি কক্ষনো হাসতো না। এখন ওর চাইতে ভালোবাসার কষ্ট, ভালোবাসতে না পারার দুঃখ আর কে বেশী জানে!! ভালোবাসার সামনে নতজানু সেই রাজপুত্রের মতো রূপবান দুঃখী যুবকের চোখে চোখ রেখে কোমল স্বরে ও বলতো “আপনি তো জানেনই বহ্নি অধরা...তবে কেন তাকে মিছেমিছি ধরতে চাইছেন?"
© শিখা রহমান (২০১৬)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৪৮