“By any chance তুমি কি বাংলাদেশের?” প্রশ্নটা শুনে ঘাড়ের ওপর দিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে থাকা দুজনকে এড়িয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম।
কোনরকম রেফারেন্স ছাড়াই পোলাপান হাওয়ায় প্রশ্ন ছোড়ে; প্রশ্ন বোঝার জন্য আর উত্তর বোঝাবার জন্য কোর্সসাইটে পোষ্ট করা লেকচার নোটস কম্পিউটারে ওপেন করতে হয় আর পোলাপান সব ঘাড়ের ওপরে চলে আসে। কাল পরশু মিডটারম পরীক্ষা উপলক্ষ্যে আজ অতিরিক্ত বা বিশেষ অফিস আওয়ার। নিজে কোন এককালে ছাত্র ছিলাম বলেই জানি পরীক্ষার আগের দিনই সব পড়াশোনা এবং প্রশ্ন। অফিসরুমে ছয়জন পালাক্রমে প্রশ্ন করছে আর বাইরে করিডোরেও বেশ কিছু অপেক্ষমান ছাত্রছাত্রী।
প্রশ্নটা পরীক্ষা সম্পর্কিত না বলে একটু অবাক “কেন বলতো?” “না দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে বললাম...” হেসে বললাম “ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। চলে না...শুধু মানচিত্রটা ভালোবাসি বলেই ঝুলিয়ে রেখেছি!!”
বাংলাদেশের মানচিত্র কেউ চেনে বলে এমন ব্যস্ততার মাঝেও মন ভালোর সুর বেজে উঠলো। পশ্চিম উপকূলের মানুষগুলোকে বাংলাদেশ চেনাতে হয় না; নাম বললেই চিনতে পারে। অনেক ছাত্র ছাত্রীতো আগ বাড়িয়ে বলে “তোমরা আগে পূর্ব পাকিস্তান ছিলে তাই না?” “হুউউ...এখানে keyword কিন্তু was…ছিলাম কারণ থাকা সম্ভব ছিলো না!!”
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনে যখন ছিলাম বাংলাদেশ কোথায় চেনাতে গলদঘর্ম অবস্থা; ভুগোল, ইতিহাস এদের দিয়ে নৈবচ নৈবচ!! মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পালটা জিজ্ঞাসা করতাম “কি মনে হয় তোমার? বাংলাদেশ কোথায় অবস্থিত?” বেশীরভাগ মানুষই আন্দাজে ঢিল ছুড়তো “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ইন্ডিয়ার ধারে কাছে!!” একজনকে একবার ধাঁধায় ফেলার জন্য দুষ্টুমি করে বলেছিলাম “আমাকে দেখতে ইন্ডিয়ানদের মতো মনে হচ্ছে? আশ্চর্য!!” সে সাথে সাথে উত্তর পালটে বললো “ভুল হয়েছে…বাংলাদেশ মনে হয় দক্ষিন আমেরিকায় তাই না? You look exotic like a Brazilian!!” দ্বৈত অনুভূতি....একইসাথে বাংলাদেশকে না চেনার দুঃখ আর আমাকে ব্রাজিলিয়ানদের মতো চমকপ্রদ সুন্দর বলার আনন্দ!!
প্রায় একযুগ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বা দ্বিতীয় বছরে ক্লাসে একবার পানি ব্যবহারের হিসেবের উদাহরণ দিচ্ছিলাম; অনেক শহরের বা কাউন্টির নিজস্ব কিছু সূত্র থাকে উপাত্তের ওপরে ভিত্তি করে। বড় বড় শহর, যেমন নিউইয়র্ক, লাস ভেগাস বা লস এঞ্জেলেসের পাশপাশি কয়েকটা ছোট শহরের গড় পড়তা পানি ব্যবহারের উদাহরন দেখাচ্ছিলাম।
ইচ্ছে করেই একটা ছোট শহরের উদাহরণ দিয়েছিলাম, যেখানে বিয়ার তৈরীর বিশাল কারখানা আছে। এই উদাহরণের পরে ইচ্ছে করেই বলেছি “বুঝতে পারছি না গ্রাম্য এলাকার এই ছোট্ট শহরে এত্তো বেশী পানি কিসে খরচ হয়?” পড়ানো আসলে অনেকটাই মঞ্চে অভিনয় করার মতো। এই যে চিন্তিত ভাব, না জানার ভাব করা, এটা হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাসে আলোচনায় অংশগ্রহনে বাধ্য করার একটা কায়দা।
ক্লাসে বেশ কিছু ছেলেমেয়ের মুখ হাসি হাসি হয়ে গেলো। একটু অবাক ভাব করে বললাম “কি ব্যাপার? জানো নাকি কেন?” অতি আগ্রহী ছাত্র ছাত্রীরা বলে উঠলো “শিখা…তুমি জানো না যে ওই শহরে বিয়ার তৈরী করা হয়?” “তাই নাকি? জানতাম না…আসলে যে দেশ থেকে এসেছি সেখানে ড্রিঙ্ক করাটা সামাজিক রীতি নয়তো…তাই খবর রাখা হয় না!!”
এক ছেলে খুব গম্ভীর ভাবে বললো “কথাটা ঠিক না। আমার এক ভারতীয় বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম…ওখানে সবাই খুব ড্রিঙ্ক করেছে!!” “কিন্তু আমিতো ইন্ডিয়ান নই…আমি বাংলাদেশী!!” “ওই একই কথা!!” “মোটেও এক কথা নয়। দুটো আলাদা দেশ আর সংস্কৃতিও অনেক আলাদা। তোমাকে কানাডিয়ান বললে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না।“
প্রথম দিকে অনেকেই ভাবতো বোধহয় আমি ভারতীয়; ভুল ধারনা সংশোধন করতে করতে এতোদিনে কাজের জায়গায় মোটামুটি সবাই জেনে গেছে যে আমি বাংলাদেশের। যে কোন কোর্সে প্রথম ক্লাসেই নিজের কথা বলার সময়ে বলে দেই আমি বাংলাদেশের। দুই দশক হয়ে গেলো অথচ এখনো “আমি বাংলাদেশের!!” বলার সময়ে কিযে অদ্ভুত ভালো লাগে!!
কোন কোন দিন অফিস ফাঁকা থাকলে ছাত্র বা ছাত্রী কাজের কথা শেষে বলে “তোমার গল্প বলো শুনি…কিভাবে এখানে এলে?” কখনোবা বাঁধা সময়ের একটু আগে পড়ানো শেষ হয়ে গেলে ক্লাসে ছেলেমেয়েগুলো বলে “তোমার গল্প বলো শিখা!! তোমার দেশের গল্প…“ মন ভালো হয়ে যায়। সহকর্মী বা ছাত্রছাত্রী কখনো বলে “এর আগে বাংলাদেশের কাউকে চিনতাম না। তোমাকে চেনার পরে, তোমার কাছে গল্প শুনে বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়…কোন একদিন বেড়াতে চলে যাবো।“ মন ভালো হয়ে যায়।
ক্লাসে ব্রীজ ডিজাইন পড়ানোর ফাঁকে বাঁশের কঞ্চির সাঁকোর ছবি দেখাচ্ছিলাম। সেই ছোট্টবেলায় একটা বা কয়েকটা বাঁশের কঞ্চির সাঁকোর ওপরে ভর করে ছোটখাট খাল বা ধানের ক্ষেতে পানির ওপরে দিয়ে পার হতাম সেই গল্প। পাখির ডানার মতো দুপাশে হাত মেলে টালমাটাল পা ফেলতে হয়; একটু হিসেবে ভুল হলেই বা পা ফসকালেই ঝপাত!! Engineers without Borders (EWB)এর সুবাদে কখনো দু’একজন ইন্ডিয়া বা থাইল্যান্ডে এমন বাঁশের সাঁকো পার হয়েছে বা দেখেছে; ক্লাসে এই সুযোগে তাদের গল্পগুলো শুনি।
সেইদিন ক্লাস শেষে এক ছাত্র এসে বললো “তুমি যে বাংলাদেশের তা জানতাম না!! বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম জানো?” বিস্ময় আর ভালোলাগা তখন আকাশ ছুঁয়েছে “তাই নাকি? কোথায় কোথায় বেড়ালে?”
- বেড়াতে গিয়েছিলাম বান্দরবন আর কক্সবাজার। কি আশ্চর্য সুন্দর দেশ তোমার!! কি দারুন সব খাবার!!
- ঢাকায় বড় হয়েছি। তোমার কথা শুনে দেশে যেতে ইচ্ছে করছে।
- ঢাকায় ছিলাম আসা যাওয়ার পথে। এয়ারপোর্টতো ঢাকায়। মুগ্ধ হয়েছি তোমাদের সুন্দরবন দেখে…অপূর্ব ম্যানগ্রোভ জঙ্গল!! তবে…
“তবে কি?” একটু চিন্তিত হয়ে তাকালাম…কোন বাজে অভিজ্ঞতা হয়নিতো!! একটু থেমে সে হাসিমুখে তাকালো “তোমার দেশের মানুষগুলোর মতো এমন সুন্দর মানুষ আমি কোথাও দেখিনি…ইন্ডিয়াতেও নয়। এতো সরল, এতো ভালো, এতো অতিথিপরায়ন!!” ভালোলাগার বাতাসে ভাসলাম আবারো।
দেশকে ভালোবাসি জোর দিয়ে বলা হয় না। স্বার্থপরের মতো যাকে ফেলে এসেছি তাকে ভালোবাসার দাবী করতে পারি কিনা তাও জানি না। শুধু জানি “বাংলাদেশ” শুনলেই বুকের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, অলৌকিক বায়োস্কোপে সাদাকালো আবছায়া ফ্ল্যাশব্যাক শুরু হয়...শুধু জানি অস্তিত্বে, রক্তস্রোতে কোথাও দেশ রয়ে গেছে, দেশ রয়েই যায়!!
© শিখা (২০শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৮)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১:২৫