২ ডিসেম্বর
গতকাল (১ ডিসেম্বর’১১) নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে বিজয় মাসের প্রথম তারিখ। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তীতে শিল্পকলা একাডেমী ৪০ হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে উদযাপন করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর। বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিটে একাডেমী ভবন ঘিড়ে এই ৪০ হাজার মোমবাতি জ্বালানো হয়। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। এ দিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ১লা ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষাণার আহ্বান জানিয়েছে। বিজয়ের মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
একাত্তরের এই সময়ে বাংলার দামাল সন্তানেরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন কোনঠাসা হতে থাকে পাক বাহিনী। নভেম্বরের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। আর এদিকে দেশ জুড়ে চলছিল প্রতিরোধ। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাক বাহিনী।
মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরে আকস্মাৎ এমন এক হামলা চালায় যার জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান বাহিনী। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী পঞ্চগড় মুক্ত করে এগিয়ে চলছিল ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় রামপুরা ও মালিবাগে এদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সমূহে তখন মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়।
৭১ সালের এ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা যখন রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছিল নানা অপপ্রচার। এ দিকে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে প্রতিদিন শহীদ হচ্ছিল হাজারো মুক্তিকামী জনতা। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিল না মা-বোনেরা।
নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আখাউড়া রেল স্টেশনে চলে সম্মুখযুদ্ধ। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী।
৩ ডিসেম্বর
সারাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিজয় উৎসব। দেশের নানা জায়গায় শুরু হয়েছে বিজয় মেলা। বিজয়ের উল্লাসে উদ্বেলিত আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সহ শিশু-কিশোর সবাই।
৭১ এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর একেরপর এক হামলায় পাক হানাদারেরা তখন দিশেহারা। এই মাসের শুরু দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুক্তিবাহিনীর সাথে পেরে উঠতে না পেরে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন বাড়িয়ে দিল আগের চাইতে বেশি পরিমাণে।
১৯৭১ সালের এই দিনে ভারতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিয়ে জাতিসংঘের কাছ সুবিধা আদায় করা। তারা চেয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আদায়। পাকিস্তান চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে যদি দুই দেশের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে দেখানো যায় তাহলে জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য উভয় পক্ষকে বাধ্য করবে এবং উভয় দেশে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে। আর এতে করে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান করবে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এই দিন বিকেলের দিকে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোর্ট, শ্রীনগর, অবনত্মীপুর, উত্তরালই সহ আগ্রার বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ভারতের উপর পাকিস্তান বাহিনীর এই হামলা পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১১টায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের উপর পাল্টা হামলা চালায় এই দিনে।
এদিনে তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন জানায়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিবে তারা।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।
৪ ডিসেম্বর
১৯৭১ সালের এই সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য সময়টুকু ছিল অস্থির আর উদ্বেগের। এই দিনে জাতিসংঘে চলে চরম উত্তেজনা। কারণ পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করা। যার ফলে পাকিস্তান বাহিনী অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করার সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, “এই মূহুর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।” উল্লেখ্য, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে জাতিসংঘে উপস্থাপন করার জন্য পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৭১ এর ৩ ডিসেম্বর ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিমানহামলা চালায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই তারিখে রাতের বেলা ভারত পাকিস্তানের উপর হামলা চালায়।
এই যখন উৎকন্ঠাময় অবস্থা তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিত এক পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানান।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাশ করানো জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই যখন চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে ছিলেন তখন আসলো খুশির সংবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রধানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে আরো একটি আনন্দের সংবাদ ছিল যে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা।
এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষন্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি জামাতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানান যে, “প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের সাথে রয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে লক্ষীপুর হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষনের ঘটনায় লক্ষীপুর ছিল বিপর্যস্ত।
একাত্তরের এই দিনে ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করেন। ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন মেহেরপুর। এছাড়া ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে কামালপুর নিজেদের আয়ত্তে আনেন।
৫ ডিসেম্বর
একাত্তরের এই দিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নয়ের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশংকা করেছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিবির দুইভাগে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। ৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রেক্ষাপটে এই দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি ছিল এই যে, “পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে।” এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন জানায়। কিন্তু চীন ভেটো প্রদান করে এবং অন্যরা ভোটদানে নিজেদের বিরত রাখে। এই দিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্নক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সে জন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশ্যে বেতারে ভাষণ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সকল বিদেশী জাহাজগুলোকে বন্দরে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশী জাহাজগুলো এই সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে যে শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এই দিন লেফটন্যান্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাক বাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৭১ এর এই দিনে আখাউড়া সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। মিত্রবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক অবরোধ করে ফেলে। এর ফলে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে।
৬ ডিসেম্বর
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় যশোর ও কুড়িগ্রাম। প্রথম কোন জেলা শহর হিসেবে যশোরই প্রথম হানাদার মুক্ত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী। ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে তারা খুলনার শিরোমনিতে অবস্থান নেয়। পাক হানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাওয়ার ফলে এই দিন যশোর শত্রু মুক্ত হয়।
এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম জেলা। ৮টি থানা নিয়ে সে সময়ে কুড়িগ্রাম একটি মহকুমা ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালিয়ে পরাস্ত করে পাক হানাদার বাহিনীকে। এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীর ৬ষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে ১৪ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী, ২৮শে নভেম্বর নাগেশ্বরী ও ৩০ই নভেম্বর উত্তর ধরলা মুক্ত করে। মুক্তিবাহিনী ১লা ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরের চারপাশে অবস্থান নেয়। ৬ তারিখ পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর উপর নিয়মিত আক্রমণ চালাতে থাকে। অতঃপর ৬ই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।
এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শহীদ লেফটন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরণোত্তর) খেতাব পান। বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করেন- শওকত আলী এবং সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু। বীর প্রতীক খেতাব পান- বদরুজ্জামান, আব্দুল হাই সরকার, আবদুল আজীজ এবং তারামন বিবি।
৭ ডিসেম্বর
সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিজয় উৎসব। এ যেন বিজয়ের উল্লাসে উল্লসিত সারা দেশ। প্রায় সব জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিজয় মেলা।
১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরের কেশবপুর হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামসরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় বরণ করে। কেশবপুরকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তিবাহিনী রাইফেলের আগায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে কেশবপুর থানায় উত্তোলন করার মধ্য দিয়ে কেশবপুর বিজয় উদযাপন করে। এ সময় কেশবপুর উপজেলার সর্বস্ততের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন।
রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামসরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিজয় দেখে প্রাণভয়ে কেশবপুর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। আজকের এই দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখতে কেশবপুর পৌরসভার উদ্যোগে একটি বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
একের পর এক জায়গা শত্রুমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা বীরবলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আজকের এই দিনে জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুরও শত্রু মুক্ত হয়।
৮ ডিসেম্বর
মুক্তিযুদ্ধের আগুন ঝড়া দিনগুলোর আজকের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় ময়মনসিংহের গৌরীপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে পৌঁছে। হানাদার বাহিনী ভৈরব রেলপথ দিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় শুরু করে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। পাক বাহিনী নিয়মিত ধ্বংসলীলা চালাতে থাকলে শহরের বাসিন্দারা তাদের ব্যবসা, বসতবাড়ি ফেলে জান বাঁচাতে অন্যত্র চলে যায়।
পাকিস্তান বাহিনীর এই নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে, নিজ মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে গৌরীপুরের মুক্তিকামী মানুষ দলে দলে সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিকামী মানুষেরা গৌরীপুর ডিগ্রী কলেজ প্রাঙ্গনে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে হানাদার বাহিনীর উপর একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। গেরিলা হামলার মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড মেরে ধ্বংস করে গৌরীপুরের রেলপথ, সেতু, গৌরীপুর টেলিফোন একচেঞ্জ। এতে পাক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম বাধাগ্রস্থ হয়।
১৯৭১ সালের এই দিনেও শত্রুমুক্ত হয় চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মীরসরাই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী মীরসরাই ছেড়ে পালিয়ে যায়। মীরসরাইয়ের বিজয় উল্লাসে সে দিন মাতোয়ারা হয়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা মীরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মীরসরাইয়ের বিজয় উদযাপন করেন সে দিন।
মীরসরাই উপজেলার তালবাড়িয়া রেলষ্টেশন রোডের লোহার ব্রীজ নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর সহায়তায় অগনিত মুক্তিযোদ্ধা, নারী, শিশু, পুরুষদের ধরে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করে লোহার ব্রীজের নিচে ফেলে দিত।
৯ ডিসেম্বর
একাত্তরের এই সময়ে দ্রুত মুক্ত হতে থাকে একের পর এক জায়গা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হঠতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ নেয়। আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিতে আদেশ দেন। উদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কারণ বীর সন্তানদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া মোটেও সহজ কাজ নয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে সমস্ত জায়গাগুলো শত্রুমুক্ত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা।
দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
৭১ এর এই দিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে মুক্তিবাহিনী সকাল ১১টার দিকে শহরের চারিদিকে অবস্থান নেয়। এর ফলে পাক হানাদারদের এ দেশীয় এজেন্ট আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার ফিরোজ বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই খবর পেয়ে জেলা শহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত এসে কুমারখালী শহর ঘিরে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। মুক্তিবাহিনী আবারো পাল্টা হামলা চালিয়ে রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে ফেলে এবং অতর্কিত হামলা চালালে পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
খবরটোয়েন্টিফোর.কম পত্রিকায় প্রকাশিত