বাইরে বেরোতে বেরোতে রাজন লক্ষ্য করলো, চারপাশে বিষম অন্ধকার। সে একবার উপরের দিকে মুখ তুলে আকাশের পানে চাইলো। স্বচ্ছ, কালো। পরশু রাতে জোৎস্না ছিলো। সে আকাশের থেকে মুখ নামিয়ে ফের নিজের চামড়ার ব্যাগটায় একবার হাত বোলালো। জহির ভাইয়ের বাড়িতে খেতে বসবার সময়ে সে অনুভব করছিলো, প্রত্যেকে যেনো বহন করে চলা মুখোশ উন্মোচনের অপেক্ষায়, ইঙ্গিতবহ সেই মুহূর্তটি কোনভাবে আবির্ভূত হলেই বারুদ জ্বলে উঠবে। সে সন্তর্পণে খাচ্ছিলো আর সকলের মুখাবয়ব অবলোকন করছিলো। ভয়ে কেঁপে উঠেনি, নিজেকে এই অভয় দেয় কীভাবে? সচেতনতাকে প্রতিনিয়ত প্রাণপাত করে একাগ্র রেখে আজ উত্তোরণের এই পর্যায়ে সে উপনীত হয়েছে। এখানে নিশ্চয়তার আখ্যান ব্রাত্য, সত্য কেবল লাটিমের অবিরাম ঘুর্ণনের আদিঅন্ত।
রাজন ভাবলো, সম্ভাব্য শঙ্কার মুহুর্মুহু ধাবমানতা চেতনাকে একমুখী ও অসহিষ্ণু করে তোলে কিনা। দশদিন আগে সন্ধ্যায় ফুলার রোডে সে একনাগাড়ে মেরে যাচ্ছিলো ফার্স্ট ইয়ারের সেই ক্যাবলা সিরিয়াস ছেলেটিকে- আয়ত চোখ, ঘুমভাঙ্গা ফোলা ফোলা মুখ, রুক্ষ কোঁকড়ানো চুলে প্রেমপূর্ণ মননের উচ্ছিষ্ট ইনোসেন্স; অতোশত সে বুঝতে চাইছেনা আজকাল। তার কপালের রগ ফুলে উঠেছিলো- গোঁয়ার রাগের মুহূর্তে যা তার বৈশিষ্ট্য, বাশার জোর করে তাকে না ছাড়ালে হয়তো গুরুতর জখমই করে ছাড়তো ছেলেটিকে। এমন কোন ঘটনায় পরবর্তীতে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে দেখেছে, তার পৌরুষের চেতনা কি তবে বিকৃত গতিপ্রকৃতির? সাবলীলতা ও সহজাত অভিব্যক্তির পরিবর্তে আত্মঅস্বীকৃতির চূড়ান্ত যাতনার দিকে ধাবিত? তার চারপাশের সকলেই মনে করে- নারীসঙ্গবঞ্চিত যাপন কিংবা প্রিয় পুরুষের অন্তর্গত পৌরুষকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে নারীর কমনীয়তার প্রতি বিদ্রুপাত্মক কোন বার্তা ছুঁড়ে দিতে সে উন্মুখ। কিন্তু সে এমনটা মনে করেনা। এরকম যে কোন ঘটনায় যখন সে প্রেমিক ছেলেটিকে পেটায়; তার সঙ্গীনীর দিকে ফিরেও চায়না। নারীদের নিয়ে আদিরসাত্মক কোন আলাপেও সে অংশগ্রহণ করেনা- না না, এসবে তার মন নেই। সে বোঝে; অমিমাংসিত এমন কোন আক্রোশের কাছে যখন সে পরাভূত হয়- প্রতিপক্ষকে নির্বিকারচিত্তে মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পরে যখন সে স্থানত্যাগ করে- তার দ্রুতই ঘুম পেয়ে যায়। কানের কাছে মগজের সজাগ কোষগুলো ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে- এবারে বিশ্রাম নাও তুমি, বিশ্রাম নাও। জ়ৈবিক অস্তিত্ব মাত্রই সন্তরণের বিপ্রতীপে আলস্য আকাঙ্ক্ষী, তার কাছে সমর্পণ করো।
আগাতে আগাতে সে রাস্তার যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানকার আলো উজ্জ্বলতম। সরু একটা গলির মুখেই ল্যাম্পপোস্ট, যার গোড়া বরাবর একটা নেড়ি কুকুর মুতে ভিজিয়ে দিয়ে হেঁটে নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। তখন কোত্থেকে একটা ষন্ডামার্কা কালো কুকুর এসে তার দিকে গর্জন করা শুরু করলো। কুকুরদ্বয়ের তর্জন-গর্জন দেখতে দেখতে রাজন একটা স্টেশনারী দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘হাফ লিটার পানির বোতল কতো?’
‘পনেরো টাকা।’ দোকানদার মুখ না তুলেই জবাব দেয়।
রাস্তাটা এতো রাতেও বেশ সরব। মানুষজন দিব্যি চলাচল করছে। এই যে মাত্রই প্রধান সড়কে একটা সিটিং সার্ভিস বাস বিপদজনকভাবে একটা প্রাইভেট কারের গা ঘেঁষে চলে গেলো। কারের ড্রাইভার কাঁচ নামিয়ে গালি দিতে দিতেই বাসটা অনেকদূর এগিয়ে পরবর্তী কাউন্টারে এসে থেমে প্যাসেঞ্জার নিতে শুরু করেছে। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সে বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো, ধরালো এবং প্রথম টান দিয়ে অকারণেই আনন্দিত হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। বেশ ভালো বাতাস দিচ্ছে। রাজন ভাবে, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের দিকে তার আরো সাবধানে লক্ষ্য করা দরকার। জহির ভাইও আজকে কথাটা বলছিলেন। সাধারণ জনগণ নির্বাচনের আগে আগে আরো বেশী করে সরকারবিরোধী হয়ে উঠে। রাস্তাঘাট, রেস্টুরেন্টে তাদের কথাবার্তা লক্ষ্য করলে সম্ভাব্য পরিস্থিতির আঁচ পাওয়াটা সম্ভব। রাজন নিজের উপরে সামান্য বিরক্ত হয়। রেস্টুরেন্টটায় পান খাওয়ার জন্য হলেও কিছু সময় বসতে পারতো। এমন ট্রিকি সময়ে আমপাবলিকদের পালস ধরবার কোন সুযোগ মিস করার মানে হয়না। সে টের পেলো, ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙ্গে আসছে। সকালে ডিপার্টমেন্টে একটা জরুরী ক্লাস ছিলো; না গেলেই নয়, ক্লাস থেকে হলে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করে ঘন্টা দুয়েক জমাট একটা ঘুম দিয়েছিলো। ঘুমের মাঝে স্বপ্নেও কতো কী দেখে ফেললো! কলাপাতায় তার আট বছর বয়সী শরীরটাকে রেখে তার চাইতে বয়সে একটু বড় বন্ধুবান্ধবেরা কলাপাতা ধরে টান দিচ্ছে আর সে প্রাণভরে হাসছে। স্বপ্নে সে তার কলেজের অংকের শিক্ষক রমেশ বাবুর বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো। কলেজের পুরো দুই বছর সে রমেশ স্যারের কাছে অংক করতে যেতো। অংক তো উছিলা মাত্র, স্যারের ষোড়শী কন্যা অরুণিমার ছিপছিপে লম্বা মুখ ছিলো আসল আকর্ষণ। ঘুম থেকে উঠে সে বালিশ সামান্য ভেজা পেয়েছিলো। ভাগ্যিস, রুমমেট শিশির তখন বাইরে ছিলো। নয়তো স্বপ্নে তার কেঁদে ফেলার ঘটনা গোটা হলে চাউর করে বেড়াতো।
ভরা পেটে আপনাআপনিই অলসতা এসে ভর করে। শরীরে জড়তা চলে আসে। রাজন চায়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলো এবং প্রথম টান দিয়ে বুঝতে পারলো, আর হাঁটা সম্ভব নয়। সে দ্রুত পায়ে আগাতে চেষ্টা করলো এবং খুব অনায়াসেই বাস কাউন্টারের সামনে গিয়ে টিকেট কেটে জানালার পাশে বাম দিক থেকে দ্বিতীয় সিটটা যোগাড় করে তাতে ধুপ করে বসে পড়লো।
ছেলেবেলায় বিশু কাকার কাছ থেকে উপহার পাওয়া টকটকে লাল রঙের লাটিম থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে যেদিন প্রথম কারো গায়ে হাত তুলে তা উদযাপন করতে সবান্ধবে গিয়েছিলো শুঁড়িখানায়; কিছুর স্মৃতি থেকেই স্বপ্ন তাকে বঞ্চিত করলোনা। এতো দ্রুত সময়ের মধ্যে কিভাবে সে এতোকিছু দেখে ফেললো, তা নিয়ে ভাবার সুযোগটুকুও জেগে উঠে তার হলোনা। সে দেখলো, বাস মতিঝিল পার করতেই বাসযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড হট্টগোল জুড়ে দিয়েছে। রাস্তার পেছন থেকেও তাদের বাসের উদ্দেশ্যে মানুষজনের তুমুল কোলাহল। সে নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় দিলো এবং খুব দ্রুতই বুঝে গেলো- ড্রাইভার একজনকে চাপা দিয়ে যতোটা দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়বার তালে আছে। যে কোন ট্রিকি সিচুয়েশন এখন থেকে এড়ায়ে চলবা, রাস্তাঘাটে ভুলেও কারো সাথে কোন ঝামেলায় জড়াবা না- জহির ভাই আজকের আগেও পইপই করে এসব কথা অনেকবার করে বুঝিয়েছে। তার সব মনে পড়লো। সে একবার ডানদিকে নিজের মাথা ঝোঁকালো, চারপাশে উপস্থিত যাত্রীদের মুখের দিকে নিবিড়ভাবে তাকাতে চাইলো। দেখলো, তাদের নিজেদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ ক্রমেই প্রকাশ্য হচ্ছে। সে অকস্মাৎ সিট ছেড়ে উঠলো, বাস ততোক্ষণে রমনার কাছাকাছি এসে গেছে। যাত্রীরা ড্রাইভার কতোটা পাষণ্ড সে বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছে তার উদ্দেশ্যে কুৎসিত গালাগাল করতে আরম্ভ করেছে। সে হেল্পারের আতংকিত চোখকে উপেক্ষা করে, সকলকে হকচকিত করে চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লো। বাস থেকে নামতে নামতেই পেছনে ফিরে যতোটা দেখা যায়; ততোটুকুর মধ্যে সে দেখলো, এবারে সকলের দৃষ্টি তার দিকেই নিবন্ধ। ড্রাইভার হয়তো দুই একটা খিস্তিও করে থাকবে।
রাজন ভাবলো, মতিঝিলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানো যেতে পারে। ভাবলো, এবং চমকে উঠলো। সে কোন পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো তবে? এতোক্ষণ সে তবে কী ভাবছিলো? কী ভেবে সে মনঃস্থির করলো যে বাস থেকে নেমে সে এতদূর হেঁটে হেঁটে মতিঝিলে যাবে চাপা পড়া মানুষটাকে কাছ থেকে দেখতে? আগামীকাল দুপুরে শামসুল আসবে তার কাছ থেকে লোডেড পিস্তলটা নিতে। আজকাল হলের ভেতরে বড্ড গন্ডগোল, যেখানে-সেখানে যা খুশী তাই রাখবার উপায় নেই। পরশুদিনও তো হাফিজ বংশালে বেদম মার খেয়ে হলে ফিরে আসলো। এখন কোন একশন নেওয়ারও উপায় নেই। সামান্য উনিশ-বিশ হলে অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর সে কিনা, অসম্ভব! সেই কবে না কবে; বারো-পনেরো বছর তো হবেই, গাড়ি চাপা পড়া বোন আর দুলাভাইয়ের লাশ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো। রাজনের স্মৃতি আজও জাগরূক। থেঁতলানো দুটি লাশ, তার কোমর জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত জননী, সামান্য দূরত্বে বামে জনকের মূর্ছিত অবয়বে সম্ভাব্য পিতৃহীনতার আশঙ্কা। সেই স্মৃতি ভেসে উঠতেই কি তবে…… রাজন নিজের উপরে ক্ষুব্ধ হয়। সেন্টিমেন্ট এবং পার্থিব চেতনার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা জরুরী। সে হলের উদ্দেশ্যে সতর্ক চোখে হাঁটতে থাকে। উত্তোরণই শেষ কথা, নিজের ঘরের কাছাকাছি এসে পড়লে রাজন স্বগতোক্তি করে।
তবে, পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখমুখ ডলতে ডলতে পত্রিকার খোঁজ করতে সে সোজা চলে যায় রিডিং রুম বরাবর।